আলেমগণের মধ্যে মতভেদ কারণ এবং আমাদের অবস্থান মতভেদের কারণসমূহ শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন রহ.
কারণ ১: যিনি শরী‘আতের হুকুম বর্ণনায় ভুল করেছেন, ভিন্নমত পোষণকারী এই ব্যক্তির কাছে দলীল না পৌঁছা।

এই কারণটা ছাহাবীগণের পরবর্তী যুগের মানুষের মধ্যে কেবল সীমাবদ্ধ নয়; বরং ছাহাবী এবং তৎপরবর্তীগণের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। আমরা দুটো উদাহরণ পেশ করব- যা ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ঘটে গেছে।

প্রথম উদাহরণঃ- আমরা ছহীহ বুখারী এবং অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীছ সম্পর্কে জানি যে, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেন এবং পথিমধ্যে তাঁকে বলা হল, সেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে, তখন তিনি থেমে গেলেন এবং ছাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করতে লাগলেন। তিনি মুহাজির ও আনছারগণের সাথে পরামর্শ করলেন এবং তাঁরা এ বিষয়ে ভিন্ন দুটো মত পোষণ করলেন। তবে ওখান থেকে ফিরে আসার অভিমতটাই ছিল বেশী অগ্রাধিকারযোগ্য। মতবিনিময় সভার এক পর্যায়ে আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাযিয়াল্লাহু আনহু আসলেন- তিনি তাঁর কোন প্রয়োজনে অনুপস্থিত ছিলেন। অতঃপর বললেন, এ বিষয়ে আমার জ্ঞান রয়েছে, আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘যখন তোমরা কোন এলাকায় মহামারীর কথা শুনবে, তখন সেখানে যাবে না। কিন্তু যদি তা তোমাদের সেখানে থাকা অবস্থায় দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে তোমরা বেরিয়ে যাবে না’।[1] বুঝা গেল, মুহাজির ও আনছারের বড় বড় ছাহাবীর রাযিয়াল্লাহু আনহুম এই হুকুম অজানা ছিল। অতঃপর আব্দুর রহমান রাযিয়াল্লাহু আনহু এসে তাঁদেরকে এই হাদীছটা সম্পর্কে খবর দিলেন।

দ্বিতীয় উদাহরণঃ- আলী ইবন আবু তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু-এর মতে, কোন গর্ভবতীর স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন অথবা বাচ্চা প্রসবের দিন- এই দুই সময়ের মধ্যে দীর্ঘতম সময় পর্যন্ত সে ইদ্দত পালন করবে। অতএব, যদি সে চার মাস দশ দিনের আগে বাচ্চা প্রসব করে, তাহলে তাঁদের নিকট তার ইদ্দত পালনের মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। [অর্থাৎ বাচ্চা প্রসব সত্ত্বেও তাকে ইদ্দত পালন অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা এক্ষেত্রে চার মাস দশ দিন দীর্ঘতম সময়]। আর যদি বাচ্চা প্রসবের আগে চার মাস দশ দিন শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাচ্চা প্রসব করা পর্যন্ত সে ইদ্দত পালন করতে থাকবে। [যেহেতু এক্ষেত্রে বাচ্চা প্রসবের সময় হচ্ছে দীর্ঘতম সময়]। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত’।[2]

অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের বিধবাগণ চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষা করবে’।[3]

উভয় আয়াতের মধ্যে ‘আম খাছ ওয়াজহী’[4] عموم وخصوص وجهي-এর সম্পর্ক। আর এমন সম্পর্কযুক্ত দুই আয়াত বা হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পদ্ধতি হল, এমনভাবে হুকুম গ্রহণ করতে হবে- যাতে উভয় আয়াত বা হাদীছের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় থাকে। তবে তা করতে গেলে আলী ও ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা-এর পদ্ধতি মেনে নেওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই।

কিন্তু সুন্নাত এসবেরই ঊর্দ্ধে। ‘সুবায়আ আল-আসলামিইয়া রাযিয়াল্লাহু আনহা-এর হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি সুবায়আ তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক দিন পরে প্রসূতি অবস্থায় পতিত হলে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম তাঁকে আবার বিয়ে করার অনুমতি দেন’।[5] এর অর্থ এই যে, আমরা সূরা ত্বালাকের উক্ত আয়াতের অনুসরণ করব- যে সূরাকে ‘ছোট সূরা নিসা’ বলা হয়। আর এই আয়াতে আল্লাহর সাধারণ ঘোষণা হচ্ছে, ‘আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত’।[6]আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, যদি এই হাদীছ আলী ও ইবনু আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুমা পর্যন্ত পৌঁছত, তাহলে তাঁরা নিশ্চয়ই তা মেনে নিতেন এবং নিজেদের মত ব্যক্ত করতে যেতেন না।

>
[1] . বুখারী, ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, হা/৫৭২৯; মুসলিম, ‘সালাম’ অধ্যায়, হা/২২১৯।

[2] . সূরা আত-ত্বালাক ৪।

[3] . সূরা আল-বাক্বারাহ ২৩৪।

[4] এটি উসূলে ফিক্বহ-এর একটা পরিভাষা। দুইটা আয়াত বা হাদীছের প্রত্যেকটাতে একই সময়ে একদিক বিবেচনায় ‘আম’ عام এবং অন্যদিক বিবেচনায় ‘খাছ’ خاص হুকুম পাওয়া গেলে তাকে ‘আম-খাছ ওয়াজহী’ বলে। আর যা দুই বা ততোধিক বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে, তাকে ‘আম’ عام বলে এবং যা দুই বা ততোধিক বস্তুকে অন্তর্ভুক্ত করে না, তাকে ‘খাছ’ خاص বলে।

আম-খাছ ওয়াজহী-এর উদাহরণ:

মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রীদেরকে রেখে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাদের বিধবাগণ চার মাস দশ দিন প্রতীক্ষা করবে’ [বাক্বারাহ ২৩৪]। অত্র আয়াত সবধরনের স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘আম’। সুতরাং গর্ভবতী মহিলা, গর্ভবতী নয় এমন মহিলা, বিয়ের পর সহবাস করা হয়েছে এমন মহিলা এবং সহবাস করা হয়নি এমন মহিলা সবাই এই আয়াতের আওতাভুক্ত হবে। এই দিক বিবেচনায় আয়াতটা ‘আম’। কিন্তু যে স্ত্রীর স্বামী মারা গেছে, তার ক্ষেত্রে আয়াতটা ‘খাছ’।

‘আর গর্ভবতী নারীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত’ [আত-ত্বালাক্ব ৪]। অত্র আয়াত তালাকপ্রাপ্তা ও বিধবা স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘আম’। কিন্তু গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে ‘খাছ’। সুতরাং প্রথম আয়াতের ‘আম’ হুকুম দ্বিতীয় আয়াতের ‘খাছ’ হুকুমের উপর এবং দ্বিতীয় আয়াতের ‘আম’ হুকুম প্রথম আয়াতের ‘খাছ’ হুকুমের উপর বহন করতে হবে। তখন অর্থ দাঁড়াবে, গর্ভবতী ব্যতীত স্বামী মারা গেছে এমন সব মহিলা চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করবে। আর গর্ভবতী মহিলা সন্তান প্রসব পর্যন্ত ইদ্দত পালন করবে।-অনুবাদক।

[5] . বুখারী, ‘তালাক্ব’ অধ্যায়, হা/৫৩১৮-৫৩২০; মুসলিম, ‘তালাক্ব’ অধ্যায়, হা/১৪৮৪।

[6] . সূরা আত-তালাক্ব ৪।