তৃতীয় অধ্যায়ে আমাদের দেশের অসংখ্য মুসলিমদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের মাঝে প্রচলিত যে সব শির্কী কর্মকাণ্ডের কথা আলোচিত হয়েছে, আশা করি এর দ্বারা চিন্তাশীল পাঠক মহলের নিকট এর সাথে জাহেলী যুগের মানুষের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের কী পরিমাণ মিল বা অমিল রয়েছে, তা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এর পরেও বিষয়টি যাতে সর্ব সাধারণের নিকট সম্পূর্ণভাবে পরিষ্কার হয়ে যায় সে জন্যে নিম্নে উভয় সময়ের শির্কী কর্মকাণ্ডের একটি তুলনামূলক বর্ণনা ছক আকারে প্রদান করা হলো :
| জাহেলী যুগের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাস | বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিমদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাস | 
| গণক ও কাহিনদের ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস | গণক, টিয়া পাখি ও বানরের মাধ্যমে ভাগ্য জানার চেষ্টা করা | 
| আররাফদের গায়েব সম্পর্কীয় কথায় বিশ্বাস | জিন সাধকদের গায়েব সম্পর্কীয় কথায় বিশ্বাস | 
| জ্যোতিষদের ভাগ্য সম্পর্কীয় কথায় বিশ্বাস | প্রফেসর হাওলাদার ও অন্যান্য জ্যোতিষদের ভাগ্য সম্পর্কীয় কথায় বিশ্বাস | 
| -- | আমাদের নাবী ও ওলিগণ গায়েব জানেন | 
| পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের মঙ্গল ও অমঙ্গল জানার চেষ্টা করা | টিয়া পাখি ও বানরের সাহায্যে ভাগ্য জানার চেষ্টা করা | 
| ওয়াদ, সুআ‘, য়াগুছ ইত্যাদি ওলিদের নামে নির্মিত মূর্তিসমূহ প্রয়োজন পূরণ করতে পারে বলে বিশ্বাস করা | আউলিয়াগণ বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা | 
| -- | খতমে নারী পড়ার মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম নিলেই তাঁর নামের বদৌলতে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে যায় বলে বিশ্বাস করা | 
| খ্রিস্টান ও হিন্দুদের ন্যায় অবতারবাদে বিশ্বাস করা | আল্লাহ নিজেই রাসূল হয়ে আগমন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা | 
| -- | আহমদ আর আহাদ এর মধ্যে কেবল ‘মীম’ অক্ষরের পাথ্যর্ক বলে বিশ্বাস করা | 
| -- | আরশে যিনি আল্লাহ ছিলেন মদীনায় তিনিই রাসূল হয়ে আগমন করেছিলেন বলে বিশ্বাস করা | 
| দেবতারা ইহকালীন কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূর করতে পারে বলে বিশ্বাস করা | ওলীদের মধ্যকার গাউছ ও কুতুবগণ দুনিয়া পরিচালনা করেন এবং মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা | 
| ওলি ও ফেরেশ্তাদের নামে নির্মিত মূর্তি ও দেবতাসমূহ আল্লাহর কাছে মানুষের জন্য শাফা‘আত করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা | আউলিয়াগণ নিজস্ব মর্যাদা বলে আল্লাহর কোনো পূর্বানুমতি ব্যতীত তাঁদের ভক্তদের জন্য শাফা‘আত করে তাদেরকে মুক্তি দিতে পারবেন বলে বিশ্বাস করা | 
| ফেরেশ্তা ও ওলিদের নামে নির্মিত দেবতাদেরকে সাধারণ মানুষদের জন্য আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে মনে করা | মৃত ওলীদেরকে আল্লাহর নিকটতম করে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে মনে করা | 
| -- | মৃত ওলিগণ ভক্তদের সমস্যা সমাধানে হস্তক্ষেপ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা | 
| -- | ওলিগণ সাগরকে তার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বারণ করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা | 
| উয্যা ও যাতে আনওয়াত নামের গাছ সর্বস্ব দেবতা যুদ্ধে বরকত ও বিজয় এনে দিতো বলে বিশ্বাস করা | ওলীদের কবরের উপর অথবা পার্শবর্তী স্থানে উৎপন্ন বা লাগানো গাছের শিকড়, ফল ও পাতার মাধ্যমে বরকত ও বিবিধ কল্যাণ লাভ করা যায় বলে মনে করা | 
| -- | কবরের পুকুর ও কূপের পানি পান ক’রে এবং মাছ, কচ্ছপ ও কুমীরকে খাবার দিয়ে রোগ মুক্তি ও বরকত কামনা করা | 
| ‘মানাত’ নামের পাথর সর্বস্ব দেবতার নিকট প্রয়োজন পূরণের জন্য কামনা করা | আজানগাছী পীরের দরবারে রক্ষিত কথিত আবু জেহেলের হাতের পাথর দিয়ে রোগ মুক্তি কামনা করা | 
| -- | নারায়ণগঞ্জের কদমরসূল দরবারে রক্ষিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথিত কদম মুবারকের ছাপ বিশিষ্ট পাথর দ্বারা রোগ মুক্তি ও কল্যাণ কামনা করা | 
| উপত্যকার জিন সরদারের নিকট আশ্রয় কামনা করা | কাঠ ও মধু সংগ্রহকারীদের দ্বারা জঙ্গলের জিন ও হিংস্র প্রাণীর অনিষ্ট থেকে রক্ষার জন্য জঙ্গলের জিন সরদারিনীর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা | 
| -- | বিল ও জলাশয়ের মাছ ধরার জন্য পানি সেচের পূর্বে ‘কাল’ নামক জিনকে শিরনী দিয়ে সন্তুষ্ট করা | 
| পৃথিবীর ঘটনা প্রবাহের উপর তারকা ও নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাস করা | মানুষের ভাগ্যের উপর গ্রহ ও তারকার প্রভাবে বিশ্বাস করা | 
| -- | তারকার সুদৃষ্টিতে জমিতে স্বর্ণ জন্মে বলে বিশ্বাস করা | 
| গোত্রীয় নেতাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী গোত্র শাসন করা | মানব রচিত বিধানের আলোকে দেশ শাসন করা | 
| -- | আল্লাহর পরিবর্তে দেশের জনগণকে ক্ষমতায় বসানোর সর্বময় ক্ষমতার মালিক মনে করা | 
| দাদ ও প্লেগ রোগকে নিজ থেকে সংক্রামক রোগ বলে বিশ্বাস করা | কলেরা, বসন্ত, দাদ, এজিমা, যক্ষ্ণা, প্লেগ ও এইড’স রোগকে নিজ থেকে সংক্রামক রোগ বলে মনে করা | 
| দেবতাদের দিকে মুখ করে দো‘আ করা | দো‘আ গৃহীত হওয়ার জন্য মুরশিদ, পীর ও ওলিদের কবরের দিকে মুখ করে দো‘আ করা | 
| দেবতারা ছোট ছোট ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের নিকট তা কামনা করা | মৃত ওলিগণ সাহায্য করতে পারেন, এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁদের নিকট সাহায্য চাওয়া | 
| -- | ঝড়-তুফানের সময় আল্লাহর বদলে পাঁচ পীর, খওয়াজ খিজির ও বদর পীরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করা | 
| ওলিদের মূর্তির সামনে বিনয়ের সাথে দাঁড়ানো | ওলিদের কবর ও পীরের সামনে বিনয়ের সাথে দাঁড়ানো | 
| ভাল-মন্দ সর্বাবস্থায় মূর্তির নিকট সাহায্য চাওয়া | ওলীদের নিকট সাহায্য কামনা করা | 
| ওয়াদ, সুয়া‘ ইত্যাদি অলিগণের প্রথমত কবর এবং পরে তাঁদের মূর্তির সামনে অবস্থান গ্রহণ করে আল্লাহর উপাসনায় মনোযোগ ও তাঁর নিকটবর্তী হতে চাওয়া | ওলীদের কবরে অবস্থান গ্রহণ করে তাঁদের বাতেনী ফয়েয হাসিল করা এবং তাঁদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে চাওয়া | 
| চাঁদ ও সূর্যকে সেজদা করা | ওলীদের কবরে সেজদা করা | 
| বিপদাপদ দূর করার জন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে নযর-নিয়াজ ও মানত করা | বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ওলীদের কবরের মানত করা। | 
| দেবতাদেরকে আল্লাহর চেয়ে অধিক ভালবাসা | আল্লাহর হুকুমের উপরে পীরের হুকুমকে প্রাধান্য দেয়া | 
| দেবতারা মানুষের ক্ষতি সাধন করতে পারে বলে মনে করা | ওলীদের কবরকে ভয় করা | 
| দেবতাদের নিকট প্রয়োজন পেশ করা | ওলীদের নিকট প্রয়োজন পূর্ণ করে দেয়ার জন্য আবেদন করা | 
| উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দেবতাদের উপর ভরসা করা | উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ওলিদের উপর ভরসা করা | 
| প্রয়োজন নিয়ে দেবতাদের শরণাপন্ন হওয়া | প্রয়োজন নিয়ে ওলিদের স্মরণাপন্ন হওয়া এবং তাঁদের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করা | 
| ধর্ম যাজকদেরকে হারাম ও হালাল নির্ধারণকারী বানিয়ে নেওয়া | শরী‘আত পালনের ক্ষেত্রে সহীহ হাদীসের উপর পীর ও মাযহাবের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া | 
| -- | রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা পীরের নাম জপ করা | 
| দেবতাদের সাথে সম্পর্কিত কথিত বরকতপূর্ণ স্থান সমূহ যিয়ারত করতে যাওয়া | ওলীদের কবর ও তাঁদের সাথে সম্পর্কিত স্থানসমূহ দূর-দূরান্ত থেকে যিয়ারত করতে যাওয়া | 
| -- | মৃত্যুর পর ওলিগণ রূহানী শক্তি বলে অনেক কিছু করতে পারেন বলে বিশ্বাস করা | 
| দেবতাদের গায়ে হাত বুলিয়ে বরকত হাসিল করা | ওলীদের কবর, কবরের দেয়াল, গিলাফ ও তাঁদের স্মৃতিসমূহ স্পর্শ করে বরকত হাসিল করা | 
| দেবতা ও বাপ-দাদার নামে শপথ গ্রহণ করা | আগুন, পানি ও মাটি ইত্যাদির নামে শপথ করা | 
| দেবতাদের নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানাদির নাম রাখা, বিশেষ করে তাদের দাস- আবদ, গোলাম ইত্যাদি বলা | রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কোনো ওলীর নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানাদির নাম রাখা, বিশেষ করে তাদের দাস- আবদ, গোলাম ইত্যাদি বলা | 
| বরকত হাসিলের জন্য সন্তানদেরকে দেবতাদের কাছে নিয়ে যাওয়া | ওলীদের কবর থেকে বরকত লাভ ও রোগ মুক্তির জন্য সন্তানদেরকে সেখানে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের গায়ে কবরের কূপের পানি ছিটানো ও পান করানো | 
| শির্কী পন্থায় অসুখ নিবারণের জন্য চেষ্টা করা | বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্রের মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক করা | 
| চোখের কুদৃষ্টি থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য গলায় ঝিনুক থেকে আহরিত মুক্তার মালা পরানো। | কারো চোখ লাগা থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য তাদের গলায় মাছের হাড়, শামুক ইত্যাদি ঝুলিয়ে রাখা। | 
উপর্যুক্ত তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে, আমাদের দেশের অনেক মুসলিমদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের সাথে জাহেলী যুগের মুশরিকদের বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসের যথেষ্ট মিল রয়েছে। তাদের মধ্যে এমনও অনেক শির্কী কর্ম রয়েছে যা জাহেলী যুগের মুশরিকদের মধ্যে ছিল না। বিশেষ করে নৌকা যোগে কোথাও যাওয়ার বিষয়টির কথা বলা যায়। জাহেলী যুগের লোকেরা কখনও নৌকা যোগে কোথাও যাওয়ার প্রাক্কালে ঝড় ও তুফানের কবলে পতিত হলে তারা বিপদ থেকে মুক্তির জন্য একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকেই স্মরণ করে তাঁকে আহ্বান করতো বলে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে।[1] অথচ দেখা যায়, অনেক মুসলিমরা অনুরূপ বিপদে পতিত হলে সাহায্যের জন্য একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান না করে ওলিদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান করে থাবেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, জাহেলী যুগের মানুষেরা যতটুকু শয়তানের শিকারে পরিণত হয়েছিল আমাদের দেশের অনেক মুসলিমরা এর চেয়েও অধিক শিকারে পরিণত হয়েছে।
>