নবীদের কাহিনী ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ৯০০ টি
নবীদের কাহিনী ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ৯০০ টি
আনছারগণের অপূর্ব ত্যাগ(الإيثار الرائع للأنصار)

আল্লাহপাক ঈমানের বরকতে আনছারগণের মধ্যে এমন মহববত সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন যে, মুহাজিরগণকে ভাই হিসাবে পাওয়ার জন্য প্রত্যেকে লালায়িত ছিলেন। যদিও তাদের মধ্যে সচ্ছলতা ছিল না। কিন্তু তারা ছিলেন ঈমানী প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। সবাই মুহাজিরগণকে স্ব স্ব পরিবারে পেতে চান। ফলে মুহাজিরগণকে আনছারদের সাথে ভাই ভাই হিসাবে ঈমানী বন্ধনে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়। তারা তাদের জমি, ব্যবসা ও বাড়ীতে তাদেরকে অংশীদার করে নেন। এমনকি যাদের দু’জন স্ত্রী ছিল, তারা একজনকে তালাক দিয়ে স্ত্রীহারা মুহাজির ভাইকে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। রাসূল (ছাঃ) ও মুহাজিরগণের প্রতি এইরূপ অকুণ্ঠ সহযোগিতার জন্য তাঁরা ইতিহাসে ‘আনছার’ (সাহায্যকারী) নামে অভিহিত হয়েছেন।[1] যাদের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيْمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلاَ يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

‘আর মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এই নগরীতে (মদীনায়) বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে, তারা (আনছাররা) তাদেরকে (মুহাজিরদেরকে) ভালবাসে এবং মুহাজিরদের যা দেওয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে কোনরূপ আকাংখা পোষণ করে না। আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তারা নিজেরা ছিল অভাবগ্রস্ত। বস্ত্ততঃ যারা মনের সংকীর্ণতা হ’তে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৫৯/৯)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের প্রশংসায় বলেন, لَوْلاَ الْهِجْرَةُ لَكُنْتُ امْرَأً مِنَ الأَنْصَارِ ‘যদি হিজরতের বিষয়টি না থাকত, তাহ’লে আমি আনছারদের একজন হিসাবে গণ্য হ’তাম’ (বুখারী হা/৭২৪৫)।لَوْ سَلَكَتِ الأَنْصَارُ وَادِيًا أَوْ شِعْبًا، لَسَلَكْتُ وَادِىَ الأَنْصَارِ أَوْ شِعْبَهُمْ ‘যদি আনছারগণ কোন উপত্যকা বা ঘাঁটিতে অবতরণ করে, তাহ’লে আমিও তাদের সেই উপত্যকা বা ঘাঁটিতে অবতরণ করব’ (বুখারী হা/৩৭৭৮)। আর হিজরতকারী ও সাহায্যকারী উভয়দলের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও প্রথম দিককার এবং (পরবর্তীতে) যারা তাদের অনুসরণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (তওবাহ ৯/১০০)

[বিস্তারিত ‘মাদানী জীবন’-এর ‘আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন’ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য]

[1]. আজকাল অনেক বাঙ্গালী মুসলমানকে তাদের নামের শেষে ‘কুরায়শী’ ও ‘আনছারী’ লিখতে দেখা যায়। অথচ এ লকব স্রেফ কুরায়েশ বংশীয়দের জন্য এবং মদীনার আনছারদের জন্য খাছ। অন্যদের জন্য নয়। এখন এসব ‘লকব’ ব্যবহার করা স্রেফ রিয়া ও অহংকারের পর্যায়ভুক্ত হবে। যাকে হাদীছে ‘জাহেলিয়াতের অহংকার’ (عُبِّيَّةُ الْجَاهِلِيَّةِ) বলা হয়েছে (তিরমিযী হা/৩৯৫৫; মিশকাত হা/৪৮৯৯)। এগুলিকে রাসূল (ছাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন পায়ের তলে (كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوعٌ) পিষ্ট করেছেন’ (মুসলিম হা/১২১৮)। উল্লেখ্য যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, الأَئِمَّةُ مِنْ قُرَيْشٍ ‘নেতা হবে কুরায়েশদের মধ্য হ’তে’ (ছহীহুল জামে‘ হা/২৭৫৭)। এটি ছিল সে সময় খলীফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে, (ক্বিয়ামত পর্যন্ত) অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নয় (ইরওয়া হা/৫২০-এর আলোচনা)। উক্ত হাদীছ দ্বারা সে সময় মদীনার মুহাজির কুরায়েশ নেতা আবুবকর, ওমর প্রমুখদের বুঝানো হয়েছিল। সাধারণ কুরায়েশদের নয়। কেননা আবু জাহল-আবু লাহাবরাও কুরায়েশ নেতা ছিলেন। কিন্তু তারা মুসলমানদের নেতা ছিলেন না। অতএব এসব লকব থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

(১) বিশ্বাসগত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে কোন বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। সেকারণ সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন মক্কায় সেরূপ পরিবেশ তৈরী হয়নি, তখন ইয়াছরিবে পরিবেশ তৈরী হওয়ায় সেখানে হিজরতের নির্দেশ আসে। সেকারণ হিজরত ছিল ইসলামের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা।

(২) ঈমানী বন্ধন দুনিয়াবী বন্ধনের চাইতে অনেক বেশী শক্তিশালী। যেমন রক্তের বন্ধন হিসাবে চাচা আবু তালেব-এর নেতৃত্বে বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সার্বিক সহযোগিতা করলেও তা টেকসই হয়নি। অবশেষে ঈমানী বন্ধনের আকর্ষণে রাসূল (ছাঃ)-কে সুদূর ইয়াছরিবে হিজরত করতে হয় এবং সেখানে গিয়ে তিনি নতুন ঈমানী সমাজের গোড়াপত্তন করেন।

(৩) জনমত গঠন হ’ল ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার আবশ্যিক পূর্বশর্ত। তাই মক্কার জনমত বিরুদ্ধে থাকায় আল্লাহর রাসূলকে মদীনায় হিজরত করতে হয়। অতঃপর অনুকূল জনমতের কারণে শত যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মুনাফেকীর মধ্য দিয়েও তিনি সেখানে ইসলামী খেলাফত কায়েমে সক্ষম হন। আজও তা সম্ভব, যদি নবীগণের তরীকায় আমরা পরিচালিত হই।

(৪) হিজরত হয়েছিল বলেই ইসলামী বিধানসমূহের প্রতিষ্ঠা দান সম্ভব হয়েছিল। এমনকি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে ছিয়াম, যাকাত ও হজ্জ তিনটিই ফরয হয়েছিল মদীনায় হিজরতের পর।

(৫) ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধান সমূহ মদীনায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যা হিজরতের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।

(৬) ওমর (রাঃ) হিজরতকে ‘হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী’ বলে আখ্যায়িত করেন। অতঃপর এর গুরুত্বকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য স্বীয় খেলাফতকালে হিজরী বর্ষ গণনার নিয়ম জারি করেন। যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

মদীনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো‘আ করেন, اللهُمَّ أَمْضِ لأَصْحَابِى هِجْرَتَهُمْ، وَلاَ تَرُدَّهُمْ عَلَى أَعْقَابِهِمْ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ছাহাবীদের হিজরত জারী রাখ এবং তাদেরকে পিছনে ফিরিয়ে দিয়ো না’ (বুখারী হা/১২৯৫)। ফলে মুহাজিরগণ নতুন পরিবেশে নানা অসুবিধা সত্ত্বেও সেটাকে মেনে নেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, দ্বীনের হেফাযত ও দাওয়াতের স্বার্থে মুমিনের জন্য হিজরত করা ওয়াজিব। মাওয়ার্দী বলেন, কাফিরের দেশে যদি দ্বীনের দাওয়াত বাধাহীন হয় এবং কোন ফিৎনার আশংকা না থাকে, তবে তাদের সেখানেই থাকা উত্তম হবে হিজরত করার চাইতে। কেননা তাতে অন্যদের ইসলাম কবুলের সম্ভাবনা থাকে’।[1]

[1]. বুখারী ফাৎহসহ হা/৩৯০০-এর আলোচনা।

(১) স্রেফ দ্বীন বাঁচানোর স্বার্থে হিজরত করাই হ’ল প্রকৃত হিজরত।

(২) রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ হাছিলের উদ্দেশ্যে উক্ত হিজরত প্রকৃত হিজরত নয় এবং সে উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করেননি।

(৩) যাবতীয় দুনিয়াবী কৌশল ও উপায়-উপাদান ব্যবহার করার পরেই কেবল আল্লাহর বিশেষ রহমত নেমে আসে, যদি উদ্দেশ্য স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা হয়। হিজরতের পথে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে যেসব গায়েবী মদদ এসেছিল, সেগুলি আল্লাহর সেই বিশেষ রহমতেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

ওমর ফারূক (রাঃ) স্বীয় খেলাফতকালে (১৩-২৩ হিঃ) হিজরী সন প্রবর্তন করেন এবং রবীউল আউয়াল মাসের বদলে মুহাররম মাসকে ১ম মাস হিসাবে নির্ধারণ করেন। কারণ হজ্জ পালন শেষে মুহাররম মাসে সবাই দেশে ফিরে যায়। তাছাড়া যিলহাজ্জ মাসে বায়‘আতে কুবরা সম্পন্ন হওয়ার পর মুহাররম মাসে হিজরতের সংকল্প করা হয়।

ঘটনা ছিল এই যে, আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) খলীফা ওমর (রাঃ)-কে লেখেন যে, আপনি আমাদের নিকটে যেসব চিঠি পাঠান তাতে কোন তারিখ থাকে না। যাতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তখন ওমর (রাঃ) পরামর্শ সভা ডাকেন। সেখানে তিনি হিজরতকে হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী বলে আখ্যায়িত করেন এবং মুহাররম মাস থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব করেন। বিস্তারিত আলোচনার পর সকলে তা মেনে নেন। ঘটনাটি ছিল ১৭ হিজরী সনে।[1]

[1]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৩৪-এর আলোচনা; সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৩।
মাক্কী জীবন থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ -১৯ (العبر -১৯)

(১) কা‘বাগৃহ ও মাসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণকারী কুরায়েশ নেতার গৃহে জন্মগ্রহণকারী বিশ্বনবীকে তার বংশের লোকেরাই নবী হিসাবে মেনে নেননি। কারণ তারা এর মধ্যে তাদের নেতৃত্বের অবসান ও দুনিয়াবী স্বার্থের ক্ষতি বুঝতে পেরেছিলেন। সেকারণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয়েও তারা মুমিন হ’তে পারেননি’ (বাক্বারাহ ২/৮)

(২) নবী বংশের লোক হওয়া, আল্লাহর ঘর তৈরী করা ও তার সেবক হওয়া পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। বরং সার্বিক জীবনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলা ও তা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই হ’ল আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার পূর্বশর্ত’ (তওবাহ ৯/১৯-২০)

(৩) আক্বীদায় পরিবর্তন না আনা পর্যন্ত সমাজের কোন মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। যেমন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নবী হওয়ার পূর্বে তরুণ বয়সে ‘হিলফুল ফুযূল’ নামক ‘কল্যাণ সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন ও তাঁর সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রমের জন্য সকলের প্রশংসাভাজন হন। তিনি ‘আল-আমীন’ উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু তাতে সার্বিকভাবে সমাজের ও নেতৃত্বের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি।

(৪) সমাজের সত্যিকারের কল্যাণকামী ব্যক্তি নিজের চিন্তায় ও প্রচেষ্টায় যখন কোন কুল-কিনারা করতে পারেন না, তখন তিনি আল্লাহর নিকটে হেদায়াত প্রার্থনা করেন ও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর উপরে সমর্পণ করে দেন। অতঃপর আল্লাহর দেখানো পথেই তিনি অগ্রসর হন। হেরা গুহায় দিন-রাত আল্লাহর সাহায্য কামনায় রত মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর মধ্যে আমরা সেই নিদর্শন দেখতে পাই। বর্তমান যুগে আর ‘অহি’ নাযিল হবে না। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কুরআন ও সুন্নাহ মুমিনকে সর্বদা জান্নাতের পথ দেখাবে।

(৫) রক্ত, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল প্রভৃতি জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান হ’লেও মূল উপাদান নয়। বরং ধর্মবিশ্বাস হ’ল জাতি গঠনের মূল উপাদান। আর সেকারণেই একই বংশের হওয়া সত্ত্বেও আবু লাহাব ও আবু জাহল হয়েছিল রাসূল (ছাঃ)-এর রক্তপিপাসু দুশমন। অথচ ভিনদেশী ও ভিন রক্ত-বর্ণ ও অঞ্চলের লোক হওয়া সত্ত্বেও ছুহায়েব রূমী ও বেলাল হাবশী হয়েছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর বন্ধু। সেকারণ মযবুত সংগঠনে ও জাতি গঠনে আক্বীদাই হ’ল সবচেয়ে বড় উপাদান।

(৬) আল্লাহর পথের পথিকগণ শত নির্যাতনেও আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হন না। জান্নাতের বিনিময়ে তারা দুনিয়াবী কষ্ট ও দুঃখকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। মক্কার নির্যাতিত অসহায় মুসলমানদের অবস্থা বিশেষ করে বেলাল, খাববাব ও ইয়াসির পরিবারের লোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী যেকোন মানুষকে তাড়িত করে।

(৭) ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ নেতৃবৃন্দ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপর ভরসা করেন এবং ইসলামের স্বার্থে প্রয়োজন বোধ করলে আল্লাহ তাদের রক্ষা করেন। যেমন হিজরতের পথে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে রক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন, মুমিনদের রক্ষা করাই তাঁর কর্তব্য’ (রূম ৩০/৪৭; ইউনুস ১০/১০৩)

(৮) কায়েমী স্বার্থবাদী নেতৃত্ব কখনোই সংস্কারের বাণীকে সহ্য করতে পারে না। তারা অহংকারে ফেটে পড়ে এবং নিজেদের চালু করা মনগড়া রীতি-নীতির উপরে যিদ ও হঠকারিতা করে’ (বাক্বারাহ ২/২০৬)। যেমন ইতিপূর্বে মূসার বিরুদ্ধে ফেরাঊন তার লোকদের বলেছিল, ‘আমি তোমাদেরকে কেবল কল্যাণের পথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৯)। অথচ তা ছিল জাহান্নামের পথ এবং মূসার পথ ছিল জান্নাতের পথ।

মাক্কী জীবন সমাপ্ত

تمت الحياة المكية بالخير

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী জীবন (الحيـاة المدنيــة للرسول صـ)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাদানী জীবনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।-

এক. ১ম হিজরী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর সোমবার হ’তে ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর। এই সময় কাফের ও মুনাফিকদের মাধ্যমে ভিতরে ও বাইরের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলা সমূহ সংঘটিত হয়। ইসলামকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য এ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৫০টি ছোট-বড় যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ পরিচালিত হয়।

দুই. মক্কার মুশরিকদের সাথে সন্ধি চলাকালীন সময়। যার মেয়াদকাল ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ হ’তে ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রায় দু’বছর। এই সময়ে প্রধানতঃ ইহূদী ও তাদের মিত্রদের সাথে বড়-ছোট ২২টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

তিন. ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর হ’তে ১১ হিজরীতে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এই সময়ে দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। চারদিক থেকে গোত্রনেতারা প্রতিনিধিদল নিয়ে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদেশী রাজন্যবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত মারফত পত্র প্রেরণ করেন। এ সময় হোবল, লাত, মানাত, ‘উযযা, সুওয়া‘ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ মূর্তিগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সময়ে হোনায়েন যুদ্ধ এবং রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে তাবূক যুদ্ধে গমন ও সর্বশেষ সারিইয়া উসামা প্রেরণ সহ মোট ১৮টি মিলে মাদানী জীবনের ১০ বছরে ছোট-বড় প্রায় ৯০টি যুদ্ধ ও অভিযানসমূহ পরিচালিত হয়। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে ইসলাম রাষ্ট্রীয় রূপ পরিগ্রহ করে এবং তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি সমূহকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকার মত শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়।

এক্ষণে আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হিজরত কালীন সময়ে মদীনার সামাজিক অবস্থা ও সে প্রেক্ষিতে রাসূল (ছাঃ)-এর গৃহীত কার্যক্রমসমূহ একে একে আলোচনা করব।

মদীনার সামাজিক অবস্থা (الحالة الإجةماعية فى المدينة)

খ্রিষ্টীয় ৭০ সালে প্রথমবার এবং ১৩২-৩৫ সালে দ্বিতীয়বার খ্রিষ্টান রোমকদের হামলায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে ইহূদীরা ইয়াছরিব ও হিজায অঞ্চলে হিজরত করে (সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৭)। মিষ্ট পানি, উর্বর অঞ্চল এবং শামের দিকে ব্যবসায়ী পথের গুরুত্বের কারণে ইহূদী বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা গোত্রদ্বয় ইয়াছরিবের পূর্ব অংশ হাররাহ (حَرَّة) এলাকায় বসতি স্থাপন করে। তাদের অপর গোত্র বনু ক্বায়নুক্বা ইয়াছরিবের নিম্নভূমিতে বসতি স্থাপন করে। বনু ক্বায়নুক্বার শাখা গোত্রসমূহের আরবী নাম দেখে তাদেরকে আরব থেকে ধর্মান্তরিত ইহূদী বলে ঐতিহাসিকগণের অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। যেমন বনু ইকরিমা, বনু মু‘আবিয়া, বনু ‘আওফ, বনু ছা‘লাবাহ প্রভৃতি নাম সমূহ। উপরোক্ত তিনটি প্রধান গোত্র ছাড়াও ছোট ছোট বিশটির অধিক ইহূদী শাখা গোত্রসমূহ ইয়াছরিবের বিভিন্ন অঞ্চলে এ সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

অন্যদিকে আউস ও খাযরাজ, যারা ইসমাঈল-পুত্র নাবেত (نَابِت)-এর বংশধর ছিল এবং ইয়ামনের আযদ (الْأَزْدُ) গোত্রের দিকে সম্পর্কিত ছিল, তারা খ্রিষ্টীয় ২০৭ সালের দিকে ইয়ামন থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইয়াছরিবে হিজরত করে। সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থানরত ইহূদীরা তাদেরকে ইয়াছরিবের অনুর্বর ও পরিত্যক্ত এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য করে। আউসরা বনু নাযীর ও বনু কুরায়যার প্রতিবেশী হয় এবং খাযরাজরা বনু ক্বায়নুক্বার প্রতিবেশী হয়। আউসদের এলাকা খাযরাজদের এলাকার চাইতে অধিকতর উর্বর ছিল। ফলে তাদের মধ্যে নিয়মিত হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের এটাও একটা কারণ ছিল। ইহূদীরা উভয় গোত্রের উপর কর্তৃত্ব করত। তারা উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দিত। আবার উভয় দলের মধ্যে সন্ধি করে দিত। তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে সংঘটিত বু‘আছ যুদ্ধ। যাতে আউসরা খাযরাজদের উপর জয়লাভ করে। কিন্তু উভয় গোত্র সর্বদা পুনরায় পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধের আশংকা করত। ফলে তারা নিজেদের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন করে এবং উভয় গোত্রের ঐক্যমতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই খাযরাজীকে তাদের নেতা নির্বাচন করে। এমতাবস্থায় আখেরী নবীর শুভাগমনে তারা উৎফুল্ল হয় এবং নিজেদের মধ্যকার সব তিক্ততা ভুলে শেষনবী (ছাঃ)-কে স্বাগত জানাবার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, বু‘আছ যুদ্ধের দিনটিকে আল্লাহ তাঁর রাসূলের আগমনের এবং ‘ইয়াছরিব বাসীদের ইসলামে প্রবেশের অগ্রিম দিবস’ (يَوْمًا قَدَّمَهُ اللهُ لِرَسُولِهِ صـ فِى دُخُولِهِمْ فِى الإِسْلاَمِ) হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন।[1]

উল্লেখ্য যে, আউস ও খাযরাজ ছিলেন আপন দুই ভাই এবং ইসমাঈল-পুত্র নাবেত-এর বংশধর। যারা উত্তর হেজায শাসন করতেন। কিন্তু মালেক বিন ‘আজলান খাযরাজীর গোলাম হুর বিন সুমাইরকে হত্যার কারণে তাদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। যা প্রায় ১২০ বছর যাবৎ চলে। পরে তারা ইয়াছরিবে হিজরত করেন। সেখানে তাদের মধ্যে সর্বশেষ বু‘আছ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার পাঁচ বছর পর রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের বরকতে উভয় দলের মধ্যে দীর্ঘকালীন যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত হয় এবং তারা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যায়। যে বিষয়ে সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত নাযিল হয় (তাফসীর ত্বাবারী হা/১৪৭৩, ৭৫৮৯; তাফসীর ইবনু কাছীর)

২০৭ খ্রিষ্টাব্দে একই সময় বনু খোযা‘আহ গোত্র ইয়ামন থেকে হিজরত করে মক্কার নিকটবর্তী মার্রুয যাহরানে বসতি স্থাপন করে। যারা পরবর্তীকালে মক্কার শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং দীর্ঘদিন উক্ত ক্ষমতায় থাকে। অবশেষে তাদের জামাতা কুরায়েশ নেতা কুছাই বিন কিলাব মক্কার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। জামাতার বংশ হিসাবে বনু খোযা‘আহ সর্বদা বনু হাশেমকে সহযোগিতা করেছে। যা মক্কা বিজয় ও তার পরবর্তীকালেও অব্যাহত ছিল।[2]

মক্কা ও মদীনার সামাজিক অবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কার সমাজ ব্যবস্থাপনায় কুরায়েশদের একক প্রভুত্ব ছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের অধিকাংশ মূর্তিপূজারী ছিল। যদিও সবাই আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। হজ্জ ও ওমরাহ করত। ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের উপরে কায়েম আছে বলে তারা নিজেদেরকে ‘হানীফ’ (حَنِيْفٌ) বা ‘আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ’ বলে দাবী করত। বিগত নেককার লোকদের মূর্তির অসীলায় তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত। এই অসীলাপূজার কারণেই তারা মুশরিক জাতিতে পরিণত হয়েছিল এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়েছিল। তারাও রাসূল (ছাঃ)-এর প্রচারিত নির্ভেজাল তাওহীদকে তাদের কপট ধর্ম বিশ্বাস ও দুনিয়াবী স্বার্থের বিরোধী সাব্যস্ত করে রাসূল (ছাঃ)-এর ও মুসলমানদের রক্তকে হালাল গণ্য করেছিল। মক্কায় মুসলমানরা ছিল দুর্বল ও মযলূম এবং বিরোধী কুরায়েশ নেতারা ছিল প্রবল ও পরাক্রমশালী।

পক্ষান্তরে মদীনায় সমাজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারু একক নেতৃত্ব ছিল না। ধর্মীয় দিক দিয়েও তারা এক ছিল না বা বংশধারার দিক দিয়েও এক ছিল না। সর্বশেষ বু‘আছের যুদ্ধে বিপর্যস্ত আউস ও খাযরাজ প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। এর দ্বারা মদীনাবাসীদের আন্তরিক কামনা ছিল যে, তাঁর আগমনের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটবে। ফলে এখানে রাসূল (ছাঃ) ও মুহাজিরগণ ছিলেন শুরু থেকেই কর্তৃত্বের অধিকারী।

[1]. বুখারী হা/৩৭৭৭; সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৭-৩১।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৯১, ১১৭; সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৯।
মদীনার দল ও উপদলসমূহ (الأحزاب والفرق فى المدينة)

হিজরতকালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইয়াছরিবে মূলতঃ দু’দল লোক বসবাস করত। একদল ছিল ইয়াছরিবের পৌত্তলিক মুশরিক সম্প্রদায়। যারা প্রধানতঃ আউস ও খাযরাজ দু’গোত্রে বিভক্ত ছিল। আউসদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন মু‘আয ও খাযরাজদের নেতা ছিলেন সা‘দ বিন ওবাদাহ। মুনাফিক সরদার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূল ছিলেন খাযরাজ গোত্রভুক্ত। এরা ছিল বিশুদ্ধ আরবী ভাষী। রাসূল (ছাঃ)-এর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারও ছিল এই গোত্রভুক্ত।

দ্বিতীয় ছিল ইহূদী সম্প্রদায়। খ্রিষ্টানরা যাদেরকে ফিলিস্তীন ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে উৎখাত করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপর দখল কায়েম করেছিল। ইহূদীরা শেষনবীর আগমনের অপেক্ষায় এবং তাঁর নেতৃত্বে তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের আশায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল বহুদিন পূর্বে। এরা ছিল হিব্রুভাষী। কিন্তু পরে আরবীভাষী হয়। এদের প্রধান তিনটি গোত্র বনু ক্বায়নুক্বা‘, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা মদীনার উপকণ্ঠে তাদের তৈরী স্ব স্ব দুর্ভেদ্য দুর্গসমূহে বসবাস করত। দক্ষ ব্যবসায়ী ও সূদী কারবারী হওয়ার কারণে এরা ছিল সর্বাধিক সচ্ছল। চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও কূট কৌশলের মাধ্যমে এরা আউস ও খাযরাজের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধাবস্থা জিইয়ে রাখতো এবং ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে উভয় গোত্রের উপরে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতো। এই সূক্ষ্ম পলিসির কারণে তাদের বনু ক্বায়নুক্বা‘ গোষ্ঠী খাযরাজদের মিত্র ছিল এবং বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা গোষ্ঠী আউসদের মিত্র ছিল। আসলে তারা উভয়েরই শত্রু ছিল। তাদেরকে তারা সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করত। তারা এভাবে আরবদের শোষণ করত। এজন্য তাদের মূর্খতার প্রতি তাচ্ছিল্য করে তারা বলত, لَيْسَ عَلَيْنَا فِي الأُمِّيِّيْنَ سَبِيْلٌ ‘মূর্খদের ব্যাপারে আমাদের কোন দায়িত্ব নেই’ (আলে ইমরান ৩/৭৫)। অর্থাৎ মূর্খদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের অধিকার নষ্ট করায় আমাদের কোন পাপ নেই। সেই সময় ইয়াছরিবে পৌত্তলিক ও ইহূদীদের বাইরে কিছু সংখ্যক খ্রিষ্টানও বসবাস করত। যারা ইহূদীদের ন্যায় ইয়াছরিবে হিজরত করে এসেছিল শেষনবীর আগমন প্রত্যাশায়।

বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের শ্লোগানের আড়ালে উন্নয়নশীল ও বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে তাদের শোষণ-নির্যাতন, সূদী কারবার ও অস্ত্র ব্যবসা পূর্বের ন্যায় বজায় রেখে চলেছে। মুসলমানদের সম্পদ হরণ করায় ও তাদের অধিকার বিনষ্ট করায় কোন পাপ নেই বলে আজও তাদের আচরণে প্রমাণ পাওয়া যায়। ভূগর্ভের তৈল লুট করার জন্য তারা ভূপৃষ্ঠের মানুষের রক্ত পান করছে গোগ্রাসে। কিন্তু এই রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারদের রক্ত নেশা মিটছে না মোটেই। এজন্যেই এরা ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) ও ‘যোওয়াল্লীন’ (পথভ্রষ্ট) বলে কুরআনে অভিহিত হয়েছে।[1]

ইহূদীরা ভেবেছিল, শেষনবী হযরত ইসহাকের বংশে হবেন এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে তিনি খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবেন। তারা ইয়াছরিবের লোকদের হুমকি দিত এই বলে যে, سَيَخْرُجُ نَبِىُّ آخِرِ الزَّمَانِ فَنَتَّبِعُهُ وَنَقْتُلُكُمْ مَعَهُ قَتْلَ عَادٍ وَإِرَمَ ‘আখেরী যামানার নবী সত্বর আগমন করবেন। আমরা তাঁর অনুসারী হব এবং তোমাদের হত্যা করব (বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি) ‘আদ ও ইরামের ন্যায়’।[2] কিন্তু হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে শেষনবীর আগমন ঘটায় এবং তিনি হযরত মূসা ও ঈসা (আঃ) উভয়ের সত্যায়ন করায় ইহূদীরা তাঁর শত্রু হয়ে যায়।

পক্ষান্তরে তৃতীয় দল খ্রিষ্টানরা ভেবেছিল যে, শেষনবী এসে তাদের লালিত বিশ্বাস অনুযায়ী কথিত ত্রিত্ববাদ, ঈসার পুত্রত্ববাদ, প্রায়শ্চিত্ববাদ, সন্ন্যাসবাদ ও পোপের ঐশী নেতৃত্ববাদ সমর্থন করবেন। কিন্তু এসবের বিপরীত হওয়ায় তারাও রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধী হয়ে গেল। উল্লেখ্য যে, ইহূদী ও নাছারা কারু মধ্যে তাদের ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে কোনরূপ সংগ্রামী চেতনা ছিল না। ধর্মের প্রতিপাদ্য তাদের মধ্যে যা লক্ষ্য করা যেত, সেটা ছিল কেবল জাদু-টোনা, ঝাড়-ফুঁক, শুভাশুভ লক্ষণ নির্ধারণ ও অনুরূপ কিছু ক্রিয়া-কর্ম। এ সকল কাজের জন্যই তারা নিজেদেরকে জ্ঞানী-গুণী এবং আধ্যাত্মিক গুরু ও নেতা মনে করত।

চতুর্থ আরেকটি উপদল গড়ে উঠেছিল খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন উবাই ইবনে সুলূলের নেতৃত্বে। বু‘আছ যুদ্ধের পর আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্র মিলে তাকে নেতা নির্বাচিত করে। এজন্য তারা বহু মূল্যবান রাজমুকুট তৈরী করে এবং এই প্রথমবারের মত উভয় গোত্র একত্রিত হয়ে তাকে রাজ আসনে বসাতে যাচ্ছিল। এমনি সময়ে রাসূল (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে এবং উভয় গোত্র তাকে ছেড়ে রাসূল (ছাঃ)-কে নেতারূপে বরণ করে। এতে আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা মনে মনে ক্ষুব্ধ হয় এবং তাদের সকল ক্ষোভ গিয়ে পড়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে। কিন্তু অবস্থা অনুকূল না দেখে তারা চুপ থাকে এবং বছর দেড়েক পরে বদর যুদ্ধের পর হতাশ হয়ে অবশেষে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেয়। তবে আদি বাসিন্দা আউস ও খাযরাজদের অনেকে পূর্বেই ইসলাম কবুল করায় এবং তারাই রাসূল (ছাঃ)-কে ও মুহাজিরগণকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশ্রয় দেওয়ায় অন্যেরা সবাই চুপ থাকে এবং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্ব মেনে নেয়।

উপরোক্ত চারটি দল তথা (১) পৌত্তলিক আউস ও খাযরাজ (২) ইহূদী। বনু ক্বায়নুক্বা, বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা। (৩) নাছারা। যারা প্রধানতঃ নাবিত্ব বাজার(سوق النبط) এলাকায় বসবাস করত। তবে সমাজে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। (৪) খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের গ্রুপ। যারা গোপন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে সর্বদা তৎপর ছিল।

এতদ্ব্যতীত (৫) মুহাজির মুসলমানদের নানাবিধ সমস্যা মুকাবিলা করা রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য বলতে গেলে জ্বলন্ত সমস্যা ছিল। তবে মুহাজিরদের সমস্যা আনছাররাই মিটিয়ে দিত। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের পরস্পরে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। মক্কা থেকে কোন মুহাজির এলেই তারা তাকে সাদরে বরণ করে নিত। ফলে মুহাজিরগণের সমস্যা ছিল পজেটিভ। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের সমস্যা ছিল নেগেটিভ। যা সর্বদা রাসূল (ছাঃ)-কে চিন্তাগ্রস্ত করে রাখতো।

উপরোক্ত সমস্যাবলীর সাথে যোগ হয়েছিল আরেকটি কঠিন সমস্যা। সেটা ছিল (৬) মক্কার মুশরিকদের অপতৎপরতা। তারা মুহাজিরদের ফেলে আসা বাড়ী-ঘর ও ধন-সম্পত্তি জবরদখল করে নিল। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বন্দী ও নির্যাতন করতে লাগল। অধিকন্তু তাদের ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক নেতৃত্বের প্রভাব খাটিয়ে আরব উপদ্বীপের অন্যান্য ব্যবসায়ী ও সাধারণ লোকদের উস্কানি দিতে লাগল, যাতে মদীনায় খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ তারা বন্ধ করে দেয়। ফলে মদীনায় পণ্য আমদানী হ্রাস পেতে থাকল। যা মক্কার মুশরিকদের সাথে মদীনার মুসলমানদের মধ্যে ক্রমে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করে ফেলল।

[1]. সূরা ফাতিহা ৭ আয়াত; তিরমিযী হা/২৯৫৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৮২০২।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৪২৯; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১৪৬, সনদ হাসান।
মাক্কী ও মাদানী জীবনের প্রধান পার্থক্য সমূহ (الفروق الرئيسية بين الحياة المكية والمدنية)

মাক্কী ও মাদানী জীবনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কায় জন্মস্থান হ’লেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানগণ সেখানে ছিলেন দুনিয়াবী শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল ও নির্যাতিত। পক্ষান্তরে মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বাগডোর ছিল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুসলমানদের হাতে। এখানে বিরোধীরা স্থানীয় হ’লেও তারা ছিল নিষ্প্রভ। ফলে মদীনার অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ইসলামকে পূর্ণতা দানের সুযোগ আসে। আর সেকারণেই ইসলামের যাবতীয় হারাম-হালাল ও আর্থ-সামাজিক বিধি-বিধান একে একে মাদানী জীবনে অবতীর্ণ হয় ও তা বাস্তবায়িত হয়। অতঃপর বিদায় হজ্জের সময় আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ণতার সনদ হিসাবে আয়াত নাযিল হয়- اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপরে আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। বিদায় হজ্জের সময় ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহাজ্জ শুক্রবার মাগরিবের পূর্বে মক্কায় আরাফা ময়দানে অবস্থানকালে এ আয়াত নাযিল হয়। এর মাত্র ৮৩ দিন পর ১১ হিজরীর ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার মদীনায় রাসূল (ছাঃ) মৃত্যু বরণ করেন।

আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অত্র আয়াত নাযিলের পর বিধি-বিধান সম্পর্কিত আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। তবে উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন মূলক কয়েকটি মাত্র আয়াত নাযিল হয়। এভাবে আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে আল্লাহর পক্ষ হ’তে সত্য দ্বীন নাযিল হওয়ার যে সিলসিলা জারী হয়েছিল, শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় তার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আল্লাহ প্রেরিত ইলাহী বিধানের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

ইহূদীদের কপট চরিত্র (النفاق الطبيعى لليهود) :

হিজরতের পূর্ব থেকেই ইহূদীরা মক্কায় রাসূল (ছাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে জানত। এখন যখন তিনি মদীনায় হিজরত করে এলেন এবং মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার, লেন-দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার পথ অবলম্বন করলেন। যার ফলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ও হিংসা-হানাহানিতে বিপর্যস্ত ইয়াছরিবের গোত্র সমূহের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ, মধুর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল, তখন তা ইহূদীদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। তাদের আশংকা হ’ল যে, এইভাবে যদি সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও আপোষে ভাই ভাই হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহ’লে তাদের ‘বিভক্ত কর ও শোষণ কর’ নীতি মাঠে মারা যাবে। এর ফলে তাদের সামাজিক নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে। সাথে সাথে ইসলামে সূদ হারাম হওয়ার কারণে তাদের রক্তচোষা সূদী কারবার একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, যা তাদের পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ধ্বস নামাবে। এমনকি চক্রবৃদ্ধি হারে ফেঁপে ওঠা সূদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অত্যাচারমূলক চুক্তির ফলে ইয়াছরিব বাসীদের যে বিপুল ধন-সম্পদ তারা কুক্ষিগত করেছিল, তার সবই তাদেরকে ফেরৎ দিতে বাধ্য হ’তে হবে। ফলে তারা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে গোপনে শত্রুতা শুরু করে দেয়। পরে যা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। তাদের কপট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ রাসূল (ছাঃ)-এর মদীনায় পদার্পণের প্রথম দিনেই ঘটে। নিম্নের দু’টি ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।-

দু’টি দৃষ্টান্ত (نظيران للنفاق) :

(১) আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব-এর আগমন (قدوم ياسر بن أخطب) : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় আগমনের পর প্রথম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব। তিনি তার লোকদের নিকট ফিরে গিয়ে বলেন,أَطِيْعُوْنِىْ فَإِنَّ هَذَا هُوَ النَّبِىُّ الَّذِىْ كُنَّا نَنْتَظِرُ ‘তোমরা আমার আনুগত্য কর। কেননা ইনিই সেই নবী আমরা যার অপেক্ষায় ছিলাম’। কিন্তু হুয়াই বিন আখত্বাব, যিনি তার ভাই ও গোত্রের নেতা ছিলেন, তার বিরোধিতার কারণে সাধারণ ইহূদীরা ইসলাম কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।[1]

উল্লেখ্য যে, ইহূদী আলেম ও সমাজনেতাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন, لَوْ آمَنَ بِىْ عَشْرَةٌ مِنَ الْيَهُوْدِ لَآمَنَ بِى الْيَهُوْدُ ‘যদি আমার উপরে দশজন ইহূদী নেতা ঈমান আনত, তাহ’লে গোটা ইহূদী সম্প্রদায় আমার উপরে ঈমান আনতো’।[2] এতে বুঝা যায় যে, সমাজনেতা ও আলেমগণের দায়িত্ব সর্বাধিক। অতএব তাদের সাবধান হওয়া কর্তব্য।

(২) আব্দুল্লাহ বিন সালাম-এর ইসলাম গ্রহণে প্রতিক্রিয়া(رجعية من إسلام عبد الله بن سلام) : ক্বোবার পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন ইয়াছরিবে তাঁর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জার গোত্রে অবতরণ করেন, তখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন ইহূদীদের সবচেয়ে বড় আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি ছিলেন বনু ক্বায়নুক্বা‘ ইহূদী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত (আবুদাঊদ হা/৩০০৫)। তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে এমন কিছু প্রশ্ন করলেন, যার উত্তর নবী ব্যতীত কারু পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সব প্রশ্নের সঠিক জবাব পেয়ে তিনি সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে, إِنَّ الْيَهُوْدَ قَوْمٌ بُهُتٌ إِنْ عَلِمُوْا بِإِسْلاَمِىْ قَبْلَ أَنْ تَسْأَلَهُمْ بَهَتُوْنِىْ عِنْدَكَ ‘ইহূদীরা হ’ল মিথ্যা অপবাদ দানকারী এক ঘৃণিত সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করার আগেই যদি তারা আমার ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি জেনে ফেলে, তাহ’লে তারা আপনার নিকটে আমার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিবে’। তখন তিনি আব্দুল্লাহকে পাশেই আত্মগোপন করতে বলে ইহূদীদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদের নিকটে আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বলল,سَيِّدُنَا وَابْنُ سَيِّدِنَا، خَيْرُنَا وَابْنُ خَيْرِنَا ‘আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার পুত্র। আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্র’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَأَعْلَمُنَا وَابْنُ أَعْلَمِنَا ‘আমাদের মধ্যে সেরা জ্ঞানী ও সেরা জ্ঞানীর পুত্র’ (বুখারী হা/৩৯১১)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَفَرَأَيْتُمْ إِنْ أَسْلَمَ عَبْدُ اللهِ؟ ‘আচ্ছা যদি আব্দুল্লাহ মুসলমান হয়ে যায়’? জবাবে তারা দু’বার বা তিনবার বলল, أَعَاذَهُ اللهُ مِنْ ذَلِكَ ‘আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন’! অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন সালাম গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। এটা শোনামাত্র ইহূদীরা বলে উঠলো, شَرُّنَا وَابْنُ شَرِّنَا ‘আমাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ও নিকৃষ্ট ব্যক্তির পুত্র’।[3] আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) তখন তাদেরকে বললেন,يَا مَعْشَرَ الْيَهُوْدَ اتَّقُوا اللهَ فَوَ اللهِ الَّذِىْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ، إِنَّكُمْ لَتَعْلَمُوْنَ أَنَهُ رَسُوْلُ اللهِ وَأَنَّهُ جَاءَ بِحَقٍّ ‘হে ইহূদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তোমরা ভালভাবেই জানো যে, ইনি আল্লাহর রাসূল এবং ইনি সত্যসহ আগমন করেছেন’। জবাবে তারা বলল, كَذَبْتَ ‘তুমি মিথ্যা বলছ’।[4] বলা বাহুল্য এটাই ছিল ইহূদীদের সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা, যা তিনি মদীনায় পদার্পণের শুরুতেই অর্জন করেন।

আজকেও ইহূদী-নাছারাদের উক্ত বদস্বভাব অব্যাহত আছে। তাদের মিডিয়াগুলি রাসূল (ছাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বদা লাগামহীনভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিন যেমন মদীনার মুনাফিকরা ইহূদীদের দোসর ছিল, আজও তেমনি মুসলিম নামধারী বস্ত্তবাদীরা তাদের দোসর হিসাবে কাজ করছে।

[1]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯৩৯-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য, ৭/২৭৫ পৃঃ। উল্লেখ্য যে, ইহূদী নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব সম্পর্কে তার কন্যা ছাফিইয়াহ, যিনি পরবর্তীতে রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রী হয়ে উম্মুল মুমেনীন রূপে বরিত হন, তিনি বলেন, আমি আমার বাপ-চাচাদের নিকটে তাদের সকল সন্তানের মধ্যে সর্বাধিক প্রিয় ছিলাম এবং সকলের আগেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তারা আদর করতেন। যেদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রথম ইয়াছরিবে আগমন করেন ও ক্বোবায় বনু ‘আমর বিন ‘আওফের গোত্রে অবতরণ করেন, সেদিন অতি প্রত্যুষে আমার পিতা ও চাচা রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হন। অতঃপর সন্ধ্যার দিকে তারা ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আমি ছুটে তাদের কাছে গেলাম। কিন্তু আল্লাহর কসম তারা এত চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন যে, আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। এ সময় আমি আমার চাচাকে বলতে শুনলাম তিনি আমার আববাকে বলছেন, أَهُوَ هُوَ؟ ‘ইনিই কি তিনি? আববা বললেন, نَعَمْ وَاللهِ ‘আল্লাহর কসম, ইনিই তিনি’। চাচা বললেন, فَمَا فِي نَفْسِكَ مِنْهُ؟ ‘এখন তাঁর সম্পর্কে আপনার চিন্তা কী’? আববা বললেন, عَدَاوَتُهُ وَاللهِ مَا بَقِيتُ ‘স্রেফ শত্রুতা। আল্লাহর কসম! যতদিন আমি বেঁচে থাকব’ (ইবনু হিশাম ১/৫১৯; আল-বিদায়াহ ৩/২১২, আর-রাহীক্ব ১৮১ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ১২২ পৃঃ)।

অবশ্য মুসলমানদের প্রতি ইহূদীদের হিংসা ও শত্রুতা প্রমাণের জন্য এইরূপ যঈফ বর্ণনার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এজন্য পবিত্র কুরআনের সূরা বাক্বারায় বর্ণিত ১০৯, ৮৯, ১৪৬, ১২০ ও সূরা মায়েদাহ ৫১ আয়াতগুলিই যথেষ্ট।

[2]. বুখারী হা/৩৯৪১, ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায় ৫২ অনুচ্ছেদ।

[3]. বুখারী হা/৩৩২৯; মিশকাত হা/৫৮৭০, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, ‘মু‘জিযা’ অনুচ্ছেদ-৭।

[4]. বুখারী হা/৩৯১১ ‘আনছারদের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৪৫ অনুচ্ছেদ।
দেখানো হচ্ছেঃ ৪৫১ থেকে ৪৬০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯০০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 43 44 45 46 47 · · · 87 88 89 90 পরের পাতা »