পাড়া-গ্রামে এ ধরনের পরিবেশের বিরুদ্ধে মানুষ এখনও বড় সচেতন ও সোচ্চার। কিন্তু সেখানেও যে ঘুণ ধরেনি তা নয়। বর্তমানের সিনেমা, ভিডিও ও টিভির মাধ্যমে সে অসভ্যতা ভালো ঘরেও অনুপ্রবেশ করছে। যারা এমন অসভ্যতা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে।
তাদেরকে সাদাসিধা, ক্ষ্যাপা মনে করা হয়! একদা এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে কথা প্রসঙ্গে ভৎসনার সুরে বলল, তোমার ছেলেরা বড় শয়তানী করে বেড়ায়; শাসন করো।' দ্বিতীয় জন বলল, 'এখন সবারই ছেলেরা এমন করে। শুধু আমার ছেলেরা কেন? প্রথম ব্যক্তি বলল, 'আমার ছেলেরা ও পথে নেই। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি অবজ্ঞার সুরে বলল, ‘তোমার ছেলেরা তো ক্ষ্যাপা!’
এ কথা সত্য যে, পরিবেশে এমন প্রবাদ তৈরী করেছে যে, যার ফলে বলা হয়ে থাকে, ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ সত্য কথা বলে না। আর ক্ষ্যাপা ছাড়া কেউ ভালোবাসা (ব্যভিচার) ছাড়ে না! অতএব যে পরিবেশে কেউ ভালো থাকতে চাইলে তাকে ক্ষ্যাপা’ বলা হয়, সে পরিবেশে এ টিপ্পনী শোনার পর কে আর ভালো থাকতে চেষ্টা করবে?
যারা এমন নৈতিক অবক্ষয়ের পথে বাধা সৃষ্টি করেন তাদেরকে লোকেরা নাক সিঁটকে মৌলবাদী’, ‘প্রাচীন-পন্থী’ প্রভৃতি বলে ব্যঙ্গ করে। ঐ শ্রেণীর ছন্নছাড়ারা ভাবে যে, নৈতিকতার পথ হল প্রাচীন। এ আধুনিক যুগে যৌনতাই হল নারী-পুরুষের স্বাধীনতা ও প্রগতির পথ। নতুনত্ব হল সংস্কারপন্থীদের (?) পথ। নতুনত্বে আছে জীবনের নতুন আনন্দ। গতানুগতিক সেকেলে ‘মোডেল চেঞ্জ’ না করলে একঘেয়ে কোন জিনিসই ভালো লাগে না। আরবীতে একটি প্রবাদ আছে, (كل جديد لذيذ) অর্থাৎ, প্রত্যেক নতুন জিনিসই মনোহর হয়, মজাদার হয়। হাতে নতুন নোট এলে তা খরচ করতে মায়া লাগে, অন্য কেউ দেখলে তা নিতেও চায়। নতুন কনের প্রতি বরের টান একটু বেশীই থাকে। নতুনত্ব প্রায় সকলের মন আকর্ষণ করে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন তা পুরাতন হয়ে যায়, তখন সেই জিনিসের প্রতি মনের ততটা বা মোটেই টান ও আগ্রহ থাকে না। তখন নূতন নূতন ন’ কড়া, পুরনো হলে ছ’ কড়া’ তে পরিণত হয়। এটাই বাস্তব।
অবশ্য সব কিছুতেই যে নতুনত্ব ভালো তা সকলেই স্বীকার করবে না। যেমন, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে, পুরনো ঘিয়ে মাথা ছাড়ে। যতই নতুন নতুন চাল আবিষ্কার হোক এবং ফলন যত বেশীই হোক না কেন, পুরনো যুগের ও পুরনো চালের মত ভাত আর অন্য চালের হয়। অনেকে বলে, উনি পুরনো মেট্রিক পাশ, উনার শিক্ষাগত যোগ্যতা বেশী। আগেকার পড়া পড়াই ছিল--- ইত্যাদি।
পক্ষান্তরে সবচেয়ে আধুনিকতম ঐশীধর্ম ইসলামের নীতি-নৈতিকতাকে যারা প্রাচীন ও বস্তাপঁচা মনে করেন, তারা নিজেদের ধর্মের কথা ভেবে দেখতে পারেন। আর যদি ধর্মহীন। নাস্তিক হন, তাহলে তো তাঁর নিকট নূতন-পুরাতনের কোন প্রশ্নই নেই। পক্ষান্তরে নতুনত্ব ও সংস্কার আনার অর্থ যদি এই হয় যে, কিছুদিন অতিবাহিত হলেই তা বদলাতে হবে তাহলে আসল সংস্কৃতিটা কি? এর কি কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা রূপরেখা থাকবে? নারীবাদী ও যৌনদুষ্ট পরিবেশে নারী তথা জরায়ু-স্বাধীনতার যে দাবী চরিত্রহীনরা করে আসছে তা আসলে কি সংস্কার? পর্দার অন্তরাল থেকে বের হয়ে বেআবরু অবস্থায় মঞ্চে পুরুষের পাশাপাশি অবস্থানই কি সংস্কৃতি? মহিলাদের নিয়ে পুরুষদের বিভিন্ন উষ্ণ যৌনসুখ উপভোগের প্রবণতা, তাদেরকে কাছে-পাশে পাওয়ার বিভিন্ন ব্যবস্থা ইসলামের পূর্বে জাহেলী যুগে ছিল। নারী নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হত,
নৃত্যগীত হত, অর্ধনগ্ন দেহ নিয়ে যৌনসুখ ভোগ করা হত। পতিতালয় ছিল, অনেক বেশ্যাই তার ঘরের দরজায় বিশেষ পতাকা উড়উন রাখত, যা দেখে খদ্দের জমা হত। ৮৯ জন পুরুষ একত্রে জমায়েত হয়ে একটি নারীর সহিত যৌন-মিলন করত এবং তাতে গর্ভ হলে ঐ মহিলা নিজের পছন্দমত ওদের একজনকে তার সন্তানের পিতা বলে চিহ্নিত করত। কোন কোন ঈর্ষাহীন স্বামী তার স্ত্রীকে অন্যের কাছে বীর্য সংগ্রহ করে গর্ভধারণ করতে পাঠাত।
ইসলাম এসে ব্যভিচার হারাম ঘোষণা করে রমণীর মান বাড়িয়ে তুলল। সংস্কার এল মানুষের চরিত্রে। সভ্যতা বলতে যা কিছু ছিল সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে তা মানুষকে দেখিয়ে ও জানিয়ে দেওয়া হল। এ সংস্কারের আবার কি সংস্কার চাই? এর পরেও সংস্কার কি অপসংস্কার নয়? একটি মৃত ভূমিকে উৎপাদনশীল করে তাকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করা হলে বলা হয় ভূমি-সংস্কার হয়েছে। এখন যদি কোন বুদ্ধিজীবী বলেন, 'এ ভূমিরও সংস্কার। চাই; অর্থাৎ, ফুল-ফলের গাছ নষ্ট করে কাটা ও আগাছা লাগাও, তাহলেই নতুনত্ব আসবে এবং গতানুগতিক সৌন্দর্য থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা যাবে। তাহলে এমন বুদ্ধিজীবী যে কুবুদ্ধিজীবী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ যারা নারীকে মাঠে-ঘাটে, পথে-পার্কে, বাজারে-অফিসে বেপর্দায় এবং নৃত্য-গীত ও শিল্প-কলায় অবৈধ ও অশ্লীলভাবে ব্যবহার করাকে সংস্কার ও সংস্কৃতি মনে করে, সেই মাথা-মোটাদেরকে আর কি বলা যায়?
আর সংস্কার নয়ই বা কেন? নারীই তো এখন সবকিছু। নারীর হাতে রয়েছে সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। নারীর হাতে রয়েছে পুরুষের শান্তি ও স্বস্তি। সকল জ্বালার মলম। ব্যবসায় উন্নতি চাইলে একজন সুন্দরী যুবতীকে ম্যানেজার করে দাও, ব্যবসা দারুণ চলবে। চা, পান, মিষ্টি অথবা যে কোন দোকানে রূপসী যুবতীকে বসিয়ে দাও, খদ্দের বেশী আসবে তোমার ঐ দোকানেই। সেলুন খুলে যুবতীকে বসিয়ে দাও, আর কোন যুবক তোমার সেলুন ছাড়া অন্য সেলুনে যাবে না চুল-দাড়ি কাটতে। হোটেল খুলে সুন্দরী আধুনিকাদেরকে পরিচারিকা রেখে নাও, সমস্ত হোটেল বন্ধ হয়ে গেলেও তোমার হোটেল খুব ভালোভাবে। চলবে। যে কোন ব্যবসায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুন্দরী পাঠাও, সফলতা সুনিশ্চিত। যে অফিসে বারবার গিয়েও তোমার কার্য সিদ্ধ হয় না, সে অফিসে তুমি নিজে না গিয়ে তোমার আধুনিকা মিসেস’কে পাঠাও, তড়িঘড়ি কাজ হয়ে যাবে। কোন কিছুর বিজ্ঞাপন দেবে? সুন্দরীর মুখশ্রী ও সুঠাম রম্য আবেদনময়ী দেহ ব্যবহার কর, ক্রেতাদল তোমার মালকেই বেশী পছন্দ করবে। দর্জি যুবতী হলে আবার কি চাই?
সমস্ত যুবকদল ভেঙ্গে পড়বে তার কাছে জামাপ্যান্টের মাপ দিতে। পত্রিকায় মডেল যুবতী বা হিরোইনের ছবি বেশি বেশি ছাপো, পত্রিকার গ্রাহক-সংখ্যা বেড়ে যাবে নাটকীয়ভাবে। তাছাড়া পতিতালয়, ফিল্ম, ব্লু ফিল্ম প্রভৃতির ক্ষেত্রে নারীর অবদান অস্বীকার করা যায় কি? সংস্কৃতি (?) নৃত্যশালায় যুবতী নর্তকীদের পিছনে অর্থ কামাও, এমন অর্থকরী ব্যবসা আর অন্য কিছু নেই। মোট কথা, অর্থ উপার্জনের এক আজব যন্ত্র এই নারী। একে গোপনে রাখলে, সতীর হালে ঘরের বউ করে রাখলে কি করে চলে? অনেক মোটা বুঝের মানুষ মনে করে থাকে যে, ইসলাম বা মুসলিমরা নারীকে ‘ভোগ্যপণ্য বা ভোগের বস্তু’ গণ্য করে। আসলে জলাতঙ্ক রোগী তো, তাই নির্মল জলেও কুকুর দেখে। থাকে। কিন্তু জিজ্ঞাস্য যে, যাদের ঘরে-বাইরে নারী, বডিগার্ড নারী, প্রাইভেট-সেক্রেটারী নারী, নাপিত নারী, পরিচারিকা নারী, কফি পরিবেশক নারী, সম্মুখে নারী, পশ্চাতে নারী, ডানে। নারী, বামে নারী, বিয়ের আগেও শয্যাসঙ্গী নারী, অফিসে নারী, ক্লাবে নারী, খেলার মাঠে নারী, পার্কে নারী, যাদের কাছে নারী পুরুষ সমাজের সেফটি ভাল্ব’, যাদের কাছে পত্নী ও উপপত্নী সমান, যাদের জীবনই নারীতে নারীময়, তাদের কাছে নারী ভোগের বস্তু, নাকি যারা নিজের বিবাহিতা স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট এবং অন্য কোন গম্য নারীর মুখদর্শনও অবৈধ ভাবে, তাদের কাছে নারী ভোগের সামগ্রী?
যুবক বন্ধু আমার! নারীবাদীদের কুহকে পড়ে ‘মেড়া’ হয়ে যেও না। স্ত্রী-কন্যা ও বোনের ব্যাপারে ঈর্ষাহীন হয়ে পড়ে না। তাদেরকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে তুমি নিজে সীমাহীন পরাধীনতার শিকার হয়ে যেও না। আমাদের সমাজ-বিজ্ঞানী নবী বলেন, “তিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ বেহেশু হারাম করে দিয়েছেন; এদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হল মদ্যপায়ী, দ্বিতীয় ব্যক্তি হল পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, আর তৃতীয় ব্যক্তি হল ‘মেড়া’ পুরুষ; যে তার পরিবারের নোংরামীতে মৌনসম্মতি জানায়।” (আহমাদ, সহীহুল জামে’ ৩০৪৭ নং)
নারী-স্বাধীনতাবাদীর অবস্থা এই যে, তার নতি স্বীকার করা দরকার ছিল আল্লাহর বিধানের কাছে; কিন্তু তা না করে গোবেচারা নতি স্বীকার করে স্ত্রীর কাছে! তাই স্ত্রীকে অন্যের সাথে অবৈধ সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারে আঁটতে পারে না। কোন কোন কাজে বা খিদমতে বাধ্য করতে পারে না। কারণ, সে তো আধুনিক যুগের মানুষ। সে লাগামছাড়া নারী-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাই স্ত্রীকে চরম ও পরম স্বাধীনতা দিয়ে মনের উদারতা প্রকাশ করে থাকে। কেউ তাকে ‘ভেড়া’ বললেও স্ত্রী ও তার বন্ধুরা তো তাকে উদার মনের মানুষ’ বলে প্রশংসা করে। এ যুগে এটাই তো পৌরুষ। অথচ সে বেচারা যে নিজে পরাধীনতার শিকার হয়ে পড়ে, তা হয়তো নিজেও অনুভব করতে পারে না। অবশেষে সে স্ত্রৈণ ও আঁচল-ধরা’ পুরুষে পরিণত হয়, তা নিজে বুঝতে না পারলেও সমাজের সচেতন মানুষরা অবশ্যই বোঝে।
আর একটি কথা মনে রেখো বন্ধু! লজ্জা হল নারীর ভূষণ এবং সতীত্ব হল তার মূলধন। এ দুই না থাকলে নারীর আর কিছুই থাকে না। তখন অবস্থা হয় বাদুড়-চোষা তালের মত। এতদুভয় নিয়ে নারী বা অন্য কেউ যখন ব্যবসা বা চিত্তবিনোদন শুরু করে, তখন নারী যে কেবল শাড়ী-সর্বস্বই থেকে যায় তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু নারীবাদীদের তাতে কি এসে যায়? তারা তো আসলে ‘কানা বেগুনের ডোগলা খদ্দের। প্রগতিবাদীর প্রগতির চাকা সদা গতিময়। স্বামী-স্ত্রীর সংসার। সর্বদা ঘরে থেকে একঘেয়েমি জমে ওঠে মনে৷ এরও একটা সংস্কারের দরকার। এই গতানুগতিকতা দূর করতে প্রগতির পথে খোলা-মেলা বের হতে হবে প্রগতির ময়দানে মুক্ত আকাশের নিচে, কোন পার্কে, সবুজ বনানীতে, অথবা সমুদ্র সৈকতে। যেখানে প্রগতিময় প্রেমের সাক্ষী হবে ছায়াঘন বন, ফুটন্ত ফুল ও তার সুবাস, বিশাল সমুদ্রের ফুলে ফুলে ওঠা তরঙ্গমালা, সৈকতের ধুলাহীন বালি এবং সন্ধ্যা আকাশের কোটি কোটি তারকারাজি। জ্যোৎস্না-আলোকিত স্নিগ্ধময় রাত্রে প্রেমিক-প্রেমিকার মনে ক্ষণে ক্ষণে পুলক জেগে উঠবে। রোমা ছাড়া প্রেম জীবনের আর স্বাদ কোথায়? কুকুর-বিড়াল রাস্তা-ঘাটে প্রেম-মিলন ঘটায়, বাঘ-শিয়াল ঘটায় বনেঝোপে, সুতরাং মানুষ কেন তা ঘরের কোণে গোপনে ঘটাবে? আমি যে একজনকে ভালোবাসি, প্রেমের মিলন উপহার দিই, তা যদি অপ্রকাশিত থেকেই গেল এবং প্রকৃতির। কেউ জানতেও পারল না, তাহলে সে ভালোবাসা ও প্রেমের মূল্য কি?
বলা বাহুল্য এই হল প্রগতির গতি। পরন্তু সঙ্গিনী যদি উপপত্নী অথবা গার্ল ফ্রেন্ড’ হয় তাহলে প্রগতির প্রকৃতিই হল উক্ত প্রকার রোমান্স।
আসলে এসবের মূলে রয়েছে লজ্জাহীনতা ও মুসলিমের ঈমানী দুর্বলতা। মহানবী ও বলেন, “অবশ্যই লজ্জাশীলতা ও ঈমান এক অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সুতরাং দু’টির একটি উঠে গেলে অপরটিও উঠে যায়।” (হাকেম সহীহুল জামে’ ১৬০৩ নং) সুতরাং এ শ্রেণীর মানুষদের ঈমান দুর্বল অথবা একেবারে নেই বলেই লজ্জা-হায়ও নেই। আর এ কথা ঠিক যে, বেহায়া মানুষের মনে ঈমানও লুপ্তপ্রায় হতে থাকে।
পরিবেশ নোংরা করতে বড় হাত রয়েছে ঐ তথাকথিত নারীবাদী বহু লেখক-লেখিকাদের। যারা নারী-পুরুষের সর্ব বিষয়ে সমান অধিকার দাবী করে থাকেন। যারা বলেন,
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন(?) ভেদাভেদ নাই।
ইসলাম যদিও নারীর উপর কোন পীড়ন আনেনি তবুও ঐ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের পর্দার বিধানকে নারীর জন্য অবরোধ-প্রথা মনে করে দ্বীনের উপর বাকতরবারির আঘাত চালান। এদের ধারণা হল, ইসলামে নারী হল নরের দাসী। মুসলিম পরিবেশে নারীদেরকে হেরেম কারাগারে বন্দিনী করে রাখা হয়। অবশ্য এ হল কোন কোন বাহ্যিক পরিবেশের অবস্থা দর্শনের পর সীমিত ও সংকীর্ণ জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গির ফল। আর উক্ত দাবীর ফলেই কবির এ কথা সত্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছে,
পার্শ্ব ফিরিয়া শুয়েছেন আজ অর্ধনারীশ্বর,
নারী চাপা ছিল এতদিন, আজ চাপা পড়িয়াছে নর।
আজ সর্বক্ষেত্রে নারী ও নারীবাদীরা পুরুষের মত সমান অধিকার দাবী করছে। ভাবতে অবাক লাগে যে, তারা এমন অধিকার দাবী করে বসে, যাতে তাদের নিজেদেরই ক্ষতি থাকে। আমেরিকার কিছু মহিলা সৈনিক দাবী জানায় যে, বৈষম্য না রেখে পুরুষ সৈনিকদের মত তাদেরকেও মাথা নেড়া করতে অনুমতি দেওয়া হোক! কেউ চায় পুরুষদের মত প্যান্ট পরে দাড়িয়ে পেশাব করতে, পুরুষদের মত খালি গায়ে থাকতে! গরমে পুরুষরা খালি গায়ে মেয়েদের সামনে হাওয়া খাবে, অথচ মেয়েরা পুরুষদের সামনে খালি গায়ে হাওয়া খেতে পারবে না কেন? অনেকে কার্যক্ষেত্রে সমান অধিকার নিতে গিয়ে বন্ধুত্ব ও অবাধ স্বাধীনতায় সমান অধিকার দাবী করে। পুরুষ যে কাজ করবে সে কাজ নারী করবে না কেন?
নারীদেরকে যে কষ্ট ভোগ করতে হয় তা তারা একা ভোগ করবে কেন? পুরুষদেরকেও তাতে ভাগী হতে হবে। আর পরিশেষে হয়তো সম্ভব হলে এ দাবীও উঠবে যে, প্রথম সন্তান যদি স্ত্রী প্রসব করে তাহলে দ্বিতীয় সন্তান প্রসব করতে হবে স্বামীকে! অথচ সৃষ্টিকর্তা নারী-পুরুষ সকলকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে রেখেছেন ইনসাফের সাথে। তিনি নারীর উপর নরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর এ কথাও স্পষ্ট ঘোষণায় বলে দিয়েছেন যে, “যার দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কাউকে কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ এবং নারী যা অর্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ। তোমরা আল্লাহরই নিকট অনুগ্রহ ভিক্ষা কর। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।” (সূরা নিসা ৩২ আয়াত)
শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতেই নয় বরং বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও নারী ও পুরুষ এক অপরের সমকক্ষ নয়। দৈহিক ও প্রকৃতিগত বহু পার্থক্য রয়েছে নারী-পুরুষের মাঝে। যেমন, পুরুষরা নারীদের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ বেশি লম্বা, ২০ ভাগ বেশি ভারী এবং ৩০ ভাগ বেশী শক্তিশালী। পুরুষ এবং মহিলা একই খাদ্য খেলে নারীদের পক্ষে তা হজম করতে বেশি সময় লাগে। নারীদের ব্যথার অনুভূতি অনেক তীব্র। মানসিক দিক দিয়ে নারীদের পক্ষে বিষাদগ্রস্ত। হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। মস্তিষ্কের উপর হরমনের প্রতিক্রিয়াও মহিলা এবং পুরুষ। ভেদে যথেষ্ট আলাদা। মানুষের মন-মেজাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী সেরেটনী’ নামক রাসায়নিক পদার্থ নারীদের দেহে কম তৈরী হয়। যার ফলে নারীদের মানসিক প্রতিক্রিয়া পুরুষদের তুলনায় তীব্র। সে জন্যই বাইরের ঘটনার প্রতি নারীদের প্রতিক্রিয়া অনেক প্রবল। হার্ট এ্যাটাকের ফলে পুরুষদের মারা যায় শতকরা ২৪ জন এবং মহিলাদের মৃত্যুর সংখা হল ৪২। বেশি বয়সের নারীদের হাড় দুর্বল হয়। তাদের হাড়ের ওজনও পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। এমনকি তাদের মাংসপেশী কম জোড়ালো এবং তার ওজনও কম।
মোটকথা, আন্দোলনের ফলে নারী-পুরুষের সমান অধিকার নারীবাদীদের নিকট অংশতঃ স্বীকৃত হলেও প্রাকৃতিক দিক দিয়ে পুরুষ পুরুষ এবং নারী নারীই। তারা সমান হতে পারছে । হয়তো কোন কালে পারবেও না। (বিবিসির প্রতিবেদন) সুতরাং যুবক বন্ধু পানি ঘোলা করে মাছ শিকার করে যারা খেতে চায়, তাদের কুহকে পড়ে তুমিও অনুরূপ শিকারীতে পরিণত হয়ো না। এটাই আমার উপদেশ।
আমরা যে পরিবেশে বসবাস করি তার অবস্থা একেবারে উল্টা বুঝিল রাম। যেখানে কথা ছিল, দাড়িহীন মুখ দেখে লোকে ঠাট্টা করে বলত, 'আরেপুরুষ অথচ মুখে দাড়ি নেই! অথবা মুসলিম অথচ মুখে দাড়ি নেই!’ সেখানে লোকে বলে, 'এ্যা! মুখভর্তি দাড়ি! যেখানে দরকার ছিল অর্ধনগ্নতা দেখে অবাক হওয়া, সেখানে তা না হয়ে অবাক হয় পর্দা-পুশিদা দেখে! যেখানে কথা ছিল, নারী (মাথা সহ) গলা-ঢাকা ও পায়ের গাঁট-ঢাকা লেবাস পরিধান করবে, সেখানে এ শ্রেণীর লেবাস ব্যবহার করে পুরুষরা। আর নারীরা করে তার বিপরীত। অর্থাৎ, পুরুষের গলা টাই দ্বারা টাইট করে বাধা হয় এবং প্যান্ট ইত্যাদি মাটিতে ঝুলিয়ে পরা হয়। আর মহিলাদের মাথা ও গলার কাপড় নেমে যায় স্তনের উপর এবং গাটের নিচের কাপড় উঠে আসে হাঁটুর উপর! পুরুষদের চুল ছোট এবং মেয়েদের চুল বড় করার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে অধিকাংশ তার উল্টাটাই হয়ে থাকে। আর সম্ভবতঃ এ ধরণের উল্টাপাল্টা করার নামই হল বর্তমানের সংস্কৃতি ও প্রগতি। সুতরাং সমাজে ইসলামী সংস্কার আনার জন্য যে তোমার বিশেষ ভূমিকা থাকা উচিত, তা বলাই বাহুল্য। বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি এই যে, সমাজে যে শ্রেণীর মানুষ বেশী হবে তাদেরই হবে জয়জয়কার এবং তাদের চরিত্রই পরিণত হবে নৈতিকতা ও সভ্যতায়। লম্পটের সংখ্যা অধিক হলে পুরো সমাজের প্রতিনিধি হয়ে বসবে লম্পট! বেশ্যার সংখ্যা অধিক হলে তাদের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষার দাবী উত্থাপিত হলে তাদেরকেও দেওয়া হবে প্রতিনিধিত্ব! কেউ তা দিতে না চাইলে সমাজের কত চিন্তাবিদ ও কবিরা তাদের সুরে সুর মিলিয়ে গাইবেন,
কেহ নহে হেথা পাপ-পঙ্কিল কেহ সে ঘৃণ্য নহে,
ফুটিছে অযুত বিমল কমল কামনা-কালিয় দহে।
শোন মানুষের বাণী,
জন্মের পর মানব জাতির থাকে না ক’ কোন গ্লানি।
---- শুনো ধর্মের চাই
জারজ-কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!
যদিও ধর্মে উভয় সন্তানের মাঝে মানবিকতায় কোন পার্থক্য নেই তবুও উভয়ের পিতামাতার মাঝে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে তা বলাই বাহুল্য। যেমন নিজ হাতে কামাই করা টাকাও টাকা এবং চুরি করা টাকাও টাকা। কিন্তু পরিশ্রমী ও চোরের মাঝে যে বিরাট পার্থক্য আছে, তা তো সকলকেই মানতে হবে। পরন্তু সংখ্যাধিক্যের কারণে লম্পট ও বেশ্যাদের দাবী রক্ষার্থে দেশে বিশেষ আইন তৈরী হবে! বরং তাদের ঐ লাম্পট্য ও বেশ্যাবৃত্তি সুবিধা ও সহজ করার জন্য দেশের সরকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে। তাদেরকে সমাজের বন্ধু মনে করে দেশ উন্নয়নের (যৌন) কর্মী মনে করা হবে। মানবাধিকার রক্ষার নামে সংগঠন ও সংস্থা কায়েম হবে! এটাই হল বাস্তব, যাদের সংখ্যা ও ভোট বেশী, জয় তাদের। আইন প্রণয়নের ক্ষমতাও তাদেরই হাতে।
আর এও এক বাস্তব যে, পৃথিবীতে চিরদিনই সৎ ও ভালো লোকের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে অনেক কম। জগতের অধিকাংশ লোকই অসৎ। অধিকাংশ লোকেই যৌনবাদ ও জরায়ু-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। কারণ, এতেই আছে জীবনের পরম তৃপ্তি, মানুষের প্রকৃতিগত চরম সুখ। সুতরাং তারাই যে পৃথিবীর নেতৃত্ব হাতে পাবে, তা তো গণতন্ত্র-শাস্ত্র আমাদেরকে ভবিষ্যৎবাণী করে। আজ যারা অর্ধনগ্ন হয়ে কোমর দুলিয়ে দুনিয়াকে অশ্লীল নাচ দেখাচ্ছিল, তারাই কাল দুনিয়ার নেতৃত্ব হাতে পাবে। কারণ, দুনিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের নাচে খুশী হয়েছে, তাই তাদেরকে পছন্দ ও নির্বাচিত করবে। কাল যাদের দেহরূপ ও অঙ্গভঙ্গি দেখে চক্ষুশীতল করেছে, আজ দুনিয়া তাদের নিকট মাথা নত করে তাদের আনুগত্য করবে!
যুবক বন্ধু! মহানবী সঃ এর এক অহীলব্ধ ভবিষ্যৎ-বাণী শোন, তিনি বলেন, “মানুষের। নিকট এমন ধোকাব্যঞ্জক যুগ আসছে, যাতে মিথ্যাবাদীকে সত্যবাদীরূপে এবং সত্যবাদীকে মিথ্যাবাদীরূপে পরিগণিত করা হবে। যখন খেয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হবে এবং আমানতদার আমানতে খেয়ানত করবে। যখন জনসাধারণের ব্যাপারে তুচ্ছ লোক মুখ চালাবে।” (আহমাদ, ইবনে মাজাহ হাকেম, সহীহুল জামে ৩৬৫০ নং) তিনি বলেন, “কিয়ামত ততদিন পর্যন্ত কায়েম হবে না, যতদিন না পার্থিব ব্যাপারে সবচেয়ে সুখী ও সৌভাগ্যের অধিকারী হবে অধমের পুত্র অধম।” (আহমাদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে' ৭৪৩ ১ নং)
বলা বাহুল্য, সে যুগ যে এসে গেছে তাতে কোন মুমিনের সন্দেহ থাকতে পারে না। গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও লাগামছাড়া পাশ্চাত্য সভ্যতা-ঘেরা দেশ ও পরিবেশ। যেখানকার এমন কোন আইন নেই, যা মানুষের প্রবৃত্তিপূজায় বাধা দেয়। বরং অনেক আইনেই উদ্বুদ্ধ করা হয় প্রবৃত্তিপূজায়, ভোগবাদিতায় এবং ধর্মহীন অবাধ স্বেচ্ছাচারিতায়। তাদের সকলের মুখেই যেন একই বাণী,
দুনিয়াটা মস্ত বড়, খাও-দাও ফুর্তি কর,
আগামী কাল বাঁচবে কি না বলতে পার?
মরণের পরপারের কথায় অবিশ্বাসীদের এই ভোগবাদী পরিবেশে মুসলিমদের অবস্থাও বিপর্যস্ত। তারপর আবার ঘরের টেকি কুমীর। মুর্তাদ্দ বুদ্ধিজীবীরা; যারা নিজেদের কুবুদ্ধিকে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে জীবিকা ও অর্থ অর্জন করে তাদের লেখনি, বক্তৃতা ও ব্যবহারেও মুসলিম যুবক কুহকগ্রস্ত। এদের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজ ও পরিবেশ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। বাইরের শত্রু যত ক্ষতি সাধন করতে না পারে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী পারে ঐ মীরজাফরেরা।
আর বাইরের শত্রুরা এদেরকে ব্যবহার করে, এদের বুদ্ধিকে ক্রয় করে নিয়ে কাঁটা দিয়ে কঁটা তোলার কাজ করিয়ে নেয়। তাদের শক্তিশালী প্রচারমাধ্যমে তাদেরকেই সমাজসেবী। বীর-বাহাদুররূপে চিত্রিত করে।
ভাইজান! যদিও এই শ্রেণীর মানুষদের নিকট থেকে গোড়া-রক্ষণশীল’ বলে অনেক গালি ও কটাক্ষ শোনা যায়, তবুও তুমি মনে মনে আল্লাহর আদেশ পালনে গর্ববোধ করো। আর তাদের ঐ কথায় কর্ণপাত না করে ভেবো, কুত্তা হুঁকতা রহেগা, আওর হাথী চলতা রহেগা।
মুসলিম আজ সুপরিকল্পিতরূপে হিংসা ও পরশ্রীকাতরতার শিকার। মুসলিমের অমূল্য ধন চরিত্র ও নৈতিকতা দেখে সারা বিশ্বের চোখ-টাটানি রয়েছে ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই। তাছাড়া এমনিতেই মানুষ এক অপরের ভালাই দেখতে পারে না। হাসলে বলে, লোকটা প্রগম্ভ। কাঁদলে বলে, ছিচকাদুনে। বেশী কথা না বললে বলে, গোমরামুখে। কথা বললে বলে, গপে। সহ্য করলে বলে, ভীরু। প্রতিশোধ নিলে বলে, অসহিষ, সন্ত্রাসী। ভালোর চেষ্টা থাকলেও মানুষ তাকে মন্দ আখ্যা দিতে দেরী করে না। দেখতে না পারলে চলন বাঁকা লাগে। চোখে। অবশ্য এর মুলে থাকে ভুল বুঝাবুঝি ও কুধারণা মাত্র।
ইসলামের প্রতি কিছু সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের নাক-সিঁটকানির একটি কারণ এই যে, তারা মনে করেন, ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত একটি ধর্ম অথবা মতবাদ। অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন তথ্য যেমন বিজ্ঞানের সাথে সংঘর্ষ বাধিয়েছে এবং বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব তথ্য প্রকাশ করে বহু বৈজ্ঞানিককে ধর্মযাজকদের হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছে -যেমন হয়েছে। গ্যালিলিও প্রভৃতি বৈজ্ঞানিকের সাথে -তেমনি ইসলামেরও বহু তথ্য আছে যা অবৈজ্ঞানিক।
আসলে তারা কিন্তু নিছক ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মধুকে মদ মনে করেছেন। তুলনা । করেছেন দুধকে আলকাতরার সাথে। তাদের চুন খেয়ে গাল তেঁতেছে, তাই দই দেখেও ভয়। পাচ্ছেন! অথচ তারা যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে ইসলাম ও তার সংবিধান
কুরআন ও সহীহ হাদীস এবং উভয়ের সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে বিবেচনা-গবেষণা করতেন, তাহলে অন্ততঃপক্ষে তাদের সে ভুল ধারণা ও সন্দেহের মেঘ মনের আকাশ থেকে পরিষ্কার হয়ে যেত। আর ঊর্ধ্বপক্ষে তারা প্রমাণ করতে পারতেন যে, ইসলাম কোন বিকৃত ধর্ম বা মানব-রচিত মতবাদের নাম নয়। বরং ইসলাম হল মহান সৃষ্টিকর্তা মহাবৈজ্ঞানিক আল্লাহর তরফ থেকে সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি অক্ষত জীবন-ব্যবস্থা। আর তার সাথে তাদের দুই দেখে সেই ভয় দূর হয়ে যেত; যে ভয় চুন খেয়ে গাল তাতার ফলে সৃষ্টি হয়েছিল।
বিশ্বপরিচালনা করার মত শক্তি কোন ধর্মের না থাকলেও ইসলামের আছে। যেহেতু ইসলাম হল সমগ্র মানবমণ্ডলীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান। মানব-জীবনের সকল প্রকার সমস্যার পূর্ণ সমাধান এক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মে নেই। তাই তো খৃষ্টধর্মাবলম্বী হয়েও আমেরিকার এক গবেষক লেখক মাইকেল এইচ হার্ট’ তার 'দি হানড্রেড’ নামক প্রসিদ্ধ পুস্তকে মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে স্বীকার করেছেন এবং একশত মনীষীর মধ্যে তাকেই ঐ পুস্তকের প্রথমে স্থান দিয়েছেন। আর এর কারণ উল্লেখ করে বলেছেন যে, অন্যান্য মনীষী ছিলেন শুধু জাগতিক অথবা শুধু ধার্মিক নেতা। কিন্তু মুহাম্মাদ ই ছিলেন জাগতিক এবং ধার্মিক উভয় ক্ষেত্রের পুরোধা। (শ্রেষ্ঠ ১০০, ৪পৃঃ)
সুতরাং অন্য ধর্মের ব্যর্থতা দেখে অনুমান করে এ ধারণা এক প্রকার অজ্ঞতা যে, অন্য ধর্ম যা পারেনি, তা ইসলামও পারবে না। অথবা অন্যান্য ধর্মমতের অনুরূপ ইসলামও একটা ধর্মমত। বরং প্রকৃত বাস্তব এই যে, ইসলাম হল স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মনির্ভরশীলতায় পরিপূর্ণ একটি শ্বাশত ও চিরন্তন ধর্ম।
বহু যুবকই ঐ শ্রেণীর হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পড়েছে। পরিবেশের বিষাক্ত ধুয়া নাকেমুখে লেগে তাদের শ্বাসরোধ করে ফেলেছে। এর একটি ছোট্ট উদাহরণ হল দাড়ি রাখার ব্যাপার। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা আমাদের সারা দেহে বিভিন্ন ধরনের লোম সৃষ্টি করেছেন। বান্দার কাছে আনুগত্যের পরীক্ষা নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি কিছু লোম ছাঁটতে, কিছু চেঁছে ফেলতে, কিছু সৌন্দর্যের সাথে বহাল তবীয়ত ছেড়ে রাখতে আদেশ করেছেন; আর তা অবৈজ্ঞানিক নয়। কারণ আল্লাহ বিজ্ঞানময় সৃষ্টিকর্তা। “সৃষ্টি ও নির্দেশ কেবলমাত্র তাঁরই। বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহ মঙ্গলময়।” (সূরা আ'রাফ ৫৪ আয়াত) এবারে তার আদেশ। হল দাড়ি রাখা। যা পুরুষের প্রতীক, সকল মহামনীষীদের আদর্শ এবং মুসলিমের জন্য (কমপক্ষে এক মুষ্ঠি পরিমাণ) ওয়াজেব। কিন্তু পরিবেশের চাপে মুসলিম তা অস্বীকার করতে চায়। কেউ বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, 'ঈমান তো এখানে। অর্থাৎ, মুখে নয়, বুকে। আর তার মানেই হল, বুকে ঈমান রাখাই যথেষ্ট। কাজে পরিণত না করা বা আল্লাহ ও তদীয় রসুলের বিরুদ্ধাচরণ করা কোন প্রকার ক্ষতিকারক নয়! অথচ ঈমান হল, বুকে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার এবং কর্মে পরিণত করার নাম।
কেউ কেউ বলে, সে যুগে ব্লেড ছিল না, তাই লোকে দাড়ি রেখে নিত। অর্থাৎ, সে যুগে ব্লেড থাকলে তারাও দাড়ি রাখত না এবং এ যুগে ব্লেড আছে, তাই দাড়ি রাখাটা যুক্তিহীন। অবশ্য এ কথা বলা মূর্খামি বৈ কিছু নয়। যেমন বহু মূখ বলে থাকে, সে যুগে লোকেরা খেতে পেত না বলে রোযা রাখত। তাছাড়া উপবাস করতে হবে কেন?! অথচ জ্ঞানী মাত্রই
জানেন যে, দাড়ি রাখার সাথে সাথে কিছু লোম না রাখারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। গুপ্তাঙ্গ ও তার চারিপাশের লোম চেঁছে পরিষ্কার করার জন্য ৪০ দিন সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অতএব সে যুগেও যে চাঁছা-ছিলার ব্যবস্থা ছিল তা বলাই বাহুল্য।
এই পরিবেশগত কারণেই বহু মহিলা পুরুষের মুখে দাড়ি পছন্দ করে না। তাই তো অনেক স্বামী পছন্দ সত্ত্বেও শুধুমাত্র ‘মিসেস'কে খুশ করার জন্য মহানবী ৪ এর আদেশ লংঘন করে তার আনুগত্য বরণ করে নেয়।
অমুসলিম পরিবেশে বয়সে হাজার ছোট হলেও দাড়ি রাখলেই বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট থেকেও ‘চাচা’ ব্যঙ্গ শুনতে হয়। অনেকে বিশ্বকবির অনুকরণে আব্দুল মাঝির মত সকলকেই এক নজরে মুখে ছুঁচলো দাড়ি, কামানো গোঁফ এবং নেড়া মাথা থাকা অবস্থায় দেখতে পায়। তাই বহু মুসলিম যুবক শুধু কাফেরদের ঐ শ্রেণীর বিদ্রুপের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ইচ্ছা সত্ত্বেও আর দাড়ি রাখতে পারে না। অথবা রাখলেও ফ্যাশন মত কেটে-হেঁটে বাদ দিয়ে রাখে। আর ঐ একই কারণে অনেকে চাকরি পাওয়ার আগে পুরুষের পৌরুষ ও দাড়ি নষ্ট করে ফেলে।
অবশ্য অনেকে এর দায়ে লড়াইও করে থাকে। যেমন এক যুবক বাসের সীটে বসে আছে। সীট বলে রাখার জন্য বাপের বয়সের এক লোক তাকে ব্যঙ্গচ্ছলে জিজ্ঞাসা করল, 'ও চাচা! তুমি কোথায় নামবে?’ অমনি যুবক চকিত হয়ে বলে উঠল, 'ভাইপো! আমি অমুক বাসষ্ট্যান্ডে নামব। ভাবী কেমন আছে?’ বয়স্ক লোকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভাবী কে?’ যুবকটি বলল, কেন? তোমার মা। তুমি না আমার ভাইপো?' লোকটি বলল, তুমি রাগছ কেন? দাড়িওয়ালা লোকদেরকে তো চাচা বলা হয়। যুবক বলল, 'তাহলে রবি ঠাকুর তোমার কোন চাচা ছিল? মুনি-সাধুরাও কি তোমার এক একটি চাচা?’ লোকটি স্তম্ভিত হয়ে ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হল। হয়তো সে এ ভুল আর কোন দিন। করবে না।
এক সহপাঠী তার মুসলিম সহপাঠীকে বহুদিন পর সাক্ষাৎ হলে বলল, কিরে তুই এই বয়স থেকে দাড়ি ছেড়ে বুড়ো সাজলি কেন?’ মুসলিম যুবক উত্তর দিল, বুড়ো সাজার জন্য নয় রে, পুরুষ সাজার জন্য দাড়ি ছেড়েছি।' সেই সহপাঠীও সেদিন তওবা করেছিল। কিন্তু নরম জায়গায় বিড়ালের আঁচড় যে বড় সুবিধা।
আসলে মুসলিমদের উচ্চ ও দৃঢ় মনোবল নেই বলেই তাদেরকে নিয়ে লোকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তাদের ঐ পা-চাটা বহুরূপী মন-মানসিকতাই অন্যের নিকটে তাদের ওজন হাল্কা করে দিয়েছে। যে মুসলিমদের কথা ছিল, আল্লাহ ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবে না, সেই মুসলিমরা আজ সৃষ্টির দাসে পরিণত হয়ে গেছে। অর্থ ও গদির লোভে নিজের স্বকীয়তা বর্জন করতে পর্যন্ত রাজী হয়েছে। হয়তো কোনদিন যদি এর জন্য খাসি হতে হয় তাও হবে!
পক্ষান্তরে রাজনৈতিক যে মর্যাদাতেই উন্নীত হোক না কেন, কোন শিখ তার ধর্মীয় প্রতীক পাগড়ী ও দাড়ি বর্জন করে না। তবুও কই, তাদেরকে কেউ চাচা” বলে না, বলতে পারে না। কারণ, তাদের আছে সুদৃঢ় মনোবল, সুউচ্চ আত্মমর্যাদা এবং ধর্মীয় প্রতীকের প্রতি পরম শ্রদ্ধা ও চরম গুরুত্ব। কিন্তু মুসলিম হীনম্মন্যতার শিকার। নিজেদের কাছে নিজেরাই নীচ,
হীন ও নিকৃষ্ট। অপরের কাছে নিজেদেরকে নেহাতই ছোট ও লাঞ্ছিত ভাবে। যে জাতি সর্বের সেরা ও সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়ে আল্লাহ-প্রদত্ত খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পৃথিবীতে এসেছিল, যে জাতি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে নতি স্বীকার করতে জানত না, যে জাতির জন্য মহান প্রতিপালকের ঘোষণা ছিল, “তোমরা নিজেদেরকে হেয় মনে করো না। এবং চিন্তিত হয়ো না। তোমরাই হবে (পৃথিবীর) সর্বোপরি, যদি তোমরা মুমিন হও।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৩৯ আয়াত) সেই জাতির অবস্থা এই যে, সে নিজের চোখে নিজেকে ছোট ও নীচ এবং অপরকে বড় ও সমুন্নত দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। আজ শুধু মনের ভিতর প্রশ্ন জাগে যে, কোথায় সে জাতি, ভিখারীর বেশে খলীফা যাদের শাসন করিল আধা জাহান’? কোথায় সে জাতি, যে জাতির শিক্ষা ছিল,
‘আল্লাহর কাছে কখনো চেয়ো না ক্ষুদ্র জিনিস কিছু,
আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে শির করিও না নিচু।
আজ মনে শুধু প্রশ্ন জাগে,
‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান,
কোথা সে আরিফ, অভেদ যাহার জীবনে-মৃত্যু-জ্ঞান?
যার মুখে শুনি’ তৌহিদের কালাম,
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যাহার দ্বীন রবে কাপিত দুনিয়া জি-পরি-ইনসান।
স্ত্রী-পুত্রে আল্লারে সঁপি’ জিহাদে যে নির্ভিক,
হেসে কুরবানী দিত প্রাণ যারা, আজ তারা মাগে ভিখ?
কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া,
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা।
আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে লয়ে কুরআন।
আসলে আজকের মুসলিম মানসিক আগ্রাসন ও পরাজয়ের শিকার। তাই নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতেও লজ্জাবোধ করে! বাঘের বাচ্চা ছাগের পালে পড়ে নিজেকে ছাগ থেকেও ছোট ও হেয় মনে করে নিয়েছে। হিরার টুকরা মাটিতে পড়ে ধূলিধূসরিত হয়ে নিজের পরিচয় ভুলে গিয়ে নিজেকে মাটির ঢেলাই মনে করেছে। অথচ ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিতে তার গর্ব হওয়া উচিত ছিল।
মহান আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎকাজ করে এবং বলে, আমি একজন (আত্মসমর্পণকারী) মুসলিম’, সে ব্যক্তির কথা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কথা। আর কার?” (সূরা ফুসসিলাত ৩৩ আয়াত)। কিন্তু যে শক্তিবলে সে নিজেকে মু'মিন’ ও ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করবে, সে শক্তি ঈমান’ ও ‘ইসলাম’ যদি তার মন, কথা ও কাজে দুর্বল বা বিলীন থাকে তাহলে সে নিজেকে গোপন করবে না কেন? যে দেশের রচিত বিকৃত ইতিহাস তার চেহারাকে কালিমাময় করে ফেলেছে সে দেশে নিজ চেহারাকে ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে না তো আর কি করবে? ইতিহাসের পর্দা তুলে কে তার আসল পরিচয় জেনে মনের মাঝে সে হারানো শক্তি ফিরিয়ে আনবে?
হে ভাই যুবক! পারবে না কি তুমি তোমার বদনামকে সুনামে পরিণত করতে? অবশ্যই পারবে। অতএব সে শক্তি আনয়ন কর, যে শক্তি ছাড়া তুমি হীন ও ক্ষীণ। যে শক্তি পরমাণু বোমা থেকেও অনেক শক্তিমান। অতঃপর যেখানেই থেকো, যে পরিবেশেই থেকো, মাথা উঁচু করে বলে, 'আমি মুসলিম। বুক ফুলিয়ে বলো, আমি মুসলিম। জোর গলায় বলো, আমি মুসলিম। গর্বের সাথে বলো, ‘আমি মুসলিম। মনের তৃপ্তির সাথে বলো, আমি মুসলিম। নির্ভয়ে বলো, আমি মুসলিম। নির্দ্বিধায় বলো, আমি মুসলিম। হিম্মতের সাথে বলো, 'আমি মুসলিম। মনের সকল সংকোচ কাটিয়ে বলো, আমি মুসলিম। জিহ্বার জড়তা কাটিয়ে বলো, আমি মুসলিম। আমি সেই সত্তার নিকট আত্মসমর্পণকারী, যিনি বিশ্বজাহানের সৃজনকর্তা ও দয়াময় পালনকর্তা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তুমি যদি কেবল নামসর্বস্ব মুসলিম হও, অন্তঃসারশূন্য মুসলিম হও অথবা ঈমানবিহীন মুনাফিক হও, তাহলে সে সৎসাহস, সে তৃপ্তি, সে গর্ব আসবে কোত্থেকে? পায়খানায় বসে তো আর মৌমাছির পরিচয় দেওয়া চলে না ভাই! বন্ধু আমার! এত লোক, এত সমাজ, এত ধর্ম ও জাতির মধ্যে একমাত্র তুমিই শ্রেষ্ঠ জাতি, সে কথা কোন সময়ের জন্য ভুলে বসো না। কুরআন সাক্ষ্য দেয়, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি; তোমরা মানবমন্ডলীর জন্য উদ্ভূত হয়েছ। তোমরা সৎকাজের আদেশ দেবে এবং মন্দকাজে বাধা দেবে। আর আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।” (সূরা আ-লি ইমরান ১১০ আয়াত) “এভাবেই আমি তোমাদেরকে এক আদর্শ মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি; যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য সাক্ষীস্বরূপ হতে পার।” (সূরা বাক্বারাহ ১৪৩ আয়াত) আর মহানবী #$ বলেন, “ইসলাম চির উন্নত, অবনত নয়।” (দারকুনী বইহাকী, সহীহুল জামে’ ২৭৭৮ নং)
সুতরাং মুসলিম হেয় নয়, তুচ্ছ নয়, নয় অবজ্ঞার পুতুল। শত হালাকুর হালাকের মুখে শত শতবার ভেঙ্গে পড়েছি, তবুও আমি আমার স্বকীয়তা নিয়ে জীবিত আছি। কত ফেরআউনের কুটিল চক্রান্ত আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে, তবুও আমি মুসার অনুসরণ করে আজও টিকে আছি। কত ঝড়-ঝঞ্চার মুখে উড়ে-উড়ে আঘাত খেয়েছি, তবুও সেই ঘাত-প্রতিঘাতের প্রবল দ্বন্দ্বের মাঝে আমি বিলীন হয়ে যাইনি। শত বাতিলের তুফান এসে আমাকে বিনাশ করতে চেয়েছে, তবুও আমি সবকিছুকে উল্লংঘন করে পাহাড়ের মত অটল থেকেছি। আর এইভাবে বাতিলের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে এবং আঘাত খেতে খেতে আমি কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত টিকে থাকব দুনিয়াতে। কেউ নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না আমাকে।
কি দোষ আমার যে, সে দায়ে আমি অত্যাচারের নির্মম আঘাত সহ্য করব? কেন আমাকে গৃহহীন ও দেশছাড়া করার এত কুটিল চক্রান্ত? আমিও তো ঐ জালেমদের মতই একজন মানুষ। হয়তো আমার অপরাধ এই যে, আমি সত্যের আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। আমি আমার ও সারা সৃষ্টির স্রষ্টারই কেবল ইবাদত করে থাকি। এ দোষেই কি আমি আমার মাতৃভূমি থেকে বহিস্কৃত হব?
এ পৃথিবীর আসল উত্তরাধিকারী হল মুসলমান। এ পৃথিবী সুসজ্জিত ও সুশোভিত আছে
শুধু মুসলিমদের জন্যই। মুসলমান ধ্বংস ও নিঃশেষ হলে পৃথিবী ধ্বংস ও নিঃশেষ হয়ে যাবে। যতদিন পৃথিবীতে একটিও মুসলিমও বেঁচে থাকবে ততদিন পৃথিবীও মহাপ্রলয়ের কবলিত হবে না। (মুসলিম, মিশকাত ৫৫১৬ নং)
তাওহীদ কী আমানত সীন মে হ্যায় হামারে
আসা নেই মিটানা নাম ও নিশা হামারা।
সুতরাং যারা মুসলিমদের ধ্বংস কামনা করে, যারা দুনিয়া থেকে মুসলিমদের নাম ও নিশানা মিটিয়ে দিতে চায়, যারা ইসলামকে মানবতার শত্রু মনে করে, সে হিংস্র মানুষেরা জানে না। যে, তারা সেই হিংসুক শিয়ালের মত, যে একদিন একটি কাককে গাছের মগডালে বসে থেকে মনের সুখে কা-কা করতে দেখে হিংসা-জ্বালায় ফেটে পড়ে বলেছিল, ঈশ্বর একটি আকাশ-তুলতুল তুফান দেয়, তাহলে শালার কাক কোথায় থাকে তাই দেখব! অথচ শিয়াল। মশায় নিজের কথাটা ভুলেই গেছে। সে এ কথাটা মনে ভেবেও দেখেনি যে, আকাশ-তুলতুল তুফানে গাছপালা ধংস হলে বা ডুবে গেলে কাক ধংস হওয়ার আগে সে নিজে ধংস হয়ে যাবে। গাছের মগডালে পানি পৌঁছনর আগেই তার গর্তের ভিতরে যে পানি থৈ-থৈ করবে সে কথা হিংসার বিষ-জ্বালায় ভাবতেও সযোগ পায়নি।
ভাই মুসলিম যুবক! তুমি যে পরিবেশেই থাক না কেন, নিজের মাথা উঁচু রেখো; তবে অহংকারী হয়ো না। তুমি তোমার ব্যবহার ও পরিবেশকে এমন নোংরা করে রেখো না, যাতে তা দেখে ইসলাম থেকে মানুষ দূরে সরে যায়, বা দূর থেকেই ইসলামের নাম শুনেই নাক সিটকায়। এ জগতে বহু মানুষ আছে, যারা ইসলামকে মনে-প্রাণে পছন্দ করে; কিন্তু ইসলামকে দ্বীনরূপে গ্রহণ করে না। এ শ্রেণীর মানুষের ইসলাম গ্রহণ না করার যে বিভিন্ন কারণ রয়েছে তার মধ্যে একটি কারণ হল, বহু মুসলিম পরিবেশের অবাঞ্ছিত নোংরা ব্যবহার এবং অনেক ফাসেক মুসলিমের বিভিন্ন অনাচার ও দুরাচার। মুসলিমদের দুরবস্থা দেখেই তারা ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয় না। অনেকে অতি পিপাসায় পিপাসার্ত হয়ে দুর দুর থেকে কাজল-জলা দীঘির সন্ধান পেয়েও তার পানির উপর মড়া ভাসতে দেখে আর সে পানি পান করতে রুচিবোধ করে না। ইসলামে মুগ্ধ। হয়েও মুসলিমদের বেআমল পরিবেশ দেখে দূর থেকে দূরেই সরে যায়।
অবশ্য এ শ্রেণীর মানুষেরা যে জ্ঞানী মানুষ তা নয়। হীরের টুকরা যদি কারো দোষে কর্দমাক্ত হয় এবং তাতে কাদা দেখে যে হীরে কুড়িয়ে নেয় না সে জ্ঞানী হয় কি করে? ‘ছুঁচোর গলায় চন্দ্রহার’ দেখে কেউ সে হার বরণ করতে নারাজ হলে সে জ্ঞানী নয়। যে হক দেখে ব্যক্তি। চেনে না; বরং ব্যক্তির মুখ দেখে হক চিনতে চায়, তাকে কেউ জ্ঞানী বলতে পারে না। জ্ঞানী। হল সেই ব্যক্তি, যে কাদা পরিষ্কার করে হীরের টুকরা কুড়িয়ে নেয় এবং ছুঁচোর কারণে চন্দ্রহারের কদর কম মনে করে না। সেই হল জ্ঞানী, যে হক দেখে পরিবেশের বিচার করে; পরিবেশ দেখে হকের বিচার নয়।
মদীনা ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর আমার ওস্তায ডক্টর যিয়াউর রহমান আযমী সাহেব যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার কর্তৃপক্ষ ও আপনজনেরা তাতে প্রতিবাদ জানিয়ে নানা প্রলোভন ও প্রচেষ্টার বলে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তবুও তিনি হক থেকে এতটুকু বিচলিত হননি। তাকে বলা হয়েছিল, 'ধর্ম পরিবর্তন করার ইচ্ছা যদি তোমার একান্তই ছিল, তাহলে ইসলাম কেন? ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেই তো পারতো।
আজ সারা বিশ্বে তাকিয়ে দেখ, ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অর্থ-সম্পদের দিক থেকে কত উন্নত ও সমৃদ্ধ। আর মুসলিমদের অবস্থা তো অধঃপতনের অতল তলে। তাদের ব্যবহার ও পরিবেশ দেখেও কি তাদের ধর্মেই দীক্ষিত হতে উদ্বুদ্ধ হলে?
আমার ওস্তায় বলেন, এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েও আমি সকলের সামনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলেছিলাম, আমি আসলে মুসলমান ও তাদের পরিবেশ দেখে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হইনি। আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি কেবল ইসলামের সৌন্দর্য দেখেই। যত ধর্ম পৃথিবীতে ছিল বা আছে তার কিছু আল্লাহর তরফ থেকে হলেও তার শেষ ও মনোনীত ধর্ম হল ইসলাম। বিজ্ঞানের যুগে এই ছোট্ট গ্রামের মত পৃথিবীতে একটা ধর্মই যথেষ্ট। তাছাড়া অন্যান্য ধর্মে ভেজাল ও বিকৃতি অনুপ্রবেশ করে তার আসলত্ব বিলীন করে ফেলেছে এবং সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থেই এই সর্বশেষ ধর্মের অনুসরণ করার আদেশ রয়েছে। এই সকল সত্যকে উপলব্ধি করেই জ্ঞানী-গুণীরা ইসলাম গ্রহণ করেন। এবারে সে সত্য ধর্মের অনুসারীরা যদি তার সঠিক অনুসরণ না করে চলে, তাতে সত্যের কি আসে-যায়? সত্য যা তা অম্লান আছে, তা বরণ করে নিজেকে সত্যের অনুসারী করার অধিকারী তো প্রত্যেক মানুষের আছে।
কাফের ও ফাসেকদের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মুগ্ধ হয়ে, রেডিও, টিভি, ফিল্ম, পত্র-পত্রিকা। ও বই-পুস্তকের নানা অপপ্রচারের প্যাচে পড়ে যুবক তার ধর্ম-বিশ্বাসে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। উঁচু মানের চরিত্র থেকে নিচে নেমে নোংরামির অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে। যদি যুবকের নিকট এমন কোন সুগভীর দ্বীনী-সভ্যতার মজবুত ঢাল এবং প্রদীপ্ত চিন্তাশক্তি না থাকে যার দ্বারা সে হক ও বাতিল এবং উপকারী ও অপকারীর মাঝে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারে, তাহলে সে কুফরী, ফাসেকী ও অশ্লীলতায় পতিত হতে বাধ্য। নাস্তিক ও বিধর্মীয় প্রচারমাধ্যমে মুগ্ধ হয়ে যুবক সম্পূর্ণ বিপরীতমুখে পশ্চাদগামী হয়ে চলতে শুরু করে। যেহেতু তাদের কথা-কৌশলের বীজ বিনা বাধায় যুবকের মন ও মগজে উর্বর জমি পায়। অতঃপর তা তাতে বদ্ধমূল হয়ে কাণ্ড ও শাখা-প্রশাখা শক্ত হয়ে গজিয়ে ওঠে এবং নাস্তিক্যবাদের ঐ ধাধায় যুবক তার জ্ঞান ও জীবনের দর্পণে সবকিছুকে উল্টা দেখে থাকে।
এই রোগের প্রতিবিধানার্থে যুবকের উচিত, পূর্ব থেকেই ঈমানী শিক্ষার প্রতিষেধক টিকা গ্রহণ করা, ঐ সকল দ্বীন ও চরিত্র-বিনাশী প্রচারমাধ্যম থেকে দূরে থাকা এবং এমন প্রচারমাধ্যমের সাহায্য নেওয়া যা হৃদয়ে আল্লাহ ও তদীয় রসুলের প্রতি মহব্বতের বীজ বপণ করে, ঈমান ও সৎকাজে উদ্বুদ্ধ করে। আর এমন প্রচারমাধ্যম নিয়ে সন্তুষ্ট থেকে দ্বীন ও নৈতিকতা বিরোধী সমস্ত রকমের প্রচারমাধ্যমকে বর্জন করার উপর ধৈর্য ধারণ করা জরুরী। কারণ, মানুষের মন তো। মন হয়তো অনেক সময় ঐ অপকারী পত্র-পত্রিকা ও শ্রাব্য-দৃশ্য বিভিন্ন প্রোগামের প্রতি ঢলতে চাইবে এবং উপকারী পত্র-পত্রিকাদি পড়তে ও কল্যাণকর কিছু শুনতে ও দেখতে বিরক্তিবোধ করবে, এ সবে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হবে। সে ও তার মনের মাঝে যুদ্ধ হবে। সে আল্লাহর অনুগত হতে চাইলেও মন চাইবে খেল-তামাশা, অসারতা ও নোংরামিতে মত্ত থাকতে। কারণ, মানুষের মন অধিকাংশে মন্দ-প্রবণ।
ঈমান সজীব ও তাজা রাখতে যুবককে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান প্রধান পুস্তকাদি পড়তে হয় তার মধ্যে (অনুবাদ সহ) আল-কুরআনের বিশুদ্ধ তফসীর, সঠিক বঙ্গানুবাদ হাদীসগ্রন্থ। এবং কিতাব ও সহীহ সুন্নাহকে ভিত্তি করে লিখিত বিভিন্ন সত্যানুসারী উলামাগণের বইপুস্তক। আমাদের দেশে রেডিও টিভিতে তো সঠিকভাবে ঈমানের আলো পাওয়া তো অবাস্তব কল্পনা। বরং তাতে যা কিছু প্রচার হয়ে থাকে তার সিংহভাগই হল ঈমান ও ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম।
শায়খ সালেহ আল-ফাওযান বলেন, বর্তমানে যুব-সমাজ বিপজ্জনক স্রোতের সম্মুখীন। যা যুব-সমস্যার মহাসমস্যাবলীর অন্যতম। যদি তাদেরকে ঐ স্রোতের মুখে ভাসতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তাতে তাদের চরিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। আচরণ বিশৃঙ্খলগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে এবং আকীদা ও দ্বীনী বিশ্বাস বিনষ্ট ও বিলীন হয়ে যাবে। এ ধরনের বহু প্রকার বহুমুখী স্রোত, যার বহু উৎসমুখ রয়েছে। কিছু স্রোত যা বিভিন্ন প্রচার-তরঙ্গে প্রবাহিত। যেমন, রেডিও, টিভি, পত্র-পত্রিকা চরিত্র-বিধ্বংসী বই-পুস্তক ইত্যাদি যা (মিঠা অথচ) তীব্র হলাহল। যুব-সমাজ অথবা তার কিছু তরুণদল, যারা অপকারী থেকে উপকারী নির্বাচন করতে পারে না, তারা তা হাত পেতে গ্রহণ করে নিয়েছে।
যদি পাঠ্য, দৃশ্য ও শ্রাব্যের এই প্রবাহধারাগুলিকে যুবসমাজকে কবলিত করতে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে এর পরিণাম হবে চরম ভয়ানক প্রতিকুল। যেহেতু আজকের যুবকদলের অনেকের চরিত্র বিগড়ে গেছে এবং তারা প্রাচ্য অথবা প্রতীচ্যের পরিচ্ছদ, চিন্তাধারা ও আচরণ-বিধির ঠিক তেমন অন্ধানুকরণ করতে লেগেছে; যেমন তারা শুনছে, দেখছে ও পড়ছে। যা ঐ সমস্ত প্রচারমাধ্যমগুলো তাদের নিকট এনে পৌছে দিচ্ছে। যার অধিকতর পরিস্থিতি এই যে, তাতে যুবসমাজকে (চরিত্রগত দিক দিয়ে) ধংস (ও তাদেরকে পদানত) করার গুপ্ত ষড়যন্ত্রই বেশী। বরং এর চেয়ে গুরুতর আপদ এই যে, যুবকের আকীদা ও ধর্মবিশ্বাসকে পরিবর্তন করার বড় অভিসন্ধি থাকে। তাই তো সত্যসত্যই কতক (বরং অধিকাংশ) যুবক মুসলিম নাম নিয়েও নাস্তিক্য, কমিউনিজম ইত্যাদি সর্বনাশী মতবাদের বিশ্বাসীতে পরিণত হয়ে গেছে। যেহেতু সে যখন এই সমস্ত প্রচার-আহ্বানের বিষয়ের প্রতি আগ্রহী থাকে; যা তার জন্য অতি ধীরে ধীরে ও অনায়াসে নিবেদন করা হয় এবং যখন তার মন ও মস্তিষ্ক প্রত্যেক মতবাদ থেকে শূন্য থাকে, আবার তার নিকট এমন কোন প্রতিরক্ষার হাতিয়ার আর না-ই কোন এমন ইলম থাকে; যার দ্বারা সে এই সন্দিগ্ধ অভিসন্ধি অথবা এই অষ্টকারী প্রচারাদিকে বুঝতে সক্ষম হয় তখন তার নিকট যা আসে তাই সাদরে গ্রহণ করে নেয়।
অতএব যে যুবক এই প্রচার-আহ্বানকে সত্বর বরণ করে এবং যার মস্তিষ্ক প্রত্যেক উপকারী ইন্ম থেকে খালি থাকে, তার মস্তিষ্কে তা যে বদ্ধমূল হয়ে যাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য তা তার মন-মগজ থেকে ছিড়ে ফেলা বড় দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে। আর এটা হল আধুনিক অন্যতম যুবসমস্যা। (মিন মুশকিলাতিশ শাবাব ১৫-১৬পৃঃ)
কচি-কাঁচা মন নিয়ে যুবক যৌবনে পদার্পণ করে। খোলা ও উদার মন তখনও পঙ্কিল ও আবর্জনাময় থাকে না। নিরীশ্বরবাদ, নাস্তিক্যবাদ, বহুশ্বরবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা (ধর্মহীনতা) বাদ, ইয়াহুদীবাদ, খৃষ্টবাদ, মির্জাবাদ, সূফীবাদ, জরায়ু-স্বাধীনতাবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন মতবাদ, সংগঠন ও প্রভাবশীল মিশনারির প্রলোভন ও খপ্পরে যখনই কোন মুসলিমমন সর্বপ্রথম ফেঁসে যায়, তখনই মুশকিল বাধে তার সঠিক পথে ফিরে আসার ক্ষেত্রে। আরবীতে একটি কবিতা আছে,
أتاني هواها قبل أن أعرف الهوى ٭ فصادف قلبا خاليا فتمكنا
এর ভাবার্থ হল, কে না চায় তার জীবন-সঙ্গিনী প্রেমিকা সুন্দরী হোক, ধনবতী হোক, উচ্চবংশীয়া তথা মর্যাদাসম্পন্না হোক। কিন্তু তবুও দেখা যায় বহু যুবক নীচ-বংশীয়া কুৎসিত নারীর প্রেম-জালে ফেঁসে তার দায়ে জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়। আর তার কারণ হল এই যে, উদার ও উন্মুক্ত মনে প্রথমে যার প্রেম এসে বাসা বেঁধে নেয়, সুন্দরীর সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার আগে আকৃষ্যমান মনে অসুন্দরীই বিশ্বসুন্দরীরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে সমস্ত বাধা উল্লংঘন করে তাকেই তুলে নেয় জীবন-তরীতে। অথচ ঐ অবসরে যুবক নিজে অথবা তার অভিভাবক যদি সুন্দর-অসুন্দরের মাঝে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারে, সুন্দর লাভের সুফল ও অসুন্দর লাভের কুফল যুবকের মনে বদ্ধমূল করে দিতে পারে, সত্যের রূপরেখা তার মানসপটে প্রদীপ্ত রাখতে পারে এবং অসত্যের বাহ্যিক ও কৃত্রিম রূপের ভুয়ো বাহারে যাতে ধোকা না খায় সে বিষয়ে চেষ্টা রাখে, তাহলে অবশ্য এমন দুর্ঘটনা ঘটে না।
রেডিও, টিভি যাই বল না কেন, এ সবে প্রচারিত অধিকাংশ বিষয়-বস্তুই হল চিত্তবিনোদন। এতে যা লাভ হয় তার চাইতে ক্ষতির পরিমাণ অনেক গুণ বেশী। মুসলিম জাতি-গঠনমূলক তো কোন বিষয়ই নেই বললেই চলে। বরং ইসলামের আদর্শ মান হয় এ সবে, কলঙ্কিত হয় মুসলিমের চরিত্র। কোন কোন প্রোগামে ইসলাম নাম থাকলেও আসলে তা প্রকৃত ইসলামবিরোধী। অমুসলিম স্টুডিওতে ইসলামের নামে কথা বলে কোন কাদিয়ানী অথবা বাহায়ী অথবা ভ্ৰষ্ট কোন দলনেতা। তাদের মুখে বিকৃত হয় ইসলামের আসল ভাবমূর্তি। মুসলিম স্টুডিওতেও জোরে-শোরে প্রদর্শিত হয় গান-বাজনা সহ ঈদ-মীলাদুন্নাবী, মুহারর্ম, শবেবরাত প্রভৃতি বিদআতী পর্বের প্রোগাম। তাছাড়া বহুলাংশে পাশ্চাত্য সমাজ ও সভ্যতার এ্যাডভার্টাইজম্যান্ট’ চলে।
কিছুতে থাকে ইসলাম-বিরোধী প্রকাশ্য ও সরাসরি আক্রমণ এবং কিছুতে থাকে সময়বিনাশী রঙ-তামাশা ও যৌন-অনুভূতি জাগরণকারী সুড়সুড়ি। মান। করা হয় চরিত্রবাণদের চরিত্র। আর অম্লান ও প্রশংসিত হয় লম্পট ও বেশ্যাদের চরিত্র। বেশ্যাদেরকে যৌনকর্মী বলে সমাজকল্যাণমূলক কর্মতালিকায় নাম চড়িয়ে তাদেরকে সমাজের বন্ধুরূপে মর্যাদা দিতে ধৃষ্টতা প্রকাশ করে। আর এতে সহায়তা করে শুড়ির সাক্ষী মাতালরা, লম্পট ও বেশ্যা, যোনী ও যৌন-স্বাধীনতাবাদী কুপ্রবৃত্তির তাবেদাররা। সিনেমা থেকে যুবক কি লাভ করে? যে সিনেমার কোন ফিল্মই অবৈধ প্রেমমুক্ত নয়। অপসংস্কৃতি ও যৌনপ্রবৃত্তির সহজ প্রচার-কেন্দ্র এই প্রেক্ষাগৃহ। ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়স্কা। ২৫২ জন তরুণীকে নিয়ে এক জরিপে দেখা গেছে যে, এদের মধ্যে শতকরা ২৫ ভাগ তরুণী সিনেমা দেখার ফলে অবৈধ যৌন-মিলনে লিপ্ত হয়েছে। আর এদের মধ্যে শতকরা ৩৮ ভাগ।
তরুণী অবৈধ পথে পা না বাড়ালেও তারা বিভিন্ন কুচিন্তা ও মানসিক অশান্তির মাঝে কালাতিপাত করে থাকে। (আল-ইফফাহ ৫৫পৃঃ)
এরপর রয়েছে নোংরা পত্র-পত্রিকার ভূমিকা। টাইম পাশ করার জন্য বহু যুবকই এর সাহারা নিয়ে থাকে। এদের হাতে থাকে প্রচুর সময়। এমনি বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই উপন্যাস পড়ে, পড়ে বিভিন্ন প্রেম ও যৌন-নিবেদনমুলক কাল্পনিক কাহিনী। কিন্তু এর মাঝে তার ঈমানী হৃদয় কতরূপে ঝাঝরা হয়ে যায়, তা হয়তো অনেকে টেরও পায় না।
আসল কথা বলতে কি? আজ মুসলিম বিশ্ব ও বিশেষ করে তার যুবশক্তি মিডিয়া আগ্রাসনের শিকার। ‘আধিপত্য বিস্তারে যুদ্ধ জয় এক সময় অপরিহার্য ছিল। যুদ্ধ জয় অপরিহার্য ছিল মূলতঃ তিনটি কারণে। (এক), বিজিত দেশে অর্থনৈতিক লুটপাট, বাজার দখল ও রাজস্ব আয়। (দুই), রাজনৈতিক প্রভুত্ব। (তিন), শত্রুর চেতনায় পঙ্গুত্বসাধন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, নৈতিক বিপর্যয়সাধন ও এভাবে শত্রুর পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা রোধ। কিন্তু এখন যুদ্ধ জয় ছাড়াও এসব সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির ফলে প্রচারের সামর্থ্য এখন প্রচুর, কোন দেশের সীমানাই আজ আর অগম্য বা দুর্গম্য নয়। সুউচ্চ পর্বত বা বিস্তৃত মহাসাগর কোন কিছুই প্রচারের কাছে অনতিক্রম্য নয়। বিশ্বের ঘরে ঘরে যা কিছু বলার তা এখন অনায়াসেই বলা যায়, বাহিরের কথা ঘরে প্রবেশের এখন আর কোনই বাধা নেই। কিন্তু মুসলমানদের সমস্যা হল, এ কাজে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য, এর কোনটিই তাদের নেই।
শত্রুরা যখন এ ময়দানে বীরদর্পে খেলছে, সেখানে তারা প্রায় নীরব দর্শক হয়ে দাড়িয়ে আছে। প্রচারমাধ্যমের প্রায় সবই এখন অমুসলিমদের দখলে। ফলে মুসলমানেরা কি শুনবে বা দেখবে সেটিও এখন অন্যের নিয়ন্ত্রণে। চিন্তার প্রভাব প্রতিফলনে প্রচার-যন্ত্রের চেয়ে সফল মাধ্যম আর নেই। নিরেট মিথ্যাও সত্যরূপে প্রতিষ্ঠা পায় প্রচারের ফলে। প্রযুক্তির বদৌলতে শত্রুর মাইক্রোফোন এখন ঘরে ঘরে, এমনকি বেডরুমেও অনাকাঙ্খিত শত্রু হাজির ও সোচ্চার। ফলে সংকট বেড়েছে মুসলমানদের, এমনকি মুসলমান থাকা নিয়েও। শত্রুর প্রচারের বানে ভেসে গেছে অনেক মুসলমানই, এমনকি বিনষ্ট তো হয়েছে অনেকেই। ইসলামের প্রতি তাদের নেই ন্যুনতম ঈমান-আকীদা, যা মুসলিম পরিচিতির জন্য অপরিহার্য। প্রায় দুই শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের যাতাকলে মুসলমানদের যে ক্ষতি হয়েছে, প্রচারের প্রভাবে তার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হয়েছে বিগত তিরিশ বা চল্লিশ বছরে। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩৮ পৃঃ)
প্রায় সকল প্রকার শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম হল পাশ্চাত্যের হাতে। জাতিসংঘের হিসাব মত দেখা গেছে যে, আমেরিকা শুধু ইউরোপের জন্য বাৎসরিক ২২ লক্ষ ঘন্টা টিভি সম্প্রচার করে থাকে। ইউনিস্কোর এক জরিপে বলা হয়েছে যে, সারা বিশ্বে যে টেলিভিশন প্রোগ্রাম চলছে, তার মধ্যে শতকরা ৭৫ ভাগই হল আমেরিকার উৎপাদন। তাছাড়া ইন্টারনেট জগতের ৮৮% বিষয়বস্তু হল ইংরেজী ভাষায়। আসলে টিভি যোগে পৃথিবীটা এখন চারিপাশে আয়না বসানো সেলুনের মত হয়ে গেছে। অন্য কথায় গোটা বিশ্বটাই এখন এক রঙ্গমঞ্চে পরিণত হয়ে পড়েছে। যাতে রয়েছে সকল প্রকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি ধংস ও বিলীন করে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে একাকার হওয়ার প্রতি আহ্বান। আমেরিকা আজ সারা বিশ্বের মাটি দখল না করলেও সারা বিশ্বের মানুষের মন-মানসিকতা ও নৈতিকতা দখল করতে চলেছে। দুর্নিবার গতিতে তাদের সেই অপসংস্কৃতির বিভিন্ন কর্মকান্ড এই ‘গ্লোবোলাইজেশন’-এর যুগে সারা বিশ্বমনে উঁকিয়ে বসতে চলেছে।
বর্তমানের শিশু জন্মের পরে সামান্য জ্ঞান লাভ করার পর হতেই টিভির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। তাছাড়া গবেষণায় দেখা গেছে যে, কচি-কাচা শিশুমনে অনুকরণের মাত্রা রয়েছে খুব উচ্চ। শিশুরা দেখা ছবির নায়ক-নায়িকার প্রায় ৬৭% অনুকরণ করে থাকে। (আল-ইফফাহ ৫৪পৃঃ)।
আজকাল প্রায় ঘরে ঘরে টিভি। কারো ঘরে না থাকলে পাশের ঘরে গিয়ে দেখে আসতে শিশুদেরকে বাধা দেওয়া বড় শক্ত। একটা শিশুর জীবনে বর্তমানে টিভির চিয়ে অধিক প্রিয় খেলনা বা খেলার সাথী আর অন্য কিছু নেই। ফলে এই সাথীর সম্পূর্ণ প্রভাব যে তার কাঁচা মনে পড়েই থাকে, তা বলাই বাহুল্য। সাথীর অনুকরণে নিজেকেও গড়ে তুলতে চায় এক হিরো বা হিরোইন রূপে। তার স্বভাব ও আচরণ হয় প্রায় নায়ক-নায়িকার মত। আর প্রায় ছবিতেই নায়ক-নায়িকার অভিনয় ও চরিত্র হল, অপরাধ, যৌনতা, প্রেম-ভালোবাসা, অপরাধ-রহস্য, যুদ্ধ, শৈশব, ইতিহাস, ভ্রমণ, কমেডি অথবা সামাজিক প্রোপাগান্ডা নিয়ে। এর মধ্যে পনের শ’ ছবির তিন চতুর্থাংশই নির্মিত হয়েছে অপরাধ, যৌনতা ও প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে। ফলে এসব ছবি দেখার কারণেই অঙ্কুর থাকতেই উক্ত শিশুদের নৈতিক চরিত্র বিনষ্ট হতে শুরু করে।
এরা পড়াশোনা করতে চায় না। পড়তে মন পায় না। সহপাঠী ও খেলার সাথীদের সঙ্গে মারামারি করে জিততে চায়। খেলাধুলা, পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল আঁচড়ানোর। ধরন ও কথাবার্তার রীতি পাল্টে যায়। পর্দায় যা দেখে, শিশুমন তার সবটারই অনুকরণ করার চেষ্টা করে। শিক্ষক ও মা-বাপ যা শিক্ষা দিতে পারেন না, সিনেমা তা পারে। শিশুর মনে ছবির নায়কনায়িকাদের অঙ্গ-ভঙ্গি, তাদের রুচিহীন আলাপন, ক্রোধ ও অপরাধ সংঘটনে কৌশল সবই দাগ কাটে। তখন শিশু আর শিশু থাকে না। ইচর-পাকা হয়ে তার মধ্যে ফুটে ওঠে বয়স্ক অপরাধীর ভয়ঙ্কর অভিব্যক্তি। ছবির নায়কের মত সে কোমরে হোলষ্টার বাধে অথবা পকেটে পিস্তল রেখে হঠাৎ তার প্রতিপক্ষকে গুলি করতে চায়। চলচ্চিত্রে অভ্যস্ত একটি শিশুর আচরণ থেকে ফুলের পাপড়ির মত ঝরে পড়তে থাকে সুকুমার বৃত্তিগুলো। শৈশবেই সে পা বাড়ায় অপরাধ জগতের অন্ধকার গলিতে। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩৬পৃঃ)।
যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির এক অনন্য উপহার হল এই টিভি। যন্ত্রের এই যাদুকাঠির মাধ্যমে মানুষ যেন পুরো বিশ্বটাকে শোবার ঘরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সকল দেওয়াল, দরজা ও প্রহরীর বাধা উল্লংঘন করে যেমন শিশু-কিশোরদের মন কেড়ে নিতে পেরেছে, তেমনি সকল সতর্কতা ও পর্দা সত্ত্বেও অন্তঃপুরের মহিলাদেরকে ‘চোখ মারতে এবং সতী-সাধ্বীদের সতীত্ব হনন করতে প্রয়াস পেয়েছে। এমনকি স্যাটালাইটের মাধ্যমে সারা বিশ্বে প্রচারিত এই যন্ত্র-মন্ত্র যে মু’মিনের ঈমানও ছিনিয়ে নিতে চলেছে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে পরমাণু বোমার চাইতেও অধিক শক্তিশালী অস্ত্র এই টেলিভিশনকেই পশ্চিমা-বিশ্ব ব্যবহার করছে। বিশ্ব-জনমতে
প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে তারা। ইসলাম ও মুসলিমদের খামাখা বদনাম করার সুযোগ। প্রয়োগ করছে এরই মাধ্যমে। ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও বিভিন্ন অপবাদকে এক শ্রেণীর মানুষ ঘরের ভিতরে নরম বিছানায় শুয়ে শুয়ে লুফে নিচ্ছে! পশ্চিমা-সভ্যতার নৈতিকতাবিবর্জিত চরিত্রহারী বিভিন্ন রঙ-তামাশায় চমৎকৃত হয়ে ভাবতে শুরু করেছে, তারাই হল উন্নত ও সভ্য মানুষ। আর বিবেক যখন মেরে ফেলা হয়, তখন সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য, সভ্যতাকে বর্বরতা এবং বর্বরতাকে সভ্যতারপে বিবেচনা করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিবেক ধ্বংস করার মত যত মাধ্যম আছে, তার মধ্যে টেলিভিশন হল সবচাইতে বেশী বিপজ্জনক। ইউনিস্কোর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, মানুষ তার ৯০% জ্ঞান লাভ করে থাকে দর্শন-শক্তির মাধ্যমে। আর ৮% লাভ করে শ্রবণ-শক্তির মাধ্যমে। বিভিন্ন আকারআকৃতি ও ভাব-ভঙ্গিমা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে জ্ঞান দান করে কোন ভাষা বা বা শব্দ তা পারে না। (আল-ইফফাহ ৫১পৃঃ) সুতরাং এই যন্ত্র যে ছয়কে নয় এবং নয়কে ছয় করার কাজে কত বেশী উপযোগী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
হক-নাহক বা ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-অসত্যের দ্বন্দ্ব অতি পুরাতন। হক’ যেখানেই মাথা তুলে দাড়িয়ে সোচ্চার হয় নাহক’ সেখানেই তাকে পরাভূত করার উদ্দেশ্যে অধিক শক্তিশালীরূপে তৎপর হয়। যখনই সত্যের সূর্য বিশ্বজগৎকে আলোকমন্ডিত করতে চায় তখনই অসত্যের মেঘমালা তাকে আড়াল করার জন্য বিশ্বব্যাপী ঝড়-তুফান সৃষ্টি করে। ঐতিহাসিকভাবে এটাই চির সত্য।
মুসলমানরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে পিছিয়ে আছে একথা ঠিক, কিন্তু চারিত্রিক সম্পদে আজও বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি। প্রযুক্তিগত উন্নতিতে পাশ্চাত্যে ভোগ-বিলাসের জোয়ার বইলেও নৈতিকতার মানদন্ডে তারা পশুর পর্যায়ে নেমে গেছে। পশুর কাছে মনুষ্যত্ব যেমন অকাম্য, তেমনি ভোগবাদী ও জড়বাদী পাশ্চাত্যের কাছে তাওহীদবাদী মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বও অসহ্য। যুদ্ধ করে অথবা অস্ত্র দিয়ে কারো চরিত্র ধ্বংস করা যায় না। চরিত্র ধ্বংসের জন্য হানা দিতে হয় মানুষের মনোজগতে। এজন্য প্রয়োগ করতে হয় মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র। আর প্রচারমাধ্যমই হচ্ছে সেই অস্ত্র, যা পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অত্যন্ত কার্যকরভাবে প্রয়োগ করছে মুসলিম বিশ্বের দেশে দেশে।
যে ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের পূর্বপুরুষকে দিয়েছে গোলামীর জিঞ্জির এবং তাদের দিয়েছে ব্লু-ফিল্ম ও হেরোইন উপহার, সেই পাশ্চাত্যের শক্তির বিরুদ্ধে তাদের কোন অভিযোগ নেই। আশীর্বাদকে তারা অভিশাপ আর অভিশাপকে তারা আশীর্বাদ মনে করছে কেন? সঙ্গত কারণেই অনুসন্ধিৎসু মনে এসব প্রশ্নের উদয় হতে পারে। এসব প্রশ্নের জবাব দেয়াও কোন কঠিন কাজ নয়, মুসলিম তরুণ-তরুণীদের জীবন থেকে ইসলামী পরিচয় মুছে দিতে যে। প্রতিষ্ঠানকে এককভাবে দায়ী করা যায়, তা হচ্ছে পাশ্চাত্য পরিচালিত প্রচারমাধ্যম। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩৪পৃঃ) ‘প্রচার-যন্ত্রের উপর মুসলিম-মালিকানা যে নেই, তা নয়। তবে ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতার তুলনায় পাশ্চাত্যের প্রচারমাধ্যমকে সূর্য বললে মুসলিম প্রচারমাধ্যমকে মোমবাতির চেয়ে বেশী কিছু বলা যায় না। প্রচার-যন্ত্রের প্রায় সব ক’টি আবিষ্কৃত হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। ধনকুবের, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদেরও অভাব নেই সেখানে। এ মৌলিক সুবিধার জন্য পাশ্চাত্য জগৎ মুসলিম বিশ্বসহ বাদবাকি পৃথিবীতে আধিপত্য কায়েম করতে পেরেছে। ঔপনিবেশিকতার যুগ শেষ হয়ে গেলেও প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে শুরু হয়েছে এক নয়া ঔপনিবেশিকতার যুগ। সাবেক ঔপনিবেশিক শাসনকে চোখে দেখা যেত, কিন্তু বর্তমান।
ঔপনিবেশিক আধিপত্যকে দেখা যায় না। মুসলিম দেশগুলোর প্রশাসনিক পদগুলোয় দেশীয় মুসলমানরাই রয়েছে। তবে এসব দেশের আত্মার শাসক পাশ্চাত্য। এটা এমন এক মানসিক দাসত্ব, যা অন্যের নজরে আসে না এবং যে তার শিকার, সে নিজেও বোঝে না। ঔপনিবেশিক শাসনের কুফলস্বরূপ মুসলিম দেশগুলোয় এ মানসিক দাসত্ব বিস্তার লাভ করছে। স্বাধীনতা লাভ করেও আমরা নিজেদের ভাষায় কথা বলি না, নিজেদের পোশাক পরিধান করি না, নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ভালোবাসি না। ঘরে থেকেও আমরা যেন বিলেতী। ইংরেজীতে কথা না বললে অভিজাত হওয়া যায় না। মাকে ম্যাম্মি, বাবাকে ড্যাডি, চাচাকে আংকেল, চাচীকে আন্টি বলে না ডাকলে জাতে উঠা যায় না। আমাদের এ মানসিক বৈকল্যের জন্য কে দায়ী? দায়ী আমরাই। চিত্তবিনোদন ও জ্ঞানার্জনের জন্য যেসব মাধ্যমকে আমরা মোক্ষম বলে মনে করি, সেগুলোর স্বরূপ কি আমরা কখনো তলিয়ে দেখেছি?
এ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, ফুল থেকে যেমন মধু আহরণ করা যায়, তেমনি বিষও আহরণ করা যায়। আমরা মধুর পরিবর্তে যেন বিষ আহরণ করছি। সে জন্য পুঁজিবাদীরা আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে ছড়িয়ে রেখেছে চোখ ধাধানো উপকরণ। টিভি, রেডিও, সিনেমা, উপগ্রহ, ডিশ এ্যান্টিনা, ভিসিআর, ব্লু-ফিল্ম, পর্নো পুস্তক-পত্রিকা ইত্যাদি। এগুলো আধুনিক জীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বাহ্যত আমাদের জীবনকে করেছে সুন্দর ও সহজ, একথা যেমন সত্য, তেমনি এসব উপকরণকে কাজে লাগিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতেছে, একথাও সমান সত্য।' (ঐ১৩৩পৃঃ)
কিন্তু কেন তারা এ পথ বেছে নেয়? প্রথম কথা হল, নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনে। তারা মনে করে, শত্রুর উন্নত মাথা অবনত করার জন্য এ অস্ত্রের চেয়ে অধিকতর মারাত্মক অস্ত্র আর কিছু হতে পারে না। সম্মুখসমরে যেতে হয় না, কৌশলে কর্ম সারা যায়। ধরা পড়ার ভয় থাকে না। কাটা দিয়ে কাঁটা তোলা যায় অনায়াসে। সবচেয়ে বড় দুশমনকে কাবু করার জন্য তারা এই শক্তিকেই পারমাণবিক বোমার চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী মনে করে। মুসলমানই তাদের প্রধান শত্রু। তারা জানে, মুসলমানদের হাতে শক্তিশালী কোন মিডিয়া নেই এবং তাদের ‘ইনট্রিগ্রিটি অব কারেক্টারও নেই। তাই মিডিয়া সন্ত্রাসের অস্ত্রের মাধ্যমে তাদের দুর্বল করে রাখলে কখনো আর তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যদি তারা অতীতের মত আর একবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, তাহলে দুনিয়ার বাদশাহী আবার তাদের হাতে চলে যাবে। তাই তারা বিশ্বের সবচেয়ে বেশী শক্তিশালী অস্ত্র এই মিডিয়ার সম্রাট হয়ে গোটা বিশ্বকে বিশেষ করে মুসলিম দুনিয়াকে পঙ্গু করে রেখেছে। প্রধানতঃ এই উদ্দেশ্যেই তারা এ পথ বেছে নিয়েছে।' (তথ্য সন্ত্রাস)
অবশ্য মুসলিম ছাড়া অমুসলিমরা যে উক্ত যন্ত্রের ক্ষতির থাবাতে পরিণত হয় না, তা নয়। তাদের ধর্মীয় ও নৈতিক মাথাব্যথা ততটা না থাকলেও সাংসারিক জীবনে সুখ কে না চায়?
১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে ২০ হাজার লোকের উপর চালানো একটি জরিপে দেখা গেছে যে, ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী সুখী দম্পতির সংখ্যা ৪৪% থেকে ৩২% এ নেমে গেছে। এর কারণ স্বরূপ যা বলা হয়েছে তা হল দু’টি প্রথমতঃ বহু যুবতীর চাকরী-প্রবণতা এবং দ্বিতীয়তঃ স্বামী-স্ত্রীর চরিত্র-ব্যবহারে টিভি ও সিনেমা তথা চলচ্চিত্র জগতের বিপুল প্রভাব। কারণ, এ জগৎ থেকেই পাওয়া যায় স্বামীর অধীনে থেকেও স্বাধীন হয়ে চলার শিক্ষা। স্ত্রী থাকতেও গার্লফ্রেন্ড’ রাখার আধুনিক ফ্যাশন!
তদনুরূপ অপরাধ জগতেও চলচ্চিত্রের অবদান বড়। স্পেনের এক জরিপ মতে দেখা গেছে যে, ৩৯% অপরাধ (খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ ইত্যাদি) অপরাধীরা সিনেমা ও টিভির বিভিন্ন সিরিজ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সম্পন্ন করেছে। (আল-ইফফাহ ৫২ পৃঃ) ব্যাপক হারে গুপ্ত হত্যা, বিমান ছিন্তাই, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সাম্প্রদায়িকতার পশ্চাতেও রয়েছে এই সর্বনাশীর সক্রিয় ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একশ’ ভাগ অপরাধ-প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এ দুর্যোগপূর্ণ সময়ে ১৯৬৮ সালে সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান ও প্রতিরোধের উপায় নির্ধারণে এক নির্বাহী আদেশে প্রেসিডেন্ট জনসন একটি জাতীয় কমিশন গঠন করেন। কমিশন তদন্ত করে দেখতে পায় যে, এবিসি, এনবিসি ও সিবিএস টেলিভিশন নেটওয়ার্কে প্রচারিত অপরাধ-বিষয়ক অনুষ্ঠানই এসব দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য দায়ী।
ঐ মার্কিন মুলুকের হাল অবস্থা এই যে, সে দেশে প্রতি ৭ মিনিটে একটি করে নারী ধর্ষণ এবং প্রতি ২৪ মিনিটে একটি করে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। প্রতি দু’টো বিয়ের একটি এক বছরের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়। সে দেশে ১৪ বছরের কুমারী মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশটি যে সব কারণে এত কলঙ্কিত হয়েছে তা আমাদের দেশে চালান দিয়ে আমাদের তাই বানাতে চায়। ভাবখানা এই যে, আমরা তো মরেছি, এবার তোমরাও মর। আমরাও দু’বাহু বাড়িয়ে তা বরণ করে নিয়েছি। এই আগ্রাসী কালচার’ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে গণমাধ্যমগুলো। এটা করা হচ্ছে অত্যন্ত সুকৌশলে।
রেডিও-টিভি বিশেষ কায়দায় সে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কারণ, ওখানে বসে যারা কলকাঠি নাড়েন, তাদের অনেকেই ডিস্কো চরিত্রের। নানাভাবে গণমাধ্যমগুলো তরুণদের জীবন-বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি চর্চায় অনুপ্রাণিত করছে, কখনো বিজ্ঞাপনের আবরণে, কখনো সংগীতের আবহে, কখনো বিদেশী চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে, কখনোও সরাসরি এই কাজটি করে যাচ্ছে। (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ১৭পৃঃ) সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে যে, প্রতি ৮ সেকেন্ডে একজন মার্কিন মহিলা ধর্ষিতা হয়। এ হিসেবে বছরে সাড়ে ৩৯ লাখ মহিলা ধর্ষিতা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ২৬ কোটি। এর মধ্যে মহিলার সংখ্যা ৮ কোটির কাছাকাছি। বছরে যদি সাড়ে ৩৯ লাখ মহিলা ধর্ষিতা হয়, তাহলে এ পর্যন্ত তাদের মহিলার শতকরা কত ভগ্নাংশ মহিলা ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা পায়। সেটাই প্রশ্ন। হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশে এসে এখানকার নির্যাতিত মহিলাদের জন্য চোখের পানি ফেলেছেন।
চোখের পানি তো ফেলার কথা তার জন্য আমাদের। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে মনে প্রশ্ন জাগে, হিলারীদের কত জন ধর্ষণের হাত থেকে অক্ষত থাকতে পারছেন? কাউকে পোড়াতে গেলে নিজেই পুড়ে মরতে হয়। মুসলমানদের বিনাশের জন্য যে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ তথ্য-প্রবাহের নামে বিকৃত প্রচার-যন্ত্রগুলোর মুখ উন্মুক্ত করে দিয়েছে, সে যুক্তরাষ্ট্রে কারো শান্তি নেই। ঘুম হয় না; ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমাতে হয়। অনেকের বাড়িতেও কাজ হয় না।
গায়ের জোরে মুসলিম দেশগুলোকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র বলে গালি দেয়া হচ্ছে। অথচ পৃথিবীতে সন্ত্রাসের আদি জন্মদাতাই হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ। সন্ত্রাসের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে ডিশ এ্যান্টিনার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের টিভি নেটওয়ার্কগুলো। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পাশ্চাত্যের টিভি নেটওয়ার্কগুলো কিভাবে এড়াবে? স্টার টিভিতে প্রচারিত অনুষ্ঠানমালার ৯০ শতাংশই অপরাধ বিষয়ক। এসব ছবিতে আছে র্যাম্বো
স্টাইলে ফাইটিং, মারদাংগা, মারামারি। শিল্পকলা হচ্ছে জীবনের প্রতিচ্ছবি। অথচ পাশ্চাত্য ছবিতে মানুষের জীবনে মারামারি, গোলাগুলি ছাড়া আর কিছু নেই। এদের টিভি অনুষ্ঠানমালায় জীবনের সুকুমারবৃত্তির প্রতিফলন নেই, নৈতিক উন্নয়নের উপযোগী শিক্ষণীয় কিছু নেই। এটা কেন? প্রচারণার জোরে নাৎসীবাদ যেমন টিকে থাকতে পারেনি, তেমনি পাশ্চাত্যের ঘৃণিত পুঁজিবাদও প্রচারণা চালিয়ে টিকে থাকতে পারবে না। সত্যকে কিছুদিনের জন্য আড়াল করে রাখা যায়, চিরদিনের জন্য নয়। ইতিহাসের অমোঘ বিধানে ভেসে গেছে হিটলার মুসোলিনী। একই পথে হারিয়ে যাবে ইংগ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। বিশ্বের অগণিত মানুষের মনের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে জেগে থাকবে সত্যের আলো। (শাহাদাত হোসেন খান, তথ্যসন্ত্রাস ১৩৭পৃঃ)
চলচ্চিত্র জগতের যে সব সিরিজ আমরা নিয়মিত দর্শন করে চলেছি তা আসলে আমাদের। শত্রুরা সরবরাহ করে থাকে, সে কথা হয়তো আমার বহু যুবক বন্ধু জানে না। সিনেমা বা ভিডিও হলের টিকিট কেটে অথবা টিভির পর্দায় চোখ ফেলে রেখে ছেলে-মেয়ে নিয়ে অথবা গুরুজনদের পাশে বসে যে ছবি দর্শন করে তৃপ্তি লাভ করা হয়, তা আসলে আমাদের কত বড় ক্ষতি করছে এবং সারা দুনিয়াকে কোন পথে নিয়ে যাচেছু ঐ শত্রুপক্ষ, তা হয়তো অনেকে তলিয়ে দেখতেও চায়না। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইহুদীরা সারা দুনিয়াতে সন্ত্রাস এবং চরিত্রবিধ্বংসী বিষ ছড়াচ্ছে। চলচ্চিত্র জগতে ‘হলিউড’ই হলো বিশ্বের এক নম্বর প্রধান শহর, সেখানকার চলচ্চিত্র সারা দুনিয়াতে সরবরাহ হয়ে থাকে। হলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রধান অংশ ইহুদী।
হলিউড হতে প্রচুর অশ্লীল ছবি নির্মিত হয়ে পুরো বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে অবশ্য টিভি সিরিজের নিমাতারাও অশ্লীল সিনেমা নির্মাণ করে থাকে। অত্যন্ত বড় মাপের পাঁচটি টিভি কোম্পানী ছাড়াও আরো ২টি আমেরিকান টিভি কোম্পানী রয়েছে, যেগুলোর নাম হলো কেনিন এবং ইটিভি। এরা বিভিন্ন অশ্লীল সিরিজ নির্মাণ করে এবং পুরো দুনিয়ায় সাপ্লাই করে। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই এদের ৪২টি শাখা রয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে আমেরিকা, লন্ডন ও ফ্রান্সে তৈরী ব্লু ফিল্মও তারা ব্যাপকভাবে প্রচার করে থাকে। এ হল আমেরিকার মিডিয়া জগতের মোটামুটি চিত্র। আমেরিকান মিডিয়ার পুরোটাই
ইহুদীদের দখলে এবং সেই মিডিয়ার মাধ্যমে ইহুদীরা আমেরিকার ছত্রছায়ায় সংঘাত, দাঙ্গাহাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে পুরো বিশ্বেই যেন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। (তথ্য সন্ত্রাস ১৩১পৃঃ)। আমাদেরকে মুসলিম হিসাবে একটা কথা খুব সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই সব প্রচার-অভিযানের বিরাট একটা অংশের পশ্চাতে রয়েছে ইসলামী পুনর্জাগরণের। আন্দোলনসমূহকে বানচাল করার আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা। পৃথিবীর সকল ইসলাম-বিদ্বেষী শক্তি নিজেদের যাবতীয় মতবিরোধ সত্ত্বেও ইসলামী পুনর্জাগরণের বিশ্বময় আন্দোলনসমূহকে বানচাল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ ও একমত। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ওরা এক দিকে যেমন মুসলিম-বিশ্বের পুতুল সরকারগুলোকে সুকৌশলে ব্যবহার করছে, অপর দিকে বিষাক্ত অপপ্রচারণার মাধ্যমে মুসলমানদের মাঝে শ্রেণী বিরোধকে। উৎসাহিত করছে এবং উস্কানি দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। (ঐ ১১০পৃঃ)।
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশ্বের অন্যান্য জাতিকে উত্তেজিত করে লেলিয়ে দিয়ে মুসলিমদের আসল পরিচয় বিকৃত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত করে সকল জাতির নিকটে ‘হিংস্র-জীব’ রূপে তাদের পরিচয় প্রচার করা হচ্ছে! বিশ্বজুড়ে রাজনীতির চাবিকাঠি হাতে নেওয়ার যে ইয়াহুদী পরিকল্পনা কাজ করছে তা তাদের প্রটোকল’-এ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে। তাদের কর্মসূচিতে রয়েছে যে, আমরা ইহুদীরা দুনিয়ার সকল আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমগুলো সংবাদ-সংস্থাসমূহের মাধ্যমে কন্ট্রোল করব; যাতে করে দুনিয়াবাসীকে আমরা যে চিত্র দেখাতে চাই সে চিত্রই দেখবে।
অপরাধ-জগতের খবরগুলো আমরা এমন সূক্ষভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরব, যাতে পাঠকদের ব্রেন ওয়াশ হয়ে উল্টো অপরাধীদের প্রতিই তারা সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, ইহুদীরা তাদের জন্য ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মিডিয়ার সাহায্যে প্রথমতঃ তারা নিজেদের প্রকৃত চরিত্র তথা সন্ত্রাসী তৎপরতা, দাঙ্গাবাজি, অসভ্যতার লোভ-লালসা, লাঞ্ছনা, হৃদয়ের কঠোরতা, হৃদয়হীনতা এবং মানবতা-বিরোধী জঘন্য চরিত্র ঢেকে রেখে ইহুদী জাতিকে মজলুম জাতি হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছে। ইহুদী মিডিয়া তাদের শ্বেতী চেহারাকে প্লাস্টিক সার্জারীর মাধ্যমে মেকআপ দ্বারা সুন্দর করে দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছে।
ইসলামের ফজর থেকেই ইয়াহুদী-চক্রান্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে সমভাবে কাজ করে আসছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ হয়েছে সুদী ইত্যাদি কারবারে অর্থনৈতিক ময়দানে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করার পর। অর্থ যেখানে, স্বার্থ ও সাফল্য সেখানে৷ অবশেষে তারা ইউরোপ ও আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এক ইয়াহুদী রাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হল। বিভিন্ন মুসলিম দেশ জয় করে নীলনদ থেকে ফোরাতের অববাহিকা পর্যন্ত প্রায় গোটা আরব-বিশ্বকে গ্রাস করে একটি বৃহত্তর ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা আজও কাজ করে যাচ্ছে এবং তাদের প্রসিদ্ধ আন্তর্জাতিক নেতা দাজ্জাল আসা পর্যন্ত করতেই থাকবে।
এরা জানে, তাদের এ কাজে বিশেষ সহায়ক হবে প্রচারমাধ্যম। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা গড়ে তুলেছে। তাদের সংস্থার পক্ষ থেকে সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার সাংবাদিক ও রিপোর্টার। যাদের প্রধান দায়িত্ব হল, বিশ্বের সকল স্থান হতে সংবাদ সংগ্রহ করে তা প্রচার-সংস্থাগুলোর কাছে পৌছে দেওয়া এবং তাদের অনুমোদন নিয়ে তা প্রচার করা। বিশ্বের অন্যতম প্রধান সংবাদ সংস্থা হল রয়টার। দুনিয়ার এমন কোন সংবাদপত্র, রেডিও সেন্টার ও টিভি সেন্টার নেই, যারা রয়টার থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে না। বর্তমান বিশ্বের প্রধান দু’টো প্রচারমাধ্যম বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা প্রায় ৯০% সংবাদ রয়টার থেকে সংগ্রহ করে। এ রয়টার ছাড়া দুনিয়ার সমস্ত সাংবাদিকতা যেন অচল। রয়টার হচ্ছে। আকাশ সংবাদ-সংস্থার মহারাজাধিরাজ। আর তা হল ইয়াহুদীদের নিয়ন্ত্রণে।
এ ছাড়া এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি), ইউনাইটেড প্রেস (ইউপি), এজেন্সী ফ্রাস্ প্রেস (এ এফ পি) -এ সবই ইয়াহুদীদের। বর্তমান বিশ্বে সব চাইতে প্রসিদ্ধ সংবাদ প্রচারমাধ্যম হল বিবিসি। এখান হতে ৪৩টি ভাষায় সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে থাকে এবং এর খবরকে অধিকাংশ লোকে ‘অহী’ বলে ধারণা ও বিশ্বাস করে। মনে করে, এই প্রচার কেন্দ্রের খবর হল নির্ভুল সত্য এবং নিরপেক্ষও। অথচ তারা যে দ্বীনদার মুসলিমদের প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি রাখে না, তা হয়তো দ্বীনদাররাই বোঝেন এবং পাশাপাশি আরবী, উর্দু, হিন্দী ও বাংলা অনুষ্ঠান যারা।
শোনেন তারাও একথা নিশ্চয়ই অনুধাবন করে থাকবেন। আসলে এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রটিও ইয়াহুদী পরিচালিত। এর পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে তারাই। ওদিকে স্টার টিভি যখন থেকে। বিশ্বকে তা প্রোগ্রামের সেবাদাস বানিয়ে ফেলেছে, তখন থেকে ইহুদীদের প্রচার-প্রোপাগান্ডা আরো অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রিটেনের সংবাদপত্রের উপর ইহুদীদের প্রভাব প্রায় শত ভাগ। ধীরে-ধীরে তারা সবই দখল করে নিয়েছে। ব্রিটেনের নেতৃস্থানীয় ১৫টি দৈনিকের মালিকই তারা। (তথ্য সন্ত্রাস ১২১-১২৬পৃঃ)
ভাই যুবক! এই দীর্ঘ আলোচনায় বিরক্ত না হয়ে হয়তো বুঝতে পেরেছ যে, বিধর্মীদের অধর্ম প্রচারে যে জোর, মুসলিমদের ইসলাম প্রচারে সামান্যও সে জোর নেই। বিজাতির প্রচারমাধ্যম ও শক্তির কাছে মুসলিম প্রচারমাধ্যম ও শক্তি নেহাতই দুর্বল। তাদের সে আলো-ঝলমল সুশোভিত, সুরঞ্জিত বিভিন্ন প্রোগ্রাম ছেড়ে ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত সাদা-মাঠা প্রোগ্রাম আর কেই বা দেখে অথবা কেই বা শোনে? ঢাকের শব্দের মাঝে মোহন বাঁশীর সুর বিলীন হওয়ারই কথা। তাছাড়া ইসলামী সে প্রচারমাধ্যম আছেই বা ক'টা? থাকলেও সঠিক ও শুদ্ধ ইসলাম প্রচার হয়ই বা কোনটায়?
পক্ষান্তরে মানুষের মন হল মন্দ-প্রবণ, প্রবৃত্তিপরায়ণ। ভালো-মন্দ উভয়ই পাশাপাশি সুসজ্জিত থাকলে বেশীর ভাগ মানুষের মন মন্দের দিকেই আকৃষ্ট হতে থাকে, ধাবিত হয় ভালো ছেড়ে ঐ নোংরার দিকে। কিন্তু পূর্ব হতেই যদি প্রতিষেধক ঈমানী ও ইসলামী টিকা বা ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে, তাহলে ঐ সংক্রমণের ভয় আর থাকে না। সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ে পূর্ব-সতর্কতা থাকলে তার সংস্পর্শ ও ছোয়াচ থেকে সুদুরে থাকলেও সে ব্যাধির কবল থেকে
নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। আজ বর্তমান বিশ্বে আমরা শত্রুর তরফ থেকে পাতা ফাদের মাঝে বাস করছি। শত্ৰুদল আমাদেরকে নখে কাটতে পারলে আর তরবারি চায় না। তারা চায় যে,মুসলিমরা তাদের ধর্ম মত অবলম্বন করুক। নতুবা তা না করলেও অন্ততঃ পক্ষে মুসলিমরা যেন মুসলিম না থাকে বরং তারা ধর্মান্ধত্ব (?) থেকে বেড়িয়ে এসে ধর্মহীনতার আলোয় (?) আলোক-শোভিত হোক। অবশ্য বিজাতিরা একাজে বড় কৌশল ও অতি সন্তর্পণে সহায়ক হিসাবে ব্যবহার করছে আমাদেরই জাত-ভাইকে। তাই ইসলামের প্রদীপ, রহমানের আলোকবর্তিকা হয়েও ইসলাম ও রহমানের উজ্জ্বল নামকে মানকে করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। রহমান ও কাদেরের বন্ধু ও দাস হয়েও তার শত্রুতা করতে মোটেই দ্বিধা করে না। আর এ ব্যাপারে প্রতিবেদন তৈরী করার জন্য ব্যবহার করা হয় তথাকথিক কতক মুসলিম চিন্তাবিদ ও কবি-লেখককে।
যার ফলে লোহার কুঠারের কাঠ কাটার ক্ষমতা যদিও ছিলনা, তবুও তার পশ্চাতে লাগানো ঐ কাঠেরই জাত-ভাই বঁট’ সেজে বড় ঠাটবাটের সাথে চোখ বুজে আপন স্বজাতি নিধন করে চলেছে। আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও একক মাবুদ আমাদেরকে সতর্ক করে বলেন, “নিশ্চয় কাফেরদল তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা নিসা ১০১ আয়াত) “তুমি যখন তাদের দিকে তাকাও, তখন ওদের চেহারা তোমার নিকট প্রীতিকর মনে হয় এবং যখন ওরা কথা বলে, তখন আগ্রহভরে তুমি ওদের কথা শ্রবণ করে থাক। যদিও ওরা দেওয়ালে ঠেকানো কাষ্টসদৃশ। প্রত্যেক শোরগোলকে ওরা নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে। ওরাই শত্রু, অতএব ওদের সম্পর্কে সতর্ক হও। আল্লাহ ওদেরকে ধ্বংস করুন। ওরা বিভ্রান্ত হয়ে কোথায় চলেছে?” (সূরা মুনাফিকূন ৪ আয়াত)।
“তোমাদেরকে কাবু করতে সক্ষম হলে ওরা তোমাদের শত্রু হবে এবং হাত ও জিভ দ্বারা তোমাদের অনিষ্ট সাধন করবে, আর চাইবে যে, কোনরূপে তোমরাও কাফের হয়ে যাও।” (সূরা মুমতাহিনাহ ২ আয়াত)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না; তারা তোমাদের অমঙ্গল সাধনে কোন ত্রুটি করে না, তোমরা কষ্ট্রে থাক -তাতেই তাদের আনন্দ। শত্রুতা-প্রসূত বিদ্বেষ তাদের মুখেই ফুটে বের হয়। আর যা কিছু তাদের মনে লুকিয়ে আছে, তা আরো জঘন্য। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করে দেওয়া হল, যদি তোমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হও। দেখ! তোমরাই তাদেরকে ভালোবাস, কিন্তু তারা তোমাদেরকে মোটেও ভালোবাসে না, আর তোমরা সমস্ত (ঐশী) কিতাবে বিশ্বাস রাখ। (অথচ তারা তা রাখে না।)
তারা যখন তোমাদের সাথে এসে মিশে তখন বলে, 'আমরা ঈমান এনেছি। পক্ষান্তরে তারা যখন নির্জনে যায় তখন তোমাদের প্রতি রোষবশতঃ আঙ্গুল কামড়াতে থাকে। বল, তোমরা আক্রোশে মরতে থাক। আল্লাহ মনের কথা ভালোভাবেই জানেন। তোমাদের যদি কোন মঙ্গল হয় তাহলে তাদের মনঃকষ্ট হয়, আর যদি তোমাদের কোন অমঙ্গল হয়, তাহলে তারা আনন্দবোধ করে। অবশ্য যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং পরহেযগার হও, তবে তাদের চক্রান্ত তোমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। তারা যা কিছু করে, সে সমস্তই আল্লাহর আয়ত্তে রয়েছে।” (সূরা আলি ইমরান ১১৮- ১২০ আয়াত)
“ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানগণ কখনই তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের মতবাদ মেনে নিয়েছ। তুমি বল, আল্লাহর প্রদর্শিত পথই প্রকৃত সুপথ। আর তোমার নিকট যে জ্ঞান উপনীত হয়েছে তার পরও যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহর কবল থেকে রক্ষা পেতে তোমার কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই।” (সূরা বাক্বারাহ ১২০)।
“ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের অনেকেই তাদের নিকট সত্য সুপ্রকাশিত হওয়ার পরেও তাদের মনের প্রতিহিংসাবশতঃ চায় যে, মুমিন হওয়ার পর তোমাদেরকে কোন রকম কাফের বানিয়ে দেয়। (ঐ ১০৯ আয়াত)
“ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের একদল তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট করার আশা পোষণ করে। অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে তারা কেবল নিজেদেরকেই ভ্রষ্ট করে, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না।” (সূরা আ-লি ইমরান ৬৯)
“তাদের মনোবাসনা এই যে, তারা যেমন কাফের আছে, তেমনি তোমরাও কাফের হয়ে যাও; যাতে তোমরা এবং তারা সকলে একাকার হয়ে যাও।” (সূরা নিসা ৮৯ আয়াত)
“বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকবে। যাতে করে তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে -যদি তা সম্ভব হয়। তোমাদের মধ্যে যারা নিজ দ্বীন থেকে ফিরে যাবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হবে দোযখবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে।” (সূরা বাক্বারাহ ২১৭ আয়াত)
অতএব হে মুসলিম যুবকদল! “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের কোন গোষ্ঠীর কথা মেনে নাও, তাহলে ঈমান আনার পর তারা তোমাদিগকে কাফেরে পরিণত করে ফেলবে।” (সূরা আ-লি ইমরান ১০০ আয়াত)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি কাফেরদের কথা শোন, তাহলে ওরা তোমাদেরকে পেছনে ফিরিয়ে দেবে এবং তাতে তোমরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।” (ঐ ১৪৯ আয়াত) হে ভাই যুবক! জেনে রেখো, “ওরা দোযখের দিকে আহ্বান করে। আর আল্লাহ স্বীয় ইচ্ছায় ক্ষমা ও বেহেস্তের দিকে আহ্বান করেন এবং মানবমন্ডলীর জন্য স্বীয় নিদর্শন বর্ণনা করেন, যেন তারা তা হতে শিক্ষা গ্রহণ করে। (সূরা বাক্বারাহ ২২১ আয়াত)
আর মনে রেখো যে, “যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কাফের তাদের অভিভাবক হল তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।” (ঐ ২৫৭ আয়াত)
হ্যাঁ, আর বিজাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোতে যা দেখ বা শোন অথবা পড়, তাই বিশ্বাস করে তুমি নিজের বা স্বজাতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠো না। কারণ, বুঝতেই তো পারছ, তারা কোনদিন ইসলামের স্বার্থে কিছুও গাইবে না। মহান আল্লাহর সতর্কবাণী সর্বদা মনের মণিকোঠায় তুলে রেখো, তিনি বলে, “হে মুমিনগণ! যদি কোন ফাসেক (পাপাচারী) ব্যক্তি। তোমাদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।” (সূরা হুজুরাত ৬ আয়াত)
হ্যাঁ, ফাসেকের সংবাদ হলে তা পরীক্ষা করে না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করো না। সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, কোন কাফের বা ইসলাম-বিদ্বেষী কোন সংবাদ পরিবেশন করলে তা নিশ্চয়ই অবতীর্ণ ‘অহী’র মত বিশ্বাস করতে পার না।
হে মুসলিম যুবকবৃন্দ! “শয়তান তোমাদের শত্রু, অতএব তাকে শত্রুরূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে আহ্বান করে, যাতে তারা জাহান্নামী হয়।” (সূরা ফাত্বির ৬ আয়াত)
“আর আল্লাহ তোমাদিগকে শান্তিনিকেতন (বেহেস্তের) দিকে আহ্বান করেন, যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।” (সূরা ইউনুস ২৫ আয়াত) সুতরাং দুই দিকে এই দুই শ্রেণীর আহ্বান। এদিকে আহ্বান হল, মানুষের মত সুশ্রী ও সভ্য জীবন গড়ার প্রতি। পক্ষান্তরে ওদিকের আহ্বান হল, পশুর মত স্বেচ্ছারিতার জীবন গড়ার প্রতি। এবারে জীবনের মূল্যায়ন ও নিজের কদর নিজেই করা জ্ঞানীর জন্য অবশ্য-কর্তব্য।
হে যুবক বন্ধু! ঈমানের প্রদীপ্ত জ্যোতি তোমার হৃদয়কে জ্যোতির্ময় করে রাখলে বিজাতীয় মিডিয়া তা নির্বাপিত করার চেষ্টা করছে বুঝতে পেরে তোমার মন ব্যথায় টনটন করে উঠবে। সে সময় প্রয়োজন হবে ধৈর্যের। অতএব প্রচার-যুদ্ধের ঐ বাক-তরবারির আঘাতে ধরাশায়ী হয়ে অধৈর্যের সাথে ঈমানত্যাগী হয়ে যেও না। “অবশ্যই ধন-সম্পদে তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হবে এবং অবশ্যই শুনবে পূর্ববর্তী আহলে-কিতাব (ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান) ও মুশরিক (পৌত্তলিকদের নিকট থেকে বহু অশোভন উক্তি। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং পরহেযগারী অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার।” (সূরা আ-লি ইমরান ১৮৬)
“আর তাদের কথায় দুঃখ নিও না। আসলে সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর। তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞাতা।” (সূরা ইউনুস ৬৫ আয়াত)
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে সারা অমুসলিম সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ। দুনিয়ার সকল জাতি যেন কেবল মুসলিম জাতিকেই কোণঠাসা করে রাখতে চায়। সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী, ধর্মান্ধ গোড়া, মৌলবাদী, মোল্লাতন্ত্র প্রভৃতি বলে বদনাম দিয়ে, ভৌগলিকভাবে তাদের দেশ জবরদখল করে, মানসিকভাবে আগ্রাসন সৃষ্টি করে, তাদের মৌলিক অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করে; বরং তাদের যথাসর্বস্ব লুটে নিয়ে তাদেরকে সর্বহারা করতে চায় সকলেই।
এক ভবিষ্যৎ-বাণীতে এ কথার কারণ উল্লেখ করে মহানবী (সা.) বলেন যে, “অদুর ভবিষ্যতে চতুর্দিকের সকল জাতি পরস্পরকে আহ্বান করে তোমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে যেমন ভোজনকারীরা ভোজনপাত্রের উপর একত্রিত হয়ে এক সাথে মিলে ভোজন করে থাকে। কোন এক সাহাবী জিজ্ঞাসা করলেন, তখন কি আমরা সংখ্যায় কম থাকব, হে আল্লাহর রসূল? তিনি বললেন, “না, কিন্তু তোমরা হবে স্রোতে ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত। তোমাদের শত্রুদের হৃদয় থেকে তোমাদের প্রতি ত্রাস ও ভীতি তুলে নেওয়া হবে এবং তোমাদের হৃদয়ে দুর্বলতা প্রক্ষিপ্ত হবে। আর সে দুর্বলতা হল, দুনিয়াকে ভালোবাসা ও মরণকে অপছন্দ করা।” (আহমাদ, আবুদাউদ, সহীহুল জামে’ ৮১৮৩ নং)
পক্ষান্তরে এ কথায় কোন সন্দেহ নেই যে, এইভাবে মনঃকষ্ট পাওয়া এক বড় মসীবত। তবে সে মসীবত কেবল সেই মুসলিমের জন্য, যে তার নবী মা কে ভালোবাসে। আর যে তার নবী (সা.)-কে ভালোবাসে না, তার তো কোন ইসলাম-বিদ্বেষী প্রচার-প্রোপাগান্ডায় কোন প্রকার
মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়। মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসে সে ব্যক্তির নিকট মসীবত গন্তব্যস্থলের দিকে ধাবমান স্রোতের চেয়েও বেশী দ্রুতবেগে উপস্থিত হয়ে থাকে।” (সহীহুল জামে ১৫৯২ নং)
প্রত্যেক জাতির মেরুদন্ড হল তার যুব-সমাজ। যুবকের মাঝে আছে সুউচ্চ আকাঙ্খা, দৃঢ় মনোবল এবং দৈহিক শক্তিও। যুবকের মাঝে আছে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা, আছে কোন কিছু মানা বা না মানার উচ্চ প্রবণতা। নৈতিকতার শত্রুরা তা ভালোভাবে জেনেই যুবকদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য ঐ সকল প্রচারমাধ্যমগুলোতে এমন টোপ ব্যবহার করছে, যা যুবকদল
গিলে পারে না। অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী, খেলোয়াড় প্রভৃতির প্রেম সৃষ্টি করে এবং পরম নৈতিকতাকে মৌলবাদ’, ‘রক্ষণশীলতা’ প্রভৃতি বদনাম দিয়ে যুবকদের মন লুটেছে ও তাদের ঈমান কেড়েছে ওরা। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমেই তারা সুন্দরকে ঘৃণ্য এবং ঘৃণ্যকে সুন্দর নাম দিয়ে সুশোভিত করে ঘৃণ্যদলকেই সাবাসী দিয়ে পৃথিবীর নেতৃত্ব তুলে দিয়েছে ও দিতে চলেছে তাদের হাতে!
সুতরাং মুসলিম যুবকের উচিত, চারার গন্ধে ছুটে গিয়ে চটকদার টোপ না গিলা। কারণ, ঐ। টোপের আড়ালে আছে বড় ধারালো বঁড়শী; যা একবার মুখে গেঁথে গেলে টেনে ছাড়ানো হবে বড় মুশকিল কাজ।
মুসলিমের যুবকের উচিত, তাদের চরিত্র ও জীবন-কাহিনীর খবর হৃদয়-মন দিয়ে শোনা ও পড়া, যাদের খবরে রয়েছে তার পারলৌকিক মঙ্গল। আজ পৃথিবীতে যে যাকে ভালোবাসবে, কাল কিয়ামতে তার তারই সাথে হাশর হবে। সুতরাং নবী ও সাহাবাকে ভালোবাসলে তাদের সাথে, নচেৎ কোন শিল্পীকে ভালোবাসলে তারই সাথে কিয়ামতে অবস্থান করবে। কোন ফাসেক ও কাফেরকে নিয়ে মুসলিমের গর্ব করা উচিত নয়। উচিত নয় তাদের অনুকরণ, অনুসরণ ও সাদৃশ্য অবলম্বন করা। কারণ, “যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে সে তাদেরই একজন।” (আবু দাউদ, সহীহুল জামে’ ৬১৪৯ নং)
ভাই ইসলাম-দরদী যুবক! তুফান দেখে ভয়ের কারণ নেই। কারণ তুমিও যে মহাবীর। তোমার আছে ইতিহাস ও অতীত। তোমার আছে ভবিষ্যত ও বিজয়। সুতরাং যে তুফানে তুমি ভেসে যাওয়ার ভয় করছ সে তুফানের চেয়ে আরো বড় তুফান সৃষ্টি কর। তবে মন্দের মোকাবেলায় মন্দ দিয়ে এবং পেশাব দিয়ে পায়খানা ধোয়ার মাধ্যমে কারো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চেষ্টা করো না। নচেৎ বাত ভালো করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগ সৃষ্টি করে কি লাভ? বরং তোমার মাঝে যে উৎকৃষ্ট শক্তি নিহিত আছে তা ব্যয় কর। শক্তিপ্রার্থীকে শক্তি যোগাও, দাও উৎসাহ ও মনোবল। দুর্নিবার ঐ মহাপ্লাবনের সম্মুখে তুমিও নির্বিচল পর্বতসম প্রাচীর খাড়া করে। দাও। প্রতিহত হোক প্লাবনের সে গতি। “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাসাথ্য শক্তি প্রস্তুত কর, প্রস্তুত রাখ অশ্বদল। তার দ্বারা আল্লাহর শত্রুকুলকে ভীতি-প্রদর্শন ও সন্ত্রস্ত কর, তাছাড়া অন্যদেরকেও যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন।” (সূৱ আনফাল ৬০)
আর ঘরের চেঁকি কুমীর’ সাংবাদিক ও উপস্থাপকদের উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) এর একটি মহাবাণীর নজরানা পেশ করি। তিনি জিবরীল মারফৎ বর্ণনা করে বলেন, “মধ্যজগতে এক শ্রেণীর লোক নিজ নিজ কশা চিরে নিজেদেরকে শাস্তি দিচ্ছে। আর ঐ শ্রেণীর অপরাধী হল তারা, যারা ছিল এমন মিথ্যাবাদী, যাদের মিথ্যা দিকচক্রবালে পৌছে যেত। তাদের এমন শাস্তি কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে।” (বুখারী ১৩৮৬নং) পরন্তু কিয়ামত হওয়ার পর তাদের যে কি শাস্তি হবে তা আল্লাহই জানেন।
ভিডিও, টিভি, ফিল্ম প্রভৃতির ডাইরেক্টর, প্রযোজক, তারকা, হলের মালিক, প্রচারক, নোংরা পত্র-পত্রিকার লেখক, প্রকাশক, এজেন্ট, বিক্রেতা ও পাঠক প্রভৃতি যারা মানবতা ও নারী স্বাধীনতার নামে তাদের প্রচারমাধ্যমগুলোকে উদ্ধৃঙ্খলতা ও যৌনচারিতা প্রচার কাজে ব্যবহার করছে এবং এই চাচ্ছে যে, চরিত্রবাণ মুসলিম পরিবার ও পরিবেশেও যৌনতা, অশ্লীলতা ও নোংরামী প্রবেশ করুক, তাদের উদ্দেশ্যে মহান প্রতিপালকের একটি সতর্কবাণী ঘোষিত রয়েছে, যা পাঠ করে অন্ততঃপক্ষে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী মুসলিমকে সাবধান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, “যারা কামনা ও পছন্দ করে যে, ঈমানদার (মুসলিমদের) মাঝে। অশ্লীলতা (ও ব্যভিচার) প্রসার লাভ করুক, তাদের জন্য রয়েছে ইহকাল ও পরকালে মর্মন্তুদ শাস্তি।” (সরা নর ১৯ আয়াত)
আর মানবমন্ডলী তথা মুসলিম জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “হে মানুষ! তোমরা পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সে তো তোমাদেরকে এ নির্দেশই দেবে যে, তোমরা অন্যায় ও অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়ে পড় এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন সব কথা বল, যা তোমরা জান না।” (সূরা বাক্বারাহ ১৬৮ ১৬৯ আয়াত)
এমন সাংবাদিকদল রয়েছে, যারা কোন নৈতিকতা বা আদর্শভিত্তিক খবর প্রচার করে না। অথচ যৌনতা, চরিত্রহীনতা প্রভৃতির খবর শোভনীয় ও লোভনীয় ভঙ্গিমাতে প্রচার করে থাকে; যারা মুসলিম হয়েও প্রভাবশালী অমুসলিম কোন সম্প্রদায়ের নিকট সম্মান বা অর্থ লাভের আশায় ইসলাম ধংসের পশ্চাতে উঠে-পড়ে গর্বের সাথে কাজ করে যাচ্ছে, যারা চায় মুসলিমরাও কাফেরদের মত কুফরীতে একাকার হয়ে যাক, যারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত কলম ও লাগামহীন জিহ্বা ব্যবহার করে, তারা যে মুসলিমদের কাছে মানবরূপী শয়তান তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমন শয়তানদল থেকেও পানাহ চাওয়া মুসলিমের কর্তব্য। মহান আল্লাহ বলেন, “বল আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির, মানুষের উপাস্যের কাছে, তার অনিষ্ট হতে, যে কুমন্ত্রণা দিয়ে আত্মগোপন করে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, (সে কুমন্ত্রণাদাতা) জ্বিনের মধ্য থেকে (হোক) অথবা মানুষের মধ্য থেকে।” (সূরা নাস)।
ঈমান-চোর শিক্ষা-ব্যবস্থাও যুবকের নৈতিকতার পথে এক শ্রেণীর কাটা-স্বরূপ। শিক্ষাঙ্গনে যুবক-যুবতীর অবাধ মিলামিশা, প্রেম-ভালোবাসা ও যৌন-স্বাধীনতা যুবক ছাত্রের চরিত্র হনন করে। ইসলাম-বিরোধী সিলেবাস ও পাঠ্য-পুস্তক যুবকের ঈমান ধ্বংস করে। মগজ-ধোলাই হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠ-ব্যাখ্যায়। মনের কোণে নাস্তিক্যবাদ দানা বেঁধে ওঠে। শিরায়উপশিরায় ইসলাম-বিতৃষ্ণা ও মুসলিম বিদ্বেষ প্রবাহমান হয়ে যায়। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। তবে ঐ জাতীয় শিক্ষার ফলে শিক্ষিত হওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু চরিত্রবাণ মুসলিম হওয়া যায় না। দুনিয়ার চাকা চালানো যায় বটে, কিন্তু আখেরাতের চাকা অচল হয়ে যায়।
হে যুবক বন্ধু আমার! শিক্ষা গ্রহণ করা ফরয; কিন্তু যে শিক্ষায় তোমার দ্বীন ও ঈমান লুটা যায় তা শিক্ষা করা হারাম। যে শিক্ষা না শিখলে তোমার পরকাল বরবাদ হয় সে শিক্ষা শিখাই তোমার জন্য ফরয, বাকী তো তোমার গরজ। জ্ঞান-বিজ্ঞানে তুমি সমৃদ্ধ হও, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলে তুমি চির উন্নত হও, কিন্তু তা বলে তার পশ্চাতে সময় নেই’ এর ওজুহাতে ফরয শিক্ষা ত্যাগ করে বসে দুনিয়া আবাদ ও আখেরাত বরবাদ করে দিও না।
শিক্ষা লাভ করে যাও, চাকুরীর আশা থাক চাই না থাক। শিক্ষার মাঝে লুকিয়ে আছে তোমার সভ্যতা, তোমার উন্নতি। শিক্ষার মাধ্যমেই তুমি লাভ করবে উচ্চ আসন, পদমর্যাদা এবং অম্লান গৌরব। তবে হ্যা, স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা বহাল রেখে চল এবং ঈমান হারিয়ে দিও না এই কামনাই করি। দেশমাতার প্রশংসা কর, দেশের ভক্তি থাকুক তোমার হৃদয়ে। তবে জাতীয়তাবাদের অন্ধপক্ষপাতিত্ব যেন তোমার মাঝে না থাকে। পক্ষান্তরে মাথা নত কর একমাত্র আল্লাহর সম্মুখে, অন্য কিছুর সম্মুখে নয়। বন্দনা ও বন্দেগী কর কেবল তারই, অন্য কিছুর নয়। আর মনেপ্রাণে এ বিশ্বাস রেখে যে, ভাগ্যবিধাতা একমাত্র মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা, তার কোন সৃষ্টি নয়।
যে জাতি শিক্ষা দিতে এসেছিল পৃথিবীর সকল জাতিকে, যে জাতি ছিল পূর্ণ মানবতার মুর্ত-প্রতীক, যে জাতি ছিল বিশ্ব-জনমন্ডলীর জন্য একক আদর্শ, সে জাতির অবস্থা এই যে, নিজের স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য হারিয়ে অপর জাতির মাঝে একাকার হয়ে বিলীন হয়ে পড়েছে। অন্য জাতির পার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার ভালো-মন্দ সকল বিষয়ে চক্ষু বন্ধ করে অনুকরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিজের আচার-আচরণ, নৈতিকতা ও চরিত্র তথা লেবাস-পোশাকও নিজের কাছে অপছন্দনীয় হয়ে দেখা দিয়েছে। নিজের চোখে নিজেকে দেখেছে দীন-হীন-ক্ষীণরূপে। তাই তো এ জাতির এমন অবস্থা।
এ জাতির কাছে দুনিয়া না থাকলেও দ্বীন আছে আসল রূপে। অর্থ না থাকলেও আছে। নৈতিকতা, যা মুসলিমের অমূল্য ধন এবং মানবের আসল মানবতা। যাদের দ্বীন নেই, নৈতিকতা নেই তাদের পার্থিব সৌন্দর্য দেখে চমৎকৃত হয়ে, তাদের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ঝুঁকে পড়া। অবশ্যই উচিত নয় কোন মুসলিমের। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা সীমা লংঘনকারীদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ো না, অন্যথায় অগ্নি তোমাদেরকে স্পর্শ করবে। আর এই অবস্থায় আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু থাকবে না এবং তোমরা সাহায্যও পাবে না।” (সূরা হুদ ১ ১৩)
সুতরাং বিজাতীয় চাল-চলন, আচার-আচরণ ও বেশভূষায় আকৃষ্ট হয়ে বিজাতির সভ্যতার প্রতি ঝুঁকে পড়ার মানেই হল নিজের স্বরূপতা ও স্বকীয়তা বিকিয়ে সত্যকে না চিনে অথবা অপছন্দ করে অসত্যকে লুফে নেওয়া, আর তা হল দোযখবাসীদের কাজ। তাছাড়া সমাজ-বিজ্ঞানী প্রিয় নবী মুক্তি বলেন, “যে ব্যক্তি যে জাতির আনুরূপ্য অবলম্বন করে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই দলভুক্ত।” (আহমাদ ২/৫০, আবু দাউদ ৪০৩১, সহীহুল জামে’ ৬০২৫ নং)
ভালো-মন্দ বাচ-বিচার না করে অন্ধভাবে অপরের ভঙ্গিমা নকল করে চলা, কোন কোন অথবা সকল কাজে অপরের হুবহু অনুকরণ করা মানুষের জন্য নিন্দনীয়। কারণ, এমন স্বভাব হল বানরের। এই জাতিই কোন প্রকার বিচার না করেই চোখ বুজে অপরের অনুকরণ করে তৃপ্তি পেয়ে থাকে। কিন্তু মানুষ, বিশেষ করে কোন মুসলিম পারে না বিজাতির কোন অসভ্য ভঙ্গিমা নকল করে চলতে। কারণ, মুসলিমের আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আর তা বিনাশ করে অপরের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করার মানেই হল, নিজেকে ধ্বংস ও বিলীন করা। কবি বলেন,
‘পরের মুখে শেখা বুলি পাখীর মত কেন বলিস,
পরের ভঙ্গি নকল করে নটের মত কেন চলিস?
আপনারে যে ভেঙ্গে-চুরে গড়তে চাহে পরের ছাঁচে,
অলীক, ফাঁকি, মেকী সেজন, নামটা তার ক’দিন বাঁচে?
তবে কাফেরদের সর্ববিষয়ে সব রকম কাজেই যে অনুকরণ নিন্দনীয়, তা নয়। নিন্দনীয় হল সেই সব কাজের অনুকরণ করা, যা তাদের কল্পনা-প্রসূত, অমূলক ধারণা বা বিশ্বাসজনিত। যা তাদের অশ্লীলতাময় আচরণ ও অভ্যাস এবং যা নৈতিকতা-বর্জিত। যা তাদের মনগড়া উপাসনামূলক ধর্মীয় আচার। যা তাদের ধর্মীয় বা জাতীয় প্রতীক এবং অন্য জাতি থেকে পার্থক্য নির্বাচনকারী পৃথক বৈশিষ্ট্য। আর যে বিষয়ে আমাদের শরীয়তে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কারণ, তা করলে অসত্যকে সমর্থন করা হয়, যাতে হয় সত্যের অপলাপ।
এ ছাড়া নিছক পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান; যার সম্পর্ক মুসলিমের আকীদা, দ্বীন ও নৈতিকতার সাথে নেই, বরং পার্থিব উপকার আছে, তাতে যে কোন ব্যক্তির অনুকরণ অবৈধ নয়। কারণ, এ বৈশিষ্ট্য কোন জাতীয় বা ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য নয়। বরং মুসলিমই তার অধিক হকদার। অতএব মুসলিমকেই এ বিষয়ে অগ্রণী হওয়া উচিত। তবে তা তার প্রধান লক্ষ্য নয়, যেমন আমরা পুর্বেই জেনেছি। বিজাতির অনুকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করলে আমরা জানতে পারি যে, যেহেতু তাদের প্রায় সকল কর্ম হল ভিত্তিহীন, ভ্রষ্টতাপূর্ণ ও পন্ড, সেহেতু অনুকরণে ভ্রষ্টতায় পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ বিজাতির অনুকরণ মানেই হল, স্বজাতির আচরণকে অপছন্দ বা ঘৃণা করা অথবা মন্দ জানা। যাতে রয়েছে পথের দিশারী মহানবী , এর বিরুদ্ধাচরণ। আর মহান। আল্লাহ বলেন, “সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর কেউ যদি রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায়, আমি সেই দিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং দোযখে তাকে নিক্ষেপ করব, আর তা কতই নিকৃষ্ট আবাস!” (সূরা নিসা ১১৫ আয়াত)
তৃতীয়তঃ অনুকরণে রয়েছে অনুকৃত জাতির প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ ও ভালোবাসা; যা ঈমানের পরিপন্থী। চতুর্থতঃ অনুকরণ হল এক ধরনের মানসিক পরাজয় স্বীকারের নামান্তর। কারণ, অনুকরণকারী তখনই অপরের অনুকরণ করে, যখন সে অপরকে বড় ও সবল এবং নিজেকে ছোট ও দুর্বল মনে করে। আর এতে রয়েছে মুমিনের জন্য লাঞ্ছনা ও অপমান।
মুসলিম জাতি হল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি; যে জাতির অনুকরণ করে মানুষ ধন্য হয়ে থাকে। অতএব মুসলিম কেন বিজাতির অনুকরণ করবে? যে জাতির আদর্শ হলেন নবীকুলশিরোমণি সৃষ্টির সেরা মানুষ মুহাম্মাদ (সা.) সে জাতির অনুসরণীয় আদর্শ পৃথিবীতে আর কে আছে? কিন্তু তবুও সে জাতি বিজাতির গুণে মুগ্ধ, বিজাতীয় সভ্যতা নিয়ে গর্বিত, বিজাতীয় আচরণে অভ্যস্ত, এর কারণ কি?
এর কারণ প্রথমতঃ এই যে, এ জাতি নিজের সভ্যতা বিষয়ে অজ্ঞ, নিজের কৃষ্টি ও কালচার বিষয়ে উদাসীন, দ্বীন ও তার শিক্ষা থেকে বহু দূরে। তাই তো অপরের সৌন্দর্য তার চোখে ধরেছে। দ্বিতীয়তঃ জাতির দিকে তাকালে যেন গোটা জাতিকে কাঠের গড়া একটা পুতুল মনে হয়। এ জাতি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অন্যান্য জাতির তুলনায় বহু দুর্বল, মানসিক দিক দিয়ে আগ্রাসন ও পরাজয়ের শিকার, আর অস্ত্র-শস্ত্র ও যুদ্ধ-সামগ্রীর ব্যাপারেও বড় কমজোর। তাই বিজাতির প্রভুত্ব তার মনে-প্রাণে অনায়াসে বিস্তার লাভ করেছে এবং বিজাতীয় আচরণ প্রাধান্য পেয়েছে তার জীবনের পদে পদে।
পাশ্চাত্য-সভ্যতার ছোয়া লাগা মানুষ হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে পশ্চিমা-বিশ্বের অনুকরণ করে। কাফেরদের বিভিন্নমুখী বিভব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং পার্থিব উন্নয়ন দেখে মুসলিম। নিজেদেরকে হেয় ও তুচ্ছজ্ঞান করে বসেছে। ভেবেছে, দুনিয়ায় ওরা যখন এত উন্নত, তখন ওদের সভ্যতাই হল প্রকৃত সভ্যতা। সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণে এটাই ধরে নিয়েছে যে, ওরা যেটা করে, সেটাই উত্তম ও অনুসরণীয়। ওদের মত করতে পারলে তারাও ঐরূপ উন্নতির পরশমণি হাতে পেয়ে যাবে। মনে করেছে যে, ওদের ঐ ছন্নছাড়া, লাগামছাড়া, বাধনহারা যৌন-স্বাধীনতাপূর্ণ জীবনই হল ওদের উন্নতির মূল কারণ এবং প্রগতির মূল রহস্য।
তৃতীয়তঃ ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে মুছে দেওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে পরিকল্পিত প্রচেষ্টার যে কুফল, তা বহু সংখ্যক মুসলিমদের মাঝে প্রকাশ পেয়েছে। অর্থ ও নারী পেয়ে মানুষ মনুষ্যত্ব ভুলে যায় এবং পশুত্ব বরণ করে পশুবৃত্তি চালিয়ে যেতে এতটুকুও দ্বিধা করে। মুর্তাদ্দ, মুনাফিক, ও ফাসিক মুসলিমদল সে জালে ফেঁসে কাফেরদেরকে সর্বতোভাবে সহায়তা করছে। অর্থ ও নারী তথা যৌন-স্বাধীনতার স্বর্গে বসে অপরকেও ঐ স্বর্গগামী রথে চড়ে বসতে আহ্বান জানাচ্ছে। মানবতার নামে পশুত্বের পূজারীরা পশুবৃত্তিকে সুশোভিত করে সমাজে উচ্ছলতার বন্যা আনয়ন করছে। আর তৃপ্তি সহকারে ধৃষ্টতা ও গর্বের সাথে ঐ অধোগতিকে প্রগতি’ বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কাফেররা এ কথা খুব ভালোভাবে জানে যে, ইসলাম তাদের তথাকথিত ঐ প্রগতির পথে বাধ সাধবে।
তাই মুসলিমের জীবন থেকে ইসলামের আদর্শকে অথবা ইসলামের পরশ থেকে মুসলিম ও সারা বিশ্বকে পাকেপ্রকারে দুরে সরাতে না পারলে কোন শান্তি নেই, স্বস্তি নেই। তাই তো ঐ প্রচেষ্টায় ওদের এক দক্ষ নেতার দুরভিসন্ধিমূলক বক্তব্য হল, শারাবের পেয়ালা ও নারী মহামেডানদের মাঝে সেই কাজ করবে যা এক হাজার তোপেও করতে পারে না। অতএব ওদেরকে অর্থলোলুপতা ও যৌনচারিতার সাগরে ডুবিয়ে দাও। চরিত্রবিনাশী ইয়াহুদী প্রটোকল সংকল্পবদ্ধ যে, আমরা ওদেরকে নানা প্রকার মনমাতানো বিষয়-বস্তু ও খেলাধুলা দ্বারা বিভোর করে রাখব। ----আমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য হল, নৈতিকতা ধ্বংস করা। যৌন-সম্পর্ক সূর্যের আলোতে প্রকাশ পাবে।
যাতে যুবকের মনে পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতা বলে কিছু অবশিষ্ট না থাকে এবং তার যেন প্রধান চিন্তা ও লক্ষ্য হয়, কেবল যৌনক্ষুধা নিবারণ করা। এইভাবে আমরা নৈতিকতা বিনাশ সাধনে সমর্থ হব।' (আলইফফাহ ৬২প দ্রঃ)
ওদের প্রধান লক্ষ্য হল, যাতে মুসলিম ইয়াহুদী, খ্রীষ্টান অথবা অন্য কোন ধর্মে ধর্মান্তরিত হোক। আর তা না হলেও অন্ততঃপক্ষে সে যেন ইসলাম থেকে বহু দুরে সরে যায়। দ্বীনী তা'লীমের ব্যাপারে তার যেন বিতৃষ্ণা জন্মে। যথাসম্ভব সে যেন পাশ্চাত্য সভ্যতাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়। মগজ ধোলাই করার উদ্দেশ্যে সে যেন পশ্চিমে পড়াশোনা বা চাকুরীর সুযোগ পায়।
ইসলামী সংস্কৃতি ধ্বংস করার সবচাইতে বড় উপায় হল যৌনতা এবং প্রধান মাধ্যম হল নারী-দেহ। অতএব প্রচারমাধ্যমগুলোর সিংহভাগ বিষয়বস্তু হোক নারী, প্রেম ও যৌনতা। নারীকে পুরুষের পাশাপাশি বসিয়ে দেওয়া হোক। বেশ্যালয়গুলো সরকারী অনুমোদন পাক।
বেশ্যাদেরকে ‘বেশ্যা’ না বলে ‘যৌনকর্মী’ (?) বলা হোক। বিভিন্ন নারী-আন্দোলনমূলক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হোক, সে সংগঠনগুলো নারী-স্বাধীনতার দাবী নিয়ে যৌন-স্বাধীনতার কাজ চালিয়ে যাক। চাকুরী দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নারীকে বাইরে বের করে আনা হোক। সভ্য লেবাসের অন্তরাল থেকে বের করে এনে তাদেরকে ‘আলোকপ্রাপ্তা করা হোক। যাতে যুবকদল লালায়িত হয়ে নৈতিকতার বাধ ও বেড়া ভেঙ্গে যৌনতার তুফান নিয়ে আসে।
বিভিন্ন নাইট ক্লাব’ তৈরী হোক। অবাধ মিলামিশার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন বিলাসকেন্দ্র ও মিলনক্ষেত্র নির্মিত হোক। সুন্দরী-প্রতিযোগিতা এবং ফ্যাশন-ডিজাইনের বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হোক। যুবক-যুবতীর সকল পার্থক্য দুরীভূত হোক। দূর হোক গতানুগতিক সামাজিক বিবাহ-প্ৰথা। নারীকে সুযোগ দেওয়া হোক তার ইচ্ছামত মডেল ও সংখ্যার জীবনসঙ্গী খুঁজে ও বেছে নিতে। গর্ভপাত আইনতঃ বৈধ করা হোক এবং তার সকল উপায়-উপকরণ সহজ ও সুলভ করা হোক; যাতে ব্যভিচার করতে যেন কেউ মান যাওয়া বা অযাচিত সন্তান নেওয়ার ভয় না করে।
ভাই যুবক! আর কত উল্লেখ করব? তুমি জ্ঞানী ছেলে, পৃথিবীর দিকে একবার জ্ঞানচক্ষু খুলে তাকিয়ে দেখ, তোমার পশ্চাতে কত শত্রু লেগে আছে, তা অনায়াসে বুঝতে পারবে। কিন্তু তখনও কি তুমি সচেতন হবে?
আজ যেন মহানবীর মহাবাণী বাস্তব রূপ নিতে চলেছে। তিনি বলেন, “অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অনুসরণ করবে বিঘত-বিঘত এবং হাত-হাত (সম) পরিমাণ। এমনকি তারা যদি গো-সাপের (সান্ডা)র গর্তে প্রবেশ করে, তাহলে তোমরাও তাদের পিছনে পিছনে যাবে। (এবং তাদের কেউ যদি রাস্তার উপর প্রকাশ্যে সঙ্গম করে, তাহলে তোমরাও তা করবে!)” সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি ইয়াহুদ ও নাসারার অনুকরণ করার কথা বলছেন? তিনি বললেন, “তবে আবার কার?” (বুখারী, মুসলিম ২৬৬৯, হাকেম, আহমাদ, সহীহুল জামে ৫০৬৭ নং) সাহাবী হুযাইফা বিন ইয়ামান বলেন, 'তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অবলম্বন করবে জুতার মাপের মত (সম্পূর্ণভাবে)। তোমরা তাদের পথে চলতে ভুল করবে এবং তারাও তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে চলতে ভুল করবে না। এমন কি তাদের কেউ যদি শুকনো অথবা নরম পায়খানা খায়, তাহলে তোমরাও (তাদের অনুকরণে) তা খেতে লাগবে!' (আল-বিদাউ অন-নাহয়ু আনহা, ইবনে অযযাহ ৭ ১পৃঃ)।
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “পূর্ববর্তী জাতির সকল আচরণ এই উম্মত গ্রহণ করে নেবে।” (সহীহুল জামে ৭২১৯ নং) কিন্তু তিনি মুসলিম জাতিকে সতর্ক করে বলেন, “সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি আমাদেরকে ছেড়ে অন্য কারো সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না, আর খ্রীষ্টানদেরও সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।” (তিরমিযী, সহীহুল জামে ৫৪৩৪নং) যে ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টান তথা পশ্চিমা বিশ্বকে আমরা উন্নত-বিশ্ব বলি, যাদের হাতে আজ বিশ্বের নেতৃত্ব-ডোের রয়েছে, যাদেরকে নিয়ে ও যাদের মত হতে পেরে অনেকে গর্ববোধ করে থাকে, তাদের সেই বিশ্বের মানুষকে চরম যৌন ও জরায়ু-স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, আইন করে ব্যভিচার, সমকামিতা ও বেশ্যাবৃত্তিকে বৈধ করা হয়েছে। যে বিশ্বে পয়দা হয় লাখোলাখো জারজ সন্তান, হত্যা করা হয় লাখো-লাখো জ্বণ। যেখানে লাখো-লাখো রয়েছে কুমারী মাতা। যৌবন আসার পূর্বেই বা প্রারম্ভেই যেখানে নারীর মূলধন সতীত্ব ও পবিত্রতাকে বিলিয়ে দেওয়া হয়। যেখানে পশুর মত পথে-ঘাটে চোখের সামনে মানুষের যৌন-মিলন। ঘটতে দেখা যায়। যেখানে অসভ্য যৌন-স্বাধীনতাই হল প্রকৃত সভ্যতা।
যে পাশ্চাত্য ভোগবাদী পরিবেশের অবস্থা এই যে, ডানা বের হলেই বাচ্চা (ছেলে-মেয়ে) উড়ে যায় বাসা ছেড়ে, মা-বাপ ছেড়ে। বুড়ো-বুড়ী একাকীই মরে বাড়িতে। কেউ বা বাস করে কুকুর বা বিড়াল নিয়ে। পরিশেষে অনেকে বাড়ি-ঘর, টাকা-পয়সা উইল করে যায় কুকুর বা বিড়ালের নামে! মালিক হয় কুকুর বা বিড়ালের খাদেমরা। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব এ কথা।
যে বিশ্বের সংসারে আত্মীয়তার বেহেস্তী পরিবেশ বিলীনা বংশ-পরিচয়ের সূত্র নিখোঁজ। নেই স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র বন্ধন। নেই পিতা-মাতার সহিত শালীনতাপূর্ণ আচরণ এবং আমরণ সহাবস্থান। হৃদয়ে-হৃদয়ে যৌন ছাড়া পবিত্র প্রেমের যোগসুত্র বিরল। যেখানে পবিত্রতাকামীদেরকে রক্ষণশীল ও সেকেলে এবং যৌনতাকামী অশ্লীল মানুষদেরকে সংস্কারপন্থী ও প্রগতিশীল বলে আখ্যায়ন করা হয়। যেখানে পর্দা ও সতীত্ব হল উপহসনীয়।
এই হইল পাশ্চাত্য সমাজের সামান্যতম প্রতিচ্ছবি। এই হইল ধর্মহীন সমাজ ও বিকৃত যৌনাচারের অবাধ মিলামিশার ফসল। নৈতিক মূল্যবোধের এহেন অবস্থায় উগ্র যৌনস্বাধীনতাকামীদের কাছে Wife হইতেছে Wonderful instrument for enjoyments অর্থাৎ, উপভোগের এক বিস্ময়কর যন্ত্রবিশেষ। ফলে আজ তাহাদের প্রাসাদ আছে, কিন্তু গৃহ নাই। জন্মদাতা আছে, কিন্তু পিতা নাই। পরিধান আছে, কিন্তু আব্র নাই। বুদ্ধি আছে, কিন্তু বিবেক নাই। মানুষের আকৃতি আছে, কিন্তু মনুষ্যত্ব নাই।' (গণতন্ত্র কি একটি শিরকী ও কুফরী মতবাদ? মাজহারুল আনোয়ার ২২পৃঃ দ্রঃ) ।
এখানেই শেষ নয়, কুমারী মায়ের হারাম সন্তানরা আবার বাপের পরিচয় না থাকার ফলে গর্ববোধও করে থাকে। কারণ, তাদের মত যীশু খ্রীষ্টেরও পিতা পরিচিত ছিল না তাই!! তবুও ঐ সমাজকে নিয়েই আমরা গর্ব করি। তাদের চরিত্রেই আমরা মুগ্ধ হই। বলা বাহুল্য, ঐ সমাজেরই জীবাণু আমাদের দেশেরও তথাকথিত বহু বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও কবিসাহিত্যিকদের মাঝে সংক্রমণ করেছে। বরং বহুলাংশে তা আমদানী করেই আনা হয়েছে। পাশ্চাত্যের শিক্ষা-পদ্ধতি, রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা প্রভৃতিতেও প্রভাবান্বিত হয়ে সকলের ক্ষেত্রে যৌনসুখ ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করে যে যৌন-বিপ্লব এ শ্রেণীর মানুষেরা আনতে চায়, তা তাদের ছেলে-মেয়েদের লেবাসে-পোশাকে, আচার ও আচরণে প্রকাশ পায়। যার চরম সহযোগিতা করে দেশে নির্মিত ও প্রদর্শিত বিভিন্ন ফিল্ম। যাতে পশ্চিমী অবাধ যৌন-সংসর্গ ও অবৈধ প্রেম ছাড়া অন্য কোন বিষয় স্থান পায় না। আর তাতে উদ্বুদ্ধ করে পশ্চিমের ঐ ইন্দ্রিয়পরায়ণ ভোগবাদীরা। ওরা এদেরকে সংস্কারপন্থী বলে প্রশংসা করে! কিন্তু আসলে যে ওরা অপসংস্কার ও বিনাশপন্থী তা হয়তো বুঝেও বুঝে না।
যে দেশের সুখ ও সংস্কৃতি দেখে আমরা অবাক হই, তা কি আসলেই সংস্কৃতি? যুগ পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে মানুষের পরিবেশ ও ধ্যান-ধারণা। যুগের চাহিদা অনুযায়ী অপসংস্কৃতি সংস্কৃতির আকার ধারণ করেছে। কিন্তু যুগ কোন চিড়িয়ার নাম নয়। যুগ সৃষ্টি করে মানুষ। মানুষ যেমন হবে, ঠিক তেমনি হবে যুগ। মানুষ যদি নোংরা অপসংস্কৃতির চাহিদা সৃষ্টি না করে, তাহলে যুগের চাহিদার কোন প্রশ্নই ওঠে না। মানুষের মনে চিত্তজ্বালা সৃষ্টি হয়েছে। ভোগের নেশা তীব্র থেকে তীব্র হওয়ার কারণে। যেখানে ভোগের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, সেখানে চিত্তবিনোদনের উপায়-উপকরণের সীমাই বা কি করে থাকে? ভোগের নেশা যত বেড়ে চলে, ততই বেড়ে চলে আরো ভোগের আকাঙ্খা। উদ্ভব হয় নতুন নতুন বিনোদনের কেন্দ্র, উপাদান ও যন্ত্র।
যারা যত বেশী চিত্তজ্বালায় জ্বলে, তারা তত বেশী চিত্তবিনোদনের প্রয়োজন বোধ করে থাকে। তাই বিনোদনের উপাদান-উপকরণ তালাশ করে এবং বিনোদনের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। অভাব যেখানে যত তীব্র, প্রাপ্তির হাহাকারও তত বেশী। পশ্চিমা সমাজে সেই চিত্তজ্বালা প্রায় প্রতি জনে, প্রতি ঘরে, প্রতি পরিবারে প্রবেশ করে অগ্নিজ্বালার দাবদাহ সৃষ্টি করেছে। তাই তো এত অস্থিরতা। এই অস্থিরতা দুর করার জন্যই চিত্তবিনোদনের এত বৈচিত্র সৃষ্টি করা হয়। মাজা-ঘষা, পালিশ আর বার্ণিশ করা তাদের সমাজের বহিদৃশ্য নয়ন জুড়ায়; কিন্তু মাকাল ফলের মত অন্তর বিস্বাদ। যে সমাজে আমাদের মত সামাজিকতা নেই। স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, দাদা-দাদী নিয়ে সেই সমাজে কোন পরিবার গড়ে ওঠে না। স্বনির্ভরতার পাখনা উঠলেই কে কোথায় উড়ে যায় কেউ কারো খবর রাখে না। যেখানে দুই বিয়াই-এ কখনো খোশ আলাপ হয় না। যে সমাজের কোন মা পিঠা তৈরী করে মেয়ের বাড়ি পাঠান না। ----- যেখানে লায়েক সন্তানেরা বুড়ো মা-বাবাকে 'ওল্ড এজ হোম’ নামক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বন্দি খোয়াড়ে’ পাঠিয়ে দেয় অথবা নিজ বাড়িতে বুড়া-বুড়ী সরকারী চেরিটি বা লিল্লাহ খেয়ে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ধুকেধুকে মরেন। মৃত্যুর সময় স্বজনদের কেউ পাশে থাকে না।
এই যে জীবন-জ্বালা, সামাজিকতা-বিহীন এই যে সমাজ, আর রক্তের মায়া-মমতাশূন্য এই যে যান্ত্রিক জীবন, সেই জীবনকে, সেই শূন্যতাকে, সেই একাকীত্বকে দূর করার জন্য তারা বিনোদন-বৈচিত্র সৃষ্টি করে জীবনকে ভরে তুলতে চায়। ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করে দেখার ফুরসৎ তাদের নেই, সেই প্রয়োজন আছে বলেও তারা মনে করে না। ভোগের জন্যই তাদের চিত্তের প্রয়োজন। তাই চিত্ত আর ভোগের পিছনেই তারা ছুটে। এই বিত্ত দিয়ে তারা চিত্তকে সব সময় আনন্দে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করে থাকে। ওদের বিত্ত আছে, আর আছে বিত্তকে চিত্তবিনোদনের জন্য ব্যবহারের মনটাও। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত দৌলত আছে তাদের। দেহের রঙটাও লালচে সফেদ।
আমাদের মত কালো আদমীর মুগ্ধ হওয়ার, বিমোহিত হওয়ার, এমন কি সম্মােহিত হওয়ার জন্য যা কিছু তাদের থাকা দরকার, সবই আছে। তারা যা করে তাই আমাদের ভালো লাগে। ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত এই সাদা চামড়ার মানুষদের প্রভু জ্ঞান করে আমরা ধন্য হয়েছি। এ জন্য রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করলেও সাংস্কৃতিক দাসত্ব থেকে মুক্তির কখনো চেষ্টা করিনি। কারণ, জাতে ওঠার জন্য এই বন্ধনকে কখনো ছিন্ন করিনি। বরং আরো বেশী মজবুত করেছি। তাদের জাত-গোষ্ঠী সবাইকে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছি।' (দেখুন, অপসংস্কৃতির বিভীষিকা, জহুরী ১৪- ১৬পৃঃ)
আমরা আমাদের অজান্তেই পশ্চিমের পদলেহী গোলাম হয়ে পড়েছি। আজ তাদের সামান্য অনুগ্রহ লাভ করার জন্য আমরা আমাদের হাব-ভাবে ফুটিয়ে তুলছি যে, আমরা তাদেরকে মন থেকে ভালোবাসি। তাই স্বকীয়তা বিকিয়ে, স্বাতন্ত্র্য বিলীন করে চেষ্টা করি তাদের পদসেবা করার।
ইসলামে তুমি দিয়ে কবর
মুসলিম বলে কর ফখর
মুনাফিক তুমি সেরা বেদ্বীন,
ইসলামে যারা করে যবেহ
তুমি তাহাদের হও তাবে’
তুমি জুতা-বহা তারও অধীন।
তবে হ্যা, বেদ্বীন প্রতিবেশী ও জাতির সহিত দেশীয় মিল থাকতে পারে, পার্থিব লেনদেনে যোগাযোগ থাকতে পারে, সদাচার ও সদ্ব্যবহার থাকতে পারে। তা বলে নিজের স্বাতন্ত্র বিকিয়ে দিয়ে একাকার হওয়া চলে না।
আমাদের দ্বীন ও শরীয়ত যে সব বিষয়ে বিজাতির অনুকরণ করতে নিষেধ করে, তার মধ্যে একটি বিষয় হল, আকীদা ও বিশ্বাসগত বিষয়। অর্থাৎ, তারা যে শিকী ও কুফরী বিশ্বাস রাখে, সে বিশ্বাস কোন মুসলিম রাখতে পারে না। যে কুফরী মতবাদে তারা বিশ্বাসী সে মতবাদে কোন মুসলিম বিশ্বাসী হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ ঈদ ও পাল-পার্বণ উৎসব উদ্যাপন ও অনুষ্ঠানগত বিভিন্ন বিষয়। অর্থাৎ, দুই ঈদ ছাড়া কোন মুসলিম ওদের দেখাদেখি আর কোন তৃতীয় ঈদ আবিষ্কার করতে পারে না; চাহে তা কোন দুর্বল বা জাল হাদীস-ভিত্তিক হোক, অথবা নিছক মনগড়া। বলাবাহুল্য, শবে মিরাজ, শবে বরাত, মুহরম, নবীদিবস বা ঈদে-মীলাদুন্নবী ফাতেহা ইয়াযদহম, ফাতেহা দোয়াযদহম, আখেরী চাহারশোম্বা, পৌষপার্বণ, সিলভার জুবিলি, গোল্ডেন জুবিলি, জাতীয় দিবস, মসজিদ সপ্তাহ, জন্মদিন বা হ্যাপি বার্থ ডে’ উৎসব, হানিমুন, বিবাহবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, উরস-উৎসব, এপ্রিল ফুল, হ্যালোইন উৎসব, নতুন খাতা বা নববর্ষ প্রভৃতি অনুষ্ঠান উদ্যাপন ইসলামে ভিত্তিহীন এবং পরের দেখাদেখি আনন্দে ফুর্তি করার মাধ্যম মাত্র।
এ সব ঈদ বা পরব পালন কোন মুসলিম করতে পারে না। যেমন ঐ শ্রেণীর কোন উৎসবে অথবা বিজাতির কোন পাল-পার্বণে কোন মুসলিম অংশগ্রহণ করে খুশী করতে পারে না। কারণ, বিজাতির সকল ঈদ ও ইবাদত বাতিলকে ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। আর তাদের সেই ঈদের খুশীতে শরীক হওয়া বা সে উপলক্ষ্যে তাদেরকে ‘মোবারকবাদ’ পেশ করার অর্থই হল তাদের বাতিলকে স্বীকৃতি দেওয়া ও সমর্থন করা এবং আসল সত্যের অপলাপ করা। বর্তমানে বিজাতির অনুকরণে মুসলিমদেরও পরব সংখ্যা এত বেশী হয়েছে যে, তা পালন করে মনে না রাখলেও অনেক সময় ঠকতে হয়। ধর, পাড়া-গ্রাম থেকে শহরে গেলে কোন অফিসের কাজে অথবা ব্যাংকে লেনদেনের কাজে। হঠাৎ দেখলে, সে অফিসে বা ব্যাংকে তালা ঝুলছে। সুতরাং এত কষ্ট করে এসে তোমাকে ঠকতে হল। এ ছাড়া ঠকানির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে তখন, যখন পাশের কোন পরব-মানা মুসলিমকে এ বন্ধের কারণ জিজ্ঞাসা করবে এবং সে অবাক হয়ে বিদ্রুপের আগ্ন জিভে তোমাকে বলবে, 'ওঃ! মুসলিম হয়ে দাড়ি রেখে নিয়েছ বেশ। আর পবিত্র ও পরবের দিনের খবর রাখ না!' ইত্যাদি।
একদিন এক শহরের বাসস্ট্যান্ডে বাসে বসে ছিলাম। পাশের সিট ছিল খালি। এমন সময় আমার পরিচিত এক হাই-স্কুলের শিক্ষক মহাশয় বাসে উঠলেন। সালাম জানালে আমি উত্তর দিয়ে তাকে সাদরে পাশের সিটে বসতে অনুরোধ করলাম। তিনি খুশীর সাথে বসলেন। এরপর হঠাৎ করেই আমি তাকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, মার্কেট এসেছিলেন, আপনার আজ স্কুল নেই নাকি? তিনি অবাক হয়ে বললেন, 'আপনি জানেন না; আজকে ফাতেহা ইয়াযদহম, স্কুলের ছুটি?' আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েই বললাম, 'ও তাই বুঝি? আচ্ছা এই ফাতেহা ইয়াযদহম’টা কি?
তিনি যেন আরো অবাক হলেন। আসল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বড় আফশোসের সাথে বললেন, এই তো মুসলমানদের অবস্থা! নিজেদের পালপার্বণেরও খবর রাখে না। আজ তো হযরত বড় পীরের মৃত্যু-দিবস।
এরপর অবশ্য প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলেছিলাম, 'মুসলমানরা যদি নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সঠিক মতে জানত, তাহলে সত্যই তাদের এ দুরবস্থা হতো না। কিন্তু আজকাল আসল ছেড়ে দিয়ে নকল হীরা নিয়েই টানাটানি বেশী। মনে মনে ভাবলাম, কুঁড়ে চাষীই অমাবশ্যা খুঁজে বেশী। আর কাজ-চোর বউই ভাশুর মানে অধিক। নিজের ফরয আদায় থেকে যারা যত বেশী রেহাই পেতে চায়, তাদেরই এসব নকল পালপার্বণের খোঁজে ছুটি পাওয়াটা অধিক আকাংখিত। তাছাড়া যারা নামাযে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়ে না, বরং নামাযই পড়ে না, তাদেরই ফাতেহা বা ফয়তা নিয়ে বেশী খোঁজখবর ও বাড়াবাড়ি। বিজাতির অনুকরণের ফসল এই বারো মাসে তেরো পরব।' বাপকে জীবনে চোখে না দেখতে পেরে অথবা তার অবাধ্য সন্তান হিসাবে জীবন অতিবাহিত করে অথবা জীবিত অবস্থায় তার বিরোধিতা করে তার মৃত্যুর পর তার নামে ফয়তা দেওয়া হাস্যকর নয় কি?
পরন্তু আসল কথা এই যে, দ্বীনের মূল কর্মকর্তব্য বর্জন করে এই সমস্ত নকল পালপার্বণ সৃষ্টি করে একটু আনন্দ উপভোগ করাই হল এক শ্রেণীর স্বার্থপর মানুষদের উদ্দেশ্য। তাই দেখা যায় উহুদ-যুদ্ধের দিনকে স্মরণ করে অনেকে হালোয়া বানিয়ে খায়। কারণ, ঐ দিনে মহানবী রঃ এর দাত-মুবারক শহীদ হয়েছিল এবং মা-ফাতেমা তাঁকে হালোয়া বানিয়ে খেতে দিয়েছিলেন। অতএব ঐ দিনে হালোয়া খাওয়া সুন্নত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, ঐ শ্রেণীর মানুষরা দাত ভাঙ্গা (জিহাদ) কে (ফরয তো দুরের কথা) সুন্নত মনে করে না। অথচ অক্ষত দাতে হালোয়া খাওয়াকে সুন্নত মনে করে। এটা স্বার্থপরতা নয় তো কি?
দুঃখের বিষয় যে, বিজাতির দেখাদেখি এক শ্রেণীর মুসলিম যুবক; যাদের বাপের পকেটে পয়সা নেই, তারা জোর-জুলুম করে অপরের নিকট থেকে চাঁদা তুলে মহরমের পরবে ফুর্তিআমোদ করে থাকে। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের গাড়ি থামিয়ে এমন চঁদাবাজি তথা ঐ অর্থ দ্বারা না হলেও ১০ই মহরমের দিন কোন প্রকার আনন্দ অথবা শোকপালন করা ইসলামী শরীয়ত-বহির্ভূত কর্ম। যেমন বিজাতীয় সহপাঠীদের চাঁদা তুলে কোন পূজা বা জন্ম-বার্ষিকী পালন করতে দেখে মুসলিম ছাত্রদেরও অনুরূপ নবী-দিবস পালন করা ইসলামী শরীয়ত-সম্মত নয়। প্রতিবেশীর সাথে পাল্লা দিয়ে এমন কাজ মুসলিমদের জন্য সত্যই লজ্জাকর।
বলাই বাহুল্য যে, ইসলাম হল খাটি একত্ববাদের ধর্ম। এ ধর্মে কোন প্রকার ব্যক্তিপূজা (মুর্তিপূজা, দুর্গাপূজা), শক্তিপূজা, অর্থপূজা এবং এক কথায় একমাত্র মহান আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব ছাড়া অন্য কোন পূজার স্থান নেই। ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানরা আম্বিয়াগণের কবরসমূহকে মসজিদ (সিজদার জায়গা) বানিয়ে নিত। ইসলাম এ ব্যাপারেও তাদের অনুকরণ করতে নিষেধ করল। কবর ও মাজার পূজার বিরদ্ধে ইসলামের ঘোষণা এল, “তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিরা তাদের নবীগণের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে। সাবধান! খবরদার তোমরা কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করে নিও না। আমি এ করতে তোমাদেরকে নিষেধ করে যাচ্ছি।” (মুসলিম ৫৩২ নং) “আল্লাহ ইয়াহুদী জাতিকে ধ্বংস করুক; তারা তাদের আম্বিয়াগণের কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করেছে।” (বুখারী ৪৩৭ নং)।
“ওরা হল এমন জাতি; যারা তাদের কোন নেক বান্দার মৃত্যু হলে তার কবরের উপর মসজিদ তৈরী করেছে এবং তাতে তার ছবি বা মূর্তি স্থাপন করেছে। ওরাই হল আল্লাহর নিকট সবচাইতে নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।” (বুখারী ৪২৬, মুসলিম ৫২৮ নং)। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ মুসলিম বিজাতির অনুকরণে ঐ শ্রেণীর পূজায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে এবং তওহীদের ধর্মে ইবাদত ও বন্দেগীতে অন্যকে আল্লাহর শরীক অথবা মাধ্যমরূপে পূজতে শুরু করেছে। যে গায়রুল্লাহর ইবাদত (পূজা) নির্মুল ও উচ্ছেদ করার জন্য এ ধরাধামে ইসলামের আবির্ভাব ছিল, সেই ইবাদত (পূজা)কেই অভীষ্ট লাভের অনন্য উপায় বলে বরণ করে নিল মুসলিম জাতির বহু কুলাঙ্গারদল! আল্লাহ এ জাতিকে সুমতি দিন। আমীন। ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানরা রোযা রাখে, কিন্তু সেহরী খায় না। ইসলাম তাদের অন্ধ অনুকরণ করে। সেহরী খাওয়া ত্যাগ করতে নিষেধ করল। (মুসলিম ১০৯৬ নং) রোযা রাখার পর ওরা ইফতার করে, কিন্তু বড় দেরী করে। ইসলাম তাদের অনুকরণ বর্জন করতে নির্দেশ দিয়ে সূর্য ডোবার। সাথে সাথে সত্বর ইফতার করতে মুসলিম জাতিকে উদ্বুদ্ধ করল। (আবু দাউদ ২৩৫৩, ইবনে মাজাহ ১৬৯৮ নং, হাকেম ১/৪৩১)
সূর্যপূজকরা সূর্যের উদয় ও অস্তের সময় তার পূজা করে থাকে। তাই ঐ সময়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যেও নামায পড়াকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। (মুসলিম ৮৩২নং) যাতে মুশরিকদের সাথে তওহীদবাদী মুসলিমদের কোন প্রকার সাদৃশ্যভাব না ফুটে ওঠে। বৈরাগ্যবাদ বিজাতীয় আচার। ইসলামে তা নিষিদ্ধ হল। (আবু দাউদ ৪৯০৪ নং)
‘বৈরাগ্য-সাধনে মুক্তি সে আমার নয়,
অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ----।
ইসলামের এ আদর্শ হল মানব-প্রকৃতির জন্য অতুলনীয়। সুতরাং মাছ-গোশু না খাওয়া, জুতো না পরা, গাড়ি না চড়া, ইত্যাদি বিজাতীয় আচরণ, ইসলামী আচরণ নয়।
ইসলামে দলাদলি ও ফিকাবন্দী নিষিদ্ধ কর্ম। কারণ, এ আচরণ ও নীতি হল মুশরিক ও কাফেরদের। তাদের সমাজেই আছে ভেদাভেদের নানা প্রাচীর। উঁচু-নীচু পার্থক্য করার মনগড়া নানা দোষগুণ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা তাদের মত হবে না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরও বিচ্ছিন্ন হয়ে (দলে দলে বিভক্ত হয়ে) পড়েছে এবং নিজেদের মাঝে মতান্তর সৃষ্টি করেছে।” (সরা আ-লি ইমরান ১০৫ আয়াত)।
বিজাতীয় মানুষকে ঘৃণা করে নয়, বরং বাতিল থেকে হকের যে একটা পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে তা প্রকাশের জন্য এবং মুসলিম বাতিলের সাথে কোন প্রকার আপোসে সম্মত নয়, তা জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই লেবাসে-পোশাকেও সে অন্যান্য জাতি থেকে ভিন্ন। পরিচ্ছদ-পরিধানেও মুসলিমের আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। যেমন, মুসলিমের লেবাসে প্রকাশ পায় না কোন প্রকার অহংকার-অহমিকা, পাওয়া যায় না কোন বিজাতীয় গন্ধ, থাকে না কোন প্রকার দৃষ্টিকটুতা, অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনার ভাব। আর এ স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলা তার একান্ত কর্তব্য। একদা মহানবী (সা.) আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-কে দু’টি জাফরান রঙের কাপড় পরে থাকতে দেখে বললেন, “এ ধরনের কাপড় হল কাফেরদের। অতএব তুমি তা পরো না।” (মুসলিম আহমাদ ১১৬২)
এ থেকে বুঝা যায় যে, যে ধরনের লেবাস-পোশাক বিজাতির বিশেষ প্রতীক তা কোন। মুসলিম নর-নারী ব্যবহার করতে পারে না।
পুরুষের এক প্রকৃতি-সুন্দর রূপ হল তার চেহারায় দাড়ি। কুদরতের দেওয়া এই দাড়ি থাকলে মুসলিমকে দেখতে যেমন সুন্দর লাগে, তেমনি চাছা-ছিলার ঝামেলা থেকে রেহাই পায়। তাছাড়া বিশেষ করে গালে টোল পড়ার বয়সে টোলের ত্রুটি দাড়ি দিয়ে গোপন করা। যায়। এতে থুড়থুড়ে হলেও চেহারা বেশ শ্রদ্ধাপূর্ণ সুন্দর দেখায়। তবে শর্ত হল দাড়ি ছাড়ার সাথে মোছ ঘেঁটে ফেলতে হবে। নচেৎ সুন্দরের উপর অসুন্দর বেখাপ্পা দেখাবে। আর এমন চেহারা হবে মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। প্রিয় নবী স. বলেন, “তোমরা মোছ হেঁটে ফেল এবং দাড়ি ছেড়ে দাও (কমপক্ষে এক মুঠো পরিমাণ)। আর একাজ করে তোমরা মুশরিকদের অন্যথাচরণ কর।” (বুখারী ৫৮৯৩, মুসলিম ২৫৯ নং) “মোছ ছেটে ও দাড়ি রেখে অগ্নিপূজকদের বৈপরীত্য কর।” (মুসলিম ২৬০ নং) “এবং ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ১০৬৭ নং)
আর তা এই জন্য যে, ওরা কেউ আমাদের মত হতে চায় না, আমাদের কাছে আসা সত্যকে গ্রহণ করতে চায় না, তাই আমরা তাদের বাতিল চলনের বিরোধিতা করতে আদিষ্ট হয়েছি।
অনেক যুবকের অবস্থা উল্টা বুঝিল রাম। অর্থাৎ, তারা দাড়ি চেঁছে ফেলে মোছ লম্বা ছেড়ে মোছাল সেজে সেঁপে পাক দেয়। কারো বা টাঙ্গি মোছ! কারো বা হাফ-দাড়ি মোছ বা জুলফি-জোড়া মোছ। কারো বা দাড়ি-মোছ একেবারেই ছিলা! এরা সকলেই মহানবী ও ও তার অনুসারীদের বিরোধী। অনেকের দাড়ি আছে, তবে তা মহানবীর অনুকরণে নয়; বরং তা হয়তো লেনিন বা কার্লমার্কসের অনুকরণে, নচেৎ কোন প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব বা হিরোর অনুকরণে। যার দরুণ তাদের দাড়ি-মোছ ইসলামী ছাঁচ বা কাটিং মত নয়। ফ্যাশন মনে করে রাখে, এক সপ্তাহে ছাঁটে, পরের সপ্তাহে চাছে। কাউকে ছাঁটতে বা চাছতে নিষেধ করলে বুকের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, “ঈমান তো এখানে!’ অর্থাৎ, দাড়িতে নয়। কিন্তু তার জানা নেই যে, ঈমানের মূল আছে অন্তরে, আর তার কান্ড ও শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অঙ্গে ও কর্মে। সুতরাং দাড়ি রাখাও হল ঈমানের এক শাখা এবং তা ওয়াজেব।
পক্ষান্তরে আর এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা মুসলিমকে ধোকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে মেকি দাড়ি রাখে। এরা দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। চুল-দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেলে সাদাই রেখে দেওয়া বিজাতীয় আচরণ। তাই ইসলামের আদেশ হল, তা কালো ছাড়া অন্য কোন রঙ দ্বারা রঙিয়ে ফেল এবং বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করো না। (বুখারী ৩৪৬২, মুসলিম ২১০৩ নং, আহমাদ, ত্বাবারানী, সহীহুল জামে’ ১০৬৭, ৪৮৮৭ নং)
মহিলাদেরকে বেপর্দায় রাখা হল জাহেলী যুগের মানুষদের অনুকরণ। (সূরা আহযাব ৩৩ আয়াত) বরং বর্তমান বিশ্বের সমগ্র জাতির অন্ধ অনুকরণ হল মহিলাদের আব্রু ও পর্দাহীনতায় বেগানা পুরুষের সামনে যাওয়া। মাথায় পরচুলা ব্যবহার ইয়াহুদী মেয়েদের আচরণ। অতএব তা কোন মুসলিম নারী ব্যবহার করতে পারে না। (মুসলিম ২৭৪২ নং) কেউ এলে তার জন্য দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো; যেমন, কোর্টে হাকীমদের জন্য, পার্লামেন্টে স্পীকার মন্ত্রীদের জন্য, স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের জন্য অথবা কোন আলেম-বুযুর্গের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে তা’যীম প্রকাশ করা বিজাতীয় আচরণ। কোন মুসলিমের জন্য তা বৈধ নয়। (মুসলিম ৪১৩, আবু দাউদ ৫২৩০ নং প্রমুখ) বৈধ নয় কোন মৃত বা তার আত্মার উদ্দেশ্যে কয়েক মিনিট দাড়িয়ে নীরবতা পালনের সাথে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন৷ কারণ, এ প্রথাও বিজাতির নিকট থেকে ধার করা প্রথা।
গুরুজনদেরকে সালাম দেওয়ার সময় অনেকে প্রণামের অনুকরণ করে তাদের পা ছুঁয়ে সে হাত কপালে ও বুকে ঠেকিয়ে সম্মান জানায়। এ ছাড়া এই সালামে অনুপ্রবেশ করেছে আরো অনেক কিছু বিজাতীয় কায়দা।
ইসলামে এক মুসলিম অপর মুসলিমকে সাক্ষাৎ করলে যে অভিবাদন আছে, তা অন্য কোন জাতির নেই। একই সঙ্গে অভিবাদন, দুআ ও কল্যাণ কামনা অন্য কোন শব্দ ও ভাষাতে নেই। সুপ্রভাত, শুভসন্ধা, নমস্কার আর যাই বলুন না কেন সালাম’-এর সমতুল কিছুই নয়। তবুও যেন এই অতুল শব্দগুচ্ছের অভিবাদনকে পরিহার করে মুসলিম পরিবেশেও ইংরেজী কায়দায় 'গুড মর্নিং’ গুড় এভেনিং' প্রভৃতি বলে পশ্চিমী ধারায় সালাম জানানো হয়, সৈনিক পর্যায়ে সেলুট করা হয় ঐ একই কায়দায়। মৃতব্যক্তিকেও শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করা হয় ঐ পশ্চিমী ছাঁচে। ইংরেজ কালচারের জয়-জয়কার যেন সর্বত্র। পোশাকেই বলুন, চাল-চলনেই বলুন, আর তাদের বুলি-বচনের কথাই বলুন, আমরা হাতে-কলমে প্রাত্যহিক কাজ-কর্মে এই প্রমাণই রাখছি যে, আমরা তোমাদের ছিলাম, তোমাদেরই আছি। এবং তোমাদের হয়েই থাকব।' (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ২৪পৃঃ)
মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি আমাদেরকে ছেড়ে অন্যের অনুকরণ করে, সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়। তোমরা ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন (অনুকরণ) করো না। ইয়াহুদীদের সালাম হল আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করা এবং খ্রীষ্টানদের সালাম হল হাত দ্বারা ইশারা করা।” (তিরমিযী ২৮৪৮, সিলসিলাহ সহীহাহ ২১৯৪নং)*
বলা বাহুল্য যে, পোশাকে আমরা যা ব্যবহার করি, তা ওদেরই দেখে শেখা; যাতে বসে পেশাব করা যায় না, ইদ্দত যথার্থরূপে গোপন হয় না, গাটের নীচে ঝুলিয়ে না পরলে ফ্যাশন। জমে না। আর আমাদের স্ত্রী-কন্যা-বোনদেরকে যা পরিয়েছি তাও ঐ ‘ম্যাডাম’দের অনুকরণ। আলোকপ্রাপ্তা করার উদ্দেশ্যে যথা সম্ভব তাদের উন্মুক্ত হাঁটুতে, জাঙ্গে, বুকে, মাথায়, পিঠে ও নাভিতে সূর্যের আলো দিয়ে থাকি।
অনেকে বাড়িতে কুকুর পুষতে শুরু করেছে ওদের দেখাদেখি। বিবাহের পূর্বে কোর্টশীপ বা বর-কনের অবাধ মিলন ও হৃদয়ের আদান প্রদান, পয়গাম বা বাদানের সময় পয়গামের আংটি পরাবার প্রথা ইত্যাদিও ওদের নিকট থেকে অনুপ্রবেশ করেছে আমাদের সমাজে। নাম রাখাতেও অনুকরণ করা হচ্ছে বিদেশী কায়দার। অমুসলিমরা কোনদিন ভুল করেও নিজেদের ছেলে-মেয়েদের মুসলমানী নাম রাখে না। অথচ মুসলিমরা এ কাজ বড় গর্বের সাথে ফ্যাশন মনে করে পালন করে থাকে।
আর এ সবের মূল কারণ হল, আজকের মুসলিম হীনম্মন্যতার শিকার। মানসিক আগ্রাসনের শিকার হওয়ার ফলে বিজাতীয় সব কিছুকে লুফে নিতে প্রগতি ধরে নিয়েছে। সাধারণতঃ যে দুর্বল হয়, সে হয় প্রভাবশীল। আর সবল হয় প্রভাবশালী। মুসলমান মানসিক দুর্বলতার শিকার হয়ে নিজেকে প্রভাবশালী না করে প্রভাবশীল করে ফেলেছে।
ইসলাম আসার পূর্বে জাহেলী যুগ ছিল অন্ধ মূর্খতার যুগ। ভ্রষ্টতার অন্ধকার ছিল ঘন কালো হয়ে মানুষের মনে ও সমাজে। সে যুগের সেই অসভ্যতার কৃষ্ট তমসাচ্ছন্ন বিভাবরী ভেদ করে সভ্যতার সূর্য উদিত করল ইসলাম। দুর হল মুখতা ও ভ্রষ্টতার অন্ধকার, অপসৃত হল মনের কালো। নিন্দিত হল জাহেলিয়াতের সকল কর্ম। সুতরাং সে সব কর্ম ও প্রথা কোন মুসলিম যে গ্রহণ করতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। জাহেলী প্রথা যেমন, মৃতব্যক্তির জন্য মাতম করে শোক পালন করা, মর্সিয়া গাওয়া, বংশ নিয়ে গর্ব করা, অপরের বংশে খোটা দেওয়া, রাশিচক্রে বিশ্বাস রাখা, (মুসলিম ৯৩৫ নং) নিজের দেশ, ভাষা, মযহাব, গোত্র, রঙ, বর্ণ প্রভৃতিতে অন্ধ-পক্ষপাতিত্ব করা ইত্যাদি।
সকল মুসলিম ভাই-ভাই। তাদের মাঝে ভেদাভেদের কোন প্রাচীর নেই। বর্ণ-বৈষম্যের অভিশাপ থেকে মুসলিম সমাজ সম্পূর্ণ মুক্ত। এ সমাজের সকলেই সমান অধিকারের দাবিদার। “সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হল সেই ব্যক্তি, যে সব চেয়ে বেশী মুত্তাকী ও পরহেযগার।” (সূরা হুজুরাত ১৩ আয়াত) এমন কিছু আচরণ আছে যা মানুষের নয়, শয়তানের। মুসলিম শয়তানের অনুকরণ করে সে সব আচরণ করতে পারে না। যে শয়তান, তার সকল কর্ম শয়তানীতে ভর্তি। এমন কি আপাতঃদৃষ্টিতে যে কাজ মুসলিমের জন্য ভালো মনে হয় সে কাজ শয়তানের তরফ থেকে হলে জানতে হবে ঐ ভালোর মাঝে কোন কালো ভরে ফেলেছে, অপেক্ষাকৃত কোন বড় ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে।
অতএব শয়তানের শয়তানীতে অনুকরণ করা কোন মানুষের জন্য শোভনীয় হতে পারে না। বাম হাতে খাওয়া-পান করা এক শ্রেণীর মানুষের ফ্যাশন। ডান হাতে চা, বাম হাতে বিস্কুট, অথবা ডান হাতে পেন্সি বা জুস এবং বাম হাতে কেক ইত্যাদি খেয়ে তারা আধুনিকতা প্রদর্শন করে থাকে। অথচ পাশ্চাত্যের অনুকরণে এ আধুনিকতা ও ফ্যাশন হল আসলে শয়তানের। মহানবী বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন তার বাম হাতে পানাহার না করে। কারণ, শয়তান তার বাম হাত দিয়ে পানাহার করে থাকে।” (মুসলিম ২০১৯, তিরমিযী, সহীহুল জামে ৭৫৭৯ নং)
অনেক যুবক অহংকার প্রদর্শন করে ঔদ্ধত্যের সাথে বলে, বাম হাতের দোষ কি? সে হাতে খেলে ক্ষতি কি? আর তারা হয়তো এ কথাও বলে, ডান হাত লাটসাহেব নাকি? সে হাত দিয়ে পায়খানা সাফ করলে ক্ষতি কি? কিন্তু ফলকথা হল এই যে, রুচি যখন বিকারগ্রস্ত হয়, তখন স্বাদ পার্থক্য করার মত ক্ষমতাও আর থাকে না এক শ্রেণীর রোগীর কাছে। অবশ্য এমন রোগীর সত্বর চিকিৎসা করা যে জরুরী, তা হয়তো বলা নিষ্প্রয়োজন। লেবাসে-পোশাকে, চলনে-বলনে, ভাবে-ভঙ্গিতে আচরণে-প্রসাধনে নারী-পুরুষের একে অন্যের অনুকরণ করা এক চারিত্রিক দোষ। দাড়ি-মোছ চেঁছে, চুল লম্বা রেখে, ছাপা লুঙ্গি-জামা পরে, গাঁটের নীচে মাটিতে পরিহিত কাপড় ঝুলিয়ে, পাউডার মেখে, হাতে বালা, গলায় সোনার হার ইত্যাদি পরে মহিলাদের অনুকরণ করে থাকে এক শ্রেণীর লারেলাপ্পা’ মার্কা যুবক।
পক্ষান্তরে চুল হেঁটে ছোট করে, পরিহিত কাপড় গাটের উপর, বরং হাঁটুর উপর তুলে, প্যান্ট-শার্ট পরে, অঙ্গ-ভঙ্গিতে পুরুষের মত গটগট করে চলে এক শ্রেণীর আধুনিকা ‘ম্যাডাম’-এর দল। যাদেরকে পিছন থেকে দেখলে কোন দর্শক সহজে ঠাওর করতে পারে, সামনে ওটা ছেলে চলল, না মেয়ে? প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়ামক নারী-পুরুষের মাঝে বড় পার্থক্য রেখেছেন। যা অস্বীকার করলে এবং নারী-পুরুষকে সকল ময়দানে একাকার করে। দিলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সমাজে যে উচ্ছলতা ও অনৈতিকতা তথা অশান্তির ঝড় দেখা দেবে, তা বহু সমাজ-বিজ্ঞানী স্বীকার করেছেন।
যুগের ধর্ম এই
বারুদে-আগুনে একই করিলে জ্বালাইবে তোমাকেই।
শ্রেষ্ঠ সমাজ-বিজ্ঞানী নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, “আল্লাহ সেই পুরুষকে অভিশাপ করেন, যে নারীর পোশাক পরিধান করে এবং সেই নারীকে অভিশাপ করেন, যে পুরুষের পোশাক পরিধান করে।” (আবু দাউদ, হাকেম, সহীহুল জামে ৫০৯৫ নং) তিনি বলেন, “পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, মেড়া পুরুষ এবং পুরুষের বেশধারিণী মহিলা জান্নাতে যাবে না।” (নাসাঈ, বাযযার, হাকেম ১৭২, সহীহুল জামে’ ৩০৬৩ নং) তিনি নিজেও পরস্পরের বেশধারী নারী-পুরুষকে অভিশাপ করেছেন। (বুখারী ৫৮৮৫ নং, প্রমুখ) এবং আরো বলেছেন যে, “সে পুরুষ আমাদের দলভুক্ত নয়, যে কোন নারীর সাদৃশ্য অবলম্বন করে। অনুরূপ সে নারীও আমাদের দলভুক্ত নয়, যে কোন পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ৫৪৩৩ নং)
আমাদের সমাজের যুবকদলের মনকে যে শ্রেণীর মানুষ অধিকরূপে জয় ও আকৃষ্ট করতে পেরেছে, তারা হল ফিল্মী দুনিয়ার তারকা নায়ক-নায়িকারা। কাল্পনিক কাহিনীর অভিনয়ের মাধ্যমে তারা অধিকাংশ তরুণ-তরুণীর হৃদয়-কোণে বাসা বেঁধে নিয়েছে। এরা তাদেরকে এত ভালোবাসে যে, তাদের ছবি দিয়ে নিজেদের ঘর সাজায়, প্রাইভেট এ্যালবামে রাখে, তাদের ছবি ও খবর প্রকাশক পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে সাগ্রহে পড়ে মনে আমেজ নিয়ে থাকে। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে তাদের অনুকরণ করার চেষ্টা করে। যৌন-জীবনে তো বটেই, এছাড়া সামাজিক জীবনেও তারা হয় এদের একমাত্র আদর্শ। তারা চলচ্চিত্র জগতের তারা, এদের মনের আকাশের তারা, এদের চোখেরও তারা। আর সেই তারা দেখেই রাতের আঁধারে পথ নির্ণয় করে। তাদেরই অনুগ্রহ ও অনুকরণে তৈরী হয় মস্তান যুবক-যুবতী।
এক শ্রেণীর যুবক নজরে পড়ে, যাদের শার্ট বা পাঞ্জাবীর বুকের বোতাম খোলা, ফুলহাতা জামার হাত গুটানো, হাতে বালা বা সূতো বাধা, মাথায় এক ঝাকা চুল। তাদের পরনের লুঙ্গি, পায়জামা বা প্যান্ট রাস্তায় ঝাড়ু মেরে যায়। পিছন থেকে দেখে মনে মনে প্রশ্ন জাগে, ওটা ছেলে না মেয়ে? সামনে না এলে হয়তো বুঝাও যায় না। এদেরকে নাকি মস্তান’ বলে। মস্তান। হল ফার্সী শব্দ; যার অর্থ পাগল। তাহলে এরা কি আসলে পাগল? হ্যা ফিল্মের দেওয়ানা ও হিরো-হিরোইনের প্রেমে পাগল। অথবা তারা অন্যান্যদেরকে পাগল ভাবে। তাদের ঐ হিরোহিরো ভাবের মন বলে, আমাদের বুকে পাটা আছে, তাই বুক খুলে চলি। আমরা কোন নিয়ম বা আদব-কায়দা মানি না, কাউকে আদৌ ভয় করি না। খোলা বুকই তার প্রমাণ। বাহুতে আছে। প্রবল শক্তি, তার প্রমাণ হল হাতে বাধা সুতো অথবা লোহার বালা। চিত্র-তারকাদেরকে তারা এত ভালোবাসে যে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাদেরই অনুকরণে গঠিত। তাদের নামে চুলের কাট, শার্টের কাট, প্যান্টের কাট, প্রভৃতি বড়ই প্রচলিত এদের কাছে।
তাদের প্যান্টের নীচ অংশ হাই হীল জুতার নীচ পর্যন্ত গড়ায়, পথের ময়লা প্যান্টের কাপড়ে সাফ হয়। তারা চক্কর-মক্কর রংগীন কাপড়ে জামা তৈরী করে সার্কাসের রংবাজ সাজে। মহিলাদের ব্লাউজের কাপড় ওরা দখল করেছে বলে মহিলারা এক রংগা কাপড়ে সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ তৈরী করে মনের দুঃখে পেট বের করে চলেন। সোনা মানিকরা বুক উদাম করে চলে, আর তাদের সম-মনা মহিলারা পেট বের করে চলেন। তাদের কেউ কেউ স্বদেশী গান পরিবেশনের স্টাইল ছেড়ে দিয়ে পশ্চিমা কায়দায় কোমর দুলিয়ে গান করে বেড়ায়। ওরা পুরুষ হয়ে কোমর দুলিয়ে যখন গান গায়, তখন নাচনেওয়ালীরাও শরমে মুখ লুকায়। আসলে তারা বহুরূপী, তাই বিশেষ কোন এক রূপে তাদের দেখা যায় না।
অনুকরণে সোনামানিকরা বানরকেও লজ্জা দিয়েছে। এ জন্য স্বদেশী বানরকুলকে আমেরিকা নিতে চাইলেও ওদের নিতে চায় না। মাথার পিছনের দিকে তারা চুল এতই লম্বা রাখতে শুরু করেছে, যে জন্য ওদের সম-মনা মহিলারা সোনা-মানিকদের উপর রাগ করে লম্বা চুল কেটে বব কাটিং চুল রাখতে শুরু করেছে। হাতের নখ লম্বা রেখে ওরা বাঘ-ভাল্লুক সাজতে চাচ্ছে। তাদের এ অবস্থা দেখে আমরা যেমন ভয় করি, তেমনি মানবজাতির একাংশের পশুজীবনে ফিরে যেতে দেখে মনে দুঃখও পাই। (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ২৯পৃঃ)। এদের নাদুস-নুদুস চেহারা ও ভাব-ভঙ্গিমা দেখে মনে হয়, ওরা যেন কোন আমীরজাদা।
অথচ অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, বাহিরে কেঁাচার পত্তন, ভিতরে ছুঁচোর কিত্তন। যৌবনের উন্মাদনায় এরা ধরাকে সরাজ্ঞান করে। বেপরোয়া হয়ে বুক ফুলিয়ে চলে, বগলে রেডিও বা টেপ, গাড়িতে টেপ অথবা বাড়িতে টেপ, রেডিও বা টিভির শব্দে পার্শ্ববর্তী লোকদের ঘুম ও ইবাদত নষ্ট করে, জ্বালাতনে মন তিক্ত করে। বিড়ি-সিগারেট খায় বড় সাহেবী স্টাইলে। কাউকে কিছু বলতে গেলে মুখের উপরে ধুয়ো ছেড়ে লাল চোখে তাকিয়ে শাসিয়ে থাকে! মস্তানীবশে অনেকের উপর অন্যায় স্বেচ্ছাচারিতা চালায়। জোর-যুলুম করে নারীর সতীত্বনাশ, শ্লীলতাহানি, মানী-গুনীর অপমান, কারো জায়গা জবরদখল, চাঁদাবাজি অথবা সেলামী’ আদায় করে থাকে।
অথচ যুলুম হল কিয়ামতের দিনের অন্ধকার। মযলুমের হৃদয় থেকে বিষ-জ্বালায় যে আঃ বা ‘উঃ শব্দ বের হয়ে আসে, তা যে মস্তানের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে তা হয়তো অনেকেই জানে না। মহানবী বলেন, “তোমরা মযলুমের বন্দুআ থেকে সাবধান থেকোযদিও সে কাফের হয়। কারণ, ঐ দুআ ও আল্লাহর মাঝে কোন অন্তরাল থাকে না।” (সহীহুল জামে ২৬৮২ নং) অর্থাৎ, সেই বদুআ যালেমের হক্কে সত্বর লেগে যায়। হে মস্তান বন্ধু যে অহংকার তুমি আজ প্রদর্শন করছ, যে গর্বের সাথে মাটির বুকে চলাফেরা করছ, জানো কি, তা তোমার জন্য পরকালে কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনবে? যে হৃদয়ে সরিষা-দানা পরিমাণ অহংকার থাকে, সে হৃদয়ের মানুষ বেহেশ্ব যেতে পারবে না। অহংকারবশে যে সত্য প্রত্যাখ্যান এবং মানুষকে ঘৃণা করে, তাকে সাজা ভুগতে হবে দোযখে। (আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে ৭৬৭৪ নং)
যে মানুষ অহংকারবশে পরনের কাপড় গাটের নীচে ঝুলিয়ে পরে মাটিতে হেঁচড়ে নিয়ে বেড়ায়, আল্লাহ তাআলা কাল কিয়ামতের দিন সে মানুষের দিকে তাকিয়েও দেখবেন না, তার সহিত কথাও বলবেন না, তাকে গোনাহমুক্ত বা ক্ষমাও করবেন না। আর তার জন্য হবে কঠিন শাস্তি। (মুসলিম ১০৬নং, আসহাবে সুনান) হে বন্ধু! উপদেশ গ্রহণ কর,“(অহংকারবশে) মানুষের প্রতি বিমুখ হয়ো না, (কাউকে অবজ্ঞা করো না) এবং পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না। কেন না, আল্লাহ গর্বিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা লুকমান ১৮ আয়াত)
হ্যা, তোমার মস্তানীর ফলে কিছু লোক হয়তো তোমাকে বাহাদুরী দেবে। কিছু লোক দেবে সম্মান। কিন্তু তা কি তাদের অন্তর থেকে? না কি তোমার অনিষ্টের ভয়ে? দুশমনকে উচু পিঁড়ে দেওয়ার মত লোক তোমাকেও সম্মান করে না কি? যদি তাই হয় তাহলে শোন, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক তারা, যাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য তাদের তোয়া করা হয়।” (আবু দাউদ, সহীহুল জামে’ ৭৯২৩ নং)
আর “আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক কঠোর-হৃদয় দাম্ভিককে ঘৃণা করেন, যে বাজারে হৈ-হাল্লা ও গলাবাজি করে বেড়ায়, যে রাত্রে মড়ার মত ঘুমায় এবং দিনে গাধার মত মেহনত করে, যে পার্থিব জ্ঞান রাখে, কিন্তু পরকাল বিষয়ে অজ্ঞ থাকে।” (বাইহাকী ১০/ ১৯৪, সহীহুল জামে’ ১৮৭৮ নং) “শ্রেষ্ঠ তো সেই ব্যক্তি, যে তার আখলাক-চরিত্রে শ্রেষ্ঠ।” (ইবনে মাজাহ হাকেম, সহীহুল জামে ১১২৮ নং) “শ্রেষ্ঠ মানুষ হল সেই ব্যক্তি, যে অপরের সাথে মিশতে পারে এবং অপরেও তার সাথে মিশতে পারে।” (সহীহুল জামে' ২৩১ নং) অতএব তুমি কি চাও না সেইরূপ শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে?
এক বন্ধু বলল, হুযুর! আমি মনে করি, আমরা অন্যায় করি না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। জানেন না, লোহা দিয়ে লোহা কাটে? আমরা পড়ে থাকা ঋণ আদায় করে দিই, উপেক্ষিতা। নারীকে তার স্বামীর ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসি; স্বামী তাকেই নিয়ে সংসার করতে বাধ্য হয়। জোর করে চাঁদা নিই ঠিকই, কিন্তু সেই টাকা দিয়ে অনেক গরীবদের খিদমত করি। বিধবাদের দেখাশোনা করি, গরীব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিই। --- ইত্যাদি।
আমি বললাম, কিন্তু বন্ধু! পেশাব দিয়ে পায়খানা ধুয়ে লাভ কি? পায়খানার গন্ধ গেলেও পেশাবের দুর্গন্ধ ও নাপাকী তো আর কম নয়। উল্লেখিত ভালো কাজগুলোর জন্য যাকাত ও দান-খয়রাতের অর্থ আদায় করে ফান্ড তৈরী কর।
বলল, হুযুর। লোকে যাকাত দিলে ও দান-খয়রাত করলে কি আর আমাদেরকে মস্তানী করতে হত? সমাজই তো মস্তান তৈরী করে। পরিস্থিতির চাপে পড়েই অনেকে চোর-গুন্ডাবদমাশ হয়। বললাম, যা অন্যায় তা অন্যায়। কোনও সৎ উদ্দেশ্যে অন্যায় করা যেতে পারে না। যদিও বহু মস্তান অনুরূপ সৎ উদ্দেশ্য প্রকাশ করে অধিকাংশে নিজেদেরই প্রবৃত্তি-পূজা করে থাকে।
অতএব হে যৌবনমদে মত্ত মস্তান ভাই আমার। অসংযত চরিত্রকে সংযত করে মস্তানি ছাড়, যাতে পরে পস্তানি না হয়। উদ্ধৃঙ্খল চরিত্র ও দৈহিক বলের জোরে পাড়ায় পাড়ায় সরদারি করার নামে উপদ্রব ও যুলুম করে বেড়ায়ো না। কারণ, জেনে রেখো যে, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পাকড়াও বড় শক্ত। যখন ধরা খাবে, তখন জান ছুটানো দায় হয়ে পড়বে। একথা সুনিশ্চিত।
হে প্রাণচঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর!’ পরোপকারে ব্রতী হও, তবে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে। কর্ম-বিমুখ হয়ে পরের ধনে পোদ্দারি বা সর্দারি করে নয়। হে ‘বগাহীন শৃঙ্খল-ছেড়া প্রিয় তরুণ! তুমি তোমার জীবনে শৃঙ্খলতা ফিরিয়ে এনে চেষ্টা কর, যাতে সমাজে খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, অরাজকতা প্রভৃতির যুলুমবাজির সকল দরজা যেন চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। যেন বন্ধ হয়ে যায় দখলতন্ত্র বা লাঠি যার, মাটি তার’-এর নীতি। হে ‘অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত’ যুবক বন্ধু আমার শান্তি ও শৃঙ্খলা কোথায় আছে জানো? শান্তি আছে সত্য বিশ্বাসে৷
শৃঙ্খলা আছে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণে ও তার আনুগত্যে। শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে। দ্বীনের আশ্রয় নাও, তোমার সকল সমস্যার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। সমাজের আকাশ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নেবে পাপ-ঝড়ে বয়ে আনা। অশান্তির বজ্ৰবাহী কালো মেঘ। অন্ধানুকরণের কথা ছাড়ার পূর্বে নায়িকাদের দেখাদেখি সাজা মস্তান যুবতীদের কথা আর বলে পারছি না। এ কথা বিদিত যে, ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অধিক অনুকরণ-প্রিয়। একটা মডেল বা ফ্যাশন বাজারে নামলে তা ধরার জন্য ধৈর্য হারিয়ে ফেলে মেয়েরা।
বিশেষ করে আধুনিকারা অনুকরণ করে তথাকথিত প্রগতিবাদিনীদের; অর্থাৎ, যাদের নৈতিকতার গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাদের। অনুকরণ করে যৌন-স্বাধীনতাকামীদের; অর্থাৎ, যারা উপচীয়মান যৌবনকে কেবল এক জনের অধীন করে রাখে না তাদের। তাই তো এমন যুবতীর কেশবিন্যাস সাধনার মত সাধনা কাটের অথবা বাবরের মত বাবরী কাটের। মালবিকার ন্যায় সিঁথিতে সিন্দুর, বিন্দিয়ার ন্যায় কপালে টিপ, কানে লম্বা বা রথের চাকার মত বড় দুল, কোন অভিনেত্রীর মত কপালের ভ্রু চিকন করে চাঁছা, এ ছাড়া চোখের জন্য, চোখের পাতার জন্য, গালের জন্য, ঠোটের জন্য পৃথক পৃথক ‘মেকআপ তো আছেই। পরনে আছে ইউ’ বা ‘ভি’ কাটিং-এর নকশা করা খাটো ব্লাউজ। পাতলা শাড়ির কেঁাচার থাক গোজা আছে নাভির নীচে। বুকের আঁচল খানাও বেশ থাক করে সুবিন্যস্তরূপে লম্বালম্বি বাম কাঁধে চাপানো আছে; যাতে সাইড থেকে বুকে-পেটে-পিঠে হাওয়া ও আলো পায় এবং ব্লাউজের ‘কাম’ দেখিয়ে চেংড়া’দের মনে কাম সৃষ্টি করা যায়। অথবা পরিধানে আছে আধুনিক কাটিং-এর শেলোয়ার-কামিস। ওড়না খানা ‘ফর শো’ বুকে থাকানো আছে।
আর এর চাইতে বেশী আলোকপ্রাপ্তা হলে উপর দিকে থাকে আধুনিক টাইট-ফিট অর্ধ বুক খোলা গেঞ্জি অথবা ব্লাউজ এবং নীচের দিকে চোস্ত প্যান্ট অথবা সংকীর্ণ স্কার্ট; যা হাঁটু অবধি খোলা। তার পরেও পিছন দিক হতে ইঞ্চি তিনেক কাটা! পক্ষান্তরে আরো অত্যাধুনিকা হলে পরে সিন্থিয়ার মত বগল-কাটা ব্লাউজ অথবা গেঞ্জি। হাতের আঙ্গুলগুলোতে আছে হ্যালেনের মত লম্বা-লম্বা নখ, তার উপর পুরু নখ-পালিশ। পায়ে আছে উচু পেনসিল-হিল জুতো।
এরপর চুলে আছে শ্যাম্পুর সুগন্ধ, গালে আছে ক্রিমের সুবাস, গলায় ও বুকে আছে পাওডারের সুঘ্রাণ, আর লেবাসে তো পারফিউম স্প্রে করা আছেই। অতঃপর কাধে একটি ভ্যানিটি ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ির খাঁচা থেকে যখন বের হয়, তখন কি জানি কোন কাজে যায়, নাকি কারো বাসরে?
পক্ষান্তরে বিভিন্ন বাহারের অঙ্গসজ্জা করে আবেদনময়ী মস্তানা চলন ও অঙ্গভঙ্গি চুম্বকের আকর্ষণে পুরুষের দৃষ্টি ও মন লোহা যে আকৃষ্ট হবে, তা বলাই বাহুল্য। ফুল বর্ষণ হবে যৌনদৃষ্টি ও কুমন্তব্যের। অবশ্য এমন প্রসাধিকার এটাই তো আকাঙ্খা, এটাই তো লাভ। প্রগতির ঘোড়ায় চড়ে এরা চায় ভাব দেখিয়ে লাভ করতে যৌন আবেদন থাকে এদের চেহারা ও চরিত্রে, চলনে ও বলনে, আচরণ ও চাহনিতে, পোশাকে ও প্রসাধনে, ভাবে ও ভঙ্গিতে। এখানেই ঘায়েল হয়ে যায় বহু যুবক অথবা ঘায়েল হয় বহু এমন প্রসাধিকা আধুনিকারা। শুরু হয় প্রেম অথবা ঘটে যায় ধর্ষণ ও বলাৎকার।
আলোকপ্রাপ্তা যুবতীদের ছ্যাবলা পোশাক ও চাঞ্চল্য-ভরা আকর্ষণময় চলন নজরে পড়লে প্রিয় নবী (সা.) এর এক নবুয়ত-বাণী মনে পড়ে যায়; তিনি বলেন, “যদি তোমার লজ্জা না থাকে, তাহলে যা মন তাই করতে পার।” (আহমাদ, বুখারী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে’ ২২৩০ নং) অর্থাৎ, কেবল নির্লজ্জরাই এমন বেহায়ামী প্রদর্শন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে এমন নারীদের জন্য আরো কয়েকটি মহাবাণী উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানব। মহানবী ও বলেন, 'প্রত্যেক চক্ষুই ব্যভিচার করে থাকে। আর মহিলা যদি (কোন প্রকার) সুগন্ধ ব্যবহার করে কোন (পুরুষদের) মজলিসের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, তবে সে বেশ্যা মেয়ে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ প্রমুখ, সহীহুল জামে’ ৪৫৪০ নং)
তিনি বলেন, “দুই শ্রেণীর মানুষ দোযখবাসী হবে, যাদেরকে এখনো আমি দেখিনি। এদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ হল, সেই মহিলা দল; যারা কাপড় পরা সত্ত্বেও যেন উলঙ্গ থাকবে, এরা (পরপুরুষকে নিজেদের প্রতি) আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও (তাদের প্রতি) আকৃষ্ট হবে। (চুলের খোপার কারণে) তাদের মাথা হবে হিলে যাওয়া উটের কুঁজের মত। তারা বেহেশু প্রবেশ করবে না এবং তার সুগন্ধ পর্যন্তও পাবে না; অথচ তার সুগন্ধ বহু বহু দূরবর্তী স্থান থেকে পাওয়া যাবে।” (মুসলিম ২ ১২৮ নং) তিনি বলেন, “তোমাদের সবচাইতে জঘন্যতম নারী হল তারা, যারা বেপর্দা, যারা অহংকারের সাথে অন্যের অনুকরণে নিজেদের অঙ্গসজ্জা ও বহুরূপ প্রদর্শন করে থাকে। ওরাই হল কল্পট নারী। এদের মধ্যে কিঞ্চিৎই কেউ বেহেস্তে যেতে পারবে।” (বাইহাকী ৭/৮২, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৮৪৯ নং)
আর বন্য-সুন্দরী বাঘিনীদের উদ্দেশ্যে বলি যে, লম্বা নখ রাখা মানব-প্রকৃতির বিরোধী কর্ম। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “পাঁচটি কর্ম হল মানব প্রকৃতির স্বভাবসুলভ কর্ম; খতনা করা, লজ্জাস্থানের লোম চেঁছে ফেলা, মোছ ঘেঁটে ফেলা, নখ কেটে ফেলা এবং বগলের লোম দূর কর।” (বুখারী, মুসলিম, প্রভৃতি, সহীহুল জামে’ ৩২৫০ নং)
“আল্লাহর রসূল (সা.) মোছ ছাটা, নখ কাটা, বগলের লোম তুলে ফেলা এবং গুপ্তাঙ্গের লোম চেঁছে ফেলার ব্যাপারে সময় নির্ধারিত করেছেন; যাতে ৪০ দিনের বেশী সময় তা রেখে না দেওয়া হয়।” (আহমাদ ১২২, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ)।
আর পরিবারের মুরব্বী ও বাড়ির গুরুজন তথা অভিভাবকদেরকে মহানবী (সা.) এর এক মহাবাণী স্মরণ করিয়ে দিই। তিনি বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তির নিকট থেকে তার দায়িত্ব বিষয়ে (কিয়ামতে) কৈফিয়ত নেবেন; সে কি তা যথার্থ পালন করেছে, নাকি অবহেলা করে দায়িত্বে দেওয়া জিনিসকে নষ্ট করেছে? এমন কি পুরুষকে তার পরিবারের সকল সদস্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।” (নাসাঈ, ইবনে হিব্বান, সহীহুল জামে' ১৭৭৪নং)
জীবন এক অচিন দেশের সফর। আর অজানা পথের সফরে বিভিন্ন নদী-উপত্যকা, মরুপর্বত, সমুদ্র-জঙ্গল পার হয়ে ফিরে যেতে হবে আপন দেশ বেহেশ্যে। যে সফর এক দিনের নয়, এক মাসের নয়, নয় এক বা কয়েক বছরের। জীবন ভরের এই সফর সহজও নয়। কত সমস্যা, কত বাধা-বিঘ্ন, কত বিপদ-আপদ এসে উপস্থিত হয় এই লম্বা সফরের দ্বারপ্রান্তে। সুতরাং এ সফরের জন্য যেমন গাইড-বুক ও মানচিত্র চাই, তেমনি চাই মনের মত সহায়ক সঙ্গীও। মুসলিম মুসাফিরের গাইড-বুক হল আল-কুরআন, মানচিত্র হল মহানবীর আদর্শ, তরীকা বা সুন্নাহ। আর সহায়ক সঙ্গী হল আদর্শ স্ত্রী ও বন্ধু।
কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করার জীবন-সন্ধিক্ষণে এবং বিবাহের পূর্বেও সেই সঙ্গী ও বন্ধুর খোজ থাকাটা প্রায় মানুষেরই প্রকৃতিগত ব্যাপার। মানুষ যার পাশে বসে, যার সঙ্গে চলা-ফিরা করে মনে আনন্দ পায়। ভারী কথা তার নিকট বলে মনের বোঝ হাল্কা করে। নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে ডুবে থাকা হৃদয়ে সঙ্গতার আলো জ্বালিয়ে জীবনের বিভিন্ন সুখ ও সঙ্কট মুহূর্তে সহায়ক সাথী ও হিতাকাঙ্খী পরামর্শদাতার উৎসাহদান ও অনুপ্রেরণা পায়।
আর বলাই বাহুল্য যে, মনের মত সঙ্গীর সাথে কথা বলে যে আনন্দ পাওয়া যায়, সে আনন্দ আর অন্য কিছুতে পাওয়া যায় না। অন্য দিকে যার প্রকৃত বন্ধ, আছে, তার সকল ত্রুটি দেখার জন্য আর দর্পণের প্রয়োজন হয় না।
অবশ্য এমন লোকও বহু আছে, যাদের চুন খেয়ে গাল তেঁতেছে, ফলে দই দেখেও ভয় পায়। অর্থাৎ, বন্ধুত্বের বাজারে ঠকে বা কাউকে ঠকতে দেখে একাকী থাকতে পছন্দ করে এবং মোটেই কোন মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। ফলে মাথা ব্যথা করলে তা সারার চেষ্টা না করে, মাথাটাই কেটে ফেলার ফায়সালা করে নেয়। অথচ মহানবী (সা.) বলেন, “যে মু'মিন মানুষের মাঝে মিশে তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে সেই মু’মিন ঐ মু'মিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে লোকেদের সাথে মিশে না এবং তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে না।” (আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে' ৬৬৫১নং)
অন্য দিকে আর এক শ্রেণীর তরুণ ও যুবক আছে, যারা বন্ধুত্বে অতিরঞ্জন করে। ফলে ধোকা খেতে হয় তাকে। ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন, লোকেদের সাথে না মিশলে শত্রুতার উদ্ভব হয়। পক্ষান্তরে অধিকভাবে (অনেকের সঙ্গে) মিশলে অসৎ সঙ্গীও প্রশ্রয় পায়। অতএব তুমি এ দুয়ের মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর।
বন্ধুত্ব করা উচিত। তবে তা কোন পার্থিব স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে নয়। বন্ধুত্ব হতে হবে। আল্লাহর ওয়াস্তে। অর্থাৎ, একজনকে ভালোবাসবে শুধু এই জন্য যে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন, অথবা তাকে ভালোবাসলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ সম্ভব হবে, অথবা তার সহিত বন্ধুত্ব রাখলে আল্লাহ ও তার দ্বীন বিষয়ে বহু কিছু জানা যাবে, অথবা তার সংসর্গে আল্লাহর ইবাদত সঠিক ও সহজ হবে, অথবা তার পরিবেশে মিশে ইসলামী পরিবেশ গড়া সহজ হবে। এই উদ্দেশ্যই হল বন্ধুত্ব করার মহান উদ্দেশ্য। এমন সৎ উদ্দেশ্যের রয়েছে বিশাল মর্যাদা।
আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব কায়েম করার মাঝে ঈমানের পরিপূর্ণতা, মিষ্টতা ও প্রকৃত স্বাদ রয়েছে। মহানবী উক্তি বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর ওয়াস্তে কাউকে ঘৃণাবাসে, আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দান করে এবং আল্লাহর ওয়াস্তেই কিছু দান করা হতে বিরত থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ ঈমানের অধিকারী।” (সহীহ আবু দাউদ ৩৯১০ নং) “তিনটি গুণ যার মধ্যে আছে, সে ঈমানের মিষ্টতা লাভ করেছে, সকল বিষয়, বস্তু ও ব্যক্তির চাইতে আল্লাহ ও তদীয় রসুলকে অধিক ভালোবাসা, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই কাউকে ভালোবাসা এবং আল্লাহ কুফরী থেকে রক্ষা করার পর পুনরায় তাতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করা, যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করা হয়।” (বুখারী ১৬, মুসলিম ৪৩ নং)
“যে ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ পেতে পছন্দ করে, সে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যেই অপরকে ভালোবাসুক।” (আহমাদ, বাযযার, সহীহুল জামে ৫৯৫৮ নং)
“সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ সেদিন তার আরশের ছায়া দান করবেন, যেদিন তার ঐ ছায়া ছাড়া আর অন্য কোন ছায়া থাকবে না; তন্মধ্যে সেই দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করে এবং এই বন্ধুত্বের উপরেই তারা মিলিত হয় ও তারই উপর চিরবিচ্ছিন্ন (পরলোকগত) হয়।” (বুখারী ৬৬০, মুসলিম ১০৩১ নং)
“আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আমার উদ্দেশ্যে আপোসে বন্ধুত্ব স্থাপনকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত। আমার উদ্দেশ্যে আপোসে উপবেশনকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত। আমার উদ্দেশ্যে আপোসে যিয়ারতকারীদের জন্য আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত এবং আমার উদ্দেশ্যে আপোসে খরচকারীদের জন্যও আমার ভালোবাসা সুনিশ্চিত।” (আহমাদ ৫/২৩৩ মুত্যুত্ত। ১৭৭৯, ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৪৩৩ ১নং)
“কিছু লোক আছে যারা নবী নয়, শহীদও নয়। অথচ নবী ও শহীদগণ আল্লাহর নিকট তাদের মর্যাদা দেখে ঈর্ষা করবেন। আর ঐ লোক হল তারা, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আপোসে বন্ধুত্ব কায়েম করে; যাদের মাঝে কোন আত্মীয়তার বন্ধন থাকে না এবং থাকে না কোন অর্থের লেনদেন। আল্লাহর কসম! তাদের মুখমণ্ডল হবে জ্যোতির্ময়। তারা নুরের মাঝে অবস্থান করবে। লোকেরা যখন ভীত-সন্ত্রস্ত হবে তখন তারা কোন ভয় পাবে না। এবং লোকেরা যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে তখন তাদের কোন দুশ্চিন্তা থাকবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সতর্ক হও! নিশ্চয় যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোন ভয় নেই। তারা দুঃখিতও হবে। যারা মুমিন এবং পরহেযগার। তাদের জন্য ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে রয়েছে। সুসংবাদ। আল্লাহর বাক্যাবলীর কোন পরিবর্তন নেই। এটাই হল মহাসাফল্য।” (সূরা ইউনুস ৬২-৬৪ আয়াত, সহীহ আবু দাউদ ৩০১২ নং)
“আল্লাহ তাআলা বলেন, 'আমার মর্যাদার ওয়াস্তে যারা আপোসে ভালোবাসা স্থাপন করবে, তাদের জন্য হবে নূরের মেম্বর; যা দেখে নবী ও শহীদগণ ঈর্ষা করবে।” (সহীহ তিরমিযী ১৯৪৮, আহমাদ ২১৫৭৫ নং)
“ঈমানের সবচাইতে মজবুত হাতল হল, আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করা, আল্লাহর ওয়াস্তে শত্রুতা স্থাপন করা, আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসা রাখা এবং আল্লাহরই ওয়াস্তে ঘৃণা পোষণ করা।” (ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭২৮ নং)
“এক ব্যক্তি অন্য এক বস্তিতে তার এক (দ্বীনী) ভায়ের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হল। আল্লাহ তাআলা তার গমন-পথে একজন অপেক্ষমাণ ফিরিশ্যা বসিয়ে দিলেন। (লোকটি সেখানে পৌছলে) ফিরিশতা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোথায় যাওয়ার ইচ্ছা রাখ? সে বলল, 'ঐ গ্রামে আমার এক ভাই আছে, তার সাক্ষাতে যাওয়ার ইচ্ছা রাখি।' ফিরিস্তা জিজ্ঞাসা করলেন, তার কাছে তোমার কোন সম্পদ আছে কি, যার দেখাশোনা করার জন্য তুমি যাচ্ছ?' সে বলল, 'না, আমি তাকে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ভালোবাসি, তাই যাচ্ছি। ফিরিশ্মা বললেন, 'আমি আল্লাহর নিকট হতে তোমার কাছে এই। সংবাদ পৌছে দেওয়ার জন্য প্রেরিত হয়েছি যে, আল্লাহ তোমাকে অনুরূপ ভালোবাসেন, যেরূপ তুমি তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য তাকে ভালোবাস।” (মুসলিম, মিশকাত ৫০০৭ নং)
“যখন দুই ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে আপোসে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তখন তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয় সেই ব্যক্তি, যে অপরকে অধিক গাঢ়ভাবে ভালোবাসে।” (সহীহুল জামে’ ৫৫৯৪ নং)
হে যুবক বন্ধু! ভেবে দেখ, তোমার বন্ধুর সাথে যে বন্ধুত্ব রয়েছে, তা কোন স্বার্থলাভ, অর্থ লাভের জন্য তো নয়? তুমি যাকে ভালোবাস, সে ভালোবাসা তার রূপ ও সৌন্দর্যের জন্য তো নয়? তার খেলা, অভিনয় বা গান ভালো লাগে তাই তাকে ভালোবাস- এমন তো নয়? কোন রাজনৈতিক দল বা মতের ভিত্তিতে তো নয় তোমার প্রেম? তেমন কিছু হলে সে বন্ধুত্ব, সে ভালোবাসা ও প্রেম, সে মহব্বত ও প্রীতির কোন মূল্য নেই।
আল্লাহর ওয়াস্তে ও দ্বীনের স্বার্থে যে প্রেম, সে প্রেম অনির্বাণ, চিরকালীন। এমন প্রেমেরই দুই প্রেমিক ছায়াহীন কিয়ামতের দিনে আল্লাহর বিশেষ ছায়া লাভ করবে। এমন মহব্বত ও দোস্তী সেই ভীষণ কিয়ামতের দিনেও অক্ষত থাকবে, “যেদিন কোন বন্ধু কোন বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেনা।” (সূরা মাআরিজ ১০ আয়াত) সেদিন বন্ধুরা এক অপরের শত্রু হয়ে পড়বে। তবে পরহেযগাররা নয়।” (সূরা যুখরুফ ৬৭ আয়াত) তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন বিচ্ছিন্ন হবে না। কে তোমার বন্ধু? কাকে তুমি বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নিজের হৃদয়ের কোণে আসন দিয়েছ? কার নিকট তুমি তোমার জীবনের সকল রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছ? -তা ভেবে দেখেছ কি?
এ বিষয়ে আমাদের প্রিয় নবী (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করে বলেছেন যে, “মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। অতএব তোমাদের প্রত্যেকের বিবেচনা করে দেখা উচিত যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব কায়েম করছে।” (তিরমিযী ২৩৭৮ নং)
বন্ধু বন্ধুর কথা মত চলে, তার চরিত্র মত গড়ে ওঠে। দু’টি মনের অপূর্ব মিল হলে তবেই বন্ধুত্বের খাতির সহজে জমে ওঠে। এমন না হলে উভয়ের মধ্যে একজন প্রভাবশালী হয় এবং অপর জন হয় প্রভাবান্বিত। অতএব এ ক্ষেত্রে এমন সাথী নির্বাচন করা উচিত, যাতে বন্ধুত্বের আসল উদ্দেশ্য ব্যর্থ না হয়। তাছাড়া আর একটা কথা এই যে, “আত্মাসমূহ সমবেত সৈন্যদলের মত। সুতরাং আপোসে যে আত্মাদল পরিচিত ও অভিন্ন প্রকৃতির হয়, সে আত্মদলের মাঝে মিলন ও বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়ে থাকে এবং যে আত্মাদল আপোসে অপরিচিত ও ভিন্ন প্রকৃতির হয়, সে আআদলের মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্য প্রকট হয়ে ওঠে।” (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, মিশকাত ৫০০৩)।
মক্কায় এক কৌতুকপ্রিয়া মহিলা ছিল। সে যখন মদীনায় এল, তখন এমন এক মহিলার নিকট স্থান নিল, যে ছিল তারই মত কৌতুকপ্রিয়া। এ কথা শুনে মা আয়েশা (রাঃ) উক্ত হাদীস বর্ণনা করেছিলেন।
এ কথা বাস্তব যে, শুধু মানুষের মাঝেই নয়, পশু-পক্ষীর মাঝেও এমন ‘জাতীয়তাবাদ’ লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ, যে যে জাতের পাখী, সে সেই জাতের পাখীর দলেই গিয়ে মিশে থাকে, অন্যথা নয়। মালেক বিন দীনার বলেন, একদিন একটি কাককে একটি পায়রার সঙ্গে বসে থাকতে দেখে আমি অবাক হলাম। ভাবলাম, এমন তো হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হল কেন? পরক্ষণে দেখা গেল যে, উভয় পাখীই ছিল খোড়া। তাই খোড়ায়-খোড়ায় এক ধরনের মিল থাকার পরিপ্রেক্ষিতেই ঐ দুই জাতের পাখী ভাবের সাথে একত্রে বসেছিল।
মানুষের মাঝেও তাই। সাধারণতঃ যে মানুষ যে গুণ, চরিত্র ও আকৃতির, সে মানুষ ঠিক তারই মত একজন মানুষকে বেছে নিয়ে তার সহিত উঠা-বসা ও বন্ধুত্ব করে। অধিকাংশ মানুষের মাঝেই ‘জ্যায়সন কা ত্যায়সন, শুটকী কা ব্যায়গন’ এর মত এক আজব মিল ও চমৎকার সুসাদৃশ্য বর্তমান থাকে।
ভাই সঙ্গী-সন্ধানী যুবক! ভালো লোকদের ও দ্বীনদার যুবকদের প্রতি তোমার মন যদি বীতশ্রদ্ধ হয়, তাহলে জেনে রেখো যে, তোমার মাঝে কোন রোগ আছে; হয় ঈমানী রক্তস্বল্পতা, নচেৎ সন্দেহের যক্ষা, নতুবা প্রবৃত্তিপূজার রক্তচাপ। সুতরাং বন্ধুত্ব করার পূর্বে এসব রোগ সারিয়ে নিও।
যদি দেখ যে, তোমার মন আকৃষ্ট হচ্ছে এমন সব যুবকদলের প্রতি, যারা আকৃতি ও প্রকৃতিতে প্রায় নম্বর ওয়ান হিরো’ এবং স্বভাব-চরিত্রে ডবল জিরো, যাদের মাঝে আছে মস্তানী বা নোংরামি, তাহলে জেনে রেখো, তোমার মাঝেও তাদের ঐ রোগ সংক্রমণ করেছে। অতএব তাদের কাউকে বন্ধু করার আগে নিজের পজিশন পরখ করে নিও। আর মনে রেখো যে, দলদলে একবার পা পড়ে গেলে, সেখান থেকে উদ্ধার হয়ে ফিরে আসা মোটেই সহজ নয়।
যদি তুমি মনে মনে গর্বিত হও এই ভেবে যে, তুমিই বড় চরিত্রবান যুবক, তোমার মত সভ্য মানুষ আর কেউ নেই; অতএব তোমার মানের যোগ্য বন্ধু আর কেউ হতে পারে না। তাহলে এ ধারণাকে তুমি মিথ্যা জেনো। তোমার মনের মণিকোঠায় সন্ধান করে দেখো, সেখানে শয়তানের বাসা রয়েছে। সুতরাং সে সময় তুমি আউযু বিল্লাহ’ পড়ো।
আর যদি তুমি দেখো যে, তোমার নিজের মাঝে ত্রুটি আছে, কিন্তু ভালো লোককে ভালোবাস, তাদের প্রতি মন আকৃষ্ট হয়, তাদের সহিত উঠতে-বসতে ভালো লাগে, তাহলে ভেবো যে, তোমার মধ্যে কিছু মঙ্গল রয়েছে। সুতরাং সে সময় ঐ মঙ্গলকে যথাযথভাবে প্রতিপালিত কর এবং চেষ্টা কর, যাতে তাদের দলে শামিল হতে পার। বন্ধুত্ব কায়েম কর তাদের সাথে।
বন্ধুত্ব স্থাপন কর বন্ধুর তিনটি জিনিস পরীক্ষা করে। সে পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই তাকে বন্ধু বলে নির্বাচন কর, নচেৎ না।
১- প্রথমতঃ বন্ধুর জ্ঞান কত, তা বিচার কর। কারণ, জ্ঞানী বন্ধু এক নেয়ামত। যে নেয়ামত পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। যার নিকট সংকট মুহূর্তে বহু সুপরামর্শ পাওয়া যায়। যে স্পর্শকাতর সময়ে সঠিক পথনির্দেশ করে দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রে অধিক ফল লাভ করা সম্ভব হয়। এমন বন্ধুর বন্ধুত্বে ধোকাবাজির ভয় থাকে না, ভয় থাকে না কোথাও অপমানিত হওয়ার। কারণ, জ্ঞান হল আলো; চোখের আলো এবং মনেরও আলো। আর অলোর পথই ভালো। চাহে রাত্রি আসুক অথবা কাটা থাকুক পথে, নিশ্চিন্তে গন্তব্য হলের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। আর এ জন্যই একজন বিজ্ঞ বন্ধু হল সবচেয়ে বড় নেয়ামত।
জ্ঞানীর সংস্পর্শে থাকলে হৃদয় আবাদ থাকে। জ্ঞানীর পরশে নিজেকেও জ্ঞানী করে তোলা যায়। তা না গেলেও জ্ঞানীর সাথে সম্পর্ক কায়েমে মানুষের সুনাম লাভ হয় -যদিও সে সুনামের যথার্থ অধিকারী নয়। আব্দুল্লাহ বিন ত্বাউস বলেন, একদা আমাকে আমার আব্বা বললেন, 'বেটা! জ্ঞানীদের সাহচর্য গ্রহণ কর। তাদের প্রতি তোমাকে সম্পৃক্ত করা হবে - যদিও প্রকৃতপক্ষে তুমি তাদের দলভুক্ত নও (এবং নিজে তাদের মত জ্ঞানী না হও)। আর মুখদের সাহচর্য গ্রহণ করো না। কারণ, তাদের প্রতি তোমাকে সম্পৃক্ত করা হবে, যদিও আসলে তুমি তাদের দলভুক্ত নও (এবং তুমি নিজে মুখ না হও)। আর জেনে রেখো, প্রত্যেক জিনিসের একটা শেষ সীমা আছে। মানুষের বাসনার শেষ সীমা হল সুজ্ঞান লাভ। (অফিয়াতুল আ’ইয়ান ২/৫১১)।
২- বন্ধু দ্বীনদার কি না, তা দেখ। কারণ, দ্বীন হল মানুষের এমন সম্পদ, যা মানুষকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তোলে। দ্বীন দেয় জ্ঞান, মন ও দেহের খোরাক। দ্বীন হল সেই প্রতিষেধক মহৌষধ, যার ব্যবহার অন্তরের ব্যাধি দূর করে, দুর করে মনের কালিমা, প্রতিহত করে সকল অন্যায় ও অসৎ-আচরণকে। দ্বীন রক্ষা করে আল্লাহর গযব ও দোযখের আযাব থেকে।
যে ব্যক্তির দ্বীন নেই সে মৃত। বেদ্বীন মানুষের জীবনে কোন সুপরিকল্পিত আশা নেই। উদ্দেশ্যহীন জীবন-পথে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল নেই। তাই তার উপর কোন আস্থা নেই, নেই কোন ভরসা। বেদ্বীন মানুষ নিজেরই দুশমন। সুতরাং সে কিরূপে -বিশেষ করে দ্বীনদারের- দোস্ত হতে পারে? যে তার প্রতিপালককে ভালোবাসে না, সে কি তোমাকে ভালোবাসবে? তার ভালোবাসায় কি কোন ভরসা আছে? যে মহাপরাক্রমশালী বাদশা আল্লাহর ফরয আদায়ে গরয দেখায়, সে তোমার ভালোবাসার কর্জ কিভাবে আদায় করবে?
অতএব জেনে রেখো যে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। দ্বীনদার, পরহেযগার বন্ধুই তোমার বেহেস্তী পথের সঙ্গী। সেই তোমাকে সহায়তা করতে পারে মহাসাফল্যের জন্য। তাই তুমি দ্বীনদার বন্ধুই গ্রহণ কর। গরীব হলেও তাকেই তুমি অন্তরঙ্গ সাথী হিসাবে নির্বাচন কর। মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)-কে সম্বোধন করে এই আদেশ করেন যে, “তুমি নিজেকে তাদের সংসর্গে রাখবে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে আহ্বান করে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য, আর পার্থিব জীবনের সুখ-সৌন্দর্য কামনা করে তাদের হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না। পক্ষান্তরে তার অনুসরণ করো না, যার হৃদয়কে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করেছি, যে তার আপন খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে যায়।” (সূরা কাহফ ২৮ আয়াত)
আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “তুমি মু'মিন ব্যতীত আর কারো সাহচর্য গ্রহণ করো না এবং পরহেযগার মানুষ ছাড়া তোমার খাবার যেন অন্য কেউ না খায়।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে হিব্বান, হাকেম, সহীহুল জামে ৭৩৪১ নং)
৩- কারো সহিত বন্ধুত্ব গড়ার পুর্বে তার চরিত্র বিচার করে দেখো। কারণ, মানুষের জন্য সৎচরিত্রতা এক অমূল্য ধন৷ যার চরিত্র নেই, যে চরিত্রহীন, সে নিঃস্ব। সে মানুষ বাহ্যিকভাবে যতই সুন্দর ও সভ্য হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে সে অন্তঃসারশূন্য।
চরিত্রবান মানুষের এক প্রভাব আছে; যার মাধ্যমে সে অপরকে চরিত্রবান করতে পারে। তদনুরূপ দুশ্চরিত্রেরও প্রভাব কম নয়। সেও অপরকে চরিত্রহীন করতে অবশ্যই দ্বিধা করে । সুতরাং ওঠা-বসা করার সময় এ খেয়াল অবশ্যই রাখতে হবে, যাতে যুবকের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। মহান চরিত্রের উচ্চতম স্তরে অধিষ্ঠিত নবী (সা.) সৎ ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ পেশ করে বলেন, “সৎ ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হল আতর-ওয়ালা ও কামারের মত। আতর-ওয়ালা তোমাকে তার আতর উপহার দেবে, নতুবা তুমি তার নিকট থেকে আতর ক্রয় করবে, নচেৎ এমনিতেই তার নিকট থেকে সুবাস পাবে। আর কামার, হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে ফেলবে, হয় তুমি তার নিকট থেকে পাবে দুর্গন্ধ।” (বুখারী ২১০১, মুসলিম ২৬২৮ নং)
আতর-ওয়ালার পাশে বসে মন ও মগজকে যেমন আতরের সুবাসে তাজা করা যায়, তেমনি সৎ সঙ্গীর এমন সগুণাবলী আছে যে, তার মাধ্যমে নিজের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করা যায়। সৎ সঙ্গী তোমাকে এমন শিক্ষা দেবে, যা তোমার দ্বীন অথবা দুনিয়া অথবা উভয় ক্ষেত্রে যথার্থ কাজে আসবে। এমন উপদেশ ও পরামর্শ দেবে, যার মাধ্যমে তুমি তোমার জীবনে এবং মরণের পরেও উপকৃত হবে। এমন কাজের আদেশ করবে, যা করলে তোমার লাভ আছে এবং এমন কাজ হতে তোমাকে বিরত রাখবে, যে কাজে তোমার ক্ষতি ও নোকসান আছে। এমন বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব করার লাভ সুনিশ্চিত। যে বন্ধু তোমাকে গড়ে নেবে, তোমার ত্রুটি গোপন ও সংশোধন করবে, আল্লাহর আনুগত্যে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করবে, পাপ কাজে বাধা দান করবে, তোমার ও তোমার ইজ্জত রক্ষা করবে এবং তার নেক দুআয় তুমি তোমার দুনিয়া ও আখেরাতে লাভবান হবে।
পক্ষান্তরে কামারের পাশে বসলে যেমন তার ধুয়া, কয়লা বা পুরনো লোহা পোড়ার দুর্গন্ধ, হাতুড়ী পেটার শব্দ এবং আগুনের ফিনকি ও আঙ্গার ইত্যাদি দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তেমনি অসৎ সঙ্গী ও দুরাচার বন্ধুর সংসর্গে থাকে বহুমুখী ক্ষতির আশঙ্কা ও নানাবিধ। অমঙ্গল ঘটার সংশয়। কারণ, এমন বন্ধু অসৎ কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে, সৎ কাজে বাধা দান করবে, তওবার কাজে অন্তরাল সৃষ্টি করবে, অর্থ ও স্বাস্থ্যের হানি ঘটাবে। বাড়ির ইজ্জত নষ্ট। করবে, এমন কি বন্ধুর সর্বস্ব লুটে যাওয়ার প্রয়াস চালাতে কুণ্ঠিত হবে না। অতএব হে যুবক বন্ধু! হুশিয়ার ও সচেতন থেকে এমন বন্ধুত্ব গড়া থেকে। আর হ্যাঁ, খেয়াল রেখো তোমার মান ও পজিশনের কথা।
অর্থাৎ, বন্ধুর মানে তুমি খাপ খাবে কি না তাও দেখে নিও। ইঁদুর-ওয়ালা হয়ে হাতি-ওয়ালার সাথে তোমার বন্ধুত্ব সাজে না। হাতি রাখার ঘর দিতে না পারলে তুমি তোমার বন্ধুর মন যোগাতে পারবে না, বিধায় তোমার সে বন্ধুত্ব টিকবে না। এমন উচ্চ মানের বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণের প্রয়াস চালায়ো না, যার গর্ব ও অহংকারে তুমি কষ্ট পাবে। তদনুরূপ এমন নিম্ন মানের বন্ধুর সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করো না, যার মূখতায় তোমার মন ব্যথিত হয় অথবা মান-ইজ্জত হারিয়ে যায়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ার পূর্বে ঠিক তেমনি করে ভেবে নিও, যেমন ভাব বিবাহ করার পূর্বে। বন্ধু ও স্ত্রীর অনেকটা দিক প্রায় একই। অবশ্য বন্ধু পাল্টানো যায়, কিন্তু স্ত্রী পাল্টানো গেলেও, তা মোটেই সহজ নয়। একবার জোড়া লেগে গেলে চিরদিন উপভোগ করতে হয় তার চরিত্র ও ব্যবহারের মধুরতা, নচেৎ বিষময় তিক্ততা।
অতএব ধোকা খাওয়ার পূর্বে বন্ধুকে পরখ করে নিও এবং তার বাহ্যিক আড়ম্বর ও সুশোভিত ব্যবহার তথা নতুন পরিচয়ের আচমকা-সুন্দর স্বভাব দেখে তাকে বন্ধু বলে লুফে নিও না। এক ব্যক্তি হযরত উমার (রাঃ)-কে কথা প্রসঙ্গে বলল, 'অমুক লোকটা বড় খাটি লোক। তিনি বললেন, (তা তুমি কি করে জানলে?) ওর সাথে কি কোন সময় সফর করেছ? লোকটি বলল, জী না।' তিনি বললেন, 'তোমার ও তার মাঝে কি কোন দিন তর্ক বা মতবিরোধ হয়েছিল? লোকটি বলল, জী না।' তিনি বললেন, 'ওর কাছে কি কোন দিন কিছু আমানত রেখেছিলে? লোকটি বলল, জী না। পরিশেষে তিনি বললেন, তাহলে ওর সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। আমার মনে হয় তুমি ওকে কেবল মসজিদে বসে মাথা হিলাতে দেখেছ।' (উয়ুনুল আখবার ৩/ ১৫৮)
হা মানুষের সাথে ব্যবহার না করলে মানুষের আসল রূপ ধরা যায় না। আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা, ঋণ, প্রতিবেশ, বৈবাহিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিভিন্ন সামাজিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের আসল পরিচয় পাওয়া যায়। আর তখনই হয় আসল বন্ধুর অগ্নিপরীক্ষা।
অবশ্য এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, কোন বন্ধু কামেল’ নয়। কোন না কোন ত্রুটি থাকতেই পারে। তাছাড়া মন সকলের সমান নয়। প্রকৃতিগত পার্থক্য থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। দু’টি মন যে সম্পূর্ণরূপে একমত হবে, তা প্রায় অসম্ভব। আর তার জন্যই লোকে বলে, 'মনের মত মানুষ পাওয়া দায়। অতএব ঠিক ‘মনের মত’ বন্ধ পাওয়া ততটা সহজ নয়।
জনৈক দার্শনিককে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কোন ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী লম্বা সফর। করেছে?’ দার্শনিক বললেন, 'যে ব্যক্তি একটি বন্ধুর খোঁজে সফর করেছে।
আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “তোমরা কর্তব্যনিষ্ঠ রহ; আর তাতে কখনই পূর্ণরূপে সক্ষম হবে না।” (ইবনে মাজাহ হাকেম, সহীহ তারগীব ১৯০ নং)
উক্ত মহাবাণী থেকে এ কথা বুঝা যায় যে, সম্পূর্ণরূপে নিখুঁতভাবে দ্বীন ও চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং বন্ধুর মাঝে ছোটখাট কিছু ত্রুটি থেকে যাওয়াটা স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক নয়।
প্রিয় নবী (সা.) আরো বলেন যে, “মনুষ্য-সমাজ হল শত উটের মত; যার মধ্যে একটা ভালো সওয়ার-যোগ্য উট খুঁজে পাওয়া মুশকিল।” (আহমাদ; বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ সহীহুল জামে’ ২৩৩২ নং)
সুতরাং তুমিও যে একটা মনের সম্পূর্ণ পছন্দমত মানুষ সহজে খুঁজে পাবে না, তা বলাই বাহুল্য। অতএব তারই মধ্যে ভালো যুবক দেখে তুমি তোমার বন্ধুত্বের জীবন গড়ে তোল এবং একেবারে নিখুঁত খোঁজার চেষ্টা করো না, নচেৎ জীবনে কোন বন্ধুই পাবে না। বন্ধুর। ছোট-ছোট ভুল চোখ বুজে সয়ে নিও, যথাসম্ভব সংশোধন করে চলো, যথারীতি তার দোষের জন্য ওজর খুঁজে নিও। নচেৎ বন্ধুত্বের বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।