যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান আবদুল হামীদ ফাইযী ৪৬ টি
যুব-সমস্যা ও তার শরয়ী সমাধান আবদুল হামীদ ফাইযী ৪৬ টি

পক্ষান্তরে যার সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে, সে যদি অসংশোধনীয় ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে তার থেকে দূরে থেকো এবং তার গায়ে পড়া বন্ধুত্ব গ্রহণ করো না। কোন ওজুহাতে তার জীবন থেকে সরে পড়। বিশেষ করে মুখ ও আহমক বন্ধু মোটেই পছন্দ করো না। কারণ, এমন বন্ধু হল আগুনের মত; তোমাকে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলবে। মুখের মুখামি যখন মাথায় চড়ে, তখন তা আর কোন আত্মীয়তা, কোন ভালোবাসা অথবা প্রতিবেশ ইত্যাদির হকের খেয়াল রাখে না। সব কিছুকে ভুলে গিয়ে নিজের স্বভাব মত মুখামি করেই তৃপ্তি পায় মূখ মানুষ। তাতে তার বন্ধুর অপমান হলে সে কি করতে পারে? তার তো স্বাভাবিক আচরণ এটা।

অতএব দুশমন হলেও জ্ঞানীর সাহচর্য গ্রহণ করো, তবুও কোন আহম্মককে বন্ধু করে তোমার সংসর্গ দিও না। নচেৎ দেখবে, তুমি পাবে। মহান আল্লাহ তার খাস বান্দাদের বিভিন্ন গুণ বর্ণনার সময় তাদের একটি বিশেষ গুণের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, “যখন অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, 'সালাম।” (সূরা ফুরকান ৬৩ আয়াত) অথাৎ, তারা তাদের মূর্খামির সাথে জড়িয়ে না পড়ে তাদেরকে উপেক্ষা করে ও এড়িয়ে চলে।

আহাম্মক বন্ধু অনেক সময় মনের আবেগবশে বন্ধুর উপকার করার নিয়তে এমন কাজ করে বসে, যাতে প্রকৃতপ্রস্তাবে বন্ধুর অপকারই সাধিত হয়। আবার সেই উপকারের কোন প্রশংসা বা বদলা না পেলে সে কথা অপরের কাছে গেয়েও বেড়ায়। ফলে এমন বন্ধুর বন্ধুত্বে। ক্ষতি হয় দ্বিগুণ। এমন বন্ধু কখনো বাত ভালো করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগ সৃষ্টি করে ফেলে। আবার কখনো বা সাপ মারতে ছিপ ভেঙ্গে বসে থাকে। এমন বন্ধু অকারণে রাগ করে, খামাখা আড়ি পাতে ও অভিমান করে, অপ্রয়োজনে কথা বলে, অযথা খরচ করে, প্রত্যেকের উপর আস্থা রাখে এবং অপকারী ও উপকারীর মাঝে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারে না। সুতরাং এমন মিত্রের মিত্রতায় যে ঠকতে হবে, তা বলা নিষ্প্রয়োজন।

আর এ জন্যই বলা হয় যে, তিনটি জিনিস যদিও ঘটে, তবুও সত্বর অপসৃত হয়; মেঘের ছায়া, মিথ্যা সুনাম ও জ্ঞানী-অজ্ঞানীর বন্ধুত্ব। খবরদার! কোন অসদাচারীকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। করে ফেললে তাকে সৎপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কর। সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে তার দুনিয়া থেকে দুরে সরে যাও। বেনামাযী, মদ্যপায়ী, ধূমপায়ী, বিদআতী, ব্যভিচারী ও চোরা প্রকৃতির বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণ করো না। এমন বন্ধুর সঙ্গ পরিত্যাগ কর, যে দ্বীনদার লোক দেখে নাক সিটকায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, কুমন্তব্য করে। আর জেনে রেখো যে, খল বন্ধুর চেয়ে শত্রু অনেক গুণ ভালো।

এমন বন্ধুর বন্ধুত্বের বন্ধন ছিন্ন-ভিন্ন করে দাও, যে পাপ করে তোমার কাছে অথবা কোন বন্ধুমহলে প্রচার করে গর্ব প্রকাশ করে অথবা নির্লজ্জ পৃষ্ট্রের মত প্রকাশ্যে পাপ করে। লারে-লাপ্পা’ করে পাড়া মাতায়, টেপ-রেডিও-টিভির অশ্লীল গান-বাজনা-ছবি প্রকাশ্যে ফুল সাউন্ডে শোনে ও শোনায়, দেখে ও দেখায়। গুপ্ত পাপীর বাঁচার পথ আছে, কিন্তু প্রকাশ্য পাপীর বাচার পথ দুর্গম। প্রিয় নবী মুক্তি বলেন, “পাপ প্রকাশকারী ছাড়া আমার প্রত্যেক উম্মত ক্ষমাহ।” (বুখারী ৬০৬৯, মুসলিম ২৯৯০ নং)

এমন পাপাচার ও দুরাচার থেকে দূর না হতে পারলে জেনে রেখো, ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। সঙ্গ দোষে কি না হয়? ছুঁচো ছুঁলে গন্ধ হয়। শারাব খানায় বসলে বা আসা-যাওয়া করলে লোকে তোমাকে শারাবী বলবে; যদিও তুমি শারাব না খাও। তাছাড়া আজ নয় তো কাল শারাবের উগ্র গন্ধ তোমাকেও পাগল করে ফেলবে। অবশেষে তুমিও হয়তো শারাবীতে পরিণত হয়ে যাবে।

অতএব 'দুর্জনেরে পরিহারি, দুরে থেকে সালাম করি’ এমন বন্ধুর বন্ধুত্বকে কবর দিয়ে দাও। এমন বন্ধু থেকে শতবার আল্লাহর নিকট পানাহ চাও এবং সে জন্য অর্থ সহ ‘কুল আউযু বিরাব্বিন্নাস’ বার বার পাঠ কর।

অসৎ বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণ করে কাল কিয়ামতে পস্তাতে হবে। “সেদিন অত্যাচারী নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি রসূলের সাথে পথ অবলম্বন করতাম! হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার নিকট উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল। আর শয়তান মানুষকে বিপদকালে ধোকা দেয়।” (সূরা ফুরকান ২৭-২৯ আয়াত)।

হে মুসলিম যুবক! মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে তাকে তুমি ভয় করে থাক। অতএব তোমার প্রিয়তম বন্ধু তিনিই এবং তাঁর বন্ধু তুমি। সুতরাং সে বন্ধুর কোন শত্রু তোমার বন্ধু। হতে পারে না। কারণ, প্রকৃতপক্ষে সে তোমারও শত্রু। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না----।” (সূরা মুমতাহিনাহ ১ আয়াত) তোমার প্রিয়তম সুমহান বন্ধুকে যে বিশ্বাসই করে না, সে তোমার বন্ধু কিরূপে হতে পারে? “হে বিশ্বাসিগণ! বিশ্বাসিগণের পরিবর্তে অবিশ্বাসিগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।” (সূরা নিসা ১৪৪ আয়াত) তোমার শ্বাশত ধর্ম ও অম্লান নৈতিকতাকে যে মানতে চায় না এবং উল্টে তা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে, তাকে তুমি কিরূপে নিজের অন্তরঙ্গ বন্ধু করতে পার? “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের পূর্ববর্তী সেই গ্রন্থপ্রাপ্ত (ইয়াহুদ ও নাসারা)গণ, যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলার বস্তুরূপে গ্রহণ করেছে, তাদেরকে ও কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। যদি তোমরা ঈমানদার হও, তাহলে আল্লাহকে ভয় কর।” (সূরা মাইদাহ ৫৭ আয়াত)

বস্তুতঃ “তুমি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোন সম্প্রদায় পাবে না, যারা আল্লাহ ও তার রসুলের বিরুদ্ধাচারীগণকে ভালোবাসে, যদিও সে (বিশ্বাসী) তাদের পিতা অথবা পুত্র, ভ্রাতা অথবা একান্ত আপনজন কেউ হয়----I” (সূরা মুজাদালাহ ২২ আয়াত) সুতরাং যে তোমার নিজের কেউ নয়, সে বিরুদ্ধাচারী তোমার ভালোবাসার কোন পাত্র?

হ্যাঁ, আর নৈতিকতার খাতিরেই তুমি কোন যুবতীর সহিত বিবাহের পূর্বে কোন প্রকারের বন্ধুত্ব করতে পার না। বিবাহের পরই সে তোমার পরমা বান্ধবী। আমল এক হলে সে ইহকাল ও পরকালে চিরকাল তোমার চিরসঙ্গিনী হয়ে থাকবে।

জেনে রেখো বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসবে কাল কিয়ামতের বিভীষিকাময় দিনে তারই সঙ্গে অবস্থান করতে হবে। যদি কোন খেলোয়াড়কে ভালোবাস, তাহলে সেই খেলোয়াড়ের সাথে, যদি কোন শিল্পী বা হিরোকে ভালোবাস, তাহলে সেই শিল্পী বা হিরোর সাথে, যদি কোন দ্বীনদার লোককে ভালোবাস, তাহলে সেই দ্বীনদার লোকের সাথে এবং কোন কাফেরকে ভালোবেসে থাকলে, সেই কাফেরের সাথে তোমার হাশর হবে। আর সেখানে তাদের যে অবস্থা হবে, তোমারও অবস্থা হবে অনুরূপ। সুতরাং বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা গড়ার সময় সে কথাও মনে রেখো। প্রিয় নবী স. বলেন, “মানুষ যাকে ভালোবাসবে (কিয়ামতের দিন) সে তারই সাথে অবস্থান করবে।” (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৫০০৮ নং)

যুবক বন্ধু! এবারে তোমাকে সেই কথাই বলি, যে কথায় বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়। যাতে তুমি সহজে একজন বন্ধু লাভ করতে পার এবং তুমিও অপরের বন্ধুতে পরিণত হতে পার। বন্ধুত্বের প্রথম সোপান সাক্ষাতে সালাম দেওয়া। সালাম দেওয়ার মাধ্যমে কায়েম হয় সম্প্রীতি, হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে উভয়ের প্রতি উভয়ের ভালোবাসা। (মুসলিম ৫৪নং) এরপর গাঢ় পরিচয়, সুন্দর ব্যবহার, সাক্ষাতে সুমিষ্ট হাসি, উপটৌকন, উপহার ও দুআ বিনিময় ইত্যাদি।

এক ব্যক্তি মহানবী (সা.) এর নিকট এসে আরজ করল, 'হে আল্লাহর রসূল! আমাকে এমন একটা কাজ বলে দিন, যা করলে আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষেও আমাকে ভালোবাসবে।' প্রিয় নবী ও বললেন, “দুনিয়ার মায়া ত্যাগ কর, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন৷ আর মানুষের হাতে যা কিছু আছে (অর্থ-সম্পদ ইত্যাদি) তার প্রতি বিরাগ। প্রকাশ কর, মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে।” (ইবনে মাজাহ ৪১০২, সহীহুল জামে ৯২২ নং)। মানুষ চায় না যে, তার কাছে কেউ কিছু চাক। অতএব তুমি কোন মানুষের কাছে চাইলে তার মন সঙ্কুচিত হবে এবং তুমি তার নিকট থেকে তা না পেলে তোমার মনও ছোট হবে। এর ফলে ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হতে পারবে না। অন্যথা ঋণ, সাহায্য ইত্যাদি না। চাইলে অনায়াসে তুমি তার ভালোবাসার পাত্র হতে পারবে।

পক্ষান্তরে চারটি জিনিস ভালোবাসা সৃষ্টি করে; স্মিতমুখে সাক্ষাৎ, উপকার সাধন, সহমত অবলম্বন এবং কপটতা বর্জন। আর যার মুখ মিষ্টি তারই বন্ধু বেশী। খেয়াল রেখো যে, বন্ধুত্বের খাতিরে যা কিছু করছ, তার বিনিময়ে প্রতিদানের আশা করো । কারণ, ভালোবাসার একটি মহৎ উপায় হল, প্রতিদানে কিছু পাওয়ার আশা না করে নিঃস্বার্থভাবে কেবল ভালোবেসে যাওয়া।

আর এ কথাও মনে রেখো, অতি প্রেম যেখানে, নিত্য যেও না সেখানে৷ যাবে যদি নিত্যি, ঘটবে একটা কিত্যি। বরং অতিরঞ্জনের পথ বর্জন করে মধ্যবর্তী পথ অবলম্বন কর। এ ব্যাপারে মহানবী মুক্তি বলেন, “(প্রত্যেক দিন সাক্ষাৎ না করে) একদিন বাদ পর দিন সাক্ষাত কর। তাতে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।” (বাযযার, ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৩৫৬৮ নং) প্রেমের বেদনার প্রকৃতিই এমন যে, প্রেমে বিরহের আঘাত যত বেশী পড়ে, প্রেমের ফোড়া ততই টলটলে হয়ে বেড়ে ওঠে। প্রেমাস্পদের প্রতি হৃদয়ের টান তত বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে মনকে ব্যাকুল করে তোলে। আর সেখান থেকে সৃষ্টি হয় প্রকৃষ্ট বন্ধুত্বের সুদৃঢ় বন্ধন।

হে যুবক বন্ধুবন্ধুত্বের পথ বড় বন্ধুর। এ পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। নয় ঝড়ঝঞ্চাহীন ও বিপদমুক্ত। কারণ, দোস্তী কুরবানী চায়। কুরবানী পেশ করতে না পারলে দোস্তীতে স্বস্তি পাওয়া যায় না। আর এখানেই হয় প্রকৃত বন্ধুর মহা অগ্নিপরীক্ষা। তাছাড়া সুসময়ে বন্ধু বটে অনেকেই হয়, অসময়ে হায় হায় কেহ কারো নয়’ এই বাস্তব উদাহরণের নাম বন্ধুত্ব নয়। প্রকৃত বন্ধু হল সেই, যে বন্ধুর বিপদের সময় হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে আমার দুর্নাম রটার সময় বলে, 'ও আমাদের গ্রামের একটা ছেলে। আর সুনাম প্রচারের। সময় বলে, 'ও আমার প্রাণপ্রিয় অথবা খাস বন্ধু!’ আসল বন্ধু সে নয়, যে আমার অভাবের সময় খোঁজ রাখে না। আর আমার ধনলাভের সময় এসে বলে, 'আই লাভ ইউ।' এমন কপট ও স্বার্থপর বন্ধু থেকে তোমাকে আল্লাহর পানাহ রইল।

প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে সামান্য মতবিরোধের ফলে বন্ধুত্বের মুলে কুঠারাঘাত হানে। উড়ো খবর ও কান-ভাঙ্গানিতে বিশ্বাস ও আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং বন্ধুত্বের বন্ধন-সূত্রকে ছিন্নভিন্ন করে। অথচ ঈমানের এক দাবী এই যে, বন্ধুত্বের অঙ্গীকার বন্ধু যথারীতি পালন করতে বদ্ধপরিকর থাকবে। (হাকেম ১ ১৬, সহীহুল জামে ২০৫৬ নৎ)।

প্রকৃত বন্ধু সে নয়, যে মুখের কথায় একশ ছড়ি গুনে খায়, অথচ আসলে সে ফুলের ঘায়ে মূৰ্ছা যায়। এমন বাকসর্বস্ব, ধৈর্যহীন, অদূরদর্শী বন্ধু থেকে আল্লাহ আমাকে ও তোমাকে আশ্রয় দান করুন। প্রকৃত বন্ধু তো সেই ব্যক্তি, যে পীড়িত হলে তার পীড়া দেখে তুমিও পীড়িত হও এবং তুমি পীড়িত হলে তার দর্শনলাভে ও সান্ত্বনাদানে সুস্থ হয়ে ওঠ। যে বন্ধু তোমাকে এসে বলে, ‘ইন্নী উহিব্রুকা ফিল্লাহ এবং তার প্রত্যুত্তরে তুমি তাকে বল, ‘আহাব্বাকাল্লাযী আহবাবতানী ফীহ।

ভাই যুবক! জীবনে চলার পথে বহু বন্ধুই আসে-যায় এবং মনের প্রেম-কোঠায় প্রবেশের জন্য তার সুদৃঢ় দ্বারে করাঘাত করে যায়। কিন্তু যে বন্ধু ঐ দ্বারে প্রবেশ করে মনের নিভৃত কোণে স্থায়ী আসন পেতে নিতে পারে, সেই হয় প্রকৃত বন্ধু। এমন বন্ধুই তুমি লাভ কর, এই কামনা করি।

অবশ্য আর একটি প্রকৃষ্ট বন্ধুর কথাও তোমাকে জানিয়ে রাখি, আর তা হল একটি মনের মত উপকারী বই। কোন বন্ধু না পেলে এ বন্ধু পাওয়া সাক্ষর মানুষের জন্য মোটেই কঠিন নয়। অতএব ভেবে ও খুঁজে দেখো, দেখবে এ বন্ধুর সাথে কোন দিন মনোমালিন্য ঘটবে না। ঘটবে না কোন স্বার্থপরতার মন কষাকষি। দুঃখের বিষয়, কড়ি ফটকা চিড়ে দই, কড়ি বিনে বন্ধু কই? কোন স্বার্থ ছাড়া কেবল আল্লাহ ও দ্বীনের উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব আর কে করে? খেয়াল করে দেখবে, যারাই তোমাকে বন্ধু বলে গলায় লাগাতে আসছে, তাদের অধিকাংশই তোমাকে সম্মান প্রদর্শন করলেও আসলে তোমার কি মান? তোমার শাখা-সোনার মান। অধিকাংশ বন্ধুই হল দুধের মাছি। এরা কোন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আসে, স্বার্থ উদ্ধার হলে অথবা স্বার্থে আঘাত লাগলে সরে পড়ে। যে জিনিসের জন্য সে বন্ধুরা তোমাকে ভালোবাসছিল তা তোমার কাছে না পেলে পরক্ষণে তোমাকে বিদায় জানাবে। আজ ধনবান আছ, এখন তোমার বন্ধু অনেক। কিন্তু কাল গরীব হয়ে গেলে সবাই তোমার নিকট থেকে কেটে পড়বে। আজ তোমার একটা পদ আছে বলে তোমার বন্ধুর অভাব নেই। কিন্তু কাল পদ চলে গেলে তোমার বন্ধুরাও তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। পার্থিব স্বার্থে বন্ধুত্বের ধারা এই, রীতি এই।

আর দুনিয়ার এ রীতি বড় পুরাতন, নুতন নয়। কিন্তু তুমি তোমার বন্ধুর জন্য খাটি বন্ধু হও। সকল স্বার্থ ত্যাগ করে কেবল আল্লাহর ওয়াস্তে নিঃস্বার্থ বন্ধুরূপে পরিচয় ও প্রমাণ দাও। স্বার্থে আঘাত লাগলে ধৈর্য ধরে নাও। আর তার জন্য বন্ধুত্বের বুনিয়াদে আঘাত হেনো না। মনে রেখো, “কোন মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত (পূর্ণ) মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার ভায়ের জন্য তাই পছন্দ করেছে, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।” (বুখারী ৭, মুসলিম ৪৫ নং) সাবধান! তোমার বন্ধু যে চিরদিন বন্ধু থাকবে, সে ধারণা সঠিক না-ও হতে পারে। আজ যে বন্ধু আছে কাল সে শত্রুতে পরিণত হতে পারে। সুতরাং তোমার রহস্য ও দুর্বলতার ব্যাপারে তোমাকে সতর্ক থাকা উচিত। আর এ জন্যই দূরদর্শী সমাজ-বিজ্ঞানী নবী ৯৪ বলেন, “তোমার বন্ধুকে মধ্যমভাবে ভালোবাস (অর্থাৎ, তার ভালোবাসাতে তুমি অতিরঞ্জন করো)। কারণ, একদিন সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আর তোমার শত্রুকে তুমি মধ্যমভাবে শত্রু ভেবো। (অর্থাৎ, তাকে শত্রু ভাবাতে বাড়াবাড়ি করো না। কারণ, একদিন সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হতে পারে।” (সুতরাং তখন তোমাকে লজ্জায় পড়তে হবে।) (তিরমিযী ১৯৯৭, সহীহুল জামে’ ১৭৮ নং)

শেখ সাদী বলেন, 'যা তোমার গোপন, তা নিজের বন্ধুকেও বলো না; যদিও সে তোমার বন্ধুত্বে খাঁটি। কারণ, বলা যায় না, কালচক্রে সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আর অতি কদর্য অসদ্ব্যবহার বা পারতপক্ষের কোন কঠিন শাস্তি কোন শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করো। না। কারণ, কোনদিন সে তোমার ঘনিষ্ট বন্ধুতেও বদলে যেতে পারে। সুতরাং পূর্ব হতেই সতর্ক থেকো; যাতে ভবিষ্যতে পস্তাতে না হয় এবং লজ্জিত হতেও না হয়। তিনি আরো বলেন, যে গোপনীয় কথা তুমি গোপন রাখতে চাও, তা তোমার বন্ধুকেও বলো না। কারণ, তোমার বন্ধুরও অনেক বন্ধু আছে। সেও তাদের নিকট তা প্রকাশ করতে পারে।

হ্যাঁ, আর এমনি করেই সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য, তারপর বিচ্ছিন্নতা ও শত্রুতা। আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব হলেও কোন এক পক্ষের পাপের কারণেই উভয়ের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। মহানবী ঐ বলেন, “যখন কোন দুই ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, তখন তাদের কারো একজনের কোন পাপ সংঘটন ছাড়া আল্লাহ তাদের মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করেন।” (সহীহুল জামে ৫৬০৩ নং) যুবক বন্ধু! অতএব খেয়াল রেখো, যাতে বন্ধুত্বের পর বিশেষ করে ঐ বন্ধুত্বের কারণে তোমাদের কারো দ্বারা যেন কোন পাপ সংঘটিত না হয়। সুতরাং সতর্ক দৃষ্টি রেখো, যাতে তোমার বন্ধুর কুদৃষ্টি তোমার বোন, স্ত্রী অথবা কন্যার উপর না পড়ে। মানুষ তো। আর তার মন তো মন্দপ্রবণ এবং শয়তান বড় শত্রু। বন্ধুর সহিত তোমার বন্ধুত্ব যতই গাঢ় ও নিবিড় হোক না কেন, সে গাঢ়তা ও নিবিড়তা তোমার বোন-স্ত্রী-কন্যার মনে প্লাবিত হবে কেন? জানের বন্ধু হলেও, ফিরিস্তাতুল্য চরিত্র হলেও পর্দার আয়াত তো আর মনসুখ হচ্ছে না। আর যদি তাই মনে করে পর্দার কুরআনী বিধানকে অবজ্ঞা কর, তাহলে জেনে রেখো, তোমার জানতে অথবা অজান্তে এমন কীর্তি ঘটতে পারে, যার জন্য তোমার ইহকালও বরবাদ হতে পারে এবং পরকাল ধংস তো করলেই। বন্ধু তখন বিষফোড়া হবে এবং তার গুপ্ত যন্ত্রণায় ছটফট করবে। যখন না পাবে মরণের কোন পথ, আর না-ই পাবে শান্তির কোন প্রলেপ। তাছাড়া তোমার ও তোমার বংশের দুর্নাম রটতে থাকবে এবং তখন তুমি শাক দিয়ে মাছ ঢাকতেও পারবে না। পরন্তু তোমার তো জানা আছে যে, দাইয়ুস বেহেস্তে যাবে না।

পক্ষান্তরে এ কথা দুনিয়া জানে যে, একজন দুশমন যা ক্ষতি করতে পারে, তার চাইতে অনেক গুণ বেশী করতে পারে একজন বন্ধু। শত্রুর ক্ষতির হাত থেকে সতর্ক থাকা যায়, কিন্তু। বন্ধুর ব্যাপারে তা হয় না। শত্রু পাহারা দেওয়া যায়, কিন্তু বন্ধু পাহারা দেওয়া যায় না। ফলে অসতর্ক থাকা অবস্থাতেই কাছে থেকেই বন্ধুর বন্দুক বুক ঝাঝরা করে দেয়। আবার শত্রু প্রকাশ্য হলে তার দ্বারা যত ক্ষতি হয়, বন্ধু শত্রু হয়ে গেলে তার দ্বারা ক্ষতি হয় আরো মারাত্মক, অধিক ভয়ানক।

আপন যখন পর হয় এবং বন্ধু যখন শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়, তখনকার মর্মব্যথা যে কত নিদারুণ, কত গভীর হয়ে বন্ধুকে নিষ্পেষিত করে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার আন্তরিকতা ও গাঢ়তা অনুযায়ী সেই বেদনার পরিমাণ কম ও বেশী হয়ে থাকে। বন্ধুত্বের গাঢ়তা বেশী থাকলে বেদনা ও আক্ষেপের পরিমাণ বেশী হয়ে থাকে। এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলার স্মৃতি ও আঘাতে হৃদয় দগ্ধীভূত হয়ে মানুষ অনেক সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু এমন দুটি জিনিস আছে, যা হারিয়ে গেলে তার জন্য কেঁদে চক্ষুদ্বয় হতে রক্তধারা প্রবাহিত করলেও তার এক দশমাংশ হকও আদায় হয় না। সে দু'টির একটি হল, যৌবন এবং অপরটি হল, বন্ধু।

আপনজন ও বন্ধুর কথায় মনে দাগ কাটে বড়। তবুও ভুলে যেতে হয়। বন্ধুর বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু বাস্তব এই যে,

‘হাড় ভাঙ্গলে জোড়া লাগে কলে আর বলে,

মন ভাঙ্গলে জোড়া লাগে না ইহ-পরকালে।

কাটা চামড়ায় জোড়া লাগে ঠিকই, কিন্তু দাগ থেকে যায়। দুশমনির সব কথাই ভুলে যেতে হয়, কিন্তু কিছু কথা আছে, যা মনে রাখতে হয়; ভুললে চলে না। আর তা হয় ভবিষ্যতের জন্য বড় শিক্ষা ও উপদেশ।

যে সব কারণে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় তার মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন অন্যতম। অনেক মানুষ আছে, যাদেরকে বাইরে ও দুরে থেকেই ভালো লাগে, ভিতরে ও কাছে এলে লাগে তার বিপরীত। আর ভাই-বোন বা ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে দূরের বন্ধু কাছে হয়, গোপন বিষয়ে খবর নেওয়ার পথ অধিক ও সূক্ষম হয়, ভুল বুঝাবুঝির মত ক্ষেত্র তৈরী হয়। ফলে সৃষ্টি হয় বিষ্ণা, কলহ ও বিচ্ছেদ। বিচ্ছেদের আর এক কারণ হল টাকা। তাই বন্ধুত্ব রাখতে হলে টাকা-পয়সা লেনদেনের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। নচেৎ টাকা এমন জিনিস যে, সে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারে, আবার বিচ্ছেদও। কথায় বলে, 'টাকা তুমি যাচ্ছ কোথা? পিরীত যথা। আসবে কবে? বিচ্ছেদ যবে।

এ সব ছাড়া অনেক মানুষ আছে, যারা কতটা পেলাম’ কেবল সেই হিসাব রাখে। পক্ষান্তরে কতটা দিলাম সে হিসাব রাখে না। অর্থাৎ, না পেলে হৈচৈ করে, অথচ দেওয়ার মনমানসিকতা রাখে না। এই মানুষরাই সব সময় অপর পক্ষের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে থাকে এবং নিজের ঘাড়ে দোষ নিতেই চায় না। এরা চায় আঘাত দোব, কিন্তু আঃ শুনব না। বারুদে আগুন দোব, কিন্তু বিস্ফোরণ দেখব না। এরা চায় আগুন ধরাব, আর ধূপের সুগন্ধ নেব।' এই শ্রেণীর স্বার্থপর, বিবেক ও ইনসাফহীন মানুষের সাথে যে বন্ধুত্ব রাখা বড় দায়, তা বহু অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রের জানা।

তুমি মনের মত বন্ধু পাও, বন্ধুমহলে সুখী হও, সংসার ও দ্বীন-ধর্মে উপকৃত হও এবং কিয়ামতের ছায়াহীন প্রখর রৌদ্রময় দিনে আল্লাহর ছায়া লাভ কর, মনে-প্রাণে এই কামনা করি।

কবির ভাষায় যুবকের যৌবন হল, বারিদের বারিধারা, মহাগিরির প্রস্রবণ। সুতরাং এই টলটলায়মান বারিধি এবং উপচীয়মান স্রোতস্বিনীকে সঠিক গতিপথে নিয়ন্ত্রিত ও প্রবাহিত করার জন্য দুই ধারে উঁচু ও মজবুত বাঁধ চাই। চাই সর্বনাশা বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। যৌবনের প্রারম্ভে মনের আঁধার কোনে কত রকম কুচিন্তা আসে। আসে কত অশুভ পরিকল্পনা। আর তা দূর করার জন্য চাই এমন সুব্যবস্থা, যাতে যুবসমাজ বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার দিকে অগ্রসর ও ধাবিত না হয়। বলা বাহুল্য, উক্ত নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা। ও সুব্যবস্থা বলতে আমরা যা বুঝি তা-ই হল ইসলামের জীবন-ব্যবস্থা। যে সর্বাঙ্গ-সুন্দর ও শ্বাশত ব্যবস্থা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। রক্ষা করে উচ্ছলতা ও ভ্রষ্টতার কবল থেকে।

কিন্তু মানুষ তো আর সকলে সমান নয়। তাই কিছু সমাজসেবী বেছে নিয়েছেন খেলাধূলার পথ। কিন্তু লুফে নিয়েছেন তাদের পথ, যারা আসলে ভোগবাদী, পরকালে অবিশ্বাসী। যাদের । শ্লোগান হল, দুনিয়াটা মস্তবড়, খাও-দাও স্ফুর্তি কর। যাদের বিশ্বাসই হল ‘নো লাইফ আফটার দি ডেথ। যাদের পরম লক্ষ্য হল, মানুষকে ধর্মের নৈতিকতা থেকে বের করে এনে মুক্ত স্বেচ্ছাচারিতার জীবনে শুধু ভোগ-বিলাস ও চিত্তবিনোদনে ব্যাপৃত রাখা। আর তার জন্যই পৃথিবীর একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ মাঠে-ময়দানে ও খেলাধূলার আনন্দ মেলায় নিজেদের অবসর-বিনোদন ছাড়াও নিজেদের অমূল্য সময় নষ্ট করেও চিত্তবিনোদন করে থাকে।

অবশ্য এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কিছু খেলাধূলা আছে, যাতে সত্যই মানুষ উপকৃত হয়ে। থাকে। সুস্থ শরীর গঠনে ও মানসিকভাবে মনে হৃর্তি আনতে তথা পড়াশোনায় মনোযোগিতা বাড়াতে খেলাধূলার একটা বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু মুসলিম যুব-সমাজের জন্য তা নিয়ম-ছাড়া, বাঁধন-হারা ও সীমাহীন নয়। জীবনের একটি মাত্র লক্ষ্য ঠিক রেখে (বৈধ) উপলক্ষ্য যদি যথানিয়মে ব্যবহার করা হয়, তবেই আমাদের মঙ্গল। নচেৎ উপলক্ষ্য যদি লক্ষ্যে পরিণত হয়, তাহলেই আমাদের সর্বনাশ। নিয়মতান্ত্রিকভাবে কিছু খেলার মধ্যে উপকার থাকলেও তার অপকারিতার দিকটা ভুলে গেলে চলে না। ভুললে হয়তো এমনও হতে পারে যে, জীবনের জমা-খরচের হিসাবে কেবল নাকের বদলে নরুন’ পেয়ে সন্তুষ্ট থেকে যাব।

সাধারণভাবে প্রায় সকল খেলাতে যেমন খেলোয়াড় ও তাদের সমর্থক ও দর্শকদের মাঝে সম্প্রীতি সৃষ্টি হয়, তেমনি সৃষ্টি হয় বিদ্বেষ ও শত্রুতা। কখনো কখনো হিংসা থেকে শুরু করে মারামারি ও দাঙ্গাতে গিয়ে পৌঁছে।

এই খেলার টানে মুসলিম যুবকের কত নামায নষ্ট হয়। নামাযের জামাআত চলে যায়। অনেকে সময় পার করে কাযা পড়ে নেয়। কিন্তু মহান আল্লাহ বলেন, “দুর্ভোগ (বা ওয়াইল দোযখ) সেই নামাযীদের জন্য, যারা তাদের নামায সম্বন্ধে উদাসীন।” (সূরা মাউন ৫-৬ আয়াত) তিনি আরো বলেন, “অতঃপর তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তীরা; যারা নামায নষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুবর্তী হল। যার ফলে তারা অচিরেই গাই’ (নামক দোযখের এক উপত্যকা) প্রত্যক্ষ করবে।” (সূরা মারয়াম ৫৯ আয়াত)

এই খেলাধূলা ও বিভিন্ন শরীর-চর্চায় মুসলিম তার লজ্জাস্থানকে নির্লজ্জভাবে উন্মুক্ত করে মহানবীর প্রকাশ্য বিরোধিতা করে থাকে।

মহিলার সর্বশরীর হল লজ্জাস্থান। কেবল গুপ্তাঙ্গ ও বক্ষঃস্থলই নয়; বরং তার দেহের অন্যান্য অঙ্গও লজ্জাস্থান; যা স্বামী বা একান্ত এগানা পুরুষ ছাড়া অন্যের সামনে প্রকাশ করতে লজ্জা হওয়া উচিত। অনুরূপ পুরুষের কেবল প্রস্রাব ও পায়খানা-দ্বারই লজ্জাস্থান নয়; বরং তার পার্শ্ববর্তী উপর দিকে নাভি পর্যন্ত এবং নিচের দিকে হাঁটু পর্যন্ত দেহ লজ্জাস্থান, যা বের করতে পুরুষকে লজ্জা করা উচিত। কিন্তু খেলোয়াড় যুবক-যুবতীরা লজ্জার মাথা খেয়ে কেবল নাম কেনার উদ্দেশ্যে নিজেদের লজ্জাস্থান খুলে দেখাতে এতটুকু সংকোচও করে না। কারণ, তাদের গোড়ার শিক্ষাই হল, সংকোচেরি বিহ্বলতায় হয়ো না মীয়মানা। অথচ দ্বীনের নবী %ি বলেন, “লজ্জা হল ঈমানের অন্যতম শাখা।” (বুখারী ৯, মুসলিম ৩৫নং)

মহানবী (সা.) আরো বলেন, “নারী হল সবটাই লজ্জার জিনিস।” (তিরমিযী, সহীহুল জামে ৬৬৯০নং) “(পুরুষের) নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত স্থান হল লজ্জাস্থান।” (হ্যমে সহীহুল জামে’ ৫৫৮৩ নং) তিনি আরো বলেন, “তুমি তোমার উরু খুলে রেখো না এবং কোন জীবিত অথবা মৃতের উরুর দিকে তাকিয়ে দেখো না।” (আবু দাউদ, সহীহুল জামে” ৭৪৪০ নং)

অন্যত্র বলেন, “তুমি তোমার জাং ঢেকে নাও। কারণ, জাং হল লজ্জাস্থান।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী হাকেম, ইবনে হিব্বান, সহীহুল জামে ৭৯০৬ নং)

কয়েক প্রকার খেলার মাঝে রয়েছে যৌনচারিতা, চোখ ও হাতের ব্যভিচার। যে খেলায় সুপ্ত যৌন অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগ্রত করা হয়। আর এটা তখন হয়, যখন প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কোন কিশোরী বা যুবতী দল! যখন শুধুমাত্র নাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে নারী প্রগতিবাদের দোহাই দিয়ে নারীবাদী স্বার্থপর পুরুষ উদ্যোক্তা ও দর্শকদের সামনে কতক যুবককে উষ্ণ ছোয়া দিয়ে থাকে এবং গরম পরশ খেয়ে থাকে।

যুবক বন্ধু! এ কথা বলো না যে, ঐ সময় খেলোয়াড়রা ঐ দিকে মন দেয় না। তুমি তোমার মনে ভালো করে চিন্তা করে দেখো। নচেৎ তার কোন এমন বন্ধুর মুখ হতে শুনো, যে হাডুডু খেলায় কোন মহিলা টিমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। আর খেলা চলা কালে দর্শকদের টিপ্পনী ও শিস কাটার কথা তো অবশ্যই শুনে থাকবে।

বন্ধু আমার! যুবক হয়ে তুমি নিশ্চয় জান যে, ঘর্ষণ ছাড়া শুধুমাত্র দর্শনেই কত বড় আকর্ষণ আছে। বাধা সত্ত্বেও ঐ নারী-সৌন্দর্যের দর্শনই কেবল মিলন ঘটাতে বাধ্য করে। পূর্ণিমার চাদের ঝলমলে রূপ দেখে সমুদ্রে জোয়ার আসে। যুবতীর যৌবনভরা রূপ-লাবণ্য দেখেই যুবকের তরঙ্গায়িত যৌবনের জোয়ার উত্তাল হয়ে ছুটে আসে।

বন্ধু একটি অভিজ্ঞতার কথা শোন, এক ব্যক্তি নিজের উপরে স্ত্রী হারাম (যিহার) করেছিল। যিহার করলে কাফফারা লাগে। একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে তাকে একটি দাস মুক্ত করতে হবে। ক্রীতদাস পাওয়া না গেলে বা তা ক্রয় করে স্বাধীন করার ক্ষমতা না থাকলে

স্পর্শ করার পূর্বে একটানা দুই মাস রোযা রাখতে হবে। এতেও অসমর্থ হলে ষাটজন মিসকীনকে আহার করাতে হবে। (সূরা মুজাদালাহ ৩-৪ আয়াত দ্রঃ) কিন্তু এ ব্যক্তি কাফফারা আদায়ের পূর্বেই স্ত্রী-মিলন করে ফেলে মহানবীর দরবারে উপস্থিত হয়ে নিজের অবস্থার কথা। খুলে বললে তিনি তাকে এ কাজের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। লোকটি বলল, 'জ্যোৎস্নার আলোতে আমি তার পায়ের মল বা নূপুর দেখে ধৈর্য রাখতে পারিনি!' (আবু দাউদ ২২২৩, সহীহ তিরমিযী ৯৫৮, নাসাঈ ৩৪৫৭, ইবনে মাজাহ ২০৬৫ নং)

হ্যাঁ বন্ধু! এটাই অক্লীব মানুষের প্রকৃতি। যুবকের যৌবনের উপচীয়মান জোয়ারের বেসামাল। আক্রমণ। অতএব এবার বল তো, পায়ের অলঙ্কার দেখে অথবা পায়ের রলার নিম্নাংশ চাদের আলোতে দেখে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে পায়ের রলার উপরের অংশ, বরং তারও উপরের অংশ জাং সূর্যের আলোতে দেখলে যুবকের মনের অবস্থা কি হতে পারে? আবার দর্শনের সাথে সাথে যদি তা স্পর্শ করে, বরং শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, তাহলে অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে তার অনুমান অবশ্যই করতে পারবে।

পক্ষান্তরে প্রিয় নবী বলেন, “যে মহিলা স্পর্শ করা হালাল নয় তাকে স্পর্শ করার চেয়ে তোমাদের কারো মাথায় লোহার উঁচ গেঁথে যাওয়া অনেক ভালো!” (তাবরানী সহীহুল জামে' ৫০৪৫ নং)

আর মহান আল্লাহর মহাঘোষণা শোন, “যারা আল্লাহ ও তদীয় রসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা অপদস্থ হবে; যেমন অপদস্থ হয়েছে তাদের পূর্ববর্তীরা।” (সূরা মুজাদালাহ ৫ আয়াত)

এই খেলায় হয় অর্থের অপচয়। জুয়া ও জুয়া-জাতীয় খেলায় কারো পৌষমাস, কারো সর্বনাশ হয়। একটি টুর্নামেন্ট চালাতে, বাইরের টিম আনতে, খেলার বিভিন্ন সাজসরঞ্জাম। ও পুরস্কারাদি সহ আরো অন্যান্য খাতে অপব্যয় হয় লক্ষ-লক্ষ ডলারের। এক দিকে দেশের এক শ্রেণীর মানুষ দারিদ্রের কারণে না খেয়ে মরে, আর অন্য দিকে অন্য এক শ্রেণীর বিলাসী মানুষ ৫ টাকার টিকিট ৫০০ টাকায় কিনে খেলা দেখতে দূর-দূরান্তে সফর করে। একদিকে সরকারের বিশেষ খাতে ঘাটতি পূরণের জন্য জনগণের উপর ট্যাক্স ইত্যাদি বাড়ানো হয়, কোন কোন জিনিসের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর অপরদিকে খেলার পেছনে ব্যয় করা হয় তার চেয়ে আরো অনেকগুণ বেশী বেশী টাকা।

ভাবতে আরো অবাক লাগে যে, একটা কাঠের ব্যাট বিক্রয় হয় কয়েক লক্ষ টাকায়। আর তা এ জন্য যে, ঐ ব্যাট বিশ্বকাপ জিতে জাতির মান রক্ষা করেছে এবং এই ক্রয়ের ফলে ক্রেতার নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাবে। খেলার পাগল বন্ধু আমার! মহান প্রতিপালক আল্লাহ বলেন, “আর তোমরা কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই এবং শয়তান তার প্রতিপালকের প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।” (সূরা ইসরা ২৬-২৭ আয়াত) মহানবী (সা.) বলেন, “পাঁচটি বিষয়ে কৈফিয়ত না দেওয়ার পূর্বে কিয়ামতের দিন কোন মানুষের পা সরবে না--- (তন্মধ্যে একটি বিষয় হল এই যে,) সে তার ধন-সম্পদ কোন উপায়ে অর্জন করেছে এবং কোন্ পথে তা ব্যয় করেছে?” (তিরমিযী, সহীহ তারগীব ১২১ নং)

খেলা তার খেলোয়াড় ও দর্শকদেরকে মানসিক বিকারগ্রস্ত করে ছাড়ে। খেলার নেশা খেলাপ্রিয়দেরকে হার-জিতের সময় এক প্রকার মাতাল করে তোলে। জিতার খবর শোনা মাত্র কেউ কেউ খুশীতে কেঁদে ফেলে! বিজয়-উল্লাসে যুবক-যুবতীর দল কাপ মাথায় নাচতে শুরু করে। যেন মাথায় তাদের ব্রঞ্জ বা স্টেইনলেশ স্টিলের কাপ নয়, বরং ‘সাত রাজার ধন মানিক’ পেয়ে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ডিস্কো ড্যান্স প্রদর্শন করে। অনেকে অনেকের মুখ-মিষ্টিও করায়।

পক্ষান্তরে হারার খবর শোনা মাত্র কেউ কেউ মুছা যায়! কেউ বা ক্ষোভ ও দুঃখে ফেটে পড়ে নিজের রেডিও-টিভি ভেঙ্গে ফেলে। কেউ কেউ খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। মনের বিষন্নতায় অনেকের ঘুম আসে না কয়েক রাত! কেউ বা আত্মহত্যা করে খেলার মস্তান’ বা খেলার শহীদ’ হয়ে খেলাধূলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নজীর সৃষ্টি করে!!

আর এইভাবে খেলা যেন আমাদের জীবনের একটি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে পড়েছে। যার দরুন তার উন্নতি-অবনতিও আমাদের জীবনে বিরাট আন্দোলন ও পরিবর্তনের তুফান ডেকে আনে। অথচ দ্বীন বা ইসলাম মুসলিমের প্রাণ হওয়া সত্ত্বেও তার পরাজয়ে বিষন্ন হতে এবং বিজয়ে আনন্দিত হতে খুব কম সংখ্যক লোকই পরিদৃষ্ট হয়। সাহায্য-সহানুভূতিতে যে জাতির উপমা হল একটি দেহের মত; যার একটি অঙ্গ ব্যথিত হলে বাকী সকল অঙ্গ সমানভাবে ব্যথিত হয়। কিন্তু সেই জাতির দেহাঙ্গের বহু স্থান ব্যথিত হওয়া সত্ত্বেও সে ব্যাপারে বহু কম সংখ্যক মুসলিমেরই মাথা-ব্যথা দেখা যায়।

বহু খেলা এমন আছে, যাতে খেলোয়াড় বা দর্শকের প্রাণহানি বা অঙ্গহানি ঘটে। কেবলমাত্র নাম কেনার জন্য উচু উচু পর্বতমালায় চড়তে গিয়ে, দুরন্ত ষাড়ের সঙ্গে লড়তে গিয়ে, মোটর সাইকেল বা কার রেসে প্রথম স্থান অধিকার করতে অথবা বিশ্বরেকর্ড ভাঙ্গতে গিয়ে কত ‘বীর-বাহাদুর’দের জীবন ক্ষয় হয়ে যায়। কত দর্শক খেলা দেখতে গিয়ে ভিড়ের চাপেও জান কুরবানী দেয়!

খেলা এমন জিনিস, যা অনর্থক সময় নষ্ট করে। অথচ মুসলিম যুবকের উচিত, সময়ের যথােচিত কদর করা, সময়ের যথার্থ মূল্যায়ন করা। কারণ, সময়ই হল জীবন। অতএব যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে ভালোবাসে, সে ব্যক্তির উচিত, সময়ের অপচয় না করা। হাসান বসরী (রঃ) বলেন, 'হে আদম সন্তান! তুমি আসলে কতকগুলি দিনের সমষ্টি।

সুতরাং যখনই তোমার একটি দিন চলে যায়, তখনই তোমার (জীবনের) একটা অংশ ধ্বংস হয়ে যায়।” সময়ের গুরুত্ব বর্ণনা করে মহানবী বলেন, “পাচটি জিনিসের পূর্বে পাঁচটি জিনিসের যথার্থ সদ্ব্যবহার করো; তোমার মরণের পুর্বে তোমার জীবনকে, তোমার অসুস্থতার পুর্বে তোমার সুস্থতাকে, ব্যস্ততার পুর্বে তোমার অবসর সময়কে, বার্ধক্যের পূর্বে তোমার যৌবনকালকে এবং দরিদ্রতার পূর্বে তোমার ধনবত্তাকে।” (হাকেম কইহাকী সহীহুল জামে' ১০৭৭৭ নং)

বহু মানুষ আছে, যারা সময়ের কদর বোঝে। আমরা ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে, প্লেনে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লম্বা সফর করলে সে সময়ে রাজনৈতিক ভুয়ো গল্প বা খেলাধূলা নিয়ে বিভিন্ন আস্ফালনমূলক কথাবার্তা আলোচনা করে থাকি। কেউ বা তাস ইত্যাদি খেলে সময় কাটিয়ে থাকে। কিন্তু ওরা সে সময় কিছু না কিছু পড়ে থাকে। এমন কি ২০/৩০ মিনিটের সফর হলেও সঙ্গে রাখা বই অথবা ম্যাগাজিন খুলে পড়তে শুরু করে। পৃথিবীতে এমন মানুষরাই হল উন্নত ও কাজের মানুষ। আর তারাই হল শিক্ষিত জাতির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।

মুসলিম যুবককেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত। জাতির হারিয়ে যাওয়া গৌরব ফিরিয়ে আনতে শিক্ষিত যুব-সমাজকেই আগুয়ান হতে হবে। জীবন্ত সময়কে হত্যা করে নয়, বরং সে সময়কে আরো তরোতাজারূপে প্রাণবন্ত রাখতে তার উচিত হল, তা যথা কাজে, কাজের মত কাজে, যথারীতি ব্যয় করা।

পরন্তু বাস্তব কথা হল এই যে, ইসলামী অভিধানে ‘অবসর’ বা ‘অবকাশ’ বলে কোন শব্দ নেই। কারণ, মুসলিমের জীবন হল কাজে-কাজে পরিপূর্ণ। দুনিয়ার কাজ না থাকলে দ্বীনের কাজে, সংসারের ব্যস্ততা না থাকলে পরকালের চিন্তায় সে সব সময় ব্যস্ত থাকে। মহান আল্লাহ বলেন, “অতএব যখন তুমি অবসর পাও তখন পরিশ্রম কর এবং তোমার প্রতিপালকের প্রতি মনোনিবেশ কর।” (সরা ইনশিরাহ ৭-৮) আর মহানবী (সা.) বলেন, “মানুষ মারা গেলে তার (সকল)। আমল বন্ধ হয়ে যায়।------।” (মুসলিম ১৬৩১ নং) অর্থাৎ, মরণের পূর্ব পর্যন্ত তার কর্ম বন্ধ হয় না। অতএব যে জাতির কোন অবসর নেই, তার আবার অবসর-বিনোদন’ কি? মুসলিমের জীবনের মূল্য আছে, লক্ষ্য আছে। যাদের জীবনের কোন লক্ষ্য নেই, কেবল তাদের কাছেই সময়ের কোন কদর নেই। সুতরাং মুসলিম খেল-তামাশায় তার জীবন ও সময় অপচয় করতে পারে না।

মুসলিম স্রষ্টায় বিশ্বাসী। অতএব তাকে এ কথা বিশ্বাস করতেই হবে যে, তাকে বেকার সৃষ্টি করা হয়নি। তাকে সৃষ্টি করার পশ্চাতে এক মহৎ উদ্দেশ্য ও গুরুত্বপূর্ণ রহস্য আছে।

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেন, “তোমরা কি মনে কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি। এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?” (সূরা মু'মিনুন ১১৫ আয়াত)

“আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যে যা কিছু আছে তার কোনটাই আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি; আমি এ দু’টিকে বৃথা সৃষ্টি করিনি। কিন্তু ওদের অধিকাংশই তা জানে না। সকলের জন্য নির্ধারিত আছে ওদের বিচার দিবস।” (সূরা দুখান ৩৮-৪০ আয়াত) “আসমান ও জমিন এবং এতদুভয়ের মাঝে যা কিছু আছে তা আমি ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি যদি চিত্তবিনোদনের উপকরণ সৃষ্টি করতে চাইতাম, তবে আমি আমার নিকট যা আছে তা নিয়েই করতাম; যদি আমাকে করতেই হত তাহলে।” (সূরা আম্বিয়া ১৬-১৭ আয়াত)

তার অগণিত সৃষ্টির মাঝে রয়েছে হাজারো রহস্য। তাঁর তওহীদ ও একত্ববাদের নিদর্শন। পক্ষান্তরে সৃষ্টির পশ্চাতে তার উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করে তিনি বলেন, “আমি জিন ও ইনসানকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত ৫৬ আয়াত) সুতরাং যে জীবন ও সময় আল্লাহর ইবাদতের জন্য এবং তার ইবাদতের সহায়ক দুনিয়াদারী করার জন্য সৃষ্ট, তা মুসলিম খেলায় ও হেলায় নষ্ট করতে পারে না।

যে দেহ ও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহর সৃষ্টি এবং আমাদের নিকট যা আমানত, সে দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কাজে কিরূপে ব্যয় করতে সাহস করতে পারি? তিনি আমাদেরকে, আমাদের হায়াত ও মওতকে খেলার জন্য নয়, বরং কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহর ঘোষণা হল, “যিনি তোমাদেরকে এই পরীক্ষা করার জন্য জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন যে, কে তোমাদের মধ্যে কর্মে সবচেয়ে উত্তম।” (সূরা মুল্‌কঃ ২আয়াত)।

যুবক ভাই আমার! তোমার এ শক্তিমত্তার জীবন খেলার জন্য নয়। এ জীবন তোমাকে দেওয়া হয়েছে, যাতে তুমি পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পার। যাতে তুমি জীবনদাতার জন্য জীবন ও সময় কুরবানী দিতে পার। আর মনে রেখো যে, তোমার জীবনের সাথে ওদের জীবনের কোন তুলনাই হয় না, যারা জানে না যে, তারা কেন সৃষ্ট হয়েছে। যাদের জীবনের লক্ষ্যবস্তু কোন কিছু নেই। যাদের জীবন হল, পার্থিব জীবন ও বা। অতএব তাদের খেলাধুলার বিরাট উন্নতি ও অগ্রগতি (?) দেখে তোমার ঈর্ষা হবে। কেন? জীবন সফরে তুমি আছ ঘোড়ার পিঠে। সুতরাং ওরা মরা গাধা নিয়ে বিশাল উন্নত বলে প্রচার-যন্ত্রে প্রচার চালালে তোমার তাতে ঈর্ষার কি আছে? ঘোড়া থাকতে মৃত গাধার জন্য হিংসা কিসের?

যে উন্নতির মাঝে আল্লাহর সম্মতি ও সন্তুষ্টি নেই, তা তো আসলে উন্নতি নয়; বরং সেটাই হল অবনতি। যে প্রগতির সম্মুখে উজ্জ্বল লক্ষ্যপথ নেই, তা আসলে অধোগতি। অতএব এমন দুর্গতিকে প্রগতি মনে করার কোন কারণ নেই বন্ধু। খেলাধুলায় কাপ’ জিতে জাতির নাম ও মান রক্ষা হয় না ভাই! জাতির নাম ও মান রক্ষা হয়, জাতির জন্য কাজ করলে। আর খেলা কোনদিন কাজ নয়। কাজ না করে খেলা করলে বকুনি বা মার খেতে হয়েছে শিশুবেলায় অভিভাবকদের কাছে। অতএব সে খেলায় নাম কেন হবে? জাতির হেদায়াত-উজ্জ্বল জীবন গড়তে, আদর্শ-ভিত্তিক পরিবেশ গড়তে, জাতির জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করতে যে সাধনার দরকার, সে সাধনার মাঝেই আছে জাতির নাম ও মান।

খেলোয়াড় বন্ধু আমার! সে শরীরের গঠন-আকৃতি সুঠাম ও মজবুত করে কি লাভ, যে শরীরের হৃদয় হল মৃত? সে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে লৌহসদৃশ কঠিন করে কি ফল, যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোন নৈতিকতা নেই, সত্য পথে জিহাদের কোন প্রস্তুতি নেই?

শরীরচর্চাকারী খেলোয়ার বন্ধু! তুমি হয়তো আয়নার সামনে দাড়িয়ে তোমার কাধে ওঠা শক্ত পেশী দেখেছ, বুক ও বাহুর মজবুত মাশুল দেখেছ, কিন্তু এ সুঠাম দেহ ও সুডৌল শরীরকে সেই দোযখের লেলিহান আগুন থেকে রক্ষা করার উপায় দেখেছ কি, যে দোযখের ইন্ধন হল মানুষ ও পাথর; যার নিয়ন্ত্রণভার অর্পিত আছে এমন কঠোর-হৃদয় ফিরিস্তাদের উপর, যারা আল্লাহর আদেশের অন্যথাচরণ করেন না এবং তাই করেন, যা করতে

তাদেরকে আদেশ দেওয়া হয়? আল্লাহর পানাহ, যাতে তোমার এ সৌষ্ঠবসম্পন্ন লোহার দেহ দোযখের ইন্ধন না হয়।

এক শ্রেণীর খেল-তামাশায় উন্মত্ত মানুষদের জন্য আল্লাহ বলেন, “(হে নবী!) তুমি তাদের সঙ্গ ত্যাগ কর, যারা তাদের দ্বীনকে ক্রীড়া-কৌতুকরূপে গ্রহণ করে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে প্রতারিত করে। আর এর দ্বারা তাদেরকে উপদেশ দাও, যাতে কেউ নিজ কৃতকার্যের জন্য ধংস না হয়। যখন আল্লাহ ব্যতীত তার কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী থাকবে না এবং বিনিময়ে সবকিছু দিলেও গৃহীত হবে না। এরাই স্বীয় কৃতকার্যের জন্য ধ্বংস হবে। তাদের অবিশ্বাস হেতু পানীয়ের জন্য উত্তপ্ত পানি ও যন্ত্রণাপ্রদ শাস্তি আছে।” (সূরা আনআম ৭০ আয়াত)। তিনি আরো বলেন, “জনপদসমুহের অধিবাসীরা কি ভয় করে না যে, আমার শাস্তি তাদের উপর আসবে চাশতের সময়, যখন তারা ক্রীড়ারত থাকবে?” (সূরা আরাফ ৯৮ আয়াত)

সমাজবিজ্ঞানী নবী (সা.) বলেন, “আমার উম্মতের মধ্যে কিছু সম্প্রদায় এমন হবে, যারা পান-ভোজন ও খেল-তামাশার মাধ্যমে রাত্রিযাপন করবে। অতঃপর সকাল হলে তারা বানর ও শুকরদলে রূপান্তরিত হয়ে যাবে।” (ত্বাবারানী, সহীহুল জামে’ ৫৩৫৪ নং)

যে সব খেলায় একতরফাভাবে আর্থিক ক্ষতি বিদ্যমান, ইসলামে সে সব খেলাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন মদ ও মূর্তিপূজার পাশাপাশি জুয়া খেলাকে করা হয়েছে অবৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! মদ, জুয়া, মুর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য-নিৰ্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা থেকে দূরে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর সারন ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি নিবত্ত হবে না?” (সূরা মাইদাহ ৯০-৯১ আয়াত)

আর এই আইনের আওতায় পড়ে সেই সকল খেলা, যাতে আছে অনুরূপ একতরফা আর্থিক ক্ষতি এবং একপক্ষের বিনা মেহনতে অসঙ্গতভাবে অর্থলাভ। যেমন লটারী, ডাইস, বিমা, বাজি রেখে তাস খেলা ইত্যাদি।

যে সব খেলায় আছে বৈষয়িক, সাংসারিক, ও দৈহিক ক্ষতি এবং যা অনর্থক সময় নষ্ট করে, সে সব খেলাও ইসলামে বৈধ নয়। যেমন দাবা ও পাশা জাতীয় সকল খেলা মুসলিমের জন্য হারাম। আল্লাহর নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি পাশা-জাতীয় খেলা খেলল, সে যেন নিজ হাতকে শুয়োরের রক্তে রঞ্জিত করল।” (আহমাদ, মুসলিম ২২৬০, আবু দাউদ ৪৯৩৯ ইবনে মাজাহ ৩৭৬৩ নং)

তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তি পাশা-জাতীয় খেলা খেলল, সে আল্লাহ ও তার রসুলের নাফরমানী করল।” (মালেক, আবু দাউদ ৪৯৩৮, ইবনে মাজাহ ৩৭৭৬২, হাকেম ১/৫০, সহীহুল জামে’ ৬৫২৯ নং)

আর এ পর্যায়ের খেলা হল, তাস, লুডু কেরামবোর্ড ও গুটি খেলা, পায়রা উড়িয়ে খেলা। ইত্যাদি। এ সব খেলায় অযথা সময় নষ্ট হয় এবং তাতে শারীরিক কোন উপকার লাভ তো হয়ই না, বরং অপকার হয়ে থাকে। এ সবে মানুষকে কুঁড়ে, অলস ও অকর্মণ্য করে তোলে। পক্ষান্তরে এ সবে কিছু বাজি থাকলে জুয়াতে পরিণত হয়ে থাকে। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে যে, তাহলে ইসলামে কি খেলার নাম-গন্ধই নেই? জবাবে বলা যায় যে, হ্যাঁ, ইসলামে কোন খেলার গন্ধই নেই। কারণ মুসলিমদের খেলা খেলার কোন সময়ই নেই। খেলা হল প্রত্যেক লক্ষ্যহীন কাজের নাম; যে কাজের পিছনে শুদ্ধ বা অশুদ্ধ। কোন লক্ষ্যই থাকে না, নিছক সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে করা হয়। আর মুমিনের প্রত্যেক কাজের পিছনে লক্ষ্য আছে। তার এমন কোন সময় নেই, যা কাটাতে হয়। তার প্রতিটি মুহূর্ত হয় ইবাদতে কাটে, নচেৎ ইবাদতে সহায়ক কোন পার্থিব কাজে।

অতএব তার সময় কাটে না। নয়, বরং সে সময়ই পায় না। সুতরাং মুসলিম যদি কোন নির্দিষ্ট কাজ থেকে কিছু ফুরসৎ পায় এবং তাকে সে অবকাশ বলে। মনে করে, তবে সেই অবকাশকেও কাজে লাগিয়ে ‘অবসর-বিনোদন’-এর কাজ নিতে পারে। এতে কাজের একঘেয়েমি কেটে যাবে এবং নতুনভাবে ঐ কাজে মনের উদ্যম ফিরে পাবে। এর জন্য ঐ অবসর সময়ে গঠনমূলক সবান্ধব বৈঠক করে এবং যুবশিবির স্থাপন করে দ্বীনী ও সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে তার মাধ্যমে সময় কাটাতে পারে।

পক্ষান্তরে যে খেলায় মুসলিমের উপকার আছে, যা উদ্দেশ্যপ্রণােদিত, যাতে আছে দ্বীন, প্রাণ ও স্বাস্থ্য রক্ষার অনুশীলন, সংসার ও স্বামী-স্ত্রীর প্রেম-বন্ধন দৃঢ় করার উপায়, যে খেলায় অর্থের অপচয় নেই, সময়ের অপব্যয় নেই, যাতে কোন প্রকার শরীয়ত-বিরোধী কর্ম করতে হয় না, এমন খেলা মুসলিমের জন্য অবশ্যই বৈধ। শরীয়তে এ বিষয়ে সংকীর্ণতা নেই। (সিলসিলাহ সহীহাহ ১৮২৯ নং দ্রঃ)।

যেমন দৌড়-প্রতিযোগিতা, বিশেষ করে নিরালায় স্ত্রীর সাথে দৌড়-প্রতিযোগিতা করা ইসলামের এক সাংসারিক আদব। মহানবী (সা.) স্বয়ং নিজ স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) এর সহিত এমন। প্রতিযোগিতা করে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে প্রেম ও আনন্দ প্রকাশের এক সুন্দর নজীর রেখে গেছেন। (আবু দাউদ, নাসাঈ, ত্বাবারানী, ইবনে মাজাহ, ইরওয়াউল গালীল ১৪৯৭ নং দ্রঃ)।

স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের প্রেমকেলি করা, মিলনের পূর্বে ভূমিকা স্বরূপ বিভিন্ন আচার ও শৃঙ্গার ইসলামে বৈধ। এতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মধুর থেকে মধুরতম হয় এবং উভয়ে ব্যভিচার থেকে বাচতে পারে। ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বৈধ। যেমন বৈধ তীরন্দাজি খেলা। কারণ, এতে মুসলিমের ঈমান, জান, ধন ও মান রক্ষার উদ্দেশ্যে জিহাদী অনুশীলন হয়। আর জান রক্ষার তাকীদেই সঁতার খেলাও ইসলামে বৈধ। (নাসাঈ, ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ৩১৫নং দ্রঃ)

আধুনিক বিশ্বের ফুটবল, হাডুডু ইত্যাদি স্বাস্থ্যরক্ষামূলক খেলাধূলাও কিছু শর্তের সাথে বৈধ। যেমন এই খেলা খেলতে গিয়ে যেন জাং বের না হয়। কারণ, জাং হল লজ্জাস্থানের অংশ। এ খেলা যেন যথাসময়ে জামাআতে নামায বা অন্যান্য ইবাদত থেকে উদাসীন ও গাফেল করে না রাখে এবং এতে যেন শরীয়ত-বিরোধী কোন বিষয় বা বস্তু শামিল না থাকে। বলা বাহুল্য, ইসলাম যে খুশী ও আনন্দ প্রকাশকে হারাম করেছে তা নয়। তবে ইসলামের প্রত্যেক কাজ হল সীমাবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। লাগামছাড়া ও বাঁধনহারা নয়। যে খুশীতে আল্লাহ খুশী, সে খুশী ইসলামের কাম্য। যে আনন্দে আল্লাহ সন্তুষ্ট, সে আনন্দ মুসলিমের কর্ম ও ধর্ম। শুধু নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধি ও প্রবৃত্তিপুজার জন্য নয়, বরং যে আনন্দে সৃষ্টির মনে আনন্দের ঢেউ আনা যায়, সেই আনন্দই মুসলিমের পরম আনন্দ। তাই তো সে পোলাও নিজে খেয়ে যে আনন্দ পায়, তার চেয়ে বেশী আনন্দ পায় তা অপরকে খাইয়ে। নিজে ভালো পরে যে খুশী। অনুভব করে, অপরকে তা পরিয়ে অনুভব করে তার চাইতে বেশী খুশী। যে আনন্দের মাঝে। বেদনা লুকিয়ে থাকে, তা মুসলিমের কাম্য নয়।

কাম্য হল নির্মল আনন্দ। বরং যে বেদনার মাঝে আনন্দ লুকিয়ে আছে, তাও তার কাম্য। সুতরাং যুবক বন্ধু! খেল, খুশী কর। কিন্তু তাতে তোমার মহান প্রভুকে নাখোশ করো না। এতো গেল খেলোয়াড়দের কথা। এবার দর্শকদের কথায় আসা যাক। যে খেলার পাগলরা খেলা দর্শন করে, তারাও আসলে তাদের মনের মাঠে হাত-পা নেড়ে খেলে থাকে। মনেমগজে খেলার বিভিন্ন দিক বিচার করে, ভুল ধরে, কখনো খেলোয়াড়কে আবার কখনো বা রেফারীকে ভৎসনা ও গালিমন্দ করে থাকে। অথচ তারা জানে যে, কল্পনা করা ও মুখে বলা যত সহজ, কাজে পরিণত করা তত সহজ নয়।

কিন্তু এতে লাভ কি হয়? মনে মনে এক প্রকার তৃপ্তিকর আনন্দ অনুভব ও সময় কাটানো ছাড়া আর কিছু হয় কি? এতে শারীরিক কোন উপকার হয় কি? বিধায় তা বৈধ কি?

বৈধ কি দূর-দূরান্তে সফর করে টিকিট কিনে, কখনো ৫ টাকার টিকিট ৫০০ টাকায় কিনে ঘন্টার পর ঘন্টা রৌদ্রতাপে অথবা বৃষ্টির নিচে অথবা কনে শীতে বসে থেকে হাততালি দেওয়া অথবা দাঁড়িয়ে ড্যান্স করতে করতে মুখে নানা মন্তব্য করা?

অনুরূপ বৈধ কি ঐ খেলা টিভির পর্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা দেখে যাওয়া? তদ্রুপ কানের গোড়ায় রেডিও লাগিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কেবল খেলার হৈচৈ ও ফলাফল শুনে যাওয়া?! সংসারের কাজ, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা ইত্যাদি কর্তব্য ছেড়ে সময় নষ্ট করে চিত্তবিনোদনে কি ইসলাম অনুমতি দেয়?

যদি কেউ বলেন, বৈধ খেলা দেখা বৈধ। কারণ স্বয়ং আল্লাহর নবী , এবং তার অল্প বয়স্কা পত্নী হযরত আয়েশা (রাঃ) তার পশ্চাতে পর্দায় থেকে মসজিদে হাবশীদের যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা দেখেছেন। তাহলেও এ শর্ত স্বীকার করতেই হবে যে, তা যেন অধিক সময় নষ্ট

করে, নামায ও তার জামাআত নষ্ট না করে। কারো উরর দিকে যেন তাকানো না হয়। (পুরুষ দেখলে) সে খেলা যেন কোন মহিলার না হয়। তাতে যেন কোন প্রকার অর্থের অপচয় ঘটে। ইত্যাদি। আমাদের দেশে মেলা হল নানা খেলার আখড়া। কোন কোন মেলা আবার শির্কের (মুর্তি বা কবরপূজা ও উরসের) উৎসব-কেন্দ্র। এ সব উৎসবে কোন মুসলিমের অংশগ্রহণ করা নিশ্চয়ই বৈধ নয়। তাছাড়া মেলা হল প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন-ক্ষেত্র, 'চুম্মা কা ওয়াদা পূরণের স্থান। রঙ-তামাশার রঙ্গমঞ্চ। সাধারণতঃ জুয়ারী, শারাবী, লম্পট ও অসদাচারীদের সমাবেশস্থল। এখানে কোন চরিত্রবান যুবক-যুবতীর যাওয়ার অর্থই হল অসৎচরিত্রতাকে পছন্দ করা এবং নিজের সচ্চরিত্রতাকে বিনষ্ট করা।

খেলার নেশায় অনেকে আবার খেলার খবর রাখতেও এত অতিরঞ্জন করে যে, শুধু খেলার খবর নেওয়ার জন্যই রেডিও-টিভি বা পত্রিকা ক্রয় করে। যেমন এই শ্রেণীর যুবকদের মন যোগাতে ঐ সব প্রচারমাধ্যমে খবরের একটা বড় অংশ খেলার জন্য নির্ধারিত করা হয়; বরং শুধু খেলাধুলা নিয়েই বিশেষ পত্রিকা বাজারে প্রকাশিত হয়ে থাকে। আর খেলার পাগল যুবকরা কেবল মাত্র খেলার খবরটি শোনার জন্য উদ্বিগ্ন থাকে এবং পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টে খেলার খবরই আগে পড়ে থাকে! কত যুবক-যুবতী তো তার দেশে বিশ্বকাপ হবে অথবা তার দেশ তাতে খেলতে সুযোগ পাবে শুনে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে কয়েক দিন ধরে এ নিয়ে খুশী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রোড জাম করে, সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে নেচে-গেয়ে বেড়ায়!!

কি জানি এতে তারা কি লাভ বা তৃপ্তি পায়? শুধু যুব-সমাজই নয় বরং দেশের বৃদ্ধ নেতা-নেত্রীরাও তাতে গর্ববোধ করে থাকে। কারণ, খেলাধুলার উন্নয়নে নাকি জাতির মর্যাদা ও অম্লন গৌরব আছে!!! একদা আমার এক বন্ধু এক মজলিসে খেলার কথা চলতে চলতে বিশ্বকাপের সেমিফাইন্যালে কোন্ কোন্ দেশ উঠল তা বলতে না পারলে আমাকে বলে ফেলল, তুমি দেখছি কিছুরই খবর রাখ না! আমি অন্য কিছু না বলে তাকে শুধু বললাম যে, আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযু বিকা মিন ইলমিল লায়্যানফা।' (অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমি সেই জ্ঞান থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা কোন উপকার সাধন করে না।)

পরিশেষে যুবক বন্ধুদেরকে এই অনুরোধ করি যে, ক্লাবগুলোকে শুধুমাত্র হৈচৈ ও খেলার জন্য ‘কিলাব’-ঘর করে রেখো না। বরং ঐ ক্লাবকে জাতির কূলব’ ও প্রাণকেন্দ্র করে গড়ে তোল। যুবশক্তি ‘মেন-পাওয়ার’-এ পরিণত হোক ইসলামের স্বার্থে, মুসলিম জাতির স্বার্থে।

উপসংহারে যুবক বন্ধুর জন্য এক আধ্যাত্মিক ব্যায়ামের কথা বলি, যাতে তার ঈমান ও দ্বীন মজবুত হতে পারে। পূর্ণ মু'মিন যুবকের নিজ মন ও প্রবৃত্তির সহিত সাত পর্যায়ের নিয়মিত ব্যায়াম ও অনুশীলন হওয়া উচিতঃ

প্রথমতঃ নিজের আত্মার সহিত এই পরামর্শ হওয়া উচিত যে, সে আগামীতে কোন্ ধরনের নেক কাজ করবে? যে কাজ তার ভবিষ্যতে কাজে দেবে সে কাজের পরিকল্পনা করবে, ক্ষয়শীল আয়ু ও লয়শীল জীবনের কয়টা দিনে আল্লাহর কোন অবাধ্যতা করবে না। হেলায় সুযোগ না হারিয়ে পরবর্তীতে লাঞ্ছিত হওয়ার কাজ কখনই করবে না।

দ্বিতীয়তঃ খুব সতর্কতার সহিত লক্ষ্য ও খেয়াল রাখবে, যাতে কোন প্রকার পাপ ও ত্রুটি ঘটে বসে। প্রবৃত্তি যেন কোন প্রকার কু’-এর দিকে ঝুঁকে না বসে। সর্বদা মনের মাঝে এই অনুভুতি রাখবে যে, আল্লাহ তাআলা সুক্ষদর্শী, সর্বদ্রষ্টা। তিনি তার সকল কাজ সুক্ষভাবে দর্শন করছেন। তাঁর ফিরিস্তা সকল ভালোমন্দ নোট করে রাখছেন। যার আলোকে তার সামনে একদিন জবাবদিহি করতে হবে।

তৃতীয়তঃ আত্মার কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। মানুষের মন অধিকাংশ মন্দপ্রবণ, মনের প্রকৃতি হল দেহের আরাম-প্রিয়তা, আলস্য ও স্বেচ্ছাচারিতা। কারো বাধ্য হয়ে থাকা মনের প্রকৃতি নয়, কোন শক্ত কাজ করা মনের স্বভাব নয়। অতএব মনের এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কারণ, এমনও হতে পারে যে, প্রবৃত্তিবশে “তোমরা যা পছন্দ কর না, তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং তোমরা যা পছন্দ কর, তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর (কোটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর তা) আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না।” (সূরা বাক্বারাহ ২১৬ আয়াত)

এ জিহাদে বিজয় লাভ করলে মানুষ প্রকৃত মানুষ’ ও ‘মানব’ হতে পারে। নচেৎ মনের কাছে পরাজিত হলে সে পশুত্বে অবতরণ করে। আল্লাহর ওয়াদা হল, “যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে তাদেরকে আমি আমার পথে পরিচালিত করে থাকি। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে থাকেন।” (সূরা আনকাবুত ৬৯ আয়াত)

চতুর্থতঃ আত্মসমালোচনা করবে। সারা দিনের কৃত আমলের উপর নিজ আত্মার হিসাব নেবে। ভালো কাজ করে থাকলে আল্লাহর শুকর করবে এবং মন্দ কাজ করে থাকলে লজ্জিত হয়ে অনুতাপের সাথে তার নিকট তওবা করবে। আর আগামীতে যেন সে ত্রুটি না হয় তার জন্য যথার্থ খেয়াল রাখবে।

পঞ্চমতঃ ত্রুটি হলে নিজের মন ও আত্মাকে ভৎসনা ও তিরস্কার করবে। ঔদাস্য ও অবজ্ঞার জন্য নিজেকে ধিক্কার জানাবে। কৃত ভুলের জন্য মনকে আক্ষেপ-জ্বালায় দগ্ধীভূত করবে।

ষষ্ঠতঃ কৃত পাপের জন্য নিজের মনকে শাস্তি প্রদান করবে। মনের পছন্দনীয় কিছু জিনিস ত্যাগ করে শাস্তির কথা নিজের মনের মণিকোঠায় আন্দোলিত করে রাখবে।

আর সপ্তমতঃ ভালো কাজ করে থাকলে তার জন্য মনকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করবে। ভালো কাজ করলে এমনিতেই মুমিনের হৃদয় হর্ষোৎফুল্ল হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও বৈধ কোন উপায়ে মনকে আরো চাঙ্গা করা, মনের মাঝে একঘেয়েমি দূরীভূত করা এবং পুনঃপুনঃ মনের উদ্যম ফিরিয়ে আনা কর্তব্য। যাতে ইহকালের বৈধ খুশী ব্যবহার করে পরকালের পরম খুশী লাভের অধিক সুযোগ লাভ হয়। আল্লাহর আনুগত্য ও ছাত্র-জীবনে এমন আত্মসমীক্ষা বড় ফলপ্রসূ।

ঢেউ খেলানো যৌবনের সাথে সাথে যে মন-মাতানো গান-বাজনায় যুবকের মন তালেতালে গেয়ে ও নেচে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বহু যুবককে দেখা যায় যে, সুর-ঝংকার ও বাজনার তালে-তালে গা ও মাথা হিলিয়ে থাকে; যদিও বা সে গানের ভাষা বা অর্থ না বোঝে। কখনো বা বেসামাল হয়ে হাততালি সহ ‘ড্যান্স’ শুরু করে থাকে। কিন্তু এমন কাজ অস্বাভাবিক হল একজন মুসলিমের জন্য। কারণ, মুসলিমের প্রকৃতি হল। ইসলামের প্রকৃতি। আর সে প্রকৃতিতে এ শ্রেণীর প্রবৃত্তি পূজা তথা ‘ধেই-ধেইনি’ একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তির জন্য রুচিবিরুদ্ধ কর্ম।

পক্ষান্তরে যে সকল পথ দিয়ে শয়তান মানুষের মনের কোণে আসন পেতে নিতে পারে, তার মধ্যে তিনটি প্রধান পথ হল, মানুষের ঔদাস্য, ক্রোধ ও কাম। একটু উদাসীন অথবা ক্রোধান্বিত হলে শয়তান যেমন সত্বর মনের সিংহাসনে আরোহণ করে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে বিপদে ফেলে থাকে, ঠিক তেমনি কাম ও কামনার ছিদ্রপথে প্রবেশ করে শয়তান প্রবৃত্তি-পূজায় লিপ্ত করে মানুষকে। তার মনে নতুন নতুন বাসনা সৃষ্টি করে এবং সেই বাসনা চরিতার্থ করার বিভিন্ন উপায়-উপকরণও বাতলে দেয়। গান-বাজনা এমনই এক শয়তানী উপকরণ, যার মাধ্যমে মানুষ তার কামনা-বাসনায় পরিপূর্ণ জ্বালাময় হৃদয়ে অপূর্ব শান্তির দিশা পায়। নিরানন্দ চিত্তে আনন্দের তুফান আনতে সক্ষম হয়। আর এরই মাঝে শয়তান ঐ মানুষের মনে গাফলতি ও ঔদাস্য সৃষ্টি করতে আরো সহজ রাস্তা পায়।

এর ফলে ধীরে-ধীরে সে মানুষকে তার আসল প্রভুর স্মরণ ও দাসত্ব থেকে দূরে সরিয়ে এনে নিজের দাস বানিয়ে নিতে কৃতার্থ হয়। কিছু যুবক আছে; যাদেরকে দ্বীনের কাজে আসতে বললে তারা বলে, কি করি? সময় পাই । অথচ যখন তাকে তাস, কেরাম বা দাবা খেলাতে অথবা গান-বাজনা শুনতে দেখে যদি বলা হয় যে, এ কাজ কেন করছ? এ তো হারাম!' তখন চট করে সে বলে, কি করি বলুন? সময় তো কাটাতে হবে!' এমন মানুষ দ্বীনের কথা শোনার জন্য সময় পায় না, আবার তার হাতে এত জ্বালাময় সময় আছে যে, তা কোন মন-মাতানো, হৃদয়-ভুলানো উদাসকারী বিষয় ছাড়া কাটতেই চায় না। এমন মানুষের মনে শয়তানের বড় প্রভাব থাকে।

এ ধরনের পরস্পর-বিরোধী জবাব দিয়ে সে শুধুমাত্র পিছল কেটে নিজ দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি সাধন করে থাকে। কখনো বা গান-বাজনার নেশায় সংসারের কাজ ও কর্তব্য ভুলে বা ছেড়ে বসে। অবহেলা প্রদর্শন করে সামাজিক কাজেও। এস, এবারে দেখা যাক কোন্ কিতাবে আছে রে ভাই হারাম বাজনা-গান? কুরআন শরীফের সূরা লুকমানের ৬নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “এক শ্রেণীর লোক আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অন্ধভাবে অসার বাক্য ক্রয় করে (বেছে নেয়) এবং আল্লাহর প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।”

প্রায় সকল তফসীর-কিতাবে এই আয়াতের তফসীরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মসউদ (রাঃ) তিন তিনবার কসম খেয়ে খেয়ে বলেছেন, 'উক্ত আয়াতে ‘অসার বাক্য বলতে ‘গান’কে বুঝানো হয়েছে। অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) এবং জাবের (রাঃ) ও ইকরামা (রহঃ) হতে। গান হল অসার, অবান্তর, অশ্লীল ও যৌন-উত্তেজনামূলক অথবা শির্কী ও বিদআতী কথামালাকে কবিতাছন্দে সুললিত ও সুরেলি কণ্ঠে গাওয়া শব্দধ্বনির নাম। যা ইসলামে হারাম। হারাম তা গাওয়া এবং হারাম তা শোনাও। গানে হৃদয় উদাস হয়, রোগাক্রান্ত ও কঠোর হয়। গান হল ‘ব্যভিচারের মন্ত্র’, অবৈধ ভালোবাসার আজব আকর্ষণ সৃষ্টিকারী যন্ত্র।

তাই তো “মহানবী (সা.) নগ্নতা ও পর্দাহীনতা এবং গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ৬৯১৪ নং) মিউজিক বা বাজনা শোনাও মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কারণ, বাজনা-ঝংকারও মানুষের মন মাতিয়ে তোলে, বিভোরে উদাস করে ফেলে এবং উন্মত্ততায় আন্দোলিত করে। সবচেয়ে শুদ্ধ হাদীসের কিতাব বুখারী শরীফে, মহানবী (সা.) বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় হবে; যারা ব্যভিচার, (পুরুষের জন্য) রেশমবস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার (হারাম হওয়া সত্ত্বেও) হালাল মনে করবে।” (বুখারী ৫৫৯০, আবু দাউদ, তিরমিযী, দারেমী, সহীহুল জামে ৫৪৬৬ নং)

তিনি বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে, তাদের মাথার উপরে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হবে এবং নর্তকী নাচবে। আল্লাহ তাদেরকে মাটিতে ধসিয়ে দেবেন এবং বানর ও শূকরে পরিণত করবেন!” (ইবনে মাজাহ ইবনে হিব্বান, ত্বাবারানী, বাইহাকীর শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামে ৫৪৫৪ নং)।

তিনি আরো বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের মাঝে (কিছু লোককে) মাটি ধসিয়ে, পাথর বর্ষণ করে এবং আকার বিকৃত করে (ধ্বংস করা) হবে। আর এ শাস্তি তখন আসবে, যখন তারা মদ পান করবে, নর্তকী রাখবে এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাবে।” (সহীহুল জামে’ ৩৬৬৫, ৫৪৬৭ নং) প্রিয় নবী আরো বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য মদ, জুয়া, ঢোল-তবলা এবং বীণা-জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করেছেন।” (আহমাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৭০৮ নং)

অন্য এক হাদীসে মহানবী (সা.) বলেন, “ফিরিশতা সেই কাফেলার সঙ্গী হন না; যে কাফেলায় ঘন্টার শব্দ থাকে।” (আহমাদ, সহীহুল জামে” ৭৩৪২ নং)

আর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “ঘন্টা বা ঘুঙুর হল শয়তানের বাশি।” (মুসলিম ২১১৪ আবু দাউদ ২৫৫৬ নং) সুতরাং বলাই বাহুল্য যে, যে কাফেলা, অনুষ্ঠান, মিছিল, মিটিং, বিয়ে বা দাওয়াতে মিউজিক থাকে অথবা কোন বাদ্যযন্ত্র বা রেকর্ডের গান-বাজনা থাকে, সেখানে অবশ্যই ফিরিশ্যার স্থানে শয়তান আশ্রয় নেয়। তাই এমন শয়তানী অনুষ্ঠানে যোগদান করাও মুসলিমের জন্য অবৈধ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, 'ঢোলক হারাম, বাদ্যযন্ত্র হারাম, তবলা হারাম এবং বাঁশীও হারাম।' (বাইহাকী) হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন, 'ঢোলক মুসলিমদের ব্যবহার্য নয়। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মসউদের সহচরগণ ঢেলক দেখলে ভেঙ্গে ফেলতেন।' (দেখুন, তাহরীমু আলাতুত ত্বার্ব, আলবনী)

উল্লেখ্য যে, বহু জাহেল মনে করে থাকে যে, দাউদ নবী (আঃ) বাঁশীর সুরে জগতের মানুষকে মোহিত করতেন! অতএব বাঁশীর সুর বা মিউজিক হারাম হওয়ার কথা নয়।

এ কথা মনে রাখা দরকার যে, একজন নবীর উপর কলঙ্ক ও অপবাদ দেওয়া সাধারণ গোনাহর কাজ নয়। আর কেবলমাত্র ধারণা করে কথা বলাও মহাপাপ। বলা বাহুল্য, হযরত দাউদ (আঃ) বংশীবাদক ছিলেন না। তবে যবুর পাঠের সময় তার কণ্ঠ বড় মিষ্ট ছিল। আর তার সুরেই লোকে মোহিত হত।

তাছাড়া মহানবীর শরীয়তে যা হারাম ঘোষিত হয়েছে, তা পূর্ববর্তী কোন নবীর আমলে হালাল থাকলেও শেষ নবীর উম্মতীর জন্য তা হারাম।

পক্ষান্তরে সুর করে আযান দেওয়া, কুরআন পাঠ করা বা ইসলামী গজল আবৃত্তি করা বিধেয় ও বৈধ হলেই সুর করে অসার-অশ্লীল কথা গাওয়া বৈধ হতে পারে না। এ শ্রেণীর বক্তারা বলতে চায় যে, মদ যদি হারাম হল, তাহলে তোমরা কেন দুধ খাও বল?’ অর্থাৎ, দুধ পান হালাল হলে, মদ পানও হালাল। কারণ, উভয়ই তো পানীয়। কিন্তু জ্ঞানী সুধীজন ঐ শ্রেণীর প্রবৃত্তিপুজারীদের এমন হাস্যকর যুক্তি ভ্রান্ত বলেই আদৌ ভ্রূক্ষেপ ও গ্রাহ্য করেন না।

তারা অবশ্যই দুধ ও মদের মাঝে অতি সহজে পার্থক্য নির্বাচন করতে পারেন।

এক হাদীসে সর্বশেষ নবী (সা.) বলেন, “ইহ-পরকালে দুটি শব্দ-ধ্বনি অভিশপ্ত; সুখ ও খুশীর সময় বাশীর শব্দ এবং মসীবত, শোক ও কষ্টের সময় হা-হুতাশ ধনি।” (সহীহুল জামে’ ৩৮০১, সিলসিলাহ সহীহাহ ৪২৭ নং) ‘গানে জ্ঞান বাড়ে' কথাটিও নিছক প্রবৃত্তিপূজকের তরফদারিমূলক যুক্তিহীন উক্তি। কারণ, জ্ঞানের উৎস গান নয়। জ্ঞানের উৎস হল কুরআন। অবশ্য অবৈধ প্রণয় ও ভালোবাসার জ্ঞান লাভ করার এক উপযুক্ত মাধ্যম ও প্রধান উৎস বটে।

অনেকের ধারণা যে, ‘গান হল রূহের খোরাক। দুশ্চিন্তা ও কষ্টের সময় জ্বালাময় হৃদয়ের পোড়া-ঘায়ের মলম!

অথচ প্রকৃতপ্রস্তাবে গান হল, ‘প্রেম-পীড়িত’ রূহের খোরাক। কারণ, প্রেমে থাকে মাদকতা। বনের ময়ুর নাচার মত হৃদয়ের মঞ্চে প্রেমের রুনুঝুনু নাচ আছে। আর সে নাচের সাথে তাল মিলায় ঐ গান-বাজনা। তাছাড়া অবৈধ প্রেম ও ভালোবাসা সৃষ্টি করে শয়তান। তাই শয়তানের বাণীর মাঝেই পিরীতের জ্বালাময় অন্তরে মিঠাপানির আস্বাদ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে কুরআন হল রহমানের বাণী। আর তা হল মুসলিম রূহের একমাত্র খোরাক। বিরহ বেদনাহত বহু যুবক, যাদের স্ত্রী (কাছে) নেই, অনুরূপ বহু যুবতী, যাদের স্বামী (কাছে) নেই, তারা গান-বাজনা শুনে (অনেকে বা গেয়ে-বাজিয়ে) মনকে ‘ফ্রি’, স্থির ও সানিত করতে চায়। এরা কিন্তু আসলে মনের তাপকে গানের আগুন দিয়ে ঠান্ডা করতে চায়। যার ফলে সেই তাপ আরো বৃদ্ধি পায়।

কারণ, অধিকাংশ গান হল প্রেমমূলক; প্রেমকাহিনী, প্রেম-মিলন, বিরহ-বেদনা, মিলন-আবেদন, নারী-সৌন্দর্য প্রভৃতি যৌনজীবনের গাথা কথাই গানে গাওয়া হয়ে থাকে। যা শুনে যৌনক্ষুধা আরো বেড়ে যায়। ছাই-চাপা প্রেমের আগুন গানের বাতাসে গল্প করে জ্বলে উঠে ফিনকি উড়াতে শুরু করে। আর তখনই মন চুরি করে গোপনে স্বামী বা স্ত্রীর খেয়ানত করে বসে অথবা করতে চায়! মনের জ্বালা মিটাবার জন্য দুরের বন্ধুর প্রতীক্ষা করতে আর ধৈর্য থাকে না।

বলা বাহুল্য, এ জন্যই সুবিজ্ঞ সাহাবী বলেন, 'গান হল ব্যভিচারের মন্ত্র। অতএব গানে কক্ষনই মন সানিত হয় না; বরং আরো বিক্ষিপ্ত, চিন্তিত ও উত্তেজিত হয়। দগ্ধ, অস্থির ও ব্যাকুল মনকে শান্ত ও স্থির করতে হলে মনের সৃষ্টিকর্তার প্রেকিশন’ নিতে হবে। তিনি বলেন, “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকরে (স্মরণে) প্রশান্ত থাকে। আর জেনে রাখ, আল্লাহর যিকরেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।” (সূরা রা'দ ২৮ আয়াত)

পক্ষান্তরে যারা এর বিপরীত কাজ করে, তাদের ফলও হয় উল্ট। মহান আল্লাহ সে কথাও বলেন যে, “যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর যিকর (স্মরণে) বিমুখ হয়, তিনি তার জন্য নিয়োজিত করেন এক শয়তানকে। অতঃপর সেই হয় তার সহচর। শয়তানরাই মানুষকে সৎপথ হতে বিরত রাখে, অথচ মানুষ মনে করে তারা সৎপথে পরিচালিত হচ্ছে। যখন সে আমার নিকট উপস্থিত হবে, তখন সে শয়তানকে বলবে, 'হায়! আমার ও তোমার মাঝে যদি পুর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান হত! কত নিকৃষ্ট সে সহচর।” (সূরা যুখরুফ ৩৬-৩৮ আয়াত)

এই যৌবন-জল-তরঙ্গ রোধিবি কি দিয়া বালির বাঁধ?

কে রোধিবি এই জোয়ারের টান গগনে যখন উঠেছে চাদ?

যৌবনে পদার্পণ করার সাথে সাথে যৌনানুভূতি ও যৌন-চিন্তা সহ যৌন-উন্মাদনার মানসিক আন্দোলন প্রাণী-জগতের এক প্রকৃতিগত ব্যাপার। মনের ভিতর বেড়ে ওঠে যৌনক্ষুধা, কেমন এক প্রকার অস্থিরতা, ক্ষিপ্ততা ও অস্বস্তিকর চাঞ্চল্য। মন চায় কিছু ভাবতে, কাউকে কাছে পেতে এবং তার কাছে মনের কথা খুলে বলতে, মন চায় আকাশ-কুসুম কল্পনা করতে। হৃদয় যেন উছুল হতে চায়, চায় সকল প্রকার বাধা ও লাগাম অমান্য করতে কিন্তু না। ইসলাম এ সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণরেখা এঁকে দিয়েছে। এনেছে নৈতিকতা এবং শৃংখলতার বিভিন্ন বিধি-নিয়ম। তাই মুসলিম যুবক লাগামহীন উদ্ধৃঙ্খল নয়। নয় নিয়ন্ত্রণহারা খেয়াল-খুশীর পূজারী। আর “আল্লাহ তাআলা সেই যুবককেই পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন, যার যৌবনে কোন কুপ্রবৃত্তি ও ভ্রষ্টতা নেই।” (আহমাদ)

কিন্তু যুবকের বর্তমান পরিবেশ এমন যে, সেখানে তার যৌন-চেতনা বৃদ্ধি করা হয়। সময় হওয়ার পুর্বেই যুবকের যৌবন বেসামাল গতিতে এসে উপস্থিত হয় তার দেহ-মনে। যৌনানুভূতিতে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়। প্রলুব্ধ ও উত্তেজিত করা হয় তার কামনাময় হৃদয়কে। বাড়ির বাইরে, রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে, ট্রেনে-বাসে যুবতীর সৌন্দর্য অনায়াসে চোখে পড়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুরভিতার দেহের সাথে দেহ স্পর্শ হয়। নগ্নতা ও পর্দাহীনতার ফলে মহিলার রূপ যুবকের হৃদয়-মনে ছোয়া দেয়, দোলা দেয়। বাড়িতে টিভির পর্দায় যা প্রদর্শিত হয় তাও নগ্নতা ও অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ। কেউ কেউ সানুগ্রহে দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখে অভিনেত্রীদের অর্ধনগ্ন ছবি। প্রায় প্রত্যেক পণ্যদ্রব্যের প্যাকেটে ও প্রচারে ব্যবহার করা হয় অর্ধনগ্ন সুদর্শনা নারীর ছবি।

পত্র-পত্রিকার প্রচ্ছদ তথা পাতায় পাতায় নজরে পড়ে ঐ একই দৃশ্য। তা পড়তে গিয়েও পাওয়া যায় বিভিন্ন শ্রেণীর যৌন-উত্তেজনামূলক কাল্পনিক গল্প, কাহিনী ও ঘটনা। স্কুল-কলেজে যুবক-যুবতীর অবাধ সংসর্গ ও মিলামেশা। অফিসে গেলেও ঐ একই অবস্থা। ফলে যুবকের জন্য সুচিন্তায় মনকে ধরে রাখা এত কঠিন হয়েছে যে, তার চাইতে হাতে আগুনের আঙ্গার রাখা অতি সহজ ব্যাপার। কচিন্তা করবে না বলে মনকে সুদৃঢ় করলেও তার উপায়-উপকরণ এত সহজলব্ধ যে, তার গতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সত্যই সুকঠিন।

যুবক বন্ধু! যদি তোমার জীবনে এমন কঠিন পরীক্ষা এসেই থাকে, তবে ঐ কুচিন্তাকে যেন মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়ে বসো না। পাথরের উপর থেকে যেমন বৃষ্টির পানি অতি সহজে গড়িয়ে যায়, ঠিক তেমনি ঐ নারী বা যৌন-চিন্তাও যেন তোমার মনের পাথরে স্থান না পায়। চলার পথে কোন নারী যদি তোমার মনে কুচিন্তার সূত্রপাত করেই যায়, তবুও তুমি সেই সুতো নিয়ে যেন নির্জনে থেকে কোন কামনার জাল বুনতে শুরু করে দিও না। তোমার মনকে ধরার জন্য যদি কেউ জাল বিছিয়ে অপেক্ষাও করতে থাকে, তবুও তুমি ‘ফাদ-ছাড়া বক’এর মত অবশ্যই নিজেকে বাঁচিয়ে নিও। খবরদার! ঐ কুচিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করো না। নচেৎ ঐ চিন্তার পথে মনের লাগাম ছেড়ে দিলে, সে লাগাম শয়তানের হস্তগত হয়ে তোমাকে এমন স্থানে যেতে বাধ্য করবে, যেখানে তোমার ধ্বংস অনিবার্য।

মনের জল্পনা-কল্পনা তোমার সম্মুখে উড়ন্ত একটি পাখির মত। পাখিটিকে উড়তে দিলে সে তার উড়ার পথ অবশ্যই অতিক্রম করবে। আর যদি তাকে উড়তে না দিয়ে শিকার করে অথবা পিঞ্জরাবদ্ধ করে ফেল, তাহলে সে তোমার আয়ত্তাধীন হয়ে যাবে।

অতএব তোমার মনের ভিতরে কোন মন্দ কম্পনা এলে তা সত্বর দূর করে ফেল, যদি তা না কর তাহলে জেনে রেখো, তা চিন্তায় পরিণত হবে। চিন্তাকেও মনে বিচরণ করার সুযোগ দিও না, নচেৎ তা বাসনা ও কামনায় পর্যবসিত হয়ে যাবে। যদি তা হয়েই থাকে, তাহলে সে কামনাকেও নিবৃত্ত কর, নচেৎ তা দৃঢ়-সংকল্পে পরিণত হবে। এই পরিকল্পনাকেও পরাভূত কর, নচেৎ তা কর্মে পরিণত হয়ে যাবে। আবার কর্মকেও প্রতিহত না করতে পারলে তা অভ্যাসে পরিণত হবে। আর কোন কর্ম অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে কখনো তুমি তার কবল থেকে রেহাই পেতে পারবে । (আল-ফাওয়াইদ, ইবনুল কাইয়েম)।

হ্যা, সত্যই তো। কল্পনার চারাগাছ, যা এইমাত্র বেড়ে উঠেছে, তাকে সহজেই হাত দিয়ে টেনে ছিড়ে ফেলতে পার। কিন্তু সেই বটবৃক্ষ বড় হওয়ার পর তাকে ক্রেন লাগিয়ে তুলতে পারবে না। মনের মাটি থেকেও এমন অভ্যাসের বনস্পতি তোলা কম দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়।

হে কল্পনাবিহারী যুবক বন্ধু! ফিরিস্তার জ্ঞান আছে, কিন্তু প্রবৃত্তি নেই। পশুর জ্ঞান নেই, কিন্তু প্রবৃত্তি আছে। আর মানুষের জ্ঞান ও প্রবৃত্তি দুই আছে। সুতরাং যার প্রবৃত্তি সংযত ও নিয়ন্ত্রিত এবং জ্ঞান আলোকিত, সে হল ফিরিস্তার মত মানুষ। পক্ষান্তরে যার জ্ঞান অনুজ্জ্বল এবং প্রবৃত্তি উদ্ধৃঙ্খল, সে হল পশুর মত জীব। অতএব তুমি চেষ্টা কর, যাতে ফিরিস্তার গুণের কাছাকাছি মানুষ হতে পার।

যখনই তোমার মন তোমার খেয়ানত করতে চায় এবং কোন পাপ করার পরিকল্পনা করে, তখনই মনকে আল্লাহর স্মরণ দিয়ে ক্ষান্ত কর। কিন্তু তাতে যদি তোমার মন ক্ষান্ত না হতে চায়, তাহলে সৎচরিত্রবাণ মানুষদের চরিত্র স্মরণ করিয়ে নিবৃত্ত কর। তাতেও যদি নিবৃত্ত না হতে চায়, তাহলে এই ভেবে তাকে পরাস্ত কর যে, তোমার এই পাপ-পরিকল্পনার কথা লোক-সমাজে প্রকাশ পেলে তুমি লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। তোমার ও তোমার বংশের দুর্নাম রটবে। এখনো যদি তুমি তোমার মনকে ক্ষান্ত না করতে সক্ষম হও এবং পার্থিব অপমানেরও যদি ভয় তোমার মনে না আসে, তাহলে জেনে নিও যে, তোমার মনোবৃত্তি এবারে পশুবৃত্তিতে পরিণত হয়ে গেছে। (হাকযা অ্যালামতনিল হায়াহ ২৭পৃঃ)

সুতরাং মন্দ চিন্তা-ভাবনা ও কল্পনা থেকে দুরে থাক। যখনই কোন প্রকার যৌন-চিন্তা তোমার হৃদয় মাঝে প্রবেশ করতে চায়, তখনই তুমি তোমার হৃদয়দ্বার বন্ধ করে দাও। আর সেই চিন্তা শুরু করে দাও, যা তোমার দুনিয়া ও আখেরাতে কাজে দেবে। চিন্তা কর, আল্লাহর বড় বড় সৃষ্টি নিয়ে; বিশাল সমুদ্র, সুউচ্চ পর্বতমালা, দিগন্তু-প্রসারী মেঘমালা, ভয়াবহ বসু-বিদ্যুত ও আগ্নেয়গিরী, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জলপ্রপাত, চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্ররাজি ইত্যাদি নিয়ে। আল্লাহর বড়ত্ব ও শক্তিমত্তা নিয়ে, আখেরাত ও কবর নিয়ে এবং মুসলিম জাতির বর্তমান দুঃখজনক পরিস্থিতি নিয়ে।

পার্থিব জগৎ তথা আমাদের পরিবেশের অবস্থা এই যে,

ফুলে-ফুলে সেথা ভুলের বেদনা, নয়নে-অধরে শাপ,

চন্দনে সেথা কামনার জ্বালা, চাদে চুম্বন-তাপ!

সেথা কামিনীর নয়নে কাজল, শ্রোণীতে চন্দহার,

চরণে লাক্ষা, ঠোটে তাম্বুল, দেখে মরে আছে মার!

প্রহরী সেখানে চোখা চোখ নিয়ে সুন্দর শয়তান,

বুকে-বুকে সেথা বাকা ফুল-ধনু, চোখে চোখে ফুল-বাণ।

এমন মনোহর পরিবেশ বিশেষ করে যুবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং মনকে মুগ্ধ করবে – সেটাই স্বাভাবিক। চোখে-চোখে চোখাচোখি হয়ে প্রেমের ঝিলিক মারবে, দৃষ্টির কুহকে পড়ে মন চুরি হবে, নজর-বাণ মেরে একে অপরকে ঘায়েল করবে, নয়নের যাদু অপরকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে এটাই আমাদের পরিবেশের প্রকৃতি। কিন্তু হে সুনয়ন নবীন বন্ধু আমার! এই নজরবাজি হল তোমার জন্য বড় ফিতনার বিষয়। এই নজর কত ব্যভিচার ও অশ্লীলতায় নামিয়েছে, কত আবেদের ইবাদত নষ্ট করেছে, কত হাকীমের হিকমত দিয়েছে হারিয়ে।

নয়না এখানে যাদু জানে সখা, এক আঁখি-ইশারায়,

লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায়!

দৃষ্টি হল হৃদয়ের আয়না। হৃদয়ে কামনার ছবি চোখের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে। বান্দা দৃষ্টি অবনত করলে তার মন ও ইচ্ছা শান্ত ও সংযত থাকে। চোখের লাগাম ছেড়ে দিলে হৃদয়ের ডোরও লম্বা হয়ে ছাড়া যায়। বেগানা মহিলার উপর দৃষ্টি পড়া স্বাভাবিক ব্যাপার। মুসলিম। যুবকের জন্য যা অস্বাভাবিক তা হল, দৃষ্টি ফিরিয়ে না নেওয়া অথবা বারবার দৃষ্টিপাত করা।

নারীর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ হল একটি বীজ বপনের মত। মাটিতে ফেলার পর যদি তার প্রতি আর ভ্রুক্ষেপ না করা হয়, তাহলে অচিরেই তা শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ফেলার পর তার । উপর পানি-সিঞ্চন দেওয়া হলে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়, আকার নেয় বড় গাছের। অনুরূপ কোন সুবদনার উপর নজর পড়লে তা ফিরিয়ে নিয়ে মনের কোণে সে ছবিকে স্থান না দিলে তাতে কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু যদি দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার সেই মুখশ্রীর প্রতি নজর দৌড়ানো হয়, তাহলে মনের জমিতে সেই নজর-বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয় অবৈধ প্রেমের চারাগাছ। এরপর আরো বারবার নজরের সেচ, ইশারা ও চোখ মারার খোড়, মুচকি হাসির সার ইত্যাদি দিয়ে যত্ন নিলে ধীরে-ধীরে বেড়ে ওঠে সেই গাছ। তখন তার শিকড় মোটা ও শক্তিশালী হলে মনের পলস্তরা করা মেঝে ও দেওয়াল ফাটিয়ে তোলে।

এ জন্যই সমাজ-বিজ্ঞানী নবী (সা.) বলেন, “একবার নজর পড়ে গেলে আর দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখো না। প্রথমবারের (অনিচ্ছাকৃত) নজর তোমার জন্য বৈধ। কিন্তু দ্বিতীয়বারের নজর বৈধ নয়। (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, হাকেম, সহীহুল জামে” ৭৯৫৩ নং)

জারীর (রাঃ) আল্লাহর রসূল জি কে জিজ্ঞাসা করলেন যে, কোন মহিলার উপর আমার আচমকা নজর পড়ে গেলে আমি কি করব? তিনি বললেন, “তোমার নজর ফিরিয়ে নাও।” (আহমাদ, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, সহীহুল জামে ১০১৪ নং)

বলা বাহুল্য এ কারণেই মহিলাদেরকে বেগানার সামনে নিজের চেহারা গোপন করতে আদেশ করা হয়েছে। যাতে এক হাতে তালি না বাজে এবং বাঁশ না থাকার ফলে বাঁশরী বাজার কোন আশঙ্কা অবশিষ্ট না থাকে। এই নজরই নজরবাজদেরকে নিয়ে যায় ব্যভিচারের দিকে। নজরই হল ব্যভিচারের প্রথম বুনিয়াদ ও ভূমিকা। এই ছোট্ট অঙ্গার টুকরা থেকেই সূত্রপাত হয় বিরাট অগ্নিকান্ডের। একবারের দর্শন দর্শকের শয়নে-স্বপনে-নিশি-জাগরণে তার স্মৃতিপটে ভেসে ভেসে ওঠে এবং শুরু হয় নানা কল্পনা, নানা আশা ও কামনা।

আর দৃষ্টি ও চোখের ইশারার সাথে সাথে যদি একটু মুচকি মধুর হাসি থাকে, তাহলে ঐ হাসির ভিতরেই ফাসী। তারপরই সাক্ষাৎ ও সালাম। অতঃপর মনের কথা প্রকাশ এবং সময় ও স্থান নির্ধারণ। অতঃপর নৈতিকতার বিনাশ সাধন। এমন অশ্লীলতাকে সমূলে ধ্বংস করার জন্যই বীজ অবস্থাতেই তা নষ্ট করে ফেলতে আদেশ এল কুরআন মাজীদে। মহান আল্লাহ বলেন, “মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাযত করে; এটিই তাদের জন্য উত্তম। ওরা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত। আর মু’মিনা নারীদেরকে বল, তারাও যেন নিজেদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হিফাযত করে---I” (সূরা নুর ৩০-৩১ আয়াত)

মহানবী (সা.) বলেন, “চোখ দু’টিও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, (কাম-নজরে নারীর সৌন্দর্যের প্রতি) দৃষ্টিপাত করা। কান দু’টিও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, (যৌন-কথা) শ্রবণ করা। জিভও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, (যৌন-কথা) বলা। হাতও ব্যভিচার করে। আর তার ব্যভিচার হল, সকামে স্পর্শ করা। ব্যভিচার করে পা দু’টিও। আর তার ব্যভিচার হল, (যৌনক্রিয়ার উদ্দেশ্যে) হেঁটে যাওয়া।” (মিশকাত ৮৬ নং)

তরণ বন্ধু আমার। সৃষ্টির প্রতি এই যে, আলো চাল দেখলে ভেঁড়ার মুখ চুলকায়, টক বা তেঁতুল দেখলে মুখে পানি আসে। এই প্রকৃতিকে দমন করা কঠিন হলেও করতে হবে। তবে দমনের আগে যদি মুল কারণ ধ্বংস করা সম্ভব হয়, তবে সেটাই উত্তম। সেটা আমাদের। এখতিয়ারে আছে। আর তা হল এই যে, আমরা কোন অবৈধ নারীর প্রতি দৃকপাত করব না। হঠাৎ নজর পড়ে গেলে সত্বর ফিরিয়ে নেব। দেখব না কোন নারীর ছবি, ফিল্ম, নাটক, যাত্রা প্রভৃতি নারীর প্রদর্শনী।

যারা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করে ও ধর্ষণকে মন্দ জানে, তাদের উচিত, নগ্নতাকে মন্দ জানা এবং পর্দা-প্রথার প্রচলন করা। কারণ, চোখের ও মুখের সামনে তেঁতুল কচলাব এবং যার মুখে পানি আসবে তাকে শাস্তি দেব -এমন যুক্তি ভ্রান্ত।

আজব কবিরাজ তুমি দেখি এ ভূবনে,

খাটার পেয়ালা রাখ রোগীর সামনে!

আগুনের কাছে মোম রাখলে গলে তো যাবেই। তবে তাদের গোড়া কেটে ডগায় পানি ঢালার কি যুক্তি হয়? যে পরিবেশে অবৈধ প্রণয়-সুত্র গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা হয় বিভিন্ন উপায়ে, প্রচারমাধ্যম সহ দেশীয় তাগুতী আইনেও এ প্রেমকে বৈধ ও প্রশংসনীয় কর্ম বলে মনে করা হয়, উভয় পক্ষের সন্তুষ্টি ও প্রেম-ঘটিত অবৈধ যৌনাচার ব্যভিচারকে কোন অপরাধ বলে মনে করা হয় না, পরন্তু গোটা বিশ্বজুড়ে এমন পরিবেশ গড়ে উঠেছে, যাতে ‘বিশ্ব-ভালোবাসা দিবস’ পালিত হচ্ছে, সে পরিবেশে বাস করে যুবক আর নিজেকে কতটা পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে?

অবশ্য সে যুবকের জন্য পূর্ণ পরিমাণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যে যুবকের বুকে আছে নিয়ন্ত্রক যন্ত্র পরিপূর্ণ ঈমান এবং ইসলামী নৈতিকতা।

হে নবীন তরুণ বন্ধু আমার! সদা-সর্বদা এ কথা মনে রেখো যে, মহান প্রতিপালক সর্বদা তোমার প্রতি সুক্ষ দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি প্রত্যেক বান্দার সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত। “চক্ষুর চোরা চাহনি এবং অন্তরের গোপন কথা তিনি জানেন।” (সূরা মু'মিন ১৯ আয়াত) তিনি বলেন, “আর অবশ্যই আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার অন্তরে নিভৃত কুচিন্তা সম্বন্ধে আমি অবহিত আছি। আমি তার গ্রীবাহিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর। স্মরণ রেখো, দুই ফিরিস্তা তার ডান ও বামে বসে তার কাজকর্ম লিপিবদ্ধ করে থাকে।” (সূর কুফ ১৬-১৭ আয়াত)

মনে রেখো বন্ধু! যে চোরা চক্ষু দ্বারা তুমি অবৈধ মহিলার রূপ দর্শন-তৃপ্তি উপভোগ করবে, সেই চক্ষু কাল কিয়ামতে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষি দেবে। মহান আল্লাহ বলেন, “পরিশেষে যখন ওরা দোযখের নিকটে পৌছবে তখন ওদের চোখ, কান ও দেহের চামড়া ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে।” (সূরা ফুসৃসিলাত ২০ আয়াত) আর ভুলে যেও না যে, “নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় -ওদের প্রত্যেকের নিকট (বিচার-দিবসে) কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত) তুমি কি চাও না পরিত্রাণ ও আল্লাহর ভালোবাসা? মহান আল্লাহ বলেন, “যখন আমি আমার বান্দাকে ভালোবাসতে শুরু করি, তখন আমি তার শোনার কান, দেখার চোখ, ধরার হাত হয়ে যাই -----।” (বুখারী)

অর্থাৎ, যদি তোমার মাঝে আল্লাহর ভালোবাসা আনতে চাও, তাহলে তোমাকে তোমার চোখ দ্বারা কেবল সেই জিনিস দেখা উচিত, যা দেখলে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। আর সে জিনিস মোটেই দেখা উচিত নয়, যা দেখলে তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে যান। প্রিয় বন্ধুর ইচ্ছা অনুযায়ী না চললে কি বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা থাকে?

ছল চাহনির বন্ধু আমার! যদিও মনে কর যে, ‘দিল হ্যায় কে মা নেহী’ তবুও তুমি তোমার মনের বিরুদ্ধে জিহাদ কর। দৃষ্টিকে সংযত রাখার জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালাও। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথে সর্বপ্রকার সাধনা ও সংগ্রাম কর। সমস্যার সমাধানের পথ তিনি সহজ করে দেবেন। তিনি বলেন, “যারা আমার পথে সংগ্রাম (ও সাধনায় আত্মনিয়োগ) করে, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করি। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথের সাথী।” (সূরা আনকাবুত ৬৯ আয়াত)। আর মহানবী মুক্তি বলেন, “সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জিহাদ হল, নিজের মন ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ।” (সহীহুল জামে ১০৯৯ নং)

কোন কিছুর উপর ধৈর্য ধারণ করার চেষ্টা করলে আল্লাহ ধৈর্য ধরার তওফীক দিয়ে থাকেন। পীড়িত হৃদয়ে সবর দান করে থাকেন। (বুখারী) সুতরাং মনের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ধৈর্যের সাথে দৃষ্টি সংযত রাখতে অভ্যাসী হও। পবিত্রতার পথ তোমার জন্য সহজ হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।

চঞ্চল-মনা বন্ধু আমার! এমন জায়গায় বসো না, যে জায়গায় বসলে তোমার নজর নিয়ন্ত্রণে রাখতে কষ্ট হয়। মহানবী সঃ বলেন, “খবরদার! তোমরা রাস্তার ধারে বসো না। আর একান্তই যদি বসতেই হয়, তাহলে তার হক আদায় করো।” লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, রাস্তার হক কি? হে আল্লাহর রসূল!' তিনি বললেন, “দৃষ্টি সংযত রাখা, কাউকে কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দান করা (এবং পথভ্রষ্টকে পথ বলে দেওয়া)।” (আহমাদ, বারী মুসলিম, আবু দাউদ, সহীহুল জামে’ ২৬৭৫ নং)

অনুরূপ বাড়ির ছাদে বা এমন উঁচু জায়গায় বসতেও নিষেধ করেছেন আমাদের আদর্শ নবী মুহাম্মাদ । (সিলসিলাহ সহীহাহ ১৪-১৫)

এই আদেশ ছিল সেই যুগের; যে যুগের মহিলাদের কোন গোপনীয় অঙ্গ -এমন কি চেহারা পর্যন্ত দেখা যেত না। যারা পথে চলার সময় নিজেদেরকে প্রদর্শন করার বা পর-পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মনোভাব রাখত না। রাস্তার এক ধার ঘেসে এমনভাবে চলত যে, দেখে মনে হত, তারা দেয়ালের সাথে মিশে যাচ্ছে। পরন্তু উক্ত আদেশ ছিল সেই যুবক ও পুরুষদের জন্য, যারা ছিলেন প্রকৃত আলোকপ্রাপ্ত আল্লাহ-ভীরু মানুষ। যারা পথের ধারে বা কোন উঁচু জায়গায় বসে বসে মহিলা দেখবেন, এমন কথা কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল। সুতরাং আমাদের এই বর্তমান নগ্নতা ও ঈমান-দুর্বলতার যুগে সে আদেশ কত বড় গুরুত্ব রাখতে পারে, তা অনুমেয়। যে যুগের লারেলাপ্পা’ মার্কা যুবতী, টো-টো’ কোম্পানী মহিলা এবং বেসামাল নগ্ন পোশাকে নিজেদেরকে প্রদর্শন করে যুবককে আকর্ষণকারিণী তরুনীদল। রাস্তায়-রাস্তায় বিনা বাধায় বুক ফুলিয়ে ও আংশিক খুলে হাওয়া খেয়ে বেড়ায়, যারা নিজেদের।

রূপ-সৌন্দর্য ও আধুনিক ডিজাইনের কুরুচিসম্পন্ন পোশাক, প্রসাধন ও সাজ-সজ্জায় বিজাতীয় মহিলাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতা করে এবং যাদের হৃদয়ে না আছে। আল্লাহর ভয়, আর না-ই আছে কোন প্রকার সম্ভম ও লজ্জা। সুতরাং ‘হাগনদারীর লাজ না থাকলেও দেখনদারীর লাজ থাকা উচিত। এমন জায়গায় যুবকের বসা বা যাওয়া উচিত নয়, যেখানে নজরবাজির ফিতনা সহজে এসে যেতে পারে। যে পথে পর্দাহীনা মহিলা দেখা যায়, সে পথে হেঁটো না। দুর হলেও অন্য পথে হেঁটো। যে পুকুরের পানি খেতে পাবে না, সে পুকুরের পাড় দিয়েও যাবে না। মন ফ্রি’ করার অজুহাতে টিভি, ভিডিও, ভিসিআর বা সিনেমা-হলে ফিল্ম দেখা বর্জন কর। কারণ, ছবি হলেও, চোখের দর্শন-তৃপ্তি সে সবেও কম নয়। বর্তমান বিশ্বের খবরাখবর জানার নামে এমন পত্র-পত্রিকা হাতে ধরো না, যাতে আছে নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নারীদেহ। যথাসম্ভব বাঁচার চেষ্টা কর। আল্লাহ তোমার চেষ্টার অন্তর দেখবেন। বেড়াতে যাওয়ার নাম করে অপ্রয়োজনে কোন পর্যটনকেন্দ্র সমুদ্র-সৈকত, পার্ক ও বাজারে যেও না। যেখানে তুমি নজরের ফিতনায় পড়ে যেতে পার। আর জেনে রেখো, “আল্লাহর নিকট এ পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা হল বাজার।” (মুসলিম ৬৭১, ত্বাবারানী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৩২৭২ নং)

এ ছাড়া নোংরা নারী সমাগমস্থল মেলা-খেলাতেও যাবে না। দেখবে না যাত্রা, থিয়েটার, নাটক। এ জগতে দুই শ্রেণীর আব্দ’ বা দাস আছে। প্রথম শ্রেণী হল আব্দুর রহমান এবং দ্বিতীয় শ্রেণী হল, আব্দুশ শয়তান। উক্ত আব্দুর রহমানের বিভিন্ন গুণ বর্ণনা করার সময় মহান আল্লাহ তার একটি গুণ সম্বন্ধে এই বলেন যে, “যারা মিথ্যা ও বাতিল মজলিসে (অনুষ্ঠানে যোগদান করে না এবং অসার কার্যকলাপের সম্মুখীন হলে স্বীয় সম্মান রক্ষার্থে তা পরিহার করে ভদ্রভাবে চলে যায়।” (সূরা ফুরকান ৭২ আয়াত)

সর্ববৃহৎ মিথ্যা ও বাতিল হল শির্ক ও কুফরী। অতএব মূর্তিপূজা, কবরপূজা, উরস প্রভৃতি কোন শির্কী মেলা দেখতে যাওয়া কোন আব্দুর রহমানের কাজ বা গুণ হতে পারে না। বরং এ ধরনের মেলা থেকে কোন কিছু ক্রয়-বিক্রয়ও বৈধ নয়। ছেলে-মেয়েদেরকে বছরের স্বাদ মিষ্টি খাওয়ানোর দরকার একান্ত হয়েই থাকলে বাজার থেকে কিনে খাওয়াও। চিত্তবিনোদনের দরকার হলে কোন বৈধ স্থানে নিয়ে গিয়ে বেড়াও। কিছু কেনা-কাটার দরকার হলে শহরবাজারের দোকান থেকে কিনে নাও। দাম বেশী লাগলেও তোমার ঈমানের দাম আরো বেশী। ঈমান যাতে ধুলোধুসরিত হয়ে না যায় তার বিশেষ খেয়াল তো রাখতেই হবে তোমাকে। আর অবশ্যই শির্ক, গান-বাজনা, জুয়া, যাত্রা-নাটক, নারী সমাগম ইত্যাদি বিশেষ আকর্ষণমূলক মেলা-খেলা থেকে সাধারণ বাণিজ্য-বাজার অনেকাংশে ভালো। প্রিয় বন্ধু আমার! তোমার নজর যদি তোমাকে ফাঁকি দিতে চায়, তাহলে তাকে বশীভূত করার সবচেয়ে বড় ঔষধ হল বিবাহ। ভালো দেখে দ্বীনদার কনে খুঁজে বিয়ে করে ফেল, তাহলে তুমি যৌবনের অনেক পাপ থেকেই বাঁচতে সক্ষম হবে। “বিবাহ হল দৃষ্টি সংযতকারী। অবশ্য বিবাহ করায় অসুবিধা থাকলে রোযা রাখা উচিত। কারণ, রোযা যৌনক্ষুধাকে দমন করে।” (বুখারী, মুসলিম) পাপাচরণ বন্ধ করে।

যৌবনের বহু পাপ থেকে তোমাকে রক্ষা করতে পারে তোমার সতী স্ত্রী। পরস্ত্রী দর্শনের সর্বচাহিদা মিটাতে পারে সে। তবে অবশ্যই তাকে বাড়িতে কেবল তোমার জন্য সেজে সুন্দরী হয়ে থাকতে সুযোগ ও উৎসাহ দিও। নচেৎ তাকে দাসীর বেশে নেড়ীখেড়ী করে রাখলে। বাইরের প্রসাধিকা ও সুসজ্জিতা নারী দেখে নজর সংযত করতে পারবে না। তুমি যেমন দেখতে চাও, ঠিক তেমনি করে তাকে সাজিয়ে রাখ। দেখবে তোমার মন ও চোখ তারই রূপে মুগ্ধ হয়ে কেবল তারই হৃদয়-পিঞ্জরে সর্বদা বন্দী থেকে যাবে এবং অপর নারীর দিকে। তাকিয়ে দেখতেও ইচ্ছা করবে না।

মহানবী (সা.) বলেন, “নারী শয়তানী চিত্তে সামনে আসে এবং শয়তানী চিত্তে পিছন ফিরে যায়। (অর্থাৎ, ঐ নারীর মাধ্যমে শয়তান পুরুষকে কুমন্ত্রণা ও কুবাসনা দিয়ে থাকে। সুতরাং তোমাদের কেউ যদি কোন নারী দেখে এবং তার সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে ফেলে, তবে সে যেন (বাসায় ফিরে) নিজের স্ত্রীর কাছে আসে ও সঙ্গম করে। কারণ, এরূপ করলে তার মনের কুচিন্তা দূর হয়ে যাবে।” (মুসলিম)

পাথরে-পাথরে ঘর্ষণের ফলে আগুন জ্বলে ওঠে, চোখে-চোখে লড়ালড়ির ফলে পিরীতনেশা মেতে ওঠে। এই ফিতনা থেকে বাঁচতে, যদি কোন মহিলা তোমার সামনে পড়ে তাহলে তার দিকে চোখ তুলো না। বরং মনের ঔৎসুক্য ও উৎকণ্ঠাকে দমন করে তার খারাপ দিকটা মনে করো। হযরত ইবনে মসউদ (রাঃ) বলেন, 'যখন কোন (বেগানা) নারী তোমাকে মুগ্ধ করে ফেলে, তখন তুমি তার নোংরা দিকটা খেয়াল করো।' (যক্ষ্মল হাওয়া, ইবনুল জওযী ৩৮ পৃঃ) মনে করো, সে হয়তো ভালো মেয়ে নয়, অপরিষ্কার থাকে, গায়ে গন্ধ আছে বা কোন রোগ আছে। হয়তো বা সুন্দরী নয়, কুশ্রী। হয়তো তার মুখের শ্ৰী আছে কিন্তু কথার শ্রী নেই। হয়তো ধৃষ্ট ও গর্বিতা। ইত্যাদি।

তাছাড়া একটা কথা মনে করো যে, ‘বেল পাকলে কাকের কি? সে যেমনই হোক তাতে তোমার কি এসে যায়? তোমার জন্য সে তো বৈধ নয়। অতএব নজরের ডোর ছেড়ে তুমি কি শিকার করবে? বন্ধু আমার! নজরবাজরা সাধারণতঃ সৎচরিত্রের হয় না, তা তো তুমি জানো। আর এ জন্যই মেয়েদের দিকে ভ্যালভ্যাল করে তাকিয়ে দেখে হ্যাংলা কুকুরের মত যে সব পুরুষদের জিভে লালা আসে, ভালো মেয়েরা তাদেরকেই ঘৃণা করে বেশী। সুতরাং তুমি কোন যুবতীর প্রতি তাকিয়ে তার নিকট ঘৃণার পাত্র হবে কেন? পক্ষান্তরে নজরবাজি হৃদয়ে হাহাকার আনে, কুচিন্তা সৃষ্টি করে, অন্তরকে রোগাগ্রস্ত করে ফেলে, স্মৃতিশক্তি হ্রাস করে দেয়, শুকনো বিপদ ডেকে আনে, পরকাল থেকে উদাসীন করে তোলে।

আর নজরবাজির ‘কারেন্ট’ শাস্তির ব্যাপারে মহানবী ৯৬ বলেন, “যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের গৃহে তাদের অনুমতি না নিয়ে উকি মেরে দেখে, সে ব্যক্তির চোখ (ঢিল ছুঁড়ে) কানা করে দেওয়া তাদের জন্য বৈধ হয়ে যায়।” (বুখারী ৬৮৮, মুসলিম ২১৫৮ নং, আবু দাউদ, নাসাঈ)। অবশ্য মু'মিনের উচিত, সর্বদা আল্লাহকে ভয় করে চলা এবং দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি যাতে না পেতে হয় তার যথার্থ চেষ্টা রাখা।

হুজ্জতী বন্ধু আমার! যদি বল যে, 'হাগনদারীর লাজ না থাকলে দেখনদারীর লাজ কেন থাকবে? তাহলে তার কারণ শোন৷ দেখনদারীর লাজ এই জন্য হবে যে, তার বুকে ঈমান আছে, বেহেস্ত যাওয়ার ইচ্ছা আছে, দোযখের ভয় আছে। তাই চায় না নির্লজ্জ ও ধৃষ্ট্রের সাথে নির্লজ্জতা ও দৃষ্টামি প্রকাশ করতে। সর্বদা খেয়ালে রেখো যে, “লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি শাখা।” (আহমাদ, বুখারী, মুসলিম, প্রভৃতি সহীহুল জামে ৩১৯৭ নং) আর “লজ্জা না থাকলে তুমি যাচ্ছে তাই করতে পার।” (আহমাদ, বুখারী, আবুদাউদ, ইবনে মাজাহ সহীহুল জামে’ ২২৩০ নং)

অর্থাৎ, লজ্জাহীনরাই যাচ্ছে তাই আচরণ করে থাকে। সুতরাং যেখানেই থাক, লজ্জাশীলতা তোমার ভূষণ হওয়া একান্ত দরকার। ভাই-ভাবীর সাথে একই বাড়িতে বাস করতে বাধ্য হলে, ভাবীকে শ্রদ্ধার নজরে দেখো, চক্ষু সংযত করো এবং তার সহিত ঠিক সেই রকম আচরণ ও ব্যবহার করো, যে রকম করে থাক নিজের বড় বোনের সহিত। বিজাতির অনুকরণ করে ভাবীকে উপহাসের পাত্রী মনে করে নিজেকে তার দেওর (দেবর বা দ্বিতীয় বর) মনে করো না। যেহেতু তোমার ভাবীর পক্ষে তোমাকে আল্লাহর নবী মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন! (বুখারী, মুসলিম প্রমুখ, মিশকাত ৩১০২ নং)

অতএব ভাবী তোমার ভাবের ‘ই’ নয়; বরং ভাবী তোমার ভাবী ফিতনা। অনুরূপ একই বাড়িতে চাচাতো বোন, শ্বশুর বাড়িতে বেপর্দা শালী-শালাজ প্রভৃতিকে আপন বোনের নজরেই দেখো। নচেৎ অন্য নজর তোমাকে সজোরে আঘাত করে বিপদে ফেলবে।

পরিশেষে বলে রাখি যে, যেমন কোন মহিলার প্রতি কাম-নজরে তাকানো অবৈধ, ঠিক তেমনি অবৈধ কোন সুদর্শন কিশোরের প্রতিও। আর যা দেখা হারাম, তার ছবিও দেখা হারাম। (মুহারামাত ৪১পৃঃ দ্রঃ) পক্ষান্তরে “যে ঘরে (কোন প্রাণীর) ছবি বা মূর্তি থাকে, সে ঘরে ফিরিস্তা প্রবেশ করেন না।” (বুখারী, মুসলিম, সহীহুল জামে' ১৫৯৩ নং)

নজরবাজির বাজিতে হেরে গেলে যুবকের মনের নিভৃত কোণে গোপন প্রেম সৃষ্টি হয়ে যায়। জেগে ওঠে কত কল্পনা, কত বাসনা। পুনরায় সাক্ষাতের আশা মনকে অতিষ্ঠ ও অধীর করে। তোলে। রাতের অন্ধকারে যেন কাটার বিছানায় শয়ন করে অনিদ্রায় কল্পনার জগতে বিচরণ করে। দেখা ছবি মানসপটে ভেসে উঠলে তাতালো পাত্রে পানি পড়ার মত মনটা ছ্যাক’ করে। ওঠে। প্রেম-সমুদ্রের তরঙ্গমালা রিক্ত বক্ষকে প্রবল বেগে আঘাতের পর আঘাত দিতে থাকে। প্রণয়ের কচি-কিশলয় যেন মনের মাটি ছেড়ে কামনার মুক্ত আকাশে দোলা দেয়। শয়নেস্বপনে-নিশি জাগরণে ভালোবাসার আবেগভরা কত কবিতা স্মৃতির মানসপটে জেগে ওঠে। গোপন প্রিয়ার উদ্দেশ্যে মন গেয়ে ওঠেঃ

‘বর্ষা-ঝরা এমনি প্রাতে আমার মত কি

ঝরবে তুমি একলা মনে, বনের কেতকী?

মনের মনে নিশীথ-রাতে

চুম দেবে কি কল্পনাতে?

স্বপ্ন দেখে উঠবে জেগে, ভাববে কত কি!

মেঘের সাথে কাদবে তুমি, আমার চাতকী!

--- বন্ধু, তুমি হাতের-কাছের সাথের সাথী নও,

দুরে যত রও এহিয়ার তত নিকট হও!

থাকবে তুমি ছায়ার সাথে

মায়ার মত চাঁদনী রাতে।

যত গোপন তত মধুর - নাইবা কথা কও?

শয়ন-সাথে রও না তুমি, নয়ন পাতে রও।

ওগো আমার আড়াল-থাকা, ওগো স্বপন-চোর!

তুমি আছ, আমি আছি এই তো খুশী মোর।

কোথায় আছ কেমনে রাণী,

কাজ কি খোজে, নাই বা জানি!

ভালোবাসি এই আনন্দে আপনি আছি ভোর।

চাই না জাগা, থাকুক চোখে এমনি ঘুমের ঘোর!

রাতে যখন একলা শোব চাইবে তোমায় বুক,

নিবিড়-ঘন হবে যখন একলা থাকার দুখ।

দুখের সূরায় মস্ত হয়ে।

থাকবে এ প্রাণ তোমায় লয়ে,

কল্পনাতে আঁকব তোমার চাঁদ-চুয়ানো মুখ!

ঘুমে জাগায় জড়িয়ে রবে, সেই তো চরম সুখ!

এইভাবে যত দিন যায়, গোপন প্রিয়ার প্রতি দর্শন-তৃষ্ণা তত বেড়ে ওঠে। সাক্ষাতের বাসনা তীব্র হয়। কিন্তু বাধা পড়ে সামাজিক ও ধর্মীয় নৈতিকতার সজাগ দৃষ্টি। ফলে বেড়ে ওঠে বেদনা। আর রাত্রি যত গভীর হয়, প্রভাত তত এগিয়ে আসে। বেদনা যত নিবিড় হয়ে আসে, প্রেম তত কাছে আসে। প্রেমে যত বাধা পড়ে, প্রেম তত বেড়ে চলে। মনের বাসনা, কল্পনা ও সেই সাথে বাধার ফলে মনের চাঞ্চল্য আরো বৃদ্ধি পায়। মন চায় প্রেমের কথা প্রেমিকার কাছে ফুটে বলতে। সরাসরি সে সুযোগ না থাকলে কলম দ্বারা সে নিবেদন ও আবেগ পৌঁছে দেওয়া হয়।

একলা রাতে শুয়ে থাকি

স্বপনে তোমারে দেখি।

বালিশ ভিজে চোখের জলে

বিছান ভিজে ঘামেতে,

যারে যা চিঠি লেইখা দিলাম

সোনার বন্ধুর নামেতে---!!!

মন তখন কলমের মুখে কাগজের সাথে ভালোবাসার কত কথা বলে। কত কথা ভাষায় প্রকাশ করতে না পেরে না বলা থেকে যায়।

কলমে নাই কালি হাতে নাই জোর,

পত্র লিখতে বসে আমার রাত্রি হল ভোর!

প্রীতির সাথে ইতি দিয়ে শেষ করলাম লেখা,

জানি না যে, তোমার সাথে কবে হবে দেখা!

কখনো বা কথা হয় মনে-মনে, গোপনে, কানে-কানে, ফোনে-ফোনে। প্রেম এমনই জিনিস যে, মনের গোপন কোণে তা ধীরে-ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। প্রেম যোগায় কল্পনা। ভালোমন্দের কল্পনা। আশা ও আশঙ্কার, ভয় ও ভরসার কত শত সুদূর কল্পনা। আর কল্পনা আনে চিন্তাশক্তি ও সাহিত্যিক রচনা-শৈলিতা। প্রেম আনে জীবনের আন্দোলন, আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার। সান্নিধ্যের আশা এবং দূরত্বের হতাশ তথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কার সুখ ও কষ্ট মানুষের মনে কবিত্ব সৃষ্টি করে।

নারীর বিরহে, নারীর মিলনে, নর পেল কবি-প্রাণ,

যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।

মন তখন শুধু গেয়ে ওঠে ভালোবাসার গান, মিলনের গান, বিরহের গান।

‘তুমি আমায় ভালোবাস তাই তো আমি কবি,

তোমার এ রূপ-সে তো তোমার ভালোবাসার ছবি!

প্রেম যেমন দুই প্রকার; পবিত্র ও অপবিত্র। ঠিক কবিত্বও দুই প্রকার; বৈধ ও অবৈধ। আকাশ-কুসুম অবাস্তব কল্পনা করে আবোল-তাবোল বা অশ্লীল কথামালার কবিতার কবি সাধারণতঃ অপবিত্র প্রেমের প্রেমিকই হয়ে থাকে। আর এ শ্রেণীর কবির মন যখনই কবিতা লিখতে নির্জনে বসে, তখনই শয়তান তার সঙ্গী হয়ে কবির কল্পনায় সহযোগিতা করে। (সহীহুল জামে ৫৭০৬ নং)।

এ শ্রেণীর কবি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, “বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে থাকে। তুমি কি দেখ না যে, ওরা প্রত্যেক উপত্যকায় (লক্ষ্যহীনভাবে সর্ববিষয়ে) কল্পনাবিহার করে? এবং ওরা যা বলে, তা করে না।” (সূরা শুআরা ২২৪-২২৬ আয়াত)

এ শ্রেণীর কবি কখনো তাওহীদ ও ইসলামের প্রশংসা ও জয়গান গাইলেও শির্ক ও কুফরী তথা বিদআতের প্রশংসা এবং জয়গান গেয়ে থাকে। কখনো বীরত্বের কথা, কখনো নারীপ্রেমের কথা, কখনো সতীত্বের নিন্দা, আবার কখনো বেশ্যার প্রশংসা, এবং এইভাবে জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়ে কবিতা রচনা করে থাকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কবিতায় যা বলে, মনে তা বিশ্বাস রাখে না। যতটা বলে, বাস্তব ততটা নয় বা মোটেই নয়। যা বলে, তা নিজে করে না।

প্রেমজালে আবদ্ধ কবি বন্ধু আমার! তোমার প্রেম যদি পবিত্র হয়, তাহলে সে কথা ভিন্ন। তোমার কবিতার শব্দ-ছন্দ যদি কল্পনা-প্রসূত অবাস্তব না হয়, অতিরঞ্জিত, অশ্লীল ও নৈতিকতা-বিরোধী না হয়, বরং বাস্তবধর্মী ও সত্যের আহ্বায়ক হয়, বাতিলকে খন্ডন করার জন্য হয়, তাহলে অবশ্যই তা প্রশংসনীয়। মহান আল্লাহ বলেন, “তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা ঈমান এনে সৎকর্ম করে, আল্লাহকে খুব স্মরণ করে এবং অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারীরা শীঘ্রই জানতে পারবে, তাদের গন্তব্যস্থল কোথায়?” (ঐ ২২৭ আয়াত)

প্রেমিক বন্ধু আমার। তুমি হয়তো ভাবতেও পার যে, তোমার প্রেম পবিত্র। কিন্তু জেনে রেখো যে, মানুষের মন বড় মন্দপ্রবণ। যেটা করতে নিষিদ্ধ, সেটা করেই যেন মানুষের আনন্দ বেশী। আর যেটা নিয়ে মানুষ আনন্দে মত্ত ও উদাস হতে পারে, সেটাই দ্বীনে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি অনুরাগ, আকর্ষণ ও কৌতুহল মানুষের প্রকৃতি। বলা বাহুল্য, এখানেই থাকে সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের আসল পরীক্ষা। যে বই-এর উপর লেখা থাকে, অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য পড়া নিষেধ’ সে বইটাই অপ্রাপ্তবয়স্করা আগে পড়ার চেষ্টা করে। নচেৎ যেন, শান্তি পায় না, স্বস্তি পায় না। অধিকাংশ মানুষেরই মনের প্রবণতা ঠিক পাগলার মত; যখন পাগলাকে বলা হল, ‘পাগলা সঁকো নাড়ি নে! পাগলা বলল, মনে ছিল না, ভালো, মনে করে দিলি। আর এই বলে সে অর্ধভগ্ন বাঁশের সাঁকো নেড়ে ভেঙ্গেই ফেলল।

এমনই ঘটে থাকে। যার যাতে আনন্দ, তাকে সে কাজ করতে নিষেধ করলে অনেক সময় তার সেই প্রবৃত্তি অধিকতর প্রবল হয়ে ওঠে। পরন্তু যার যে কাজে প্রবৃত্তি, তাকে সেই কাজে নিষেধ করতে গিয়ে দেখা যায় যে, তার সে প্রবৃত্তি জেগে উঠেছে, যা সে ভুলে ছিল।

আশা করি যে, তুমি সে প্রকৃতির নও। কারণ, তোমাকে মনে রাখতে হবে যে, “বেহেস্তের পথ বড় কঁাটাময় এবং দোযখের পথ বড় আনন্দময়।” (বুখারী মুসলিম আহমাদ, তিরমিযী, সহীহুল জামে’ ৩ ১২৬, ৩১৪৭ নং) আর সে আনন্দের কি কোন মূল্য আছে, যার পশ্চাতে অপেক্ষা করে দুঃখ ও কষ্ট? কিন্তু মনের উপর তোমার যদি নিয়ন্ত্রণ না থাকে, তাহলেই সর্বনাশ! পরন্তু আকাঙ্খার ধন যত দুর্লভ হয়, মনের আকাঙ্খা তত বাড়ে। আর ভোগ যেমনই হোক, তার একটা তীব্র নেশা আছে। একপাত্র নিঃশেষ করে অবিলম্বে আর এক পাত্রের দিকে হাত বাড়াতে ইচ্ছা হয়।

মন্দপ্রবণ মন যত ভোগ করে, তার ভোগের বাসনা ততই বেড়ে চলে। তুমি যদি কারুনের সমান ধন-মাল পাও, ফেরাউনের মত সস্বাস্থ্য ও দেহ পাও এবং সর্বপ্রকার রঙ, রূপ ও লাবণ্যের দশ হাজার উদ্ভিন্ন-যৌবনা সুন্দরী যুবতী শয্যা-সঙ্গিনীরূপে পাও, তবুও তুমি কি মনে কর যে, এতে তোমার মন-জান ভরবে? কক্ষনো না। অবৈধ পথে বগাহীন মনের প্রবৃত্তি ও প্রবণতাই হল এমনি। পক্ষান্তরে হালাল পথের একটি নারীই তোমার জন্য যথেষ্ট হবে। মনের সকল চাহিদা তারই মাঝে মিটে যাবে; যদি তোমার নিয়ন্ত্রণে থাকে তবে। নচেৎ অবৈধ প্রণয় ও কামনার জ্বালা তোমার মনকে কোনদিন শান্তি দিতে পারবে না।

কহিবে না কথা তুমি! আজ মনে হয়,

প্রেম সত্য চিরন্তন, প্রেমের পাত্র সে বুঝি চিরন্তন নয়।

জন্ম যার কামনার বীজে

কামনারই মাঝে সে যে বেড়ে যায় কল্পতরু নিজে।

দিকে দিকে পাখা তার করে অভিযান,

ও যে শুষিয়া নেবে আকাশের যত বায়ু প্রাণ।

আকাশ ঢেকেছে তার পাখা

কামনার সবুজ বলাকা!

প্রেম সত্য, প্রেম-পাত্র বহু অগণন,

তাই-চাই, বুকে পাই, তবু কেন কেঁদে ওঠে মন।

নিদ্রাহারা বন্ধু আমার! ধোকা খেও না অতিরঞ্জিত উপন্যাস ও ফিল্মী-দুনিয়ার রোমান্টিক বিভিন্ন প্রেম-কাহিনী পড়ে ও শুনে। 'প্রেম অনির্বাণ’ এ কথা সত্য হলেও তোমার প্রেম যে। ঐরূপ বিরল ও রোমান্টিক হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়? তুমি তো পুরুষ। পুরুষের মত মনকে সবল কর এবং নিজেকে ‘হিরো’ করার চেষ্টা করো না।

পক্ষান্তরে যদি কোন সুন্দরী তোমাকে অযাচিতভাবে প্রেম নিবেদন করে, তবুও তুমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করে এমন ‘ইদুর-মারা কল’-এ পা দিও না। নচেৎ প্রেমিক কবি হওয়ার বদলে নিজের প্রতিভাই হারিয়ে বসবে।

হ্যা, আর ‘ইয়ে করে বিয়ে অর্থাৎ পরিচয় থেকে প্রণয় এবং প্রণয় থেকে পরিণয় হওয়ার কথা ভাবছ? এমন বিবাহকে পছন্দ করে বিবাহ' নাম দিলেও আসলে তা হল ইউরোপীয় কোটশীপ’ প্রথা। যা কোন মুসলিমের জন্য বৈধ ও শোভনীয় নয়। সূদের নাম পরিবর্তন করে লভ্যাংশ’ বললে যেমন সূদ হালাল হয় না, ঠিক তেমনি বিয়ের আগে অবৈধ প্রণয়ে ফেঁসে, চোখ, হাত, জিভ, পা ও যৌনাঙ্গের ব্যভিচার করে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিয়ে করাকে ‘লাভ-ম্যারেজ’ বা ‘পছন্দ করে বিয়ে নাম দিলে তা হালাল হয়ে যায় না। ইসলাম পছন্দ করে বিয়েকে বিধিবদ্ধ করেছে এবং বিয়ের আগে কনেকে একবার দেখে নিতে অনুমতি দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিয়ের আগে হৃদয়ের আদান-প্রদানের মাধ্যমে প্রেম সৃষ্টির জন্য বরকনের হাতে ডোর ছেড়ে দেয়নি। যেমন উভয়ের মধ্যে কারো তার বিবাহে অসম্মতি থাকলে জোরপূর্বক বিবাহ-বন্ধনকে ইসলাম অনুমোদন ও স্বীকৃতিই দেয় না।

আসল কথা হল, আধুনিক যুগের পাশ্চাত্যের অভিশপ্ত ছায়া অনেক মুসলিম যুবক-যুবতীর মাঝেও বহু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সিনেমা-জগতের মাধ্যমে এসে পড়েছে। তাই পশ্চিমী কায়দায় তারা নিজেদের সংসার গড়ে তোলার পূর্বে এমন যৌনাচার ও ভালোবাসাকে একটা বৈধ ও সভ্য ফ্যাশন বলে বরণ করে নিয়েছে। অথচ পাশ্চাত্য সমাজ, যেখানে 'লাভ-ম্যারেজ’ ছাড়া। অভিভাবকদের অভিজ্ঞতালব্ধ উপায়ে এবং শরয়ী দূরদর্শিতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিবাহ মোটেই হয় না বললেই চলে। যৌন-স্বাধীনতার সে লাগামছাড়া দেশে দাম্পত্য-জীবন যে কত তিক্ত ও জ্বালাময়, তা অনেক মানুষেই জানে।

পাশ্চাত্য সভ্যতায় আনুষ্ঠানিক বিবাহ তুলনামূলকভাবে খুবই কম হয়। আর যেটুকু হয় সেটুকু বড় দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও দেহ-মন দেওয়া-নেওয়ার পর হয়! বন্ধু-বান্ধবীরূপে বাস করতে করতে ৩৫/৪০ বছর বয়সে পেীছে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কেউ হয়, কেউ হয় না। কেউ টেস্ট করতে করতেই জীবন অতিবাহিত করে ফেলে; পছন্দ আর হয়ে ওঠে না। আমেরিকার এ রকমই এক বরের বয়স ৯৪ এবং কনের বয়স ৯৩ বছর। এই দীর্ঘ প্রায় এক শতাব্দী কাল ধরে বন্ধুত্ব ও এক অপরকে বুঝে নেওয়ার পর তারা এই সেদিন বিবাহিত সংসার-জীবনে প্রবেশ করল। আর তারা এ কথাও প্রকাশ করল যে, তাদের বাসর (?!) রাত ছিল জীবনের সবচেয়ে লম্বা (?) ও মধুরতম রাত! (আয-যিওয়াজ পত্রিকা, এপ্রিল-জুন ১৯৯৮, ২৫পৃঃ)

স্বাধীনতাকামী বন্ধু আমার! এমন নৈতিকতা ও শালীনতা-বর্জিত স্বাধীনতাকে প্রগতি ভেবে বসো না। কারণ, এটাই হল তাদের দুর্গতিময় অধোগতি।

হ্যা, আর কোন অমুসলিম নারীর প্রেমে পড়ে বলো না যে, তুমি তো একজন মানুষকে হেদায়াতের আলো দানের চেষ্টা করছ। বরং হয়তো আসল কথা হল এই যে, তুমি তার প্রেমজালে বন্দী হয়ে পড়েছ। আর তা যদি সত্য হয়, তাহলে মহান প্রভুর নির্দেশ শোন। তিনি বলেন, “মুশরিক নারীগণ ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা তাদেরকে বিবাহ করো না; যদিও তারা তোমাদের নিকট মনোহারিণী হয় তবুও মু'মিন (মুসলিম) দাসী মুশরিক নারী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর।” (সূরা বাকারাহ ২২১ আয়াত) নারী-পুরুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠার যুগে ধর্ষণ অস্বাভাবিক নয়, যেমন অস্বাভাবিক নয় যে কোনও ধরনের রমণীর সাথে ভালোবাসা হয়ে যাওয়া। যা অস্বাভাবিক তা হল, একজন জ্ঞানী ও মুসলিম যুবকের এই প্রমাণ করা যে, পিরীতে মজিল মন, কি বা হাঁড়ি, কি বা ডোম!” বেপর্দা পরিবেশে প্রেম-পিরীত স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অস্বাভাবিক হল একজন মুসলিম যুবকের বেপর্দা মহিলাকে ভালোবেসে ফেল। সহশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে প্রেম হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অস্বাভাবিক হল, মুসলিম দেশেও এমন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান চালু রাখা। বাড়ির দাসীর সঙ্গেও অবৈধ প্রণয় গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। যা অস্বাভাবিক তা হল, মুসলিম পরিবারের এমন ঢিলা তরবিয়ত ও অবজ্ঞাপূর্ণ অভিভাবকত্ব।

কোন নিকটাত্মীয়া যুবতীর সাথেও ভালোবাসা হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হল, একই বাড়িতে এগানা-বেগানার এমন সহাবস্থান।

প্রেম তো হতেই পারে। প্রেম তো এক প্রকার যাদু। কোন প্রকারের মনের মিল বা আকর্ষণ সৃষ্টি হলে এবং প্রবৃত্তির ডোর লাগামহীনভাবে ছেড়ে দিলেই ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। কোন প্রকার ভালো লেগে গেলেই হল। দ্বীন, সম্পদ, রূপ বা বংশ, কারণ যাই হোক না কেন, মনের ভালো লাগা সবার শীর্ষে। ভালো লাগার কাছে বিবেকও হার মেনে যায়। সকল বিচারবিবেচনা বিকল হয়ে পড়ে। কুৎসিত হলেও প্রেমিকের চোখে সেই হয় বিশ্বসুন্দরী। অপরাধ করলেও তার সকল ভুল ফুল স্বরূপ দৃষ্টিগোচর হয়। প্রেম মানুষকে অন্ধ ও বধির করে তোলে। বেহায়া ও নির্লজ্জ করে ফেলে, করে ফেলে অস্থির-চিত্ত ও অর্ধ-পাগল।

‘চেতনেতে অচেতন, প্রেমে টানে যার মন। নদী যখন বর্ষার পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে কানায়-কানায় প্রবাহিত হয়, তখন সে কি খেয়াল রাখতে পারে যে, পানির স্রোত কিভাবে এসে তার বুক পূর্ণ করে দিচ্ছে এবং তার উভয় কূল প্লাবিত করে বয়ে উদ্ধৃঙ্খল অবস্থায় বয়ে যাচ্ছে? নব-যৌবনের হৃদয় যখন কানায়-কানায় ভালোবাসায় ভরে ওঠে, তখন প্রেমিক নিজের আত্ম-সচেতনতার কথা ভুলেই যায়, পরন্তু প্রেমিকারও কত ত্রুটি সে লক্ষ্য করতে পারে না। ফলে দু'তরফা ক্ষতি হয়ে থাকে এমন প্রেম-রোগীর। প্রেম আনে ঔদাস্য ও অজ্ঞানতা। প্রেম করে প্রতিভা নষ্ট।

‘মানবের মনে প্রেম হইলে প্রবল,

বুদ্ধি-জ্ঞান সমুদয় যায় রসাতল।

বাঘের নিকটে কারো খাটে না শক্তি,

প্রেমের হাতেও নর নিরুপায় অতি।

প্রেম যদি জাগে মনে জ্ঞান নাহি রয়,

বিবেকের স্থান তথা নাহিক নিশ্চয়।

ব্যাটের অধীনে যথা চলে সদা বল,

প্রেমের অধীনে তথা প্রেমিক সকল।

কত মানসিক পীড়া এসে বাসা বাঁধে পিরীত-নেশাগ্রস্ত প্রেমিকের মনে। কখনো বা মনের বাঁধনকে এঁটে রাখতে না পেরে এমন আচরণ করে বসে, যা স্বাভাবিক চোখে হাস্যকর। পাগলের মত আচরণ করেও নিজেকে বীর ভাবে। নিজেকে সুপুরুষ ভেবে যারা প্রেম করে না তাদেরকে কাপুরুষ মনে করে। অনেক সময় এমন প্রেমের মজনুকে দেখে মনে হয় যে, তাকে কেউ যাদু করেছে। অনেকে অপরাধ এড়াবার জন্যও এ কথা নিজে বলে থাকে। কিন্তু আসল কথা এই যে, প্রেমের চেয়ে বড় যাদু আর কিছু নেই। অস্বাভাবিক আচরণের জন্য প্রেমের নায়ক লোকের চোখে নিন্দিত হয়। তার বদনাম ছড়িয়ে পড়ে সমাজে। প্রেম-সাধনায় সিদ্ধিলাভ না হলে অনেকে আক্ষেপে ভেঙ্গে পড়ে। অনেক সময় ভাবে মাছ ধরব, অথচ গায়ে কাদা লাগাব না। কিন্তু পরিশেষে সে প্রেমের দলদলে তলিয়ে যায়, নতুবা অন্য কেউ তার গায়ে কাদা ছিটিয়ে দেয়। অবশেষে প্রেমও সাফল্য পায় না। অথচ মাঝখান থেকে শূন্য হাতে পায় শুধু বদনাম আর অপমান।

যে সব প্রতীক প্রতিমার প্রেমে কেটেছে দীর্ঘ দিন,

যাদের জন্য নিন্দিত আমি লোকের চক্ষে হীন।

তুচ্ছে পাত্রে তারাই আমার ডুবিয়েছে খ্যাতি-যশ,

লঘু সঙ্গীত বিকিয়ে আমার সুনাম শুন্যে লীন।

পক্ষান্তরে একজন মুমিনের উচিত নয়, উদাসীন হওয়া, নিজেকে অপদস্থ ও লাঞ্ছিত করা, অবৈধ প্রণয়ে পড়ে অস্বাভাবিক আচরণ করা।

প্রেমে পড়ে প্রেমিক তার দ্বীন ও ঈমানের মত অমূল্য ধনও হারিয়ে বসে অনেক সময়। অবৈধ প্রণয়ের ঐ কুপ্রবৃত্তি মমিনের ঈমানকে দুর্বল করে ফেলে। সত্যই তো, যে হৃদয়ে। অবৈধ নারী-প্রেম সমাসীন থাকে, সে হৃদয়ে পবিত্র আল্লাহর প্রেম কেন বাসা বাঁধবে? তাই একটা বাস্তব কথা এই যে, সাধারণতঃ তারাই বেশী এই অবৈধ নারী-প্রেমে ফেঁসে থাকে, যাদের মনে ততটা অথবা মোটেই আল্লাহ-প্রেম নেই।

‘অনির্বাণ প্রেম’-এর কোন কোন হতভাগা প্রেমিক বেদ্বীন নারীর প্রেমে পড়ে, প্রিয়ার প্রেম ও মনকে জয় করতে গিয়ে নিজের দ্বীন ত্যাগ করে মুর্তাদ্দ হয়ে বসে! যার ফলে দুনিয়াতে। ইসলামী আইনে হত্যাযোগ্য অপরাধ এবং আখেরাতে চিরস্থায়ী দোযখ বাস করার মত পাপে লিপ্ত হয়ে যায়।

প্রেম দ্বীনদার যুবকের হৃদয়কেও ঈমানী চিন্তাধারা ও আল্লাহর যিকর থেকে মগুল করে রাখে। অনেক সময় নামাযগুলিতেও প্রেম ও প্রেমিকার কথা ভাবতে ভাবতে শয়তান তাকে এমন এমন কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তার নামায অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে এবং তার ‘ওঠ-বস করাই সার হয়। প্রেমিক যত তার প্রেমিকার (অবৈধভাবে) কাছে হওয়ার চেষ্টা। করে, ঠিক তত সে আল্লাহ থেকে দুর হতে থাকে। আর এইভাবে আল্লাহর ভয় ও তাকওয়া ধীরে-ধীরে হৃদয় থেকে বিলীন হয়ে যায়।

এই দিক দিয়ে প্রেম’ শয়তানের এমন এক হাতিয়ার যে, তদ্দারা সে সহজে নেক লোকদেরকে ঘায়েল করে থাকে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম বেশী করে অথবা তা করার প্রশিক্ষণ নিতে থাকে (যেমন আলেম, মসজিদের ইমাম, তালেবে ইলম প্রভৃতি) তাকে সর্বাগ্রে পরাস্ত ও ক্ষান্ত করার জন্য সে এই মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে থাকে। আর এই নারী ও অর্থ-প্রেমের মাধ্যমে ইবলীস মুসলিম সমাজকে তার শ্রদ্ধেয় আলেম সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এবং আলেম-উলামাকে সমাজের চোখে খাটো ও ঘৃণ্য করতে কৃতার্থ ও পারঙ্গম হয়।

সুতরাং আল্লাহর নিকট আমাদের এই প্রার্থনা যে, তিনি যেন মুসলিম যুব-সমাজকে শয়তানের এমন চক্রান্ত ও কুট-কৌশলের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং এমন ইলম দান করেন, যার দ্বারা হৃদয়ে তাকওয়া লাভ হয় ও শয়তান হয় লাঞ্ছিত-পরাভূত। প্রেম হল একটা এমন গোলমেলে ব্যাপার, যার মাধ্যমে মানুষের অনেক কিছুই গোলমাল হয়ে যায়। সুবুদ্ধির মাথা খাওয়া যায়। ভালো ছাত্রের সুবিন্যস্ত পড়াশোনায় তালগোল খেয়ে যায়। কখনো খেয়ো নাকো তালে আর ঘোলে, কখনো ভুলো নাকো টেমনের বোলে’ প্রবাদ ভুলে গিয়ে পরীক্ষায় গোল্লা খেয়ে থাকে। কুঁড়ি অবস্থায় ফুলের মত প্রতিভা জীবন থেকে ঝরে পড়ে। প্রেমের পরশে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়, সুচিন্তার স্থানকে কুচিন্তা এসে জবরদখল করে নেয়। ফলে অধ্যয়ন যায়, উন্নয়ন যায়, রুদ্ধ হয় জ্ঞান শিক্ষার দুয়ার।

অনেকে উন্নতির নাগাল পেয়েও নারীর মায়াজালে ফেঁসে গিয়ে পদ হারায়, চাকুরী হারায়, হারায় অনর্থক বহু ধন-সম্পদ।

ব্যভিচার বা অবৈধ যৌন-মিলন এক মহাপাপ। প্রেম প্রেমিক-প্রেমিকাকে এই পাপে লিপ্ত করায়। যদিও প্রেম ও কামনা দুটি পৃথক জিনিস, তবুও ‘বিয়ে তো করবই' এই আশায় পুঞ্জীভূত কাম চরিতার্থ করে ফেলে। মন দিতে-নিতে গিয়ে দেহ-বিনিময় ঘটে যায় এই সর্বনাশী প্রেমের ফুল-বাগানে। আর সত্য কথা এই যে, বর্তমানে প্রেম বা ভালোবাসা’ বলতে যা বুঝায় এবং অধিকাংশ তাতে যা ঘটে, তা হল ব্যভিচার। প্রেমে সর্বপ্রথম, সর্বশেষ ও আসল যে বাসনা ও আকাঙ্খা থাকে, তা হল যৌনমিলন।

এ ছাড়া যুবক-যুবতীর মাঝে বিবাহের পূর্বে পবিত্র প্রেমের কথা কল্পনাই করা যায় না। এ ধরনের প্রেম সাধারণতঃ কপট হয়ে থাকে। এমন ভালোবাসায় নায়ক-নায়িকার মাঝে কেবল এক প্রকার সুড়সুড়ি’ থাকে। আর তা মিটানোর জন্য উভয়ের মধ্যে থাকে নানা অভিনয় ও ছল-কৌশল। অতঃপর সে সুড়সুড়ি’ শেষ হতেই সব শেষ হয়ে যায়। এই শ্রেণীর প্রেমিক-প্রেমিকা সাধারণতঃ একজনকে পেয়ে সুখী হতে পারে না। আসলে এরা প্রেমিক নয়, লম্পট।

এক পাপ অপর এক পাপকে আকর্ষণ ও আহ্বান করে। দেহ-মিলন যখন ঘটবে তখন প্রকৃতিকে তো আর সব সময় বাধা দেওয়া যায় না। উভয়ের অলক্ষ্যে অবৈধ সন্তান জন্ম নেয়। এ অযাচিত ও অবাঞ্ছিত লাঞ্ছনার সন্তানকে আসতে না দিয়ে ভ্রণ অবস্থায় হত্যা করা হয়। অনেকে সঠিক সময়ে পরিস্থিতির সামাল দিতে না পেরে প্রাণ হত্যা করে। জ্বণে জীবন আসার পর তা নষ্ট করা প্রান হত্যার শামিল। কিন্তু লাগামছাড়া সমাজে তারও প্রচলন বেড়েই চলেছে। আইন করে প্রাণ-হত্যা ও গর্ভপাত বৈধ করা হচ্ছে। এমন হত্যার উপায় ও উপকরণ বড় সহজলন্ধ করা হচ্ছে।

যার প্রেক্ষিতে ব্যভিচার আরো বেড়েই চলছে। আবার মজার কথা এই যে, ঐ নিপাতকৃত প্রাণ থেকে ফ্রান্সের এক কোম্পানী মহিলাদের অতি প্রিয় প্রসাধন ও অঙ্গরাগ ‘লিপষ্টিক’ বা ‘ঠোট-পালিশ’ প্রস্তুত করে থাকে। আর এইভাবে ব্যভিচার ও প্রাণ-হত্যা এক অর্থকরী ব্যবসাতেও পরিণত হয়েছে! ব্যাংককে প্রতি বছরে ২ লাখের উপর গর্ভপাত হয়। তন্মধ্যে ৫০ ভাগ কুমারী, ৩৭ ভাগ ছাত্রী এবং বাদবাকী গৃহিণীরা এই গর্ভপাত ঘটিয়ে থাকে (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ৯৩পৃঃ দ্রঃ)।

পক্ষান্তরে জন্মের পর অনেকে সেই সদ্যপ্রসূত অযাচিত শিশুকে নিষ্ঠুরভাবে ডাসবিনে অথবা নদী-জঙ্গলে ফেলে আসে!! শুধু জ্বণ হত্যাই নয়, এই অবৈধ প্রণয়-ঘটিত কারণে মানুষ খুনও হয়ে থাকে। প্রেমে বাধা পড়লে পথের কাঁটা দূর করতে বাধাদানকারীকে খুন, প্রেমিকার প্রেমের ভিখারী অন্য কেউ আছে জানতে পেরে ঈর্ষায় সেই শরীক প্রেমিককে খুন, অথবা প্রেমিকা অন্যকেও প্রেম নিবেদন করে জানতে পেরে রাগ ও ঈর্ষায় নিজ হাতে প্রেমিকাকেই খুন করা হয়ে থাকে। অপেক্ষাকৃত ছোট পাপ করতে করতে পরিশেষে এত বড় মহাপাপ করে ফেলে প্রেমের পাগলরা, যে পাপের শাস্তি (আল্লাহ মাফ না করলে) দোযখ ছাড়া কিছু নয় পরকালে। মহান আল্লাহ বলেন, “আর যে ব্যক্তি কোন মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে তার শাস্তি হবে জাহান্নাম, সেখানেই সে চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন।” (সূরা নিসা ৯৩ আয়াত)

অবৈধ প্রেম-ঘটিত কারণে অনেকের সোনার সংসার ধংস হয়ে যায়। অপর এক নারীকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজের বিবাহিতা স্ত্রীর প্রতি অবিচার ও অত্যাচার করা হয়। অথবা কোন কুলবধুর প্রেমে পড়ে অথবা তার প্রেমকে প্রশ্রয় দিয়ে, তাকে প্রেমপত্র লিখে বা গায়ে-পড়া হয়ে সাক্ষাতে অথবা ফোনে মধুর কথা বলে প্রেমজালে আবদ্ধ করার চেষ্টা করে তার স্বামীর সংসারে অশান্তির মহাপ্রলয় আনয়ন করা হয়। লম্পট হলেও কোন স্বামীই চায় না যে, তার স্ত্রী অন্যাসক্তা হোক, যেমন কোন স্ত্রীও চায় না যে, তার স্বামী অন্যাসক্ত হোক বা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করুক। সুতরাং উভয় প্রকার ধ্বংসই যে মহাধংস তা বলাই বাহুল্য।

মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন বিবাহিতা মহিলাকে তার স্বামীর পক্ষে নষ্ট করে ফেলে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়।” (আহমাদ ২/৩৯৭, আবু দাউদ ৭৫৯, হাকেম ২/১৯৬)।

আল্লাহর রসূল (সা.) আরো বলেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে আমানতের কসম খায়। আর যে ব্যক্তি কোন স্ত্রীকে তার স্বামীর বিরুদ্ধে অথবা কোন দাসকে তার প্রভুর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে সে ব্যক্তিও আমাদের দলভুক্ত নয়।” (আহমদ ৫/৩৫২, বাযযার, ইবনে হিব্বান, হাকেম ৪/২৮৯, সহীহহুল জামে’ ৫৪৩৬নং)।

তাছাড়া অবৈধ প্রেম সৃষ্টি করার ব্যাপারে যেমন শয়তানের বড় হাত থাকে, তেমনি বৈধ প্রেম ধ্বংস করা এবং স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা হল তারই কাজ। শয়তান পানির উপর সিংহাসন পেতে বিভিন্ন মহাপাপ সংঘটিত করার জন্য নিজের চেলাদল পাঠিয়ে থাকে। প্রত্যহ হিসাব নেওয়ার সময় তার নিকট সব থেকে বেশী প্রশংসাই হয় সেই চেলাটি, যে কোন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করতে পেরেছে। সিংহাসন ছেড়ে উঠে এসে এমন চেলাকে জড়িয়ে ধরে সাবাসী ও বাহাদুরীও দেয় ইবলীস! (আহমাদ, মুসলিম ২৮ ১৩ নং)

শুধু স্বামী-স্ত্রীর মাঝেই নয়, বরং এই অশান্তির ঝড় নেমে আসে তাদের আত্মীয়দের মাঝেও। বিশেষ করে তাদের সন্তান থাকলে তাদের জীবনে যে চরম সর্বনাশী পরিণতি নেমে আসে তা অনুমেয়। কোলের ছেলে জলে ফেলে যৌবন সাজিয়ে স্বামীর সংসার ছেড়ে নতুন রসিক নাগরের সাথে গোপনে বের হয়ে সংসার ও ব্যভিচার করলে ঐ ছেলের অবস্থা যা হয় তা দেখে পথের শিয়াল-কুকুরও কাঁদে! আশ্রয়হীন হয়ে উপযুক্ত অভিভাবক বিনা মানুষ হতে গিয়ে অনেক সময় দুশ্চরিত্র ও অসৎরূপে গড়ে ওঠে। আর এর ফলে যত ক্ষতি হয়, তার মূল কারণ হল ঐ সংসার-বিনাশী মানবরূপী শয়তান রসিক নাগর। অবৈধ প্রণয় প্রণয়ীকে নিজ মা-বাপের স্নেহ-দুআ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলে। যে যুবতীকে নৈতিক কারণে মা-বাপ পছন্দ করে না, সে যুবতীর প্রেমে ফেঁসে প্রেম অনির্বাণ রাখতে গিয়ে সংসার-জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস মা-বাপকে ছাড়তে হয়। আর এ কাজে সে মা বাপের অবাধ্য সন্তানরূপে পরিচিত হয়; যে অবাধ্য সন্তান মা-বাপের অসন্তুষ্টি অবস্থায়। বেহেশু প্রবেশের অনুমতি থেকে বঞ্চিত থাকবে।

অবৈধ প্রেম করে বিয়ে করা বউ নিয়ে গঠিত সংসার অধিকাংশ টিকে না। কারণ, বিয়ের পূর্বে ভালোবাসায় অতিরঞ্জন ও অভিনয় থাকে, প্রেমের প্রবল উচ্ছ্বাসে দূরকে ভালো মনে হয়, দুরে-দুরে থাকলে প্রেম গাঢ় হয়, অতিরঞ্জিত প্রেম পাওয়া যায়, ত্রুটি নজরে পড়ে না। দুরে থেকে কেবল প্রেমের সোহাগ নেওয়া যায়, শাসনের বাধা পাওয়া যায় না। তাছাড়া নতুন নতুন সবকিছুই ভালো লাগে, অসুন্দরীকে আচমকা-সুন্দরী লাগে। দুর থেকে সরষে ক্ষেত ঘন লাগে। দুর থেকে উত্তপ্ত মরুভূমিকেও পানির সাগর মনে হয়। আর দুর বলেই-

নদীর এ পাড় কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,

ও পাড়েতে যত সুখ আমার বিশ্বাস।---

বিবাহের পূর্বে দুরে দুরে থাকলে প্রণয়িণী কেবল হৃদয়ে থাকে, বিবাহের পর সংসারে এলে, সর্বক্ষণের জন্য একান্ত কাছে এলে অনেক সময় তার বিপরীত দেখা যায়। (আর এ জন্যই নিজের স্ত্রী চাইতে অপরের স্ত্রী বেশী ভালো মনে হয়। যেমন স্ত্রীকেও অন্যের স্বামী অধিক ভালো লেগে থাকে।) অতঃপর হয় এই যে, কাছে এসে একটি আঘাত খেলেই প্রেমের সে শিশমহল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। কপট প্রেমকে ভিত্তি করে মাকড়সা বা তাসের ঘরের মত যে ঘর-সংসার গড়ে ওঠে, তা সামান্য প্রতিকূল বাতাসেই বিধ্বস্ত হয়ে যায়। পশ্চিমা দেশগুলোতে তালাকের আধিক্য এ কথার স্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। যেখানে ফুল তুলে তার গন্ধ ও সৌন্দর্য লুটে নিয়ে ঝলসে গেলে ছুঁড়ে ফেলা হয়।

নামমাত্র বিবাহ হলেও অল্প কয়েক দিনে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। তাছাড়া ঐ শ্রেণীর অনেক বিবাহ কোন চাপে পড়ে করতে হয়, মন থেকে নয়; বরং অনেক সময় সমাজ ঐ বিবাহকে প্রেমিক-প্রেমিকার ঘাড়ে শাস্তি স্বরূপ (?) চাপিয়ে দেয়। অথবা গর্ভ হয়ে গেলে প্রেমিকা অথবা তার কর্তৃপক্ষের চাপে বা কেবল লজ্জা ঢাকার জন্য প্রেমিক বিবাহ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সর্বশেষ ফল দাঁড়ায়, যুবতীর লাবণ্য ধ্বংস ও পরে বিবাহ-বিচ্ছেদ। সুতরাং এত সব ক্ষতি জেনে-শুনেও এমন ফাঁদে পা দিয়ে লাভ কি বন্ধু!

অনির্বাণ প্রেম-পীড়িত দোস্ত আমার? সুস্বাস্থ্য তোমার জন্য আল্লাহর দেওয়া এক বড় নেয়ামত ও আমানত। প্রেমের দুশ্চিন্তায় পড়ে তা হারিয়ে ফেলায় তোমার কোন অধিকার নেই। ভালো মানুষ প্রেমে পড়ে অনেক সময় রোগক্লিষ্ট হয়ে পড়ে। যেখানে দূরত্ব ও বাধা বেশী, সেখানেই প্রেমের বাড় বেশী। কারণ, অবৈধ প্রেম বাড়াতে শয়তান সহায়ক কুটনা হয়। যার ফলে নানা অশুভ চিন্তা, অবৈধ বাসনা, অবাস্তব কল্পনা এবং প্রিয়তমা হারিয়ে যাওয়া বা প্রেম অসফল হওয়ার বিভিন্ন আশঙ্কা হৃদয়-কোণে এসে বাসা বাঁধে। ফলে কখনো খাওয়াতে অরুচি জন্মে, অনিদ্রা দেখা দেয়। কখনো বা মানসিক চাপে শারীরিকভাবে ব্যাধিগ্রস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে।

‘আসক্তির ছয় চিহ্ন জেনো হে তনয়,

দীর্ঘশ্বাস, মুনমুখ, সিক্ত অক্ষিদ্বয়।

জিজ্ঞাসিলে, অন্য তিন লক্ষণ কোথায়,

স্বপ্নহার, অল্পভাষ, বঞ্চিত নিদ্রায়।

পরিবেশের হাওয়া যখন প্রেমের প্রতিকূলে চলে, তখনই প্রেমিকের মনের আকাশে দুঃখের কালো মেঘ ছেয়ে আসে, কষ্ট পায় নানাভাবে। প্রেমিক অথবা প্রেমিকার হিতাকাঙ্খী অথবা শত্রু এমন প্রেমে বাধা দিতে চায়। ব্যথিত হৃদয় না-পাওয়ার আক্ষেপ জানিয়ে দেয় প্রেমিকার কাছে

--- ভুলি নাই তবু তোমারেই ভালোবেসেছি

কখনো জীবনে কাল বোশেখীর ঝড়

এসেছে গোপনে, ভেঙ্গে গেছে বাধা ঘর।

কত হারানোর ব্যথারে ভুলিতে নীরবে গোপনে কেঁদেছি।

অগ্নি-শিখায় কভু এই মন নিজেরে করেছি ছাই,

কত অশ্রুর ধারায় এ বুক ভাসিয়েছি আমি হায়।---

প্রেম হল ক্ষণিকের মানসিক সুখ। মানুষকে বাঁচতে হলে একটা নেশা নিয়ে বাঁচতে হয়। আর সেই নেশাতে সে মনের মাঝে চরম তৃপ্তি লাভ করে থাকে। অবশ্য অবুঝ মন তখন বৈধ-অবৈধের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হয় না। কিন্তু উভয়ের মাঝেই যেন বেহেস্তী সুখের আমেজ অনুভব করে থাকে। যত ব্যথা আসে, সকল ব্যথা যেন প্রিয়ার সাক্ষাতে অথবা স্মরণে দূরীভূত হয়ে যায়।

‘সাবাস বলি পিরীত-নেশা হেতু তুমি সকল সুখের,

যতই ভুগি রোগে শোকে, বদ্যি তুমি সকল দুখের।

প্রেমের সবকিছুই অতিরঞ্জিত। অতিরঞ্জন করেই অনেকে বলে থাকে,

‘প্রেম-খাতাতে একবার যে

লিখিয়া দিয়াছে নামটি তার,

নাই প্রয়োজন স্বর্গে তাহার

নরক গিয়াছে দুরের পার!!

প্রেমিক বন্ধু আমার! এমন ভুয়ো বুলিতে ধোকা খেয়ে দুনিয়াতেই কল্পিত বেহেশু খোজার অবৈধ বৃথা চেষ্টা করো না। কারণ, প্রেম ক্ষণিকের স্বর্গ হলেও মনে রেখে যে, প্রেমের আনন্দ থাকে স্বল্পক্ষণ, আর তার বেদনা থাকে সারাটি জীবন। প্রেম মানুষকে শান্তি দেয়, কিন্তু স্বস্তি দেয় না। প্রেম হল ধূপের মত; যার আরম্ভ হয় জ্বলন্ত আগুন দিয়ে, আর শেষ পরিণতি হয় ছাই দিয়ে।

ভালোবাসা করার অর্থ হল, তুষে আগুন দেওয়া; যা একেবারে দপ করে জ্বলেও ওঠে না, আর চট করে নিভাতেও চায় না। বরং ভিতরে ভিতরে গোপনে পুড়ে ছাই হতে থাকে। হৃদয়ে আনন্দের অনুভূতি যতটা হয়, তার চেয়ে বেশী হয় ব্যথার অনুভূতি। প্রেমে আনন্দের তুলনায় ব্যথা থাকে অধিক ও নিদারুণ। আর সে ব্যথার কোন অব্যর্থ ঔষধও নেই। মোট কথা ভালোবাসা যা দেয়, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী কেড়ে নেয়।

পক্ষান্তরে কপট প্রেমে প্রেমিক যখন ধোকা খায়, তখন মনের গহিন কোণে হা-হুতাশ তাকে অস্থির করে তোলে। মনের মানসপটে স্মৃতি জাগরিত হয়ে উঠলে প্রাণে মোচড় দিয়ে ওঠে। যখন পদ্মফুল চলে যাবে এবং তার কাটার জ্বালা মনকে অতিষ্ঠ করে তুলবে তখন অপমান ও শোকে শ্বাসরোধ হবে। আর মন গেয়ে উঠবে,

--- আজ আমি মরণের বুক থেকে কাঁদি

অকরুণা! প্রাণ নিয়ে একি মিথ্যা অকরুণ খেলা!

এত ভালোবেসে শেষে এত অবহেলা।

কেমনে হানিতে পার নারী!

এ আঘাত পুরুষের,

হানিতে এ নির্মম আঘাত, জানিতাম, মোরা শুধু পুরুষেরা পারি।

আফশোষ ও আক্ষেপে মন-প্রাণ দগ্ধীভূত হবে এবং গাইবে-

‘ভুল করেছি সারা জীবন তোমায় ভালোবেসে,

জানি নাই যে, কাদতে হবে আমায় অবশেষে।

স্বার্থপরতার প্রেমে স্বার্থে আঘাত লাগলে অথবা স্বার্থে সিদ্ধিলাভ হয়ে গেলে প্রেম আর প্রেম থাকে না বন্ধু! অতএব ওদেরই একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে রেখো

‘ভালোবাসার এমনি মজা যেমন নাকি ঘি,

যাবৎ Hot তাবৎ Good, Cold হলেই ছি।”

পক্ষান্তরে ধোকাবাজি, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা এমন পাপকাজ, যা মানুষকে দোযখে টেনে নিয়ে যায়। (সহীহুল জামে ৬৭২৬ নং) একজনকে তোমাকে ছাড়া বিয়েই করব না’ বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে, তার যথাসর্বস্ব লুটে নিয়ে তাকে ধোকা দেওয়া, অথবা তার চেয়ে আরো ভালো কেউ নজরে পড়লে প্ৰথমকে বর্জন করে দ্বিতীয়কে গ্রহণ করা, ইত্যাদি প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা ঐ কপট প্রেমের আগা-গোড়াই অমানবিক কর্ম।

প্রেমের অভিনয়ে ধোকা খেয়ে গেলে আক্ষেপের সাথে নিজেকে ধিক্কারে ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে হয়। তখন আত্মহত্যা করা কঠিন মনে হয় না। প্রিয়তমা ফাকি দিলে, অথবা গাঢ় প্রেমের পর কোন কারণে উভয়ের মাঝে বিবাহে বাধা পড়লে এবং এ জগতে একমাত্র চাওয়া ও পাওয়া মন-প্রাণ দিয়ে চেয়েও না পাওয়া গেলে, জীবন রাখায় যে লাভ আছে, তা মনে করে না অনেকে। মার্কিন মুলুকে প্রতি বছর ছয় হাজারেরও বেশী তরুণ আত্মহত্যা করে শুধু ঐ অবৈধ প্রণয়-ঘটিত কারণে। (অপসংস্কৃতির বিভীষিকা ৯২ পৃঃ দ্রঃ)

সুতরাং মুসলিম যুবককে সতর্কতার সাথে জেনে রাখা উচিত যে, এমন প্রণয় মহাপাপের কাজ। পক্ষান্তরে যদি কোন প্রকারে প্রেম হয়ে গিয়ে প্রেমিকা তাকে ধোকা দিয়েই ফেলে, তাহলে তার জন্য আত্মহত্যা করতে হবে কেন? আত্মহত্যা যে আর এক মহাপাপ। সুতরাং এ ক্ষেত্রে ধৈর্যের সাথে আল্লাহর প্রশংসা করা উচিত। কারণ, তিনি তাকে এমন দ্বিচারিণী নারী থেকে রক্ষা করেছেন। যে নারী অতি সংগোপনে তার প্রেমে অন্যকেও শরীক করেছিল, সে নারীকে তার জীবন থেকে দূর করে দিয়েছেন।

আর এ কথাও মনে করা ঠিক নয় যে, দুনিয়াতে কেবল তার উপযুক্ত প্রেমময়ী মাত্র একটা লায়লাই জন্ম নিয়েছিল এবং এ জগতে আর এমন কোন নারী নেই, যে তাকে ঐ হারিয়ে যাওয়া লায়লার মত ভালোবাসবে। বরং বাস্তব কথা এই যে, অভিনীত ও অতিরঞ্জিত অবৈধ প্রেমের চাইতে বৈবাহিক-সূত্রে সৃষ্ট পবিত্র প্রেম আরো প্রগাঢ়, আরো নির্মল। কারণ, তা হল আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। তিনি বলেন, “তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পেতে পার। আর তিনি তোমাদের মাঝে পারস্পরিক প্রেম ও স্নেহ সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রূম ২১ আয়াত)

সুতরাং আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের দ্বীন-দুনিয়া ধ্বংস করে দুর্বল মনের পরিচয় দেওয়া কাপুরুষের কাজ। পক্ষান্তরে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করে সবল মনে নতুন করে পবিত্র জীবন গড়ে তোলাই হল সুপুরুষের কাজ।

১- প্রেম আল্লাহর তরফ থেকে পাওয়া মানুষের জন্য এক বড় নেয়ামত। তা যথাস্থানে প্রয়োগ করা এক ইবাদত। আর তা অপপ্রয়োগ করা হল গোনাহর কাজ। অর্থাৎ অবৈধ প্রেম হল সচ্চরিত্রতা ও নৈতিকতার পরিপন্থী। বিবাহের পূর্বে হৃদয়ের আদান-প্রদান বা পছন্দ অথবা ভালোবাসার নামে যুবক-যুবতীর একত্রে ভ্রমণ-বিহার, নির্জনে খোশালাপ, অবাধ মিলামিশা ও দেখা-সাক্ষাৎ, গোপনে চিত্তবিনোদন প্রভৃতি আদর্শ ধর্ম ইসলামে বৈধ নয়। বর্তমান পরিবেশে কেবল সেই যুবকই অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে পারে, যার হৃদয়ে আছে আল্লাহর ভয়। আর আল্লাহর ভয় বুকে থাকলে শত বাধা ও বিপত্তির মাঝে চলার পথ সহজ হয়ে যায়। আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে -এই ভয়ে যে নিজের প্রবৃত্তি দমন করবে, তার ঠিকানা হবে বেহেশ্যে। বরং তার জন্য রয়েছে দুটি বেহেশ্ত।

পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে থাকলে আল্লাহ বান্দাকে এমন নোংরামি থেকে বাঁচিয়ে নেন। ঈমানে আল্লাহর প্রতি ইখলাস থাকলে তিনি বান্দাকে অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখেন। নবী ইউসুফ (আঃ) ও যুলাইখার ব্যাপারে তিনি বলেন, “সেই মহিলা তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল এবং সেও তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ত, যদি না সে তার প্রতিপালকের নিদর্শন। প্রত্যক্ষ করত। তাকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা হতে বিরত রাখার জন্য এইভাবে নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। নিশ্চয় সে ছিল আমার বিশুদ্ধচিত্ত দাসদের একজন।” (সূরা ইউসুফ ২৪ আয়াত)

সুতরাং মনের সন্দেহ ও কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হল ঈমান। ঈমান সুদৃঢ় রাখ, কারো অবৈধ ভালোবাসায় ফাসবে না এবং অবৈধ উপায়ে কেউ তোমার মন চুরি করতে পারবে না।

২- প্রেমরোগের সবচেয়ে বড় অব্যর্থ ও আসল ঔষধ হল ধৈর্য ও মনের দৃঢ়-সংকল্পতা এবং সুপুরুষের মত মনের স্থিরতা। ইচ্ছা পাকা থাকলে উপায়ের পথ বড় সহজ। ধৈর্য কঠিন হলেও তার পরিণাম বড় শুভ; যেমন গাছের ছাল তেঁতো হলেও তার ফল ভারি মিষ্টি।মনের খেয়াল-খুশীকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৃঢ়-সংকল্প হও যে, তুমি ঐ শয়তানী কুমন্ত্রণায় সায় দেবে না। শয়তান হল তোমার প্রধান শত্রু এবং এই প্রণয়ের প্রধান দূত। আর মহান আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কার্যের নির্দেশ দেয়---।” (সূরা নুর ২১ আয়াত)

অতএব ধৈর্যের সাথে শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।

৩- নজর পড়ার সাথে সাথে মনের মানসপটে কোন রূপসীর ছবি অঙ্কিত হয়ে গেলে তার মন্দ দিকটা মনে করো। ভেবো, সে হয়তো আচমকা সুন্দরী, আসলে সুন্দরী নয়। নতুবা বোরকার ভিতরে হয়তো অসুন্দরী। নতুবা ওর হয়তো কোন অসুখ আছে। নতুবা ওর হয়তো বংশ ভালো নয়। নতুবা ওর হয়তো ঘর-বাড়ি ভালো নয়। নতুবা হয়তো ওর সাথে বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়। নতুবা ও হয়তো তোমাকে পছন্দ করবে না। নতুবা ওর অতীত হয়তো কলঙ্কিত, ইত্যাদি। আঙ্গুর ফল নাগালের মধ্যে না পেলে টক মনে করলে মনে সবুর হয়।

তাছাড়া বেল পাকলে কাকের কি? দেখছ কি ভ্যাভ্যা? যার সরষে তার তেল! তাতে তোমার কাজও নেই, লাভও নেই।

৪- জীবনের প্রথম চাওয়াতে ভালো বলে যাকে তুমি ভালোবেসে মনের কাছে পেয়েছ, সেই তোমাকে ভালোবাসবে এবং সে ছাড়া তোমাকে আর কেউ ভালোবাসবে না, বা আর কেউ তোমার কদর করবে না এমন ধারণা ভুল। ভালো কে? যার মনে লাগে যে তোমার ঐ লায়লার চেয়ে আরো ভালো লায়লা পেতে পার। সুতরাং বিবাহের মাধ্যমেও প্রেমময়ী ও গুণবতী সঙ্গিনী পাবে। তবে অবৈধভাবে ওর পেছনে কেন?

৫- প্রেম-পাগলা মজনু বন্ধু। আজ যাকে তুমি ভালোবাসছ, যে তোমাকে তার চোখের ইশারায় প্রেমের জালে আবদ্ধ করেছে, আজ যাকে তুমি তোমার জানের জান মনে করছ, কাল হয়তো সে তোমার অভাব দেখে, কোন অসুখ দেখে, কোন ব্যবহার দেখে অথবা তোমার চাইতে ভালো আর কোন নাগরের ইশারা দেখে, তোমাকে টা-টা’ দিতে পারে। যে তোমার ইশারায় তার নিজের মা-বাপ, বংশ, মান-সম্ভ্রম প্রভৃতি অমান্য ও পদদলিত করে তোমার কাছে এসে যেতে পারে, সে যে তোমার ও তোমার মা-বাপের মান রাখবে, তার নিশ্চয়তা কোথায়? আর এ কথাও জেনে রেখো যে, আজ তুমি মারা গেলে কাল সে আবার অন্যকে বিয়ে করে নতুন সংসারের নতুন বউ হবে। সুতরাং এমন প্রেমের প্রতিমার জন্য এত বলিদান কিসের?

প্রেমিক বন্ধু! পৃথিবীতে যত রকম আশ্চর্যময় জিনিস আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বেশী আশ্চর্যময় জিনিস হল মেয়ে মানুষের মন। সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। তাকে জয় করতে বড় পন্ডিত ও জ্ঞানী লোকেও হিমসিম খেয়ে যায়। সুতরাং তুমি কে? তুমিও হয়তো। একদিন বলতে বাধ্য হবে যে,

এ তুমি আজ সে - তুমি তো নহ, আজ হেরি তুমিও ছলনাময়ী,

তুমিও হইতে চাও মিথ্যা দিয়া জয়ী?

কিছু মেরে দিতে চাও, অন্য তরে রাখ কিছু বাকী,

দুর্ভাগিনী! দেখে হেসে মরি! কারে তুমি দিতে চাও ফাঁকি?

---প্রাণ নিয়ে এ কি নিদারুণ খেলা খেলে এরা হায়,

রক্ত-ঝরা রাঙা বুক দলে অলক্তক পরে এরা পায়!

এরা দেবী, এরা লোভী, এরা চাহে সর্বজন প্রীতি।

ইহাদের তরে নহে প্রেমিকের পূর্ণ পূজা, পূজারীর পূর্ণ সমর্থন,

পূজা হেরি’ ইহাদের ভীরু-বুকে তাই জাগে এত সত্য-ভীতি!

নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো,

এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।

ইহাদের অতি লোভী মন,

একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন!

বন্ধু আমার যদি তুমি ভাব যে, সব নারী তো আর এক রকম নয়। আমার লায়লা আমাকে ধোকা দেবে না। কিন্তু এ কথার নিশ্চয়তা কোথায় বন্ধু? তার কি কোন বন্ধনী বা বেষ্টনী আছে? আর একান্তই যদি তোমার ঐ ধারণা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অবৈধ প্রেম খেলে কেন, লুকোচুরি করে ফিসফিসিয়ে কেন, গোপন প্রেম-পত্র লিখে কেন? বরং বৈধ উপায়ে পয়গাম পাঠিয়ে তাকে তোমার প্রণয়-সুত্রে গেঁথে নাও। হালাল উপায়ে তুমি তাকে তোমার জীবনে নিয়ে এস এবং আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানি করো না।

৬- কোন তরুণীর রূপ দেখেই ধোকা খেয়ো না বন্ধু! প্রেমিকের চোখে প্রেমিকাই হল একমাত্র বিশ্বসুন্দরী। কিন্তু সে তো আবেগের খেয়াল, বাস্তব নয়। তাছাড়া দ্বীন ও চরিত্র না দেখে কেবল রূপে মজে গেলে সংসার যে সুখের হবে, তা ভেবো না। কারণ, চকচক করলেই সোনা হয় না। কাচ না কাঞ্চন তা যাচাই-বাছাই করা জ্ঞানী মানুষের কাজ। পরন্তু ফুলের সৌরভ ও রূপের গৌরব ক’দিনের জন্য? তাই অন্তরের সৌন্দর্য দেখা উচিত। আর সত্যিকারের সে সৌন্দর্য কপালের দুটি চোখ দিয়ে নয়, বরং মন ও জ্ঞানের গভীর দৃষ্টি দিয়েই দেখা সম্ভব। অতএব সেই মন যদি নিয়ন্ত্রণ না করতে পার তাহলে তুমি ‘ইন্না লিল্লাহ-- পড়। আর জেনে রেখো যে, এমন সৌন্দর্য ও দ্বীন ও গুণের অধিকারিণী রমণী কোন দিন লুকোচুরি করে তোমার সাথে প্রেম করতে আসবে না।

৭- স্ত্রী হল জীবনের চিরসঙ্গিনী। সংসারে যত রকমের সম্পদ ও ধন মানুষ পায়, তার মধ্যে পুণ্যময়ী স্ত্রীই হল সব চাইতে বড় ও শ্রেষ্ঠ ধন। সুখ ও দুঃখের সময় সাথের সাথী এই স্ত্রী। এই স্ত্রী ও সাথী নির্বাচন করতে হলে মনের আবেগ ও উপচীয়মান যৌবনের প্রেম ও কামনা দ্বারা নয়; বরং বিবেক ও মন দ্বারা দ্বীন ও চরিত্র দেখে ভেবে-চিন্তে নির্বাচন করতে হয়। তাহলেই পরিশেষে ঠকতে ও পস্তাতে হয় না।

৮- কারো চোখের অশ্রুর কথা বলছ? তবে জেনে রেখো যে, মেয়েদের চোখ থেকে দু’ রকমের অশ্রু ঝরে থাকে; একটি দুঃখের, অন্যটি ছলনার। আর এটাও তোমার মন ও প্রেমের আবেগ দিয়ে নয়, বরং প্রজ্ঞার বিবেক দিয়ে বুঝতে হবে।

প্রেম-বিহুল বন্ধু আমার পূর্বেই বলেছি, সাগরের মত নারী ডাগর জিনিস। নারীকে ছোট ও দুর্বল ভেবো না। সমুদ্র-উপকূলে দাঁড়িয়ে মহাসমুদ্রের যতটুকু দেখা যায়, ঠিক কোন নারীর ততটুকুই অংশ দেখা সম্ভব হয়। নারী দুয়ে, অজেয় নারীর মন। আর আমার মনে হয় যে, তুমি নিশ্চয়ই দিগবিজয়ী বীর নও।

৯- তুমি যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, সে ধনীর মেয়ে নয় তো? অর্থাৎ, কোন প্রকারে সে তোমার জীবনে এসে গেলে, তুমি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার বাসনা পূর্ণ করে চলতে পারবে তো? যদি তা না হয় তাহলে শোন, দরজা দিয়ে অভাব ঢুকলে জানালা দিয়ে ভালোবাসা লুকিয়ে পালিয়ে যায়। সুতরাং প্রেমের নামে নিজের জীবনে বঞ্চনা ও অভিশাপ ডেকে এনো না।

আবার কাউকে শুধু ভালো লাগলেই হয় না। তুমি তার বা তাদের পরিবেশ ও বাড়ির উপযুক্ত কি না, তাও ভেবে দেখ। নচেৎ বাওনের চাদ চাওয়ার মত ব্যাপার হলে শুধু শুধু মনে কষ্ট এনে লাভ কি? তাছাড়া তুমি যদি তোমার শিক্ষা, চরিত্র, ব্যবহার ও সাংসারিক যোগ্যতায় তাদেরকে মুগ্ধ করতে পার, তাহলে গরীব হলেও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবে। আর তুমিই হবে তাদের যোগ্য জামাই। পক্ষান্তরে লুকোচুরিতে চরিত্র নষ্ট করে থাকলে তুমি তাদের চোখে খারাপ হয়ে যাবে। শেষে আর জামাইও হতে পারবে না।

১০- প্রেম-ভিখারী বন্ধু আমার! প্রেম যদি করতেই চাও তাহলে ক্ষণস্থায়ী এ ঢলন্ত-যৌবনা ফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কেন? অসৎচরিত্রা অসতীদের সাথে কেন? হ্যা, সে অসতী বৈকি? যে তোমার সাথে অবৈধভাবে প্রেম করতে আসে, অবাধ মিলামিশ, দেখা-সাক্ষাৎ, চোখাচোখি, হাসাহাসি করে সে অসতী বৈকি?

সুতরাং প্রেম যদি করতেই হয় তাহলে চিরকুমারী অনন্ত-যৌবনা, অফুরন্ত রূপের রূপসীদের সাথে কর। কাঞ্চন-বদনা, সুনয়না, আয়তলোচনা, লজ্জা-বিনম্র, প্রবাল ও পদ্মরাগ-সদৃশ, উদ্ভিন্ন-যৌবনা ষােড়শীদের সাথে কর। যে তরুণীরা হবে সকল প্রকার অপবিত্রতা থেকে পবিত্রা, যারা তুমি ছাড়া আর কারো প্রতি নজর তুলেও দেখবে না। যে সুরভিতা রূপসীদের কেউ যদি পৃথিবীর অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে উঁকি মারে, তাহলে তার ঝলমলে রূপালোকে ও সৌরভে সারা বিশ্বজগৎ আলোকিত ও সুরভিত হয়ে উঠবে। যে সুরমার কেবলমাত্র মাথার ওড়না খানিকে পৃথিবী ও তার সমস্ত সম্পদ ব্যয় করলেও ক্রয় করা সম্ভব হবে না। (বুখারী ৬৫৬৮ নং)।

সুতরাং হালাল উপায়ে বিবাহ কর এবং তার সাথেই প্রেম কর। আর উভয়ে আল্লাহর আনুগত্য করার মাধ্যমে ঐ রূপসীদেরকে বিবাহ করার জন্য দেন-মোহর সংগ্রহ করতে লেগে যাও।

১১- অবৈধ প্রণয় থেকে বাঁচতে নির্জনতা ত্যাগ কর। কারণ, নির্জনতায় ঐ শ্রেণীর কুবাসনা মনে স্থান পায় বেশী। অতএব সকল অসৎ-চরিত্রের বন্ধু থেকে দুরে থেকে সৎ-বন্ধু গ্রহণ করে বিভিন্ন সৎ আলোচনায় প্রবৃত্ত হও। আল্লাহর যিকরে মনোযোগ দাও। বিভিন্ন ফলপ্রসু বইপুস্তক পাঠ কর। সম্ভব হলে সে জায়গা একেবারে বর্জন কর, যে জায়গায় পা রাখলে তার সহিত দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, যে তোমার মন চুরি করে রেখেছে। টেলিফোন এলে তার কথার উত্তর দিও না। পত্র এলে জবাব দিও না। তোমার প্রণয়ের ব্যাপারে তাকে আশকারা দিও না। এমন ব্যবহার তাকে প্রদর্শন করো না, যার ফলে সে তোমার প্রতি আশা ও ভরসা করে ফেলতে পারে। বরং পারলে তাকে নসীহত করো এবং এমন অসৎ উপায় বর্জন করতে উপদেশ দিও। তাতে ফল না হলে পরিশেষে ধমক দিয়েও তাকে বিদায় দিও। আর বেকার বসে থেকো না। কোন না কোন কাজে, নিজের কাজ না থাকলে কোন সমাজকল্যাণমূলক কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা কর।

একা না ঘুমিয়ে কোন আত্মীয়, ভাই বা হিতাকাঙ্খী সৎ-বন্ধুর কাছে ঘুমাবার চেষ্টা কর। রাত্রে ঘুম না এলে যত কুরআন ও শয়নকালের দুআ মুখস্থ আছে শুয়ে শুয়ে সব পড়ে শেষ। করার চেষ্টা কর। 'সুবহানাল্লাহ’ ৩৩ বার, আহামদু লিল্লাহ’ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার” ৩৪ বার পাঠ কর। তার পরেও ঘুম না এলে, ঘুম না হলে তোমার কোন ক্ষতি হবে -এমন ভেবো না। অথবা রাত পার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে মনে আক্ষেপ করো না। এমন ভাবলে ও করলে আরো ঘুম আসতে চাইবে না। অতঃপর একান্ত ঘুম যদি নাই আসে তাহলে বিছানা ছেড়ে উঠে ওযু করে নামায পড়তে শুরু কর। এর মাঝে ঘুমের আবেশ পেলে শুয়ে পড়। ঘুম না এলে বিছানায় উল্টাপাল্টা করলে অন্যান্য দুআ পড়ার পর এই দুআ পড়, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হুল ওয়াহিদুল কাহহার, রাব্দুস সামাওয়াতি অআরযি অমা বাইনাহুমাল আযীযুল গাফফার।

১২- গান-বাজনা শোনা থেকে দূরে থাক। কারণ, পুর্বেই জেনেছ যে, গানে যুব-মন প্রশান্তি পায় না; বরং মনের আগুনকে দ্বিগুণ করে জ্বালিয়ে তোলে। সুতরাং প্রেমময় মনের দুর্বলতা দূর করতে অধিকাধিক কবর যিয়ারত কর, জানাযায় শরীক হও, মরণকে স্মরণ কর। উলামাদের ওয়ায-মাহফিলে উপস্থিত হও, তাদের বক্তৃতার ক্যাসেট শোন।

১৩- অভিনয় দেখা পরিহার কর। কারণ, ফি-যাত্রা-নাটক-থিয়েটার ইত্যাদি তো প্রেমের আগুনে পেট্রোল ঢালে। আর এ সব এমন জিনিস যে, তাতে থাকে অতিরঞ্জিত প্রেম। অবাস্তব কাল্পনিক প্রেম-কাহিনী ও রোমান্টিক ঘটনাবলী। অতএব সে অভিনয় দেখে তুমি ভাবতে পার যে, তুমিও ঐ হিরোর মত প্রেমিক হতে পারবে, অথবা ঐ হিরোইনের মত তুমিও একজন প্রেমিকা পাবে, অথবা ঐ অভিনীত প্রেম তোমার বাস্তব-জীবনেও ঘটবে। অথচ সে ধারণা তোমার ভুল। পক্ষান্তরে ঐ সকল প্রেক্ষাগৃহ বা রঙ্গমঞ্চের ধারে-পাশে উপস্থিত হয়ে চিত্তবিনোদন করার মত গুণ আল্লাহর বান্দাদের নয়; বরং প্রবৃত্তির গোলামদের।

১৪- যাকে ভালোবেসে ফেলেছ, তাকে কখনো একা নির্জনে কাছে পাওয়ার আশা ও চেষ্টা করো না। ব্যভিচার থেকে দুরে থাকলেও দর্শন ও আলাপনকে ক্ষতিকর নয় বলে অবজ্ঞা করো না। জেনে রেখো বন্ধু! যারা মহা অগ্নিকান্ডকে ভয় করে তাদের উচিত, আগুনের ছোট্ট অঙ্গার টুকরাকেও ভয় করা। উচিত নয় ছোট্ট এমন কিছুকে অবজ্ঞা করা, যা হল বড় কিছু ঘটে যাওয়ার ভূমিকা। ছোট্ট মশা নমরুদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। ছোট ছোট পাখীদল। হস্তিবাহিনী সহ আবরাহাকে ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ছিদ্র একটি বিশাল পানি-জাহাজকে সমুদ্র-তলে ডুবিয়ে দিতে পারে। বিছার কামড়ে সাপ মারা যেতে পারে। সামান্য বিষে মানুষ মারা যায়। ক্ষুদ্র হুদহুদ পাখী বিলকীস রাণীর রাজত্ব ধ্বংস করেছে। একটি ছোট্ট ইদুর কত শত শহর ভাসিয়ে দিতে পারে বন্যা এনে। আর এ কথাও শুনে থাকবে যে, হাতির কানে নগণ্য পিঁপড়া প্রবেশ করলে অনেক সময় হাতি তার কারণেই মারা যায়।

দেখানো হচ্ছেঃ ২১ থেকে ৩০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪৬ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 পরের পাতা »