আল-ফিকহুল আকবর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৫৭ টি
আল-ফিকহুল আকবর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৫৭ টি
১০. ৩. ব্যক্তির পাপ-পুণ্য বনাম সমাজ ও রাষ্ট্রের পাপ-পুণ্য

এখানে আরো লক্ষণীয় সমাজ বা রাষ্ট্রের পাপের কারণে মুমিনের নিজ ইবাদত পালনে অবহেলা। অনেক সময় আবেগী মুসলিম মনে করেন, ‘‘নামায পড়ব কার পিছে? সবাই তো বিভিন্ন পাপ বা অপরাধে জড়িত’’, অথবা মনে করেন: ‘‘এত পাপ, জুলুম বা কুফরের মধ্যে থেকে জুমুআ, জামা‘আত ইত্যাদি করে কি লাভ? অথবা আগে এ সকল পাপ, জুলুম ইত্যাদি দূর করি, এরপর জুমুআ-জামা‘আত পালন করব।

এ আবেগ মুমিনকে ভুল পথে পরিচালিত করে। মুমিনের মূল দায়িত্ব নিজের জীবনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুন্নাত অনুসারে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপালন করা। পাশাপাশি তিনি অন্যদেরকে সাধ্যমত দীন পালন ও প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দিবেন। অন্যের পাপের দায়ভার তার নয়। তার সাধ্যমত দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, আপত্তি বা ঘৃণার পরেও সমাজের সকল মানুষ, অধিকাংশ মানুষ এবং সালাতের বা রাষ্ট্রের ইমাম পাপে লিপ্ত থাকলে সে জন্য তিনি দায়ী হবেন না বা তার দীনদারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। পাপের প্রতি ঘৃণা ও আপত্তি-সহ পাপী সমাজে বাস করা, পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করা বা পাপী শাসকের আনুগত্য করার অর্থ তার পাপের স্বীকৃতি দেওয়া নয় বা তার পাপের অংশী হওয়া নয়; বরং ঐক্য বা ‘জামা‘আত’ রক্ষায় নিজের দীনী দায়িত্ব পালন করা। মহান আল্লাহ বলেন:


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَيْكُمْ أَنْفُسَكُمْ لا يَضُرُّكُمْ مَنْ ضَلَّ إِذَا اهْتَدَيْتُمْ


‘‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর শুধু তোমাদের নিজেদের দায়িত্ব। তোমরা যদি সৎপথে থাক তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’’[1]

পাপী শাসক-প্রশাসকদের পিছনে সালাতের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


يُصَلُّونَ لَكُمْ فَإِنْ أَصَابُوا فَلَكُمْ وَإِنْ أَخْطَئُوا فَلَكُمْ وَعَلَيْهِمْ


‘‘তারা তোমাদের জন্য সালাত আদায় করবে। যদি তারা সঠিক করে তবে তোমরা সাওয়াব পাবে। আর তারা যদি অপরাধ করে তবে তোমরা সাওয়াব পাবে এবং তারা পাপী হবে।’’[2]

৩৫ হিজরী সালে খলীফা উসমান (রা)-কে মদীনায় অবরুদ্ধ করে একদল বিদ্রোহী পাপাচারী এবং শেষে তারা তাঁকে নির্মমভাবে শহীদ করে। পাপিষ্ট বিদ্রোহীরা মসজিদে নববীর ইমামতি দখল করে। এরূপ ইমামের পিছনে সালাত আদায় বিষয়ে অবরুদ্ধ উসমান (রা)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন:


الصَّلاةُ أَحْسَنُ مَا يَعْمَلُ النَّاسُ فَإِذَا أَحْسَنَ النَّاسُ فَأَحْسِنْ مَعَهُمْ وَإِذَا أَسَاءُوا فَاجْتَنِبْ إِسَاءَتَهُمْ


‘‘মানুষ যত কর্ম করে তার মধ্যে সালাত সবচেয়ে ভাল কর্ম। যখন মানুষ ভাল কর্ম করে তখন তাদের সাথে তুমিও ভাল কর্ম কর। আর যখন তারা অন্যায় করে তখন তুমি তাদের অন্যায় বর্জন কর।’’[3]

রাষ্ট্রীয় পাপ ও ইসলাম বিরোধিতার প্রসার ঘটে উমাইয়া যুগে। সাহাবীগণ পাপের বিরোধিতার পাশাপাশি পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায় করতেন ও তাদের নেতৃত্বে জিহাদ ও অন্যান্য ইবাদত পালন করতেন। তারিক ইবন শিহাব বলেন:


أَوَّلُ مَنْ بَدَأَ بِالْخُطْبَةِ يَوْمَ الْعِيدِ قَبْلَ الصَّلاةِ مَرْوَانُ فَقَامَ إِلَيْهِ رَجُلٌ فَقَالَ الصَّلاةُ قَبْلَ الْخُطْبَةِ فَقَالَ قَدْ تُرِكَ مَا هُنَالِكَ فَقَالَ أَبُو سَعِيدٍ أَمَّا هَذَا فَقَدْ قَضَى مَا عَلَيْهِ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيمَانِ


‘‘প্রথম যে ব্যক্তি সালাতুল ঈদের খুতবা সালাতের আগে নিয়ে আসে সে মারওয়ান ইবনুল হাকাম। তখন এক ব্যক্তি তার দিকে দাঁড়িয়ে বলে, খুতবার আগে সালাত। মারওয়ান বলেন: তৎকালীন নিয়ম পরিত্যক্ত হয়েছে। তখন আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন, এ ব্যক্তি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: ‘তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় দেখে তবে সে যেন তা তার বাহুবল দিয়ে পরিবর্তন করে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে যেন তার বক্তব্য দিয়ে তা পবিবর্তন করে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তাহলে সে যেন তার অন্তর দিয়ে তা পরিবর্তন (কামনা) করে, আর এ হলো ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়।’’[4]

এখানে অন্যায়্যের প্রতিবাদের সমর্থন-সহ আবূ সাঈদ খুদরী (রা) মারওয়ানের পিছনে সালাত আদায় করেছেন।

প্রসিদ্ধ সাহাবী আবূ আইঊব আনসারী (রা) ইয়াযিদ ইবন মুআবিয়ার নেতৃত্বে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেন।[5] অন্যান্য প্রসিদ্ধ সাহাবীও উমাইয়া যুগে ইয়াযিদ ও অন্যান্য ফাসিক ও ইসলাম বিরোধী আইন-কানুন ও বিধিবিধানে লিপ্ত (খারিজী ও শীয়া বিচারে কাফির) শাসক ও আমীরদের অধীনে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন বা রাষ্ট্রীয় চাকরী ও দায়িত্ব পালন করেছেন। ইয়াযিদ ও পরবর্তী উমাইয়া শাসকদের সবচেয়ে কুখ্যাত প্রশাসক ছিলেন হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ। আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) ও অন্যান্য সাহাবী হাজ্জাজের ইমামতিতে আরাফার মাঠে সালাত আদায় করতেন।[6]

উমাইয়া প্রশাসক ওয়ালীদ ইবন উকবা মদপান করতেন। তিনি একদিন মাতাল অবস্থায় ফজরের সালাতে ইমামতি করেন। তার পিছনে আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) জামাআতে শরীক ছিলেন। ওয়ালীদ মাতাল অবস্থায় থাকার কারণে ফজরের সালাত চার রাকআত আদায় করেন এবং সালাম ফিরিয়ে বলেন: কম হলো কি? আরও লাগবে? তখন ইবন মাসঊদ (রা) ও মুসল্লীগণ বলেন: আজ সকালে তো আপনি বেশি বেশিই দিচ্ছেন (ইতোমধ্যেই দু রাকআত বেশি দিয়েছেন! আর লাগবে না!)।’’[7]

এখানে ইবন মাসঊদ (রা) ইমামের পাপ, মদপান ইত্যাদির কারণে বিদ্রোহ বা তার পিছনে সালাত পরিত্যাগ করে একাকী সালাতের মত প্রকাশ করেননি। কারণ জুমুআ, সালাতের জামাআত ইত্যাদি ইসলামী সমাজের ঐক্য, সংহতি বা ‘জামাআতের’ মূল ভিত্তি। জামা‘আত রক্ষা করা অন্যতম দীনী দায়িত্ব। অন্যের পাপের কারণে মুমিন নিজের দীনী দায়িত্ব বর্জন করতে পারেন না।

ইমাম বুখারী তাঁর আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে তাবিয়ী আব্দুল কারীম বাক্কা থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ‘‘আমি দশজন সাহাবীর সঙ্গ পেয়েছি যারা পাপী-জালিম শাসক-প্রশাসকদের পিছনে সালাত আদায় করতেন।’’[8]

[1] সূরা (৫) মায়িদা: ১০৫ আয়াত।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৪৬ (কিতাবুল জামা‘আত, বাবু ইযা লাম ইউতিম্মিল ইমাম...)।

[3] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৪৬ (কিতাবুল জামা‘আত, বাবু ইমামাতিল মাফতূন ওয়াল মুবতাদি)।

[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৬৯ (কিতাবুল ঈমান, বাবু ... নাহই আনিল মুনকারি মিনাল ঈমান)।

[5] ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ৬/১০৩

[6] বুখারী, আস-সহীহ ২/৫৯৭ (কিতাবুল হাজ্জ, বাবুত তাহজীরি বির-রাওয়াহ ইয়াওমা আরাফা)।

[7] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৩/৪১৪

[8] বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৬/৯০

পাপী ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি নিম্নরূপ:

(১) সালাতের ইমাম যদি রাষ্ট্রপ্রধান, প্রশাসক বা রাষ্ট্র নিয়োজিত কোনো ব্যক্তি হন তবে সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন শিরক-কুফর প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার পিছনে সালাত আদায় করতে হবে। তার পাপের প্রতি ঘৃণা, আপত্তি ও সাধ্যমত শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-সহ তার পিছনে সালাত আদায় রাষ্ট্রীয় জামা‘আত বা ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য ইসলামের নির্দেশনা ও সাহাবীগণের সুন্নাত।

(২) যদি কোনো মসজিদের নিয়মিত নিযুক্ত ইমাম পাপী হন তবে তার নিয়োগের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ পাপী হবেন। সাধারণ মুসল্লী যদি অন্য কোনো ভাল ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের সুযোগ পান তাহলে ভাল, নইলে এরূপ পাপী ইমামের পিছনেই সালাত আদায় করতে হবে। নেককার ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সুস্পষ্ট বা দ্ব্যর্থহীন কুফর-শিরক না পাওয়া পর্যন্ত কোনো অজুহাতে জামা‘আত ও জুমুআ পরিত্যাগ করা যাবে না। কোনোভাবেই ‘জামা‘আত’ বা ঐক্য নষ্ট করা যাবে না। ঐক্য বজায় রেখে উত্তম ইমামের জন্য চেষ্টা করতে হবে। এ বিষয়ে হানাফী ফকহীগণ বলেছেন:


وَلَوْ صلى خَلْفَ مُبْتَدِعٍ أو فَاسِقٍ فَهُوَ مُحْرِزٌ ثَوَابَ الْجَمَاعَةِ لَكِنْ لا يَنَالُ مِثْلَ ما يَنَالُ خَلْفَ تَقِيٍّ


‘‘যদি কেউ কোনো বিদ‘আত-পন্থী বা ফাসিক-পাপাচারীর পিছনে সালাত আদায় করে তবে সে জামাআতের সাওয়াব লাভ করবে; তবে মুত্তাকী ইমামের পিছনে সালাত আদায়ের মত সাওয়াব পাবে না।’’[1]

(৩) যার ইমাম নিয়োগ দেওয়ার বা মসজিদ বাছাই করার সুযোগ আছে তাকে অবশ্যই সুন্নাতের নির্দেশনা অনুসারে মুত্তাকী, কারী ও আলিম ইমাম নিয়োগের বা তার পিছনে সালাত আদায়ের চেষ্টা করতে হবে।

[1] আল-ফাতাওয়া হিনদিয়্যাহ ১/৮৪। আরো দেখুন: ইবনুল হুমাম, শারহু ফাতহিল কাদীর ১/৩৫০; ইবন নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক ৪/২২৯; বুরহান উদ্দীন ইবন মাযাহ, আল-মুহীত আল-বুরহানী ২/১০২; যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকায়িক ২/১৫৯, ১৬২; তাহতাবী, হাশিয়াতুত তাহতাবী আলা মারাকীল ফালাহ ১/২০৪; শুরনুবলালী, মারাকিল ফালাহ, পৃ. ১৪৩।
১০. ৫. ব্যক্তিগত ইবাদত বনাম রাষ্ট্রীয় ইবাদত

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। কুরআন ও হাদীসে মানব জীবনের সকল দিকের বিধিবিধান বিদ্যমান। কোনো বিধান ব্যক্তিগতভাবে পালনীয়, কোনো বিধান সামাজিকভাবে বা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। প্রত্যেক বিধান পালনের জন্য নির্ধারিত শর্তাদি রয়েছে। কুরআনে ‘সালাত’ প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার কুরআনে ‘চোরের হাত কাটার’, ‘ব্যভিচারীর বেত্রাঘাতের’ ও ‘জিহাদ’ বা ‘কিতালের’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ইবাদতটি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনীয়। অন্য কেউ পালন না করলেও মুমিনকে ব্যক্তিগভাবে পালন করতেই হবে। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ নির্দেশটি ‘রাষ্ট্রীয়ভাবে’ পালনীয়। কখনোই একজন মুমিন তা ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠিগত-ভাবে পালন করতে পারেন না। কোন্টি ব্যক্তিগত ও কোন্টি রাষ্ট্রীয় তা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণের কর্মধারা থেকে জানতে হবে।

আমরা দেখছি যে, সালাতের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় দুটি দিক রয়েছে। সালাত ইসলামের অন্যতম রুকন। যে কোনো পরিস্থিতিতে ও যে কোনো স্থানে মুমিনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফরয আইন ইবাদত ‘‘সালাত’’ আদায় করা। আর সালাতের একটি বিশেষ দিক ‘‘জামা‘আত’’। মুমিনের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত জামাআতে আদায় করা জরুরী। ফকীহগণের কেউ জামা‘আত ‘ফরয’, কেউ ‘ওয়াজিব’ এবং কেউ ‘ওয়াজিব পর্যায়ের সুন্নাত’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে সকলেই একমত যে, বিশেষ ওজর ছাড়া ‘জামা‘আত’ পরিত্যাগ করে একাকী সালাত আদায় করা কঠিন গোনাহের কাজ। আর জুমুআর সালাত ও ঈদের সালাত জামাআতে আদায় করা শর্ত।

সুন্নাতের নির্দেশনা অনুসারে জামাআতের জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনা, যোগ্য ইমাম নিয়োগ ইত্যাদি মুমিনের ব্যক্তিগত ফরয ইবাদত নয়, রাষ্ট্র বা সমাজের সামষ্টিক ফরয বা ‘ফরয কিফায়া’ ইবাদত। এক্ষেত্রে যাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে তারা অবহেলা করলে পাপী হবেন। ব্যক্তি মুমিন সাধ্যমত চেষ্টা, অন্যায়ের আপত্তি ও সত্যের দাওয়াত দিবেন। কিন্তু অন্যের পাপের কারণে বা অন্যের উপর রাগ করে নিজের ‘জামা‘আত’ রক্ষার দায়িত্ব নষ্ট করে নিজে পাপে লিপ্ত হবেন না। সমাজের পাপের প্রতিবাদে নিজে ‘জামাত তরকের’ পাপে লিপ্ত হওয়া ইসলামের নির্দেশনা সাথে সাংঘর্ষিক।

সালাত ছাড়া আরো দুটি রাষ্ট্র-সংশ্লিষ্ট ইবাদতের কথা তাহাবী উল্লেখ করেছেন: হজ্জ ও জিহাদ। অন্যান্য আকীদাবিদ ও ফকীহ সালাতুল জুমুআ ও দু ঈদের কথাও উল্লেখ করেছেন। প্রসিদ্ধ কালামবিদ ইমাম আবুল হাসান আশআরী (৩২৪হি) বলেন:


ومن ديننا أن نصلي الجمعة والأعياد وسائر الصلوات والجماعات خلف كل بر وفاجر كما روى أن عبد الله بن عمر كان يصلي خلف الحجاج


‘‘আর আমাদের দীনের অন্যতম দিক যে, আমরা জুমুআর সালাত, ঈদগুলো এবং অন্যান্য সকল সালাত এবং জামাআত সকল নেককার ও বদকারের পিছনে আদায় করি। যেমনিভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের পিছনে সালাত আদায় করতেন।’’[1]

হজ্জ ইসলামের পাঁচ রুকনের শেষ রুকন। এটি মূলত ব্যক্তিগত ফরয ইবাদত। মুমিন যে কোনো অবস্থায় হজ্জ ফরয হলে তা আদায় করবেন। পাশাপাশি হজ্জের ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রীয় বিষয়। হজ্জের তারিখ ঘোষণা, কার্যক্রম পরিচালনা, আরাফাত, মুযদালিফা, মিনায় ইমাম নিযুক্ত করা ইত্যাদি কর্ম অবশ্যই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাষ্ট্রপ্রধানের পাপ, অন্যায়, ইসলাম বিরোধী মতামত বা জুলুমের কারণে এক্ষেত্রে হজ্জ বন্ধ করা বা রাষ্ট্র ঘোষিত চাঁদ দেখাকে বাতিল করে নিজেদের ইচ্ছামত হজ্জ আদায় করা মুমিনের জন্য বৈধ নয়।

ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিতরেরও একই বিধান। হাদীস শরীফে ‘চাঁদ দেখে সিয়াম ও ঈদুল ফিতরের’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, যে কেউ যেখানে ইচ্ছা চাঁদ দেখলেই ঈদ করা যাবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার সাক্ষ্য গৃহীত হলে বা চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলেই শুধু ঈদ করা যাবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সমাজের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ঈদ পালন করতে নির্দেশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


الْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ النَّاسُ وَالأَضْحَى يَوْمَ يُضَحِّي النَّاسُ


‘‘যে দিন সকল মানুষ ঈদুল ফিত্র পালন করবে সে দিনই ঈদুল ফিত্র-এর দিন এবং যেদিন সকল মানুষ ঈদুল আযহা পালন করবে সে দিনই ঈদুল আযহার দিন।’’[2]

প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মাসরূক বলেন, আমি একবার আরাফার দিনে, অর্থাৎ যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখে আয়েশা (রা)-এর নিকট গমন করি। তিনি বলেন, মাসরূককে ছাতু খাওয়াও এবং তাতে মিষ্টি বেশি করে দাও। মাসরূক বলেন, আমি বললাম, আরাফার দিন হিসাবে আজ তো রোযা রাখা দরকার ছিল, তবে আমি একটিমাত্র কারণে রোযা রাখি নি, তা হলো, চাঁদ দেখার বিষয়ে মতভেদ থাকার কারণে আমার ভয় হচ্ছিল যে, আজ হয়ত চাঁদের দশ তারিখ বা কুরবানীর দিন হবে। তখন আয়েশা (রা) বলেন:


اَلنَّحْرُ يَوْمَ يَنْحَرُ الإِمَامُ وَالْفِطْرُ يَوْمَ يُفْطِرُ الإِمَامُ


যেদিন রাষ্ট্রপ্রধান কুরবানীর দিন হিসাবে পালন করবেন সে দিনই কুরবানীর দিন। আর যেদিন রাষ্ট্রপ্রধান ঈদুল ফিতর পালন করবে সে দিনই ঈদের দিন।’’[3]

মুমিনের জন্য নিজ দেশের সরকার ও জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈদ করা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ। অন্য দেশের খবর তো দূরের কথা যদি কেউ নিজে চাঁদ দেখেন কিন্তু রাষ্ট্র তার সাক্ষ্য গ্রহণ না করে তাহলে তিনিও একাকী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপরীতে ঈদ করতে পারবেন না। সাহাবী-তাবিয়ীগণ বলেছেন যে, এক্ষেত্রে ভুল হলেও ঈদ, হজ্জ, কুরবানী সবই আদায় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ভুলের জন্য মুমিন কখনোই দায়ী হবেন না।[4]

সরকারের পাপাচার বা ইসলাম বিরোধিতার অজুহাতে এ সকল ক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করা শরীয়ত নিষিদ্ধ। কোনো মুসলিম দেশকে ‘দারুল হারব’ বা ‘তাগূতী’ রাষ্ট্র বলে গণ্য করা খারিজী ও শীয়াগণের পদ্ধতি। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত শাসক বা সরকারের পাপ বা কুফরীর কারণে মুসলিমদের দেশকে কাফিরের দেশ বানান নি। ইয়াযীদের জুলম-পাপের রাষ্ট্র, মামূনের কুফরী মতবাদের রাষ্ট্র, আকবারের দীন ইলাহীর রাষ্ট্র ও অন্যান্য সকল মুসলিম রাষ্ট্রকেই তারা ‘দারুল ইসলাম’ হিসেবে গণ্য করেছেন এবং জুমুআ, জামা‘আত, ঈদ, জিহাদ, হজ্জ ইত্যাদি সকল বিষয়ে এরূপ সকল দেশে দারুল ইসলামের আহকাম পালন করেছেন।

বর্তমানে ‘সারা বিশ্বে একদিনে ঈদ’ বিষয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। তবে ‘সকল দেশে একদিনে ঈদ’ পালনের নামে ‘একই দেশে একাধিক দিনে ঈদ’ পালন নিঃসন্দেহে ইসলামী নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। বিষয়টি নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণা ও মতবিনিময় অবশ্যই হতে পারে। রাষ্ট্র যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্য কোনো দেশের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণ করে ঘোষণা দেয় তবে জনগণ তা অনুসরণ করবে। তবে আমাদের বুঝতে হবে যে, মহান আল্লাহ ইসলামকে সহজ-পালনীয় করেছেন। বর্তমানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে বিশ্বের কোথাও চাঁদ উঠলে সকল দেশেই তা জানা সম্ভব। কিন্তু অতীতে তা ছিল না। আর দূরবর্তী এলাকার চাঁদের খবর নিতে কেউ চেষ্টা করেননি। মদীনায় চাঁদ দেখার পরে -ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহায় রাতারাতি বা ৯ দিনের মধ্যে- দ্রুত দূরবর্তী অঞ্চলে সংবাদ প্রদানের চেষ্টা বা সর্বত্র একই দিনে ঈদ হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার চেষ্টা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বা খুলাফায়ে রাশেদীন করেননি। সাহাবীগণের যুগ থেকেই একাধিক দিবসে ঈদ হয়েছে।[5] একাধিক দিনে ঈদ পালন বিষয়ক হাদীসটি উদ্ধৃত করে ইমাম তিরমিযী বলেন:


وَالْعَمَلُ عَلَى هَذَا الْحَدِيثِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنَّ لِكُلِّ أَهْلِ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ


‘‘আলিমগণের সিদ্ধান্ত এ হাদীসের উপরেই: প্রত্যেক দেশের মানুষ তাদের নিজেদের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করবে।’’[6]

বস্ত্তত, সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও পরবর্তী আলিমগণ বিভিন্ন দেশে একাধিক দিনে ঈদ পালনকে ইসলামী নির্দেশনার বিরোধী বলে গণ্য করেননি। পক্ষান্তরে একই রাষ্ট্রের মধ্যে বা একই ইমামের (রাষ্ট্রপ্রধানের) অধীনে একাধিক দিনে ঈদ পালনকে সকলেই নিষিদ্ধ, অবৈধ ও ইসলামী নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক বলে গণ্য করেছেন।

[1] আবুল হাসান আশআরী, আল-ইবানাহ, পৃষ্ঠা ২০।

[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৬৫ (কিতাবুস সাওম, বাবু মা জাআ ফিল ফিতরি ওয়াল আদহা মাতা ইয়াকূনু) তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।

[3] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৫/১৭৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/১৯০; মুনযিরী, তারগীব ২/৬৮। মুনযিরী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।

[4] ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২৫৬।

[5] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৬৫ (কিতাবুস সাওম, বাবু ... লিকুল্লি বালাদিন রুইয়াতুহুম)।

[6] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৭৬ (কিতাবুস সাওম, বাবু ...লিকুল্লি আহলি বালাদিন রুইয়াতুহুম)।

‘জিহাদ’ অর্থ প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, পরিশ্রম বা কষ্ট। নিয়মিত পরিপূর্ণ ওযূ, জামাতে সালাত, হজ্জ, আল্লাহর আনুগত্য-মূলক বা আত্মশুদ্ধি-মূলক কর্ম, হক্কের দাওয়াত ইত্যাদি ইবাদতকে হাদীস শরীফে ‘‘জিহাদ’’ বা ‘‘শ্রেষ্ঠতম জিহাদ’’ বলা হয়েছে। তবে ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ অর্থ ‘‘মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ।’’ এ যুদ্ধেরই নাম কিতাল। পারিভাষিক ভাবে জিহাদ ও কিতাল একই বিষয়।[1]

জিহাদের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদ কুরবানি দেওয়া অত্যন্ত বড় ত্যাগ। এজন্য এ ইবাদতের পুরস্কারও অভাবনীয়। কুরআন ও হাদীসে জিহাদের অফুরন্ত পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে এবং এ ইবাদত পালনের জন্য বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ সকল আয়াত ও হাদীসের অর্থ জিহাদ যখন বৈধ বা জরুরী হবে তখন যে ব্যক্তি মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠে জিহাদের দায়িত্ব পালন করবে তখন সে এ পুরস্কার লাভ করবে।

জিহাদের আগ্রহ মুমিনের হৃদয়ে থাকবে। জিহাদের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদের কুরবানীর প্রতি অনীহা ঈমানী দুর্বলতার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:


مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ ، وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ


‘‘যদি কেউ এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে, সে যyুদ্ধ অংশগ্রহণ করে নি এবং যুদ্ধাভিযানে অংশগ্রহণের কোনো কথাও নিজের মনকে কখনো বলে নি, তবে সে ব্যক্তি মুনাফিকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করবে।’’[2]

আমরা দেখব যে, সাধারণভাবে জিহাদ ফরয কিফায়া এবং কখনো কখনো ফরয আইন। ফরয কিফায়া অবস্থায় যদি সকল মুসলিম তা পরিত্যাগ করে এবং ফরয আইন অবস্থায় যদি মুসলিমগণ তা পরিত্যাগ করে তবে তা তাদের জাগতিক লাঞ্ছনা বয়ে আনবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِذَا تَبَايَعْتُمْ بِالْعِينَةِ، وَأَخَذْتُمْ أَذْنَابَ الْبَقَرِ، وَرَضِيتُمْ بِالزَّرْعِ، وَتَرَكْتُمْ الْجِهَادَ، سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ ذُلا لا يَنْزِعُهُ حَتَّى تَرْجِعُوا إِلَى دِينِكُمْ


‘‘যখন তোমরা অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্যে লিপ্ত হবে, গবাদিপশুর লেজ ধারণ করবে, চাষাবাদেই তুষ্ট থাকবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করবে তখন আল্লাহ তোমাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দিবেন, দীনে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যা তিনি অপসারণ করবেন না।’’[3]

এ সকল ফযীলত ও নির্দেশনা বিষয়ক আয়াত ও হাদীসকে নিজেদের আবেগ অনুসারে ব্যাখ্যা করে খারিজীগণ জিহাদকে ফরয আইন বলে দাবি করেন। তারা ন্যায়ের আদেশ-অন্যায়ের নিষেধ এবং জিহাদের মধ্যে পার্থক্য করেন না। এমনকি তারা জিহাদকে ইসলামের ষষ্ঠ রুকন বা বড় ফরয বলে গণ্য করেন। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ, দীন প্রতিষ্ঠা বা জিহাদের নামে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে আইন হাতে তুলে নিয়েছেন বা সশস্ত্র প্রতিরোধ, আক্রমণ, হত্যা ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত হয়েছেন।[4]

তাদের বিপরীতে শীয়াগণ ‘‘মাসূম (নিষ্পাপ) ইমাম-এর নেতৃত্ব ছাড়া জিহাদ হবে না’’ বলে দাবি করেন। তাদের বিশ্বাসে দ্বাদশ ইমাম মুহাম্মাদ আল-মাহদী (২৫৬-২৭৫ হি) ২৭৫ হিজরী সাল থেকে অদৃশ্য জগতে লুকিয়ে রয়েছেন। তিনিই ইমাম মাহদী হিসেবে আবির্ভূত হবেন। তাঁর আবির্ভাবের পরে তাঁর নেতৃত্বে জিহাদ করতে হবে।[5]

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত জিহাদকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সামষ্টিক ফরয বা ফরয কিফায়া বলে গণ্য করেছেন। ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ মুসলিম ব্যক্তিগতভাবে আদায় করতে পারেন। কিন্তু জিহাদ অবশ্যই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে হবে। খারিজী ও শীয়া মতের সাথে তাদের মৌলিক তিনটি পার্থক্য রয়েছে: (১) জিহাদ ফরয কিফায়া ইবাদত, (২) জিহাদের জন্য রাষ্টপ্রধানের নেতৃত্ব জরুরী এবং (৩) রাষ্ট্রপ্রধানের মুত্তাকী বা নেককার হওয়া জরুরী নয়। আমরা তৃতীয় বিষয়টি ইতোপূর্বে জেনেছি। এখানে অন্য দুটি বিষয় পর্যালোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

[1] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ,পৃ. ১০৫-১০৬।

[2] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫১৭।

[3] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৩/২৭৪; আলবানী, সাহীহাহ ১/১৫। হাদীসটি সহীহ।

[4] বিস্তারিত দেখুন: ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ,পৃ. ৬১-৮৪।

[5] ইবন আবিল ইয্য হানাফী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২৫৮; আব্দুল আযীয রাজিহী, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ২৯০।

আমরা বলেছি যে, খারিজীগণ জিহাদকে ফরয আইন প্রমাণের জন্য জিহাদের ফযীলত ও নির্দেশ বিষয়ক সাধারণ আয়াত ও হাদীস পেশ করেন। উপরে কয়েকটি হাদীস আমরা উল্লেখ করেছি। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন:


يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانْفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انْفِرُوا جَمِيعًا


‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন কর এবং (যুদ্ধে) বেরিয়ে যাও দলে দলে অথবা বেরিয়ে যাও একত্রে।’’[1]

খারিজীগণ বলেন, এ সকল আয়াত ও হাদীসে মুমিনদেরকে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং জিহাদ পরিত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কারো অনুমতি বা নেতৃত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয় নি। এতে প্রমাণ হয় যে, জিহাদ ফরয আইন, এর জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই।

তাঁরা বলেন: মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমাদের উপর সিয়াম লিপিবদ্ধ করা হলো’’[2] এবং তিনিই বলেছেন: ‘‘ তোমাদের উপর কিতাল (যুদ্ধ) লিপিবদ্ধ করা হলো’’[3]। কাজেই সিয়াম যেমন ফরয আইন তেমনি কিতাল বা যুদ্ধও ফরয আইন।

তাঁদের বিভ্রান্তির কারণ কুরআন-হাদীসের কিছু বক্তব্যকে সুন্নাতে নববীর সামগ্রিক আওতা থেকে বের করে অনুধাবনের চেষ্টা। কুরআন ও হাদীসে মানব জীবনের সকল দিকের বিধিবিধান বিদ্যমান। প্রত্যেক বিধান পালনের জন্য নির্ধারিত শর্তাদি রয়েছে। তবে কোনো ইবাদতের শর্তাবলি কুরআনে একত্রে বা একস্থানে উল্লেখ করা হয় নি। এছাড়া অধিকাংশ ইবাদতের সকল শর্ত কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। কুরআন ও হাদীসের সামগ্রিক বিধান বা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সামগ্রিক জীবন ও এ সকল নির্দেশ পালনে তাঁর রীতি-পদ্ধতি থেকেই সেগুলোর শর্ত ও পদ্ধতি বুঝতে হবে। তা না হলে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হতে হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন:


أَقِمِ الصَّلاةَ لِدُلُوكِ الشَّمْسِ إِلَى غَسَقِ اللَّيْلِ


‘‘সূর্য ঢলে পড়া থেকে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে।’’[4]

এ নির্দেশের উপর নির্ভর করে যদি কেউ সূর্যাস্তের সময় সালাতে রত হন তবে তিনি নিজে যতই দাবি করুন, মূলত তা ইসলামী ইবাদাত বলে গণ্য হবে না, বরং তা পাপ ও হারাম কর্ম বলে গণ্য হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাদীস শরীফে ‘সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে রাত্রি পর্যন্ত’ সময়ের মধ্যে সালাত আদায়ের বৈধ ও অবৈধ সময় চিহ্নিত করেছেন এবং সূর্যাস্তের সময় সালাত আদায় অবৈধ করেছেন। এভাবে আমরা দেখছি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিক্ষার বাইরে মনগড়াভাবে কুরআন কারীমের অর্থ বা ব্যাখ্যা করা আমাদেরকে ইবাদতের নামে পাপের মধ্যে লিপ্ত করে।

জিহাদ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসও অনুরূপ। কোথাও সাধারণ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং কোথাও এর স্তর ও বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। এক আয়াতে বলা হয়েছে:


لا يَسْتَوِي الْقَاعِدُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فَضَّلَ اللَّهُ الْمُجَاهِدِينَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِينَ دَرَجَةً وَكُلاًّ وَعَدَ اللَّهُ الْحُسْنَى ...


মুমিনদের মধ্যে যারা কোনো অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও (জিহাদ না করে) ঘরে বসে থাকে এবং যারা আল্লাহর পথে নিজেদের প্রাণ ও সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা নিজেদের প্রাণ ও সম্পদ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন। উভয় প্রকারের মুমিনকেই আল্লাহ কল্যাণের (জান্নাতের) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ....।’’[5]

এ আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, জিহাদ ফরয কিফায়া ইবাদত। কোনো অসুবিধা না থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ জিহাদ পরিত্যাগ করে তবে সে পাপী হবে না। তবে যারা এ ইবাদত পালন করবেন তাঁরাই শুধু এর সাওয়াব ও মর্যাদা লাভ করবেন।

খারিজীগণ সাধারণভাবে ধার্মিক ও সমাজের পাপাচারে ব্যথিত। তবে দ্রুত সব কিছু ভাল করে ফেলার আবেগ এবং বিরোধী মানুষদেরকে নির্মূল করার আক্রোশ একত্রিত হয়ে তাদেরকে অন্ধ করে ফেলে। তারা দুটি বিষয়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকেন: (১) যে কোনো অজুহাতে মুসলিমকে কাফির বলে প্রমাণ করা এবং (২) যে কোনো অজুহাতে জিহাদের নামে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত সশস্ত্র আক্রমণ বৈধ করা। জিহাদ ফরয কিফায়া এবং জিহাদের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে যদি কোনো ফকীহের বক্তব্য তাদেরকে বলা হয় তবে তারা বলেন: আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর কথা ছাড়া কিছুই মানি না। আবার যখন তাদের মতের বাইরে কুরআন বা হাদীসের বক্তব্য তাদের সামনে পেশ করা হয় তখন বলেন: অমুক বা তমুক আলিম এগুলোকে মানসূখ বা রহিত বলেছেন! আর এ পদ্ধতিতেই তারা উপরের আয়াতটিকেও মানসূখ বা রহিত বলে দাবি করেন।

কোনো কোনো আলিম মানসূখ শব্দটি ব্যাখ্যা ও সমন্বয় অর্থে ব্যবহার করতেন। যেমন এ আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সক্ষম ব্যক্তি জিহাদ না করলে কোনো সময়ে ও কোনো অবস্থাতেই কোনো অপরাধ হবে না। কিন্তু সূরা তাওবায় আল্লাহ জানিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপ্রধান নির্দেশ দেওয়ার পরে জিহাদ না করা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।[6] এজন্য কোনো আলিম বলেছেন যে, তাওবার আয়াত দ্বারা মায়িদার আয়াত মানসূখ। অর্থাৎ একটি বিশেষ সময়ে ও বিশেষ অবস্থায় জিহাদ ফরয কিফায়া হওয়ার বিধানটি রহিত হয় এবং জিহাদ পরিত্যাগকারী পাপী হয়। এটি হলো রাষ্ট্রপ্রধানের নির্দেশের অবস্থা। এরূপ স্বাভাবিক সমন্বয় ছাড়া কুরআনের মধ্যে বিদ্যমান কোনো আয়াতকে রহিত বলে দাবি করার অর্থ মানুষের কথায় বা মানুষের মন-মর্জি অনুসারে ওহীকে বাতিল করা।

হাদীস শরীফে বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَصَامَ رَمَضَانَ كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ هَاجَرَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَوْ جَلَسَ فِي أَرْضِهِ الَّتِي وُلِدَ فِيهَا قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلَا نُنَبِّئُ النَّاسَ بِذَلِكَ قَالَ إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِهِ ... فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ فَسَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ ...


‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ-এর উপর ঈমান আনবে, সালাত কায়েম করবে, রামাদানের সিয়াম পালন করবে আল্লাহ নিজ দায়িত্বে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, সে ব্যক্তি আল্লাহর রাসত্মায় হিজরত করুক অথবা যে মাটিতে সে জন্মগ্রহণ করেছে সেখাইে বসে থাকুক। তখন সাহাবীগণ বলেন: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি এ বিষয়টি মানুষদেরকে জানিয়ে দেব না? তখন তিনি বলেন: জান্নাতের মধ্যে ১০০টি মর্যাদার স্তর বিদ্যমান যেগুলোকে আল্লাহ তাঁর রাসত্মায় জিহাদকারীদের জন্য তৈরি করেছেন... তোমরা যখন চাইবে তখন ‘ফিরদাউস’-ই চাইবে...। ’’[7]

অর্থাৎ ফরয আইন ইবাদতগুলো পালনের পর মুমিনের উচিত কাফির দেশ থেকে হিজরত করে দারুল ইসলাম বা ইসলামের রাষ্ট্রে এসে রাষ্ট্রপ্রধানের নেতৃত্বে জিহাদে শরীক হওয়া। যদি তিনি হিজরত ও জিহাদে অংশ গ্রহণ না করেন তবে পাপী বলে গণ্য হবেন না। বরং ফরয আইন ইবাদতগুলো পালন করার কারণে মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাত প্রদান করবেন। কিন্তু তা হলো সর্বনিম্ন মর্যাদার জান্নাত। জিহাদের মাধ্যমে মুমিন উচ্চতর মর্যাদার জান্নাত লাভ করেন। মুমিনের উচিত জিহাদের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ জান্নাতের বাসনা হৃদয়ে লালন করা ও আল্লাহর কাছে তা প্রার্থনা করা।

এ অর্থে এক হাদীসে আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন:


إِنَّ رَجُلا أَتَى النَّبِيَّ ﷺ فَقَالَ أَيُّ النَّاسِ أَفْضَلُ ( يا رسول الله)؟ فَقَالَ رَجُلٌ يُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِمَالِهِ وَنَفْسِهِ قَالَ ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ مُؤْمِنٌ مُعْتَزِلٌ فِي شِعْبٍ مِنْ الشِّعَابِ يَعْبُدُ اللَّهَ رَبَّهُ (وفي رواية: يُقِيمُ الصَّلاةَ وَيُؤْتِي الزَّكَاةَ وَيَعْبُدُ رَبَّهُ حَتَّى يَأْتِيَهُ الْيَقِينُ) وَيَدَعُ النَّاسَ مِنْ شَرِّهِ


‘‘একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, সর্বোত্তম মানুষ কে? তিনি বলেন: যে মুমিন নিজের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। লোকটি বলে, এরপর সর্বোত্তম কে? তিনি বলেন: যে মুমিন মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী বিজন উপত্যাকায় থেকে তার প্রতিপালকের ইবাদত করে (দ্বিতীয় বর্ণনায়: এভাবে নির্জনে একাকী সে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, মৃত্যু আগমন পর্যন্ত তার প্রতিপালকের ইবাদত করে) এবং মানুষের কোনো ক্ষতি করে না।’’[8]

এভাবে জিহাদকারী সর্বোত্তম মর্যাদা লাভ করলেন। এর বিপরীতে সমাজ ও জিহাদ পরিত্যাগ করে বিজনে নির্জনে একাকী বসবাস করে দীনের আরকান ও আহকাম পালনের কারণে দ্বিতীয় ব্যক্তি মর্যাদায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। তিনি জিহাদের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হলেন, তবে পাপী বলে গণ্য হলেন না।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:


وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ


‘‘মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। তাদের প্রতিটি দল থেকে একাংশ বের হয় না কেন? যাতে তারা দীনের জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে, যেন তারা সতর্ক হয়।’’[9]

এখানে আল্লাহ সকলকে অভিযানে না অঅনা বেরিয়ে প্রত্যেক দল থেকে কিছু মানুষকে এ ইবাদত পালনের নির্দেশ দিলেন। ফরয আইন ইবাদতের ক্ষেত্রে এরূপ সুযোগ নেই। আমরা বলতে পারি না যে, মুমিনগণ সকলেই সালাত বা সিয়াম পালন করবে না, বরং কেউ তা পালন করবে এবং অন্যরা অন্য দায়িত্ব পালন করবে।

ফরয আইন ইবাদত পালনের জন্য কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। উপরন্তু কেউ নিষেধ করলে বা বাধা দিলেও মুমিনের দায়িত্ব সকল বাধা উপেক্ষা করে তা পালন করা। পক্ষান্তরে ফরয কিফায়ার ক্ষেত্রে অনুমতি গ্রহণের অবকাশ আছে। বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পিতামাতার অনুমতি বা খিদমতের দায়িত্বের কারণে জিহাদ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। এক হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা) বলেন:


جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ فَاسْتَأْذَنَهُ فِي الْجِهَادِ فَقَالَ أَحَيٌّ وَالِدَاكَ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَفِيهِمَا فَجَاهِدْ (فَارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ فَأَحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا)


‘‘একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে এসে জিহাদের অনুমতি প্রার্থনা করে। তিনি বলেন: তোমার পিতামাতা কি জীবিত আছেন? সে বলে: হ্যাঁ। তিনি বলেন: তোমার পিতামাতাকে নিয়ে তুমি জিহাদ কর। (অন্য বর্ণনায়: তাহলে তুমি তোমার পিতামাতার কাছে ফিরে যাও এবং সুন্দরভাবে তাঁদের খেদমত ও সাহচর্যে জীবন কাটাও।’’[10]

অন্য হাদীসে আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) বলেন:


أَنَّ رَجُلاً هَاجَرَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ ﷺ مِنَ الْيَمَنِ فَقَالَ: هَلْ لَكَ أَحَدٌ بِالْيَمَنِ؟ قَالَ: أَبَوَاىَ. قَالَ: أَذِنَا لَكَ؟ قَالَ: لاَ. قَالَ: ارْجِعْ إِلَيْهِمَا فَاسْتَأْذِنْهُمَا فَإِنْ أَذِنَا لَكَ فَجَاهِدْ وَإِلاَّ فَبِرَّهُمَا.


‘‘একব্যক্তি ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট হিজরত করে আসে। তিনি তাকে বলেন: ইয়ামানে তোমার কেউ কি আছেন? লোকটি বলে: আমার পিতামাতা আছেন। তিনি বলেন: তারা কি তোমাকে অনুমতি দিয়েছেন? লোকটি বলে: না। তিনি বলেন: তুমি তাদের কাছে ফিরে যেয়ে অনুমতি চাও। যদি তারা অনুমতি দেন তবে জিহাদ করবে। তা নাহলে তুমি তাদের খিদমত করবে।’’[11]

এ সকল হাদীস প্রমাণ করে যে, জিহাদ ফরয কিফায়া। ফরয আইন হলে এরূপ বলা যায় না। আমরা বলতে পারি না যে, পিতামাতা অনুমতি না দিলে সালাত, সিয়াম, যাকাত ইত্যাদি ‘ফরয আইন’ ইবাদত না করে তাদের খিদমত করতে হবে।

এজন্য আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের ফকীহগণ একমত যে, জিহাদ ফরয কিফায়া বা সামষ্টিক ফরয, কিছু মুসলিম তা পালন করলে অন্যদের ফরয আদায় হয়ে যায়। তবে যারা পালন করবেন তারাই শুধু সাওয়াব লাভ করবেন, অন্যরা গোনাহ থেকে মুক্ত হবেন। তবে শত্রুবাহিনী যদি দেশ দখল করে নেয় অথবা রাষ্ট্রপ্রধান সকল নাগরিককে যুদ্ধে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেন তবে এ অবস্থায় জিহাদ ফরয আইনে পরিণত হয়। আল্লামা কুরতুবী বলেন:


الذي استقر عليه الإجماع أن الجهاد على كل أمة محمد صلى الله عليه وسلم فرض كفاية فإذا قام به من قام من المسلمين سقط عن الباقين، إلا أن ينزل العدو بساحة الإسلام فهو حينئذ فرض عين


‘‘যে বিষয়ে ইজমা বা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হলো, উম্মাতে মুহাম্মাদীর সকলের উপর জিহাদ ফরয কিফায়া। যখন কিছু মানুষ তা পালন করবে তখন অন্য সকলের দায়িত্ব অপসারিত হবে। তবে যখন শত্রুগণ ইসলামী রাষ্ট্রে অবতরণ করে (দখল করে নেয়) তখন তা ফরয আইন হয়ে যায়।’’[12]

[1] সূরা (৪) নিসা: ৭১ আয়াত।

[2] সূরা (২) বাকারা: ১৮৩ আয়াত।

[3] সূরা (২) বাকারা: ২১৬ আয়াত।

[4] সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৭৮ আয়াত।

[5] সূরা (৪) নিসা: ৯৫ আয়াত।

[6] সূরা (৯) তাওবা: ৩৮-৩৯ আয়াত।

[7] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৭০০।

[8] মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৫০৩।

[9] সূরা (৯) তাওবা: আয়াত ১২২।

[10] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৯৪; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৭৫।

[11] আবূ দাউদ, আস-সুনান (১৫-কিতাবুল জিহাদ, ৩৩-বাবুন ফির রাজুলি ইয়াগযু ওয়া আবাওয়াহু কারহিানি); আলবানী, সহীহুত তারগীব ২/৩২৭। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ লি-গাইরিহী বলেছেন।

[12] কুরতুবী, মুহাম্মাদ ইবনু আহমদ (৬৭১ হি), আল-জামি লি আহকামিল কুরআন ৩/৩৮।
১০. ৫. ৫. জিহাদ পালনের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান পূর্বশর্ত

আমরা দেখেছি যে, ইমাম আবূ হানীফার আকীদা বর্ণনা প্রসঙ্গে ইমাম তাহাবী বলেছেন: ‘‘মুসলিম শাসকের অধীনে- সে নেককার হোক আর পাপী-বদকার হোক- হজ্জ্ব এবং জিহাদ কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কোনো কিছুই এ দুটোকে বাতিল বা ব্যাহত করতে পারে না।’’ এ থেকে আমরা দেখছি যে, জিহাদ পালনের জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের বিদ্যমানতা, অনুমোদন ও নেতৃত্ব পূর্বশত। এটি খারিজীগণের সাথে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মৌলিক পার্থক্য। জিহাদকে ফরয আইন গণ্য করার কারণে খারিজীগণ বলেন যে, এর জন্য নির্দিষ্ট কারো অনুমতি বা নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই। কয়েকজন মানুষ একত্রে কাউকে নেতা বানিয়ে জিহাদ করতে পারেন। এখানেও তারা কুরআন-হাদীসের সাধারণ বক্তব্য, উৎসাহ ও নির্দেশকে প্রমাণ হিসেবে পেশ করেন। আহলূস সুন্নাত যে সকল দলীল পেশ করেছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:

(১) আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


إِنَّمَا الإِمَامُ جُنَّةٌ يُقَاتَلُ مِنْ وَرَائِهِ


‘‘রাষ্টপ্রধান ঢাল, যাকে সামনে রেখে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।’’[1]

আমরা দেখেছি যে, হাদীস, ফিকহ ও আকীদার পরিভাষায় ‘ইমাম’ শব্দটি শুধু রাষ্ট্রপ্রধান অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এভাবে আমরা এ হাদীস থেকে কিতাল বা জিহাদের জন্য তিনটি শর্তের কথা জানতে পারছি: (১) রাষ্ট্রের বিদ্যমানতা, (২) রাষ্ট্রপ্রধানের বিদ্যমানতা এবং (৩) রাষ্ট্রপ্রধানের নেতৃত্ব। কুরআন ও হাদীসের সামগ্রিক নির্দেশনা বিষয়টি নিশ্চিত করে। এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

(ক) মুসলিমগণ যতদিন অমুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজের অংশ হিসেবে বসবাস করেছেন ততদিন আল্লাহ জিহাদের অনুমতি দেন নি। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যখন মুসলিমগণ পৃথক রাষ্ট্রীয় সত্তায় পরিণত হন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন আল্লাহ জিহাদের অনুমতি প্রদান করেন। আল্লাহ বলেন:


أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا


‘‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে।’’[2]

(খ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে মুসলিমগণ কোনো যুদ্ধ পরিচালনা করেননি।

(গ) যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতির গুরুত্ব জানা যায় আবূ বাসীর (রা)-এর ঘটনা থেকে। হুদায়বিয়ার সন্ধির একটি চুক্তি ছিল মক্কা থেকে পলাতক মুসলিমদেরকে কাফিরদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে হুদাইবিয়ার ময়দানেই আবূ জানদাল (রা) নামক একজন নির্যাতিত মুসলিম শৃঙ্খলিত অবস্থায় মক্কা থেকে পালিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর নিকট এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শর্ত মোতাবেক তাঁকে মক্কাবাসীদের হাতে সমর্পন করেন। উপস্থিত সাহাবীগণ এ বিষয়ে খুবই আবেগী হয়ে উঠেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। এরপর আরেক নির্যাতিত মুসলিম আবূ বাসীর (রা) মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকেও ফিরিয়ে দেন। এক পর্যায়ে আবূ বাসীর (রা), আবূ জানদাল (রা) ও আরো অনেক নির্যাতিত মুসলিম মক্কা থেকে পালিয়ে সিরিয়ার পথে ‘ঈস’ নামক স্থানে সমবেত হন। মদীনা রাষ্ট্রের সাথে মক্কাবাসীদের সন্ধি থাকলেও এ নতুন জনগোষ্ঠীর সাথে তাদের সন্ধি ছিল না; বরং তাদের মধ্যে পরিপূর্ণ যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। এ অবস্থায় তাঁরা সিরিয়াগামী কুরাইশ কাফিলাগুলোর উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন। মক্কাবাসীরা বুঝতে পারে যে, এদেরকে মদীনা রাষ্ট্রের নাগরিক মেনে সন্ধিচুক্তির অন্তর্ভুক্ত করাই তাদের জন্য নিরাপদ। তাদেরই অনুরোধে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সন্ধিচুক্তির সংশ্লিষ্ট শর্তটি বাতিল করে তাঁদেরকে মদীনায় বসবাসের ব্যবস্থা করেন।[3]

এভাবে মদীনা রাষ্ট্রে বসবাসরত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ বাসীর ও তাঁর সাথীদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেন নি। এজন্য তাঁরা মদীনা রাষ্ট্রের বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য হন। এ থেকে আমরা দেখি যে, কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসকারীর জন্য সন্ধি, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্ত মান্য করা ফরয।

(২) কুরআন ও হাদীসে বারংবার ‘উলুল আমর’ বা শাসকদের আনুগত্য করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[4] আর জিহাদ আনুগত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে আনুগত্যহীনতা মুসলিম জনপদকে গৃহযুদ্ধ বা পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত করতে পারে। যদি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও আনুগত্যের বাইরে জিহাদ করার সুযোগ থাকে তবে নাগরিকগণ একে অপরের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করবেন। কখনো একে অপরকে কাফির বলে, কখনো অন্যায়ের প্রতিবাদের নামে পরস্পরে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এজন্য প্রসি্দ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস হাফিয ইবন হাজার আসকালানী বলেন:


لأنه يمنع العدو من أذى المسلمين ويكف أذى بعضهم عن بعض


‘‘রাষ্ট্রপ্রধানকে ঢাল বলা হয়েছে তার কারণ তিনি মুসলিমদেরকে শত্রুর ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন এবং মুসলিমদেরকে পারস্পরিক ক্ষতি থেকেও রক্ষা করেন।’’[5]

(৩) জিহাদের উদ্দেশ্য শুধু প্রাণহানি নয়, বরং জিহাদের উদ্দেশ্য যথাসাধ্য কম প্রাণহানির মাধ্যমে সর্বোচ্চ বিজয় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা। শত্রুর শক্তি ও দুর্বলতা বিষয়ক তথ্যাদি রাষ্ট্র প্রধান যেভাবে সংগ্রহ করতে পারেন অন্য কেউ তা পারে না। ফলে তার তত্ত্বাবধানে জিহাদ কাঙ্ক্ষিত বিজয় ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এজন্য প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল আরাবী (৫৪৩ হি) বলেন:


أَمَرَ اللَّهُ سُبْحَانَهُ النَّاسَ بِالْجِهَادِ سَرَايَا مُتَفَرِّقَةً أَوْ مُجْتَمَعِينَ عَلَى الْأَمِيرِ، فَإِنْ خَرَجَتْ السَّرَايَا فَلَا تَخْرُجُ إلَّا بِإِذْنِ الْإِمَامِ؛ لِيَكُونَ مُتَحَسِّسًا إلَيْهِمْ وَعَضُدًا مِنْ وَرَائِهِمْ ، وَرُبَّمَا احْتَاجُوا إلَى دَرْئِهِ .


‘‘(হে ঈমানদারগণ, তোমরা তোমাদের সতর্কতা গ্রহণ কর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে যাও অথবা একযোগে বেরিয়ে যাও[6] আয়াতে) মহান আল্লাহ মানুষদেরকে বিভিন্ন বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে অথবা আমীরের (শাসকের) নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে জিহাদে বের হওয়ার নির্দেশ দিলেন। বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে জিহাদে গমন করলে আমীরের (শাসকের) অনুমতি ছাড়া বের হবে না। কারণ শাসক মুজাহিদদের খোঁজখবর রাখবেন এবং তাদেরকে পিছন থেকে সহায়তা করবেন। মুজাহিদগণ অনেক সময় শাসকের প্রতিরক্ষার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।’’[7]

ইমাম কুরতুবী (৬৭১ হি) একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন:


ولا تخرج السرايا إلا بإذن الإمام ليكون متجسسا لهم، عضدا من ورائهم، وربما احتاجوا إلى درئه.


‘‘রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো বাহিনী যুদ্ধে বের হবে না। কারণ শাসক মুজাহিদদের খোঁজখবর রাখবেন এবং তাদেরকে পিছন থেকে সহায়তা করবেন। মুজাহিদগণ অনেক সময় শাসকের প্রতিরক্ষার মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েন।’’[8]

প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ইবন কুদামা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ (৬২০ হি) বলেন:


وأمر الجهاد موكول إلى الإمام واجتهاده ويلزم الرعية طاعته فيما يراه من ذلك


‘‘জিহাদের বিষয়টি ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে অর্পিত এবং তার ইজতিহাদের উপর নির্ভরশীল। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপ্রধান যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে তার আনুগত্য করা জনগণের জন্য জরুরী।’’[9]

ইবন কুদামা আকীদা বিষয়ক ‘‘লুমআতুল ই’তিকাদ’ নামক গ্রন্থে বলেন:


ونرى الحج والجهاد ماضياً مع طاعة كل إمام براً كان أو فاجراً، وصلاة الجمعة خلفهم جائزة


‘‘হজ্জ ও জিহাদ চালু থাকবে প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্যের সাথে; রাষ্ট্রপ্রধান নেককার হোক আর পাপাচারী হোক। তাদের পিছনে জুমুআর সালাত বৈধ।’’[10]

এভাবে আমরা দেখছি যে, জিহাদের ঘোষণা, শুরু ও পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধানের। কোনো মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান যদি প্রয়োজনের সময় জিহাদ বর্জন করেন তবে তিনি এ পাপের দায়ভার বহন করবেন। নাগরিকদের দায়িত্ব সরকারকে তার দায়িত্ব পালনের দাওয়াত দেওয়া, দায়িত্বহীনতার প্রতিবাদ করা। কিন্তু কোনো অবস্থায় নাগরিকগণ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে জিহাদ ঘোষণা বা পরিচালনা করতে পারেন না।

ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক জিহাদ ঘোষণা ও শুরু করার পরে যুদ্ধরত শত্রু রাষ্টের উপর আক্রমণ করার ক্ষেত্রেও অধিকাংশ ফকীহ ইমামের অনুমতি শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে কোনো রাষ্ট্র বা জনপদে শত্রুসৈন্য প্রবেশ করলে বা তা দখল করলে দেশকে দখলদার মুক্ত করতে নারী-পুরুষ প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জিহাদ করা ফরয হয়ে যায়। এরূপ যুদ্ধকে জিহাদুদ দিফা (جهاد الدفاع) বা ‘প্রতিরক্ষার জিহাদ’ বলা হয়। এক্ষেত্রে নাগরিকগণ রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধ করবেন। এ সময়ে পিতামাতা বা স্বামীর অনুমতি গ্রহণেরও আবশ্যকতা থাকে না। এ প্রসঙ্গে ইবন কুদামা আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ হাম্বালী (৬২০ হি) রচিত ‘‘আল-মুকনি’ গ্রন্থের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় সমকালীন প্রসিদ্ধ সৌদী ফকীহ শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালিহ উসাইমীন বলেন:


لا يجوز غزو الجيش إلا بإذن الإمام مهما كان الأمر؛ لأن المخاطب بالغزو والجهاد هم ولاة الأمور، وليس أفراد الناس، فأفراد الناس تبع لأهل الحل والعقد، فلا يجوز لأحد أن يغزو دون إذن الإمام إلاّ على سبيل الدفاع، وإذا فاجأهم عدو يخافون كلَبه فحينئذ لهم أن يدافعوا عن أنفسهم لتعين القتال إذاً.


‘‘রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতীত কোনো বাহিনীর জন্য জিহাদ বৈধ নয়, পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন। কারণ কুরআন-হাদীসে বিদ্যমান জিহাদ-কিতাল বিষয়ক নির্দেশগুলোর দায়ভার রাষ্ট্রপ্রধানদের উপরেই, সাধারণ মানুষেরা এ আদেশগুলো দ্বারা সম্বোধিত নয়। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের অনুসরণ করবেন। কাজেই রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতীত কারো জন্য জিহাদ বা আক্রমণ বৈধ নয়। তবে প্রতিরক্ষার যুদ্ধ হলে ভিন্ন কথা। যদি শত্রুগণ কোনো জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করে এবং তারা ভয় পায় যে, রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করলে শত্রু তাদের ক্ষতি করবে তবে এক্ষেত্রে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করবেন। এরূপ ক্ষেত্রে যুদ্ধ করা নিশ্চিত হয়ে যায়।’’[11]

[1] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৮০ (কিতাবুল জিহাদ, বাবু উকাতালু মিন ওয়ারায়িল ইমাম); মুসলিম, আস-সহীহ ৩/১৪৭১ (কিতাবুল ইমারাহ, বাবুন ফিল ইমামি ইযা আমারা..)

[2] সূরা (২২) হজ্জ, আয়াত ৩৯।

[3] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৩১১-৩১২।

[4] এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলো দেখুন: ইসলামের নামে জাঙ্গিবাদ ১৭৮-১৮৮, ২২৩-২২৭।

[5] ইবন হাজার, ফাতহুল বারী ৬/১১৬।

[6] সূরা (৪) নিসা: ৭১ আয়াত।

[7] ইবনুল আরাবী, আহকামুল কুরআন ২/৪১৪।

[8] কুরতুবী, আল-জামি লি আহকামিল কুরআন ৫/২৭৫।

[9] ইবন কুদামা, আল-মুগনী ১০/৩৬৮।

[10] ইবন কুদামা, লুমআতুল ই’তিকাদ, পৃষ্ঠা ৩০।

[11] ইবন উসাইমীন, আশ-শারহুল মুমতি’ আলা যাদিল মুসতানকী ৮/২২।

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত জিহাদ সাময়িক আবেগ এবং কিছু ভাল ও খারাপ মানুষের রক্তপাত ছাড়া কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। তারপরও আবেগী মানুষেরা ভাবেন, যে কোনোভাবে কিছু খারাপ মানুষ মেরে ফেললে বোধহয় দুনিয়া ভাল হয়ে যাবে। তারা দেখেন যে, রাষ্ট্র তাদের আবেগ অনুসারে জিহাদের অনুমতি দিচ্ছে না। অথবা রাষ্ট্র নিজেই ভাল মানুষদের দমনে লিপ্ত। এক্ষেত্রে মুমিনের দায়িত্ব আল্লাহর নির্দেশমত সহনশীলতা ও মন্দের মুকাবিলায় ভাল দিয়ে দাওয়াত চালিয়ে যাওয়া এবং এভাবে জিহাদ করার মত একটি রাষ্ট্র অর্জন করা। আবেগী মানুষের এত ধৈর্য থাকে না। আল্লাহর নির্দেশমত ইবাদত পালনের চেয়ে নিজের মর্জিমত ফলাফল অর্জনে তার আগ্রহ বেশি। তিনি মনে করেন, এভাবে মানুষদেরকে আল্লাহর পথে এনে পছন্দমত সমাজ ও রাষ্ট্র অর্জন একটি অসম্ভব ব্যাপার। এজন্য তিনি বিভিন্ন অজুহাতে অনুমোদবিহীন জিহাদ বৈধ করতে চেষ্টা করেন। এরূপ একটি অজুহাত কতল বা হত্যার বিধান।

ইসলামে হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হত্যাকারীকে শাস্তি দেন নি। কয়েকজন সাহাবী বর্ণিত মুতাওয়াতির পর্যায়ের হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, কারো জীবন, সম্পদ, পরিবার বা সম্ভ্রম আক্রান্ত হলে সে তা রক্ষার জন্য লড়তে পারবে। এজন্য তাৎক্ষনিক কারো অনুমতির প্রয়োজন তো নেইই, উপরন্তু এক্ষেত্রে সে নিহত হলে শহীদ বলে গণ্য হবে এবং আক্রমণকারী ডাকাত, লুটেরা বা সন্ত্রাসী নিহত হলে বিচারে হত্যাকারী শাস্তি থেকে রেহাই পাবে। এ অর্থের এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রা) বলেন: ‘‘একব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট এসে বলে: হে আল্লাহর রাসূল, যদি কেউ আমার কাছে এসে আমার সম্পদ কেড়ে নিতে চায় তবে আপনার মত কী? তিনি বলেন: তুমি তাকে তোমার সম্পদ দিবে না। লোকটি বলে: যদি সে আমার সাথে লড়াই করে? তিনি বলেন: তাহলে তুমিও তার সাথে লড়বে। লোকটি বলে: যদি সে আমাকে হত্যা করে? তিনি বলেন: তাহলে তুমি শহীদ হবে। লোকটি বলে: আর আমি যদি তাকে হত্যা করি? তিনি বলেন: সেক্ষেত্রে সে জাহান্নামী হবে।’’[1]

এ অর্থের হাদীসগুলোর ভিত্তিতে ফকীহগণ নিশ্চিত করেছেন এরূপ ক্ষেত্রে নিহত ডাকাত বা সন্ত্রাসীর রক্ত ‘বাতিল’; অর্থাৎ হত্যাকারী শাস্তি পাবে না।

অন্য একটি হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) বলেন: ‘‘এক অন্ধ ব্যক্তির একটি দাসী স্ত্রী ছিল। সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে গালিগালাজ করত। লোকটি তাকে নিষেধ করত, কিন্তু মহিলা কিছুতেই নিবৃত হতো না। লোকটি তাকে ভয় দেখাত কিন্তু তাতে সে ভীত হতো না। এক রাতে মহিলা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে গালিগালাজ ও ঘৃণ্য কথা বলতে শুরু করে। তখন অন্ধ লোকটি একটি ছুরি নিয়ে মহিলার পেটের উপর রাখে ও নিজের দেহ দিয়ে চেপে ধরে। এভাবে সে মহিলাকে হত্যা করে।... সকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে খুনের ঘটনা বলা হলে তিনি মানুষদেরকে সমবেত করে বলেন: আমি আল্লাহর নামে দাবি করছি, যে ব্যক্তি এ কাজ করেছে তার উপর যদি আমার কোনো অধিকার থেকে থাকে তবে সে যেন উঠে দাঁড়ায়। তখন উক্ত অন্ধ ব্যক্তি উঠে মানুষের ভিতর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে সামনে এগিয়ে আসে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সামনে বসে। সে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, আমিই তার হত্যাকারী। সে আপনাকে গালি দিত ও আপনার বিষয়ে ঘৃণ্য মন্তব্য করত। আমি তাকে নিষেধ করলেও নিবৃত হতো না এবং ধমক দিলেও ভয় পেত না। সে আমার জন্য মুক্তোর মত দুটি সন্তানন্ম দিয়েছে। সে আমার সাথে সদয় ও প্রেমময় আচরণ করত। গতরাতে সে যখন আপনাকে গালি দিতে ও নোংরা কথা বলতে শুরু করে তখন আমি ছুরি নিয়ে তার পেটের উপর রাখি এবং নিজের দেহ দিয়ে চেপে ধরি। এভাবে আমি তাকে হত্যা করি। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:


أَلاَ اشْهَدُوا أَنَّ دَمَهَا هَدَرٌ.


‘‘তোমরা সাক্ষী থাক যে, এ মহিলার রক্ত বাতিল।’’[2]

খারিজীগণ এ সকল হাদীস দিয়ে দাবি করেন যে, অন্ধ ব্যক্তি বা আক্রান্ত ব্যক্তি তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুমতি ছাড়াই কাফির বা পাপীকে হত্যা করল এবং কোনো শাস্তি পেল না। এতে প্রমাণ হলো যে, রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ছাড়াও জিহাদ করা যায়!!

আবেগের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত হলে তারা বুঝতেন যে, কতল বা হত্যার হাদীসের সাথে কিতাল বা জিহাদের বিধানের সামান্যতম সম্পর্ক নেই। এ হাদীসগুলো আরো প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় বিচার ও অনুমোদনের বাইরে কেউ কাউকে হত্যা করলে তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। তবে যদি বিচারের কাঠগড়ায় প্রমাণ হয় যে, সে আক্রান্ত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করেছে, অথবা নিহত ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে গালিগালাজ করছিল এবং তাকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তা থেকে বিরত হয় নি তবে সেক্ষেত্রে ইসলামী আইনে নিহত ব্যক্তির রক্ত বাতিল এবং হত্যাকারীর শাস্তি রহিত হবে।

ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের নামে দল-গোষ্ঠী পরিচালিত জিহাদের ক্ষতির বিষয়ে ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’-এ ইমাম আবূ হানীফার বক্তব্য নিম্নরূপ:


قُلْتُ فَمَا تَقُوْلُ فِيْمَنْ يَأْمُرُ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَى عَنِ الْمُنْكَرِ فَيَتَّبِعُهُ عَلَى ذَلِكَ نَاسٌ فَيَخْرُجُ عَلَى الْجَمَاعَةِ، هَلْ تَرَى ذَلِكَ؟ قَالَ: لاَ. قُلْتُ: وَلِمَ؟ وَقَدْ أَمَرَ اللهُ تَعَالَى وَرَسُوْلُهُ بِالأَمْرِ بِالْمَعْرُوْفِ وَالنَّهْيِ عَنِ الْمُنْكَرِ وَهَذَا فَرِيْضَةٌ وَاجِبَةٌ. فَقَالَ: هُوَ كَذَلِكَ، لَكِنْ مَا يُفْسِدُوْنَ مِنْ ذَلِكَ أَكْثَرُ مِمَّا يُصْلِحُوْنَ مِنْ سَفْكِ الدِّمَاءِ وَاسْتِحْلاَلِ الْمَحَارِمِ وَانْتِهَابِ الأَمْوَالِ، وَقَدْ قَالَ اللهُ تَعَالَى (وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ اقْتَتَلُوْا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِيْ تَبْغِيْ حَتَّى تَفِيْءَ إِلَى أَمْرِ اللهِ) قُلْتُ فَنُقَاتِلُ الْفِئَةَ الْبَاغِيَةَ بِالسَّيْفِ؟ قَالَ نَعَمْ تَأْمُرُ وَتَنْهَي فَإِنْ قَبِلَ وَإِلاَّ قَاتَلْتَهُ فَتَكُوْنُ مَعَ الْفِئَةِ الْعَادِلَةِ وَإِنْ كَانَ الإِمَامُ جَائِرًا لِقَوْلِ النَّبِيِّ عَلَيْهِ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ ( لاَ يَضُرُّكُمْ جَوْرُ مَنْ جَارَ وَلاَ عَدْلُ مَنْ عَدَلَ، لَكُمْ أَجْرُكُمْ وَعَلَيْهِ وِزْرُهُ )... فَقَاتِلْ أَهْلَ الْبَغْيِ بِالْبَغْيِ لاَ بِالْكُفْرِ وَكُنْ مَعَ الْفِئَةِ الْعَادِلَةِ وَالسُّلْطَانِ الْجَائِرِ، وَلاَ تَكُنْ مَعَ أَهْلِ الْبَغْيِ...


‘‘আমি (আবূ মুতী) বললাম, কোনো মানুষ ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে থাকেন। তখন কিছু মানুষ তার অনুগামী হয়। তখন তারা জামা‘আতের (রাষ্ট্র ও সমাজের) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এদের বিষয়ে আপনি কি বলেন? আপনি কি এরূপ কর্মের স্বীকৃতি দেন? ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘‘না’’। আমি বললাম, কেন? মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) তো ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর এতো একটি জরুরী ফরয। তিনি বলেন: তা ঠিক; তবে তারা এভাবে ন্যায়ের চেয়ে অন্যায়-ফাসাদ বেশি করে; কারণ তারা রক্তপাত করে, মানুষের ধন-সম্পদ ও সম্ভ্রম নষ্ট করার কঠিন হারামে নিপতিত হয়, ধনসম্পদ লুটপাট করে। মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘মু’মিনদের দু‘দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করবে; আর তাদের একদল অন্য দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে যারা বিদ্রোহ করে তাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে...।’’ আমি বললাম: তাহলে কি আমি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করব? তিনি বলেন: হ্যাঁ। তুমি আদেশ ও নিষেধ করবে। যদি গ্রহণ করে তবে ভাল। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তাহলে তুমি ন্যায়পন্থী দলের (রাষ্ট্র ও সমাজের) সাথে থাকবে, যদিও রাষ্ট্রপ্রধান জালিম হয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন: জালিমের জুলম ও ন্যায়পরায়ণের ইনসাফ কোনোটিই তোমাদের ক্ষতি করবে না। তোমরা তোমাদের পুরস্কার লাভ করবে এবং তারা তাদের শাস্তি পাবে।... কাজেই তুমি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে বিদ্রোহের কারণে, কাফির হওয়ার কারণে নয়। আর ন্যায়পন্থী জনগোষ্ঠী (মূল সমাজ) ও জালিম শাসকের সাথে থাকবে, কিন্তু বিদ্রোহীদের সাথে থাকবে না।’’[3]

এখানে ইমাম আবূ হানীফা রাষ্ট্রপ্রধান জালিম বা পাপী হলেও রাষ্ট্র ও সমাজের পক্ষে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি অন্যায়ের প্রতিবাদের নামে অনিয়ন্ত্রিত জিহাদের ক্ষতির দিকটি তুলে ধরেছেন। এখানে তিনি সাহাবীগণের ধারা অনুসরণ করেছেন। সাহাবীগণও এরূপ অনিয়ন্ত্রিত জিহাদের ক্ষতিকর দিক আলোচনা করেছেন।

৭৩ হিজরীতে হাজ্জাজ ইবনু ইউসূফ মক্কা অবরোধ করে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রা)-এর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালাতে থাকেন। তৎকালীন যুবকদের অনেকেই ভাবতে থাকে যে, হাজ্জাজের বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে এবং মুসলিম বিশ্ব চিরতরে কাফির-ফাসিক ও জালিমদের পদানত হয়ে যাবে। অনেক যুবকই প্রবল আবেগে আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর (রা)-এর পক্ষে জিহাদে যোগ দিতে থাকেন। এ সময়ে দু ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা)-এর নিকট এসে বলেন:


إِنَّ النَّاسَ ضُيِّعُوا، وَأَنْتَ ابْنُ عُمَرَ وَصَاحِبُ النَّبِيِّ ﷺ فَمَا يَمْنَعُكَ أَنْ تَخْرُجَ فَقَالَ يَمْنَعُنِي أَنَّ اللَّهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِي، وفي رواية: مَا حَمَلَكَ عَلَى أَنْ تَحُجَّ عَامًا وَتَعْتَمِرَ عَامًا وَتَتْرُكَ الْجِهَادَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَقَدْ عَلِمْتَ مَا رَغَّبَ اللَّهُ فِيهِ قَالَ يَا ابْنَ أَخِي بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ إِيمَانٍ بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالصَّلاةِ الْخَمْسِ وَصِيَامِ رَمَضَانَ وَأَدَاءِ الزَّكَاةِ وَحَجِّ الْبَيْتِ وفي لفظ: فَقَالا أَلَمْ يَقُلِ اللَّهُ (وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ) فَقَالَ قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ وَكَانَ الدِّينُ لِلَّهِ وَأَنْتُمْ تُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا حَتَّى تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِغَيْرِ اللَّهِ


‘‘মানুষেরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আপনি ইবনু উমার, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাহাবী, আপনাকে বেরিয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধা দিচ্ছে কিসে? তিনি বলেন, ‘‘আল্লাহ আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন, তাই আমি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছি না।’’ অন্য বর্ণনায় তারা বলেন: ‘‘কি কারণে আপনি এক বছর হজ্জ করেন আরেক বছর উমরা করেন এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করেন? অথচ আপনি জানেন যে, আল্লাহ জিহাদের জন্য কী পরিমাণ উৎসাহ দিয়েছেন?’’ তখন তিনি বলেন, ‘‘ভাতিজা, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচটি বিষয়ের উপর: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (ﷺ) উপর বিশ্বাস স্থাপন করা, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রামাযানের সিয়াম, যাকাত প্রদান ও বাইতুল্লাহর হজ্জ।’’[4] অন্য হাদীসে: ‘‘তারা বলে, আল্লাহ কি বলেন নি, ‘এবং তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয়’? তখন তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, ফিতনা দূরীভূত হয়েছিল এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তোমরা চাচ্ছ যে, তোমরা যুদ্ধ করবে যেন ফিতনা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দীন আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য হয়।’’[5]

এক খারিজী নেতা ইবন উমার (রা)-কে জিহাদ ছেড়ে হজ্জ-উমরা নিয়ে মেতে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করে। তিনি তাকে আরকানুল ইসলামের কথা বললে সে বলে:


يَا أَبَا عَبْدِالرَّحْمَنِ أَلا تَسْمَعُ مَا ذَكَرَ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ (وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ) (قَاتِلُوهُمْ حَتَّى لا تَكُونَ فِتْنَةٌ) قَالَ فَعَلْنَا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى ﷺ وَكَانَ الإِسْلامُ قَلِيلا فَكَانَ الرَّجُلُ يُفْتَنُ فِي دِينِهِ إِمَّا قَتَلُوهُ وَإِمَّا يُعَذِّبُونَهُ حَتَّى كَثُرَ الإِسْلامُ فَلَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ


‘‘হে আবূ আব্দুর রাহমান, আল্লাহ তাঁর কিতাবে কী বলেছেন তা কি আপনি শুনছেন না? তিনি বলেছেন: ‘মুমিনগণের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর সীমলঙ্ঘন করলে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে।’ (তিনি আরো বলেছেন): ‘এবং তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যতক্ষণ ফিতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয়’[6]। তখন ইবনু উমার বলেন, আমরা তো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে তা করেছিলাম। ইসলাম দুর্বল ও স্বল্প ছিল, ফলে মুসলিম ব্যক্তি তার দীনের কারণে ফিতনাগ্রস্থ হতেন। কাফিররা তাকে হত্যা করত অথবা তার উপর অত্যাচার করত। যখন ইসলাম বিস্তৃত হয়ে গেল তখন তো আর ফিতনা থাকল না।’’[7]

জুনদুব ইবনু আব্দুল্লাহ বাজালী (রা) কয়েকজন খারিজী মুজাহিদকে ডেকে একত্রিত করে তাদেরকে ঈমানের দাবিদারকে হত্যা করার বিষয়ে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কাফিরদের বিরুদ্ধে একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। যুদ্ধের মাঠে একজন কাফির সৈনিক মুসলিম বাহিনীর অনেক সৈনিককে হত্যা করে। এক পর্যায়ে উসামা ইবনু যাইদ (রা) উক্ত কাফির সৈনিককে আক্রমণ করেন। তিনি যখন তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন তখন সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে। উসামা সে অবস্থাতেই তাকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উসামাকে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলার পরেও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? তিনি বলেন, লোকটি অনেক মুসলিমকে হত্যা করে। আমি যখন তরবারী উঠালাম সে তরবারীর ভয়ে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলেছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, তুমি তার হৃদয় চিরে দেখে নিলে না কেন, সে ভয়ে বলেছে না স্বেচ্ছায় বলেছে! ... তিনি বারবারই বলতে লাগলেন, কেয়ামতের দিন যখন এ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ উপস্থিত হবে তখন তুমি কী করবে?[8]

সাহাবীগণের এ সকল বক্তব্যের মধ্যে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষণীয়:

(১) আরকানে ইসলাম ও এ জাতীয় ইবাদতই মুমিনের মূল দায়িত্ব। এগুলো ‘উদ্দিষ্ট’ ইবাদত (ইবাদতে মাকসূদা)। এগুলো পালন করাই মুমিন জীবনের উদ্দেশ্য। এগুলি পালনের গুরুত্ব কখনোই কমে না বা থামে না। পক্ষান্তরে ‘জিহাদ’ উদ্দিষ্ট ইবাদত (ইবাদতে মাকসূদা) নয়; বরং উদ্দিষ্ট ইবাদত পালনের অধিকার রক্ষার জন্যই জিহাদ। এ অধিকার বিদ্যমান থাকলে জিহাদের আবশ্যকতা থাকে না।

(২) জিহাদ করা আল্লাহর নির্দেশ এবং মানুষ হত্যা করা আল্লাহর নিষেধ। নিষেধের পাল্লাকে ভারী রাখতে হবে এবং হারামে নিপতিত হওয়ার ভয় থাকলে জিহাদ পরিত্যাগ করতে হবে।

(৩) কাফির রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র, নাগরিক ও দীনী দাওয়াতের স্বাধীনতা ও বিজয় সংরক্ষণই মূলত জিহাদ। মুসলিম ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা হত্যা জিহাদ নয়। যে ব্যক্তি নিজেকে মুমিন বলে দাবি করে বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ মুখে স্বীকার করে তাকে জিহাদের নামে হত্যা করা পারলৌকিক ধ্বংসের অন্যতম কারণ।

(৪) ফিতনা দূরীকরণ জিহাদের উদ্দেশ্য। তবে ফিতনা দূরীকরণ বলতে সমাজের সকল অন্যায়, অনাচার, কুফর, শিরক ইত্যাদি দূর করা নয়, বরং মুমিনকে জোরপূর্বক কুফরে লিপ্ত হওয়ার পরিস্থিতি দূরীকরণ বা দীনপালন ও দীনী দাওয়াতের স্বাধীনতা রক্ষা করা। এরূপ পরিস্থিতি ছাড়া জিহাদ মূলত ফিতনা দূর করে না, বরং ফিতনা সৃষ্টি করে। কারণ সকল সমাজেই অন্যায় ও জুলুম থাকে এবং সর্বদা ধর্মহীন ও পাপাচারীর সংখ্যা ও শক্তি ধার্মিক ও সৎ মানুষদের চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়। যদি ধার্মিক মানুষেরা শান্তিপূর্ণ ও ধৈর্যপূর্ণ দাওয়াত, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ না করে জিহাদ বা সশস্ত্র শাক্তি প্রয়োগ করেন তবে তা বহু মহাপাপ, হত্যা ও ফিতনার দরজা উন্মুক্ত করে। ইমাম মাহদী প্রসঙ্গে আমরা দেখব যে, দ্রুত অন্যায় দূর করে ‘আদর্শ সমাজ’ প্রতিষ্ঠার আবেগী চেষ্টা রক্তপাত ও বিভ্রান্তি ছাড়া কোনো ফল দেয় নি।

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ১/১২৪, নং ১৪০।

[2] আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/১২৭ (কিতাবুল হুদূদ, হুকম ফীমান সাববা..)

[3] ইমাম আবূ হানীফা, আল-ফিকহুল আবসাত, পৃ. ৪৫, ৫২।

[4]বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৮৪, ৩১০।

[5] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৮৪, ৩১০।

[6] সূরা (২) বাকারা, ১৯৩ আয়াত।

[7]বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৮৪, ৩১০।

[8] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৯৬-৯৭; নাবাবী, শারহু সাহীহি মুসলিম ২/১০১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১২/১৯৬, ২০১।
মুরজিয়া মতবাদ, নেক আমল, মুজিযা-কারামত, আখিরাত, ঈমান-ইসলাম ও অন্যান্য প্রসঙ্গে ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) যা বলেন

ইমাম আ’যম আবূ হানীফা নু’মান ইবন সাবিত (রাহ) বলেন:


وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّ الْمُؤْمِنَ لاَ يَضُرُّهُ الذُّنُوْبُ، وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّهُ لاَ يَدْخُلُ النَّارَ، وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّهُ يَخْلُدُ فِيْهَا، وَإِنْ كَانَ فَاسِقاً بَعْدَ أَنْ يَخْرُجَ مِنَ الدُّنْيَا مُؤْمِناً. وَلاَ نَقُوْلُ: إِنَّ حَسَنَاتِنَا مَقْبُوْلَةٌ وَسَيِّئَاتِنَا مَغْفُوْرَةٌ كَقَوْلِ الْمُرْجِئَةِ. وَلَكِنْ نَقُوْلُ: الْمَسْأَلَةُ مُبَيَّنَةٌ مُفَصَّلَةٌ: مَنْ عَمِلَ حَسَنَةً بِجَمِيْعِ شَرَائِطِهَا خَالِيَةً عَنِ الْعُيُوْبِ الْمُفْسِدَةِ وَالْمَعَانِيْ الْمُبْطِلَةِ وَلَمْ يُبْطِلْهَا بِالْكُفْرِ وَالرِّدَّةِ وَالأَخْلاَقِ السَّيِّئَةِ حَتَّى خَرَجَ مِنَ الدُّنْيَا مُؤْمِناً فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى لاَ يُضَيِّعُهَا بَلْ يَقْبَلُهَا مِنْهُ وَيُثِيْبُهُ عَلَيْهَا . وَمَا كَانَ مِنَ السَّيِّئَةِ دُوْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ وَلَمْ يَتُبْ عَنْهَا صَاحِبُهَا حَتَّى مَاتَ مُؤْمِناً فَإِنَّهُ فِيْ مَشِيْئَةِ اللهِ تَعَالَى بِقَوْلِهِ إِنْ شَاءَ عَذَّبَهُ بِالنَّارِ، وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ وَلَمْ يُعَذِّبْهُ بِالنَّارِ أَصْلاً. وَالرِّيَاءُ إِذَا وَقَعَ فِيْ عَمَلٍ مِنَ الأَعْمَالِ فَإِنَّهُ يُبْطِلُ أَجْرَهُ، وَكَذَلِكَ الْعُجْبُ.


وَالآيَاتُ ثَابِتَةٌ لِلأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلاَةُ وَالسَّلاَمُ، وَالْكَرَامَاتُ لِلأَوْلِيَاءِ حَقٌّ. وَأَمَّا الَّتِيْ تَكُوْنُ ِلأَعْدَائِهِ مِثْلِ إِبْلِيْسَ وَفِرْعَوْنَ وَالدَّجَّالِ مِِمَّا رُوِيَ فِيْ الأَخْبَارِ أَنَّهُ كَانَ وَيَكُوْنُ لَهُمْ لاَ نُسَمِّيْهَا آَيَاتٍ وَلاَ كَرَامَاتٍ، وَلكِنْ نُسَمِّيْهَا قَضَاءَ حَاجَاتٍ لَهُمْ، وَذَلِكَ ِلأَنَّ اللهَ تَعَالَى يَقْضِيْ حَاجَاتِ أَعْدَائِهِ اسْتِدْرَاجاً لَهُمْ وَعُقُوْبَةً لَهُمْ فَيَغْتَرُّوْنَ بِهِ وَيَزْدَادُوْنَ طُغْيَاناً وَكُفْراً، وَذَلِكَ كُلُّهُ جَائِزٌ وَمُمْكِنٌ. وَكَانَ اللهُ تَعَالَي خَالِقاً قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ، وَرَازِقاً قَبْلَ أَنْ يَرْزُقَ.


وَاللهُ تَعَالَي يُرَي فِيْ الآخِرَةِ، وَيَرَاهُ الْمُؤْمِنُوْنَ وَهُمْ فِيْ الْجَنَّةِ بِأَعْيُنِ رُؤُوْسِهِمْ بِلاَ تَشْبِيْهٍ وَلاَ كَيْفِيَّةٍ وَلاَ يَكُوْنَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ خَلْقِهِ مَسَافَةٌ.


وَالإِيْمَانُ هُوَ الإِقْرَارُ وَالتَّصْدِيْقُ، وَإِيْمَانُ أَهْلِ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ لاَ يَزِيْدُ وَلاَ يَنْقُصُ مِنْ جِهَةِ الْمُؤْمَنِ بِهِ، وَيَزِيْدُ وَيَنْقُصُ مِنْ جِهَةِ الْيَقِيْنِ وَالتَّصْدِيْقِ. وَالْمُؤْمِنُوْنَ مُسْتَوُوْنَ فِيْ الإِيْمَانِ وَالتَّوْحِيْدِ مُتَفَاضِلُوْنَ بِالأَعْمَالِ. وَالإِسْلاَمُ هُوَ التَّسْلِيْمُ وَالاِنْقِيَادُ ِلأَوَامِرِ اللهِ تَعَالَي. فَمِنْ طَرِيْقِ اللُّغَةِ فَرْقٌ بَيْنَ الإِيْمَانِ وَالإِسْلاَمِ. وَلَكِنْ لاَ يَكُوْنُ إِيْمَانٌ بِلاَ إِسْلاَمٍ، وَلاَ يُوْجَدُ إِسْلاَمٌ بِلاَ إِيْمَانٍ، وَهُمَا كَالظَّهْرِ مَعَ الْبَطْنِ، وَالدِّيْنُ اسْمٌ وَاقِعٌ عَلَي الإِيْمَانِ وَالإِسْلاَمِ وَالشَّرَائِعِ كُلِّهَا. نَعْرِفُ اللهَ تَعَالَي حَقَّ مَعْرِفَتِهِ كَمَا وَصَفَ اللهُ نَفْسَهُ فِيْ كِتَابِهِ بِجَمِيْعِ صِفَاتِهِ، وَلَيْسَ يَقْدِرُ أَحَدٌ أَنْ يَعْبُدَ اللهَ حَقَّ عِبَادَتِهِ كَمَا هُوَ أَهْلٌ لَهُ، وَلَكِنَّهُ يَعْبُدُهُ بِأَمْرِهِ كَمَا أَمَرَهُ بِكِتَابِهِ وَسُنَّةِ رَسُوْلِهِ ﷺ. وَيَسْتَوِيْ الْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ فِيْ الْمَعْرِفَةِ وَالْيَقِيْنِ وَالتَّوَكُّلِ وَالْمَحَبَّةِ وَالرِّضَا وَالْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ وَالإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ، وَيَتَفَاوَتُوْنَ فِيْمَا دُوْنَ الإِيْمَانِ فِيْ ذَلِكَ كُلِّهِ. وَاللهُ تَعَالَي مُتَفَضِّلٌ عَلَي عِبَادِهِ عَادِلٌ، قَدْ يُعْطِيْ مِنَ الثَّوَابِ أَضْعَافَ مَا يَسْتَوْجِبُهُ الْعَبْدُ تَفَضُّلاً مِنْهُ، وَقَدْ يُعَاقِبُ عَلَي الذَّنْبِ عَدْلاً مِنْهُ. وَقَدْ يَعْفُوْ فَضْلاً مِنْهُ.


وَشَفَاعَةُ الأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ حَقٌّ، وَشَفَاعَةُ نَبِيِّنَا ﷺ لِلْمُؤْمِنِيْنَ الْمُذْنِبِيْنَ وَلأَهْلِ الْكَبَائِرِ مِنْهُم الْمُسْتَوْجِبِيْنَ الْعِقَابَ حَقٌّ ثَابِتٌ، وَوَزْنُ الأَعْمَالِ بِالْمِيْزَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَقٌّ، وَالْوَزْنُ وَالْقِصَاصُ فِيْمَا بَيْنَ الْخُصُوْمِ بِالْحَسَنَاتِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَقٌّ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمُ الْحَسَنَاتُ فَطَرْحُ السَّيِّئَاتِ عَلَيْهِمْ حَقٌّ جَائِزٌ. وَحَوْضُ النِّبِيِّ ﷺ حَقٌّ. وَالْجَنَّةُ وَالنَّارُ مَخْلُوْقَتَانِ الْيَوْمَ لاَ تَفْنَيَانِ أَبَداً. وَلاَ تَمُوْتُ الْحُوْرُ الْعِيْنُ أَبَداً، وَلاَ يَفْنَى عِقَابُ اللهِ تَعَالَي وَثَوَابُهُ سَرْمَداً.


বঙ্গানুবাদ:

আমরা বলি না যে, পাপ মুমিনের কোনো ক্ষতি করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আমরা এও বলি না যে, মুমিন অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে। মুমিন যদি ফাসিক বা পাপী হয় কিন্তু ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করে তবে তার বিষয়ে আমরা এরূপ বলি না। আমরা বলি না যে, আমাদের নেক কর্মগুলো কবুলকৃত এবং পাপরাশি ক্ষমাকৃত। মুরজিয়াগণ এরূপ বলে। বরং আমরা বলি যে, এ বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। যে ব্যক্তি সকল শর্ত পূরণ করে এবং সকল বিনষ্টকারী ত্রুটি হতে মুক্ত থেকে কোনো নেক কর্ম করবে এবং কুফর বা ধর্মত্যাগ দ্বারা (বা অশোভন আচরণ দ্বারা)[1] তার নেককর্মটি বিনষ্ট করবে না এবং ঈমানসহ পৃথিবী ত্যাগ করবে আল্লাহ তার কর্মটি নষ্ট করবেন না, বরং তিনি তা কবুল করবেন এবং তাকে তার জন্য সাওয়াব প্রদান করবেন। কোনো মানুষ যদি শির্ক ও কুফর ছাড়া অন্য কোনো পাপ কর্ম করে তাওবা না করে ঈমানসহ মৃত্যুবরণ করে তবে তার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন থাকবে। মহান আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে জাহান্নামের মধ্যে শাস্তি দিবেন, আর ইচ্ছা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নামে কোনোরূপ শাস্তিই দিবেন না। রিয়া যদি কোনো কর্মের মধ্যে প্রবেশ করে তবে তা সে কর্মের পুরস্কার বাতিল করে দেয়। ‘উজব’ও তদ্রূপ।

নবীগণের জন্য ‘আয়াত’ প্রমাণিত। এবং ওলীগণের কারামত সত্য। আর ইবলীস, ফিরাউন, দাজ্জাল ও তাদের মত আল্লাহর দুশমনদের দ্বারা যে সকল অলৌকিক কর্ম সাধিত হয়, যে সকল অলৌকিক কর্মের বিষয়ে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, তাদের দ্বারা তা সংঘটিত হয়েছিল বা হবে, সেগুলোকে আমরা আয়াত বা কারামত বলি না, বরং এগুলোকে আমরা তাদের ‘কাযায়ে হাজাত’ বা প্রয়োজন মেটানো বলি। কারণ আল্লাহ তাঁর দুশমনদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেন ‘ইসতিদরাজ’ হিসেবে -তাদেরকে তাদের পথে সুযোগ দেওয়ার জন্য- এবং তাদের শাস্তি হিসেবে। এতে তারা ধোঁকাগ্রস্ত হয় এবং আরো বেশি অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসে নিপতিত হয়। এগুলি সবই সম্ভব।

মহান আল্লাহ স্রষ্টা ছিলেন সৃষ্টি করার পূর্ব থেকেই। তিনি রিয্কদাতা ছিলেন সৃষ্টিকে রিয্ক প্রদানের পূর্ব থেকেই। আর আখিরাতে মহান আল্লাহ পরিদৃষ্ট হবেন। জান্নাতের মধ্যে অবস্থানকালে মুমিনগণ তাঁকে দর্শন করবেন তাদের নিজেদের চর্মচক্ষু দ্বারা। এ দর্শন সকল তুলনা ও স্বরূপ-প্রকৃতি নির্ধারণ ব্যতিরেকে। মহান আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে কোনো দূরত্ব হবে না।

ঈমান হচ্ছে (মুখের) স্বীকৃতি ও (অন্তরের) সত্যায়ন। বিশ্বাসকৃত বিষয়াদির দিক থেকে (আরকানুল ঈমানের দিক থেকে)) আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীদের ঈমান বাড়ে না এবং কমে না, কিন্তু ইয়াকীন বা বিশ্বাসের দৃঢ়তা-গভীরতা ও সত্যায়নের দিক থেকে ঈমান বাড়ে এবং কমে। এভাবে ঈমান ও তাওহীদের ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। কর্মের ক্ষেত্রে তাদের মর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে।

ইসলাম অর্থ আল্লাহর নির্দেশের জন্য আত্মসমর্পন করা এবং অনুগত হওয়া। আভিধানিকভাবে ঈমান ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তবে বাস্তবে ও ব্যবহারে ইসলাম ছাড়া কোনো ঈমান হয় না এবং ঈমান ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কাজেই ঈমান ও ইসলাম হলো পিঠের সাথে পেটের ন্যায়। ঈমান, ইসলাম ও সমস্ত শরীয়তকে একত্রে দীন বলা হয়।

মহান আল্লাহর সত্যিকার মা’রিফাত (পরিচয়) আমরা লাভ করেছি, তিনি যেভাবে তাঁর কিতাবে তাঁর নিজের বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে তাঁর সকল বিশেষণ সহকারে। তবে কেউই মহান আল্লাহর সঠিক পরিপূর্ণ ইবাদত করতে সক্ষম নয়, যেরূপ ইবাদত তাঁর পাওনা। বান্দা তাঁর ইবাদত করে তাঁর নির্দেশ মত, যেভাবে তিনি তাঁর কিতাবে এবং তাঁর রাসূলের (ﷺ) সুন্নাতে নির্দেশ দিয়েছেন। মারিফাত (পরিচয় লাভ), ইয়াকীন (বিশ্বাস), তাওয়াক্কুল (নির্ভরতা), মহববত (ভালবাসা), রিযা (সন্তুষ্টি), খাওফ (ভয়), রাজা (আশা) এবং এ সকল বিষয়ের ঈমান-এর ক্ষেত্রে মুমিনগণ সকলেই সমান। তাদের মর্যাদার কমবেশি হয় মূল ঈমান বা বিশ্বাসের অতিরিক্ত যা কিছু আছে তার সবকিছুতে।

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাগণের উপর করুণাকারী ও ন্যায়বিচারক। তিনি মেহেরবানি করে অনেক সময় বান্দার প্রাপ্য সাওয়াবের চেয়ে অনেকগুণ বেশি পুরস্কার প্রদান করেন। কখনো তিনি ন্যায়বিচার হিসেবে পাপের শাস্তি প্রদান করেন। কখনো মেহেরবানি করে পাপ ক্ষমা করেন।

নবীগণের শাফা‘আত সত্য। পাপী মুমিনগণ এবং কবীরা গোনাহকারীগণের জন্য, পাপের কারণে যাদের জাহান্নাম পাওনা হয়েছিল তাদের জন্য কিয়ামাতের দিন আমাদের নবী (ﷺ)-র শাফা‘আতও সত্য। কিয়ামাতের দিন তুলাদন্ডে আমল ওযন করাও সত্য। কিয়ামাতের দিন বিবাদকারীদের মধ্যে পুণ্যকর্মের মাধ্যমে বদলার ব্যবস্থা করা সত্য। যদি তাদের সাওয়াব বা নেককর্ম না থাকে তবে পাওনাদারের পাপ তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও সত্য ও সম্ভব। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাউয সত্য। জান্নাত ও জাহান্নাম বর্তমানে সৃষ্ট অবস্থায় রয়েছে (পূর্বেই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।) জান্নাত ও জাহান্নাম কখনোই বিলুপ্ত হবে না। আয়তলোচনা হূরগণ কখনোই মৃত্যুবরণ করবে না। মহান আল্লাহর অনন্ত-চিরস্থায়ী শাস্তি ও পুরস্কার কখনোই বিলুপ্ত হবে না।

[1] আল-ফিকহুল আকবারের কোনো কোনো পান্ডুলিপিতে এ অতিরিক্ত বাক্যাংশটি বিদ্যমান।
দেখানো হচ্ছেঃ ১৮১ থেকে ১৯০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৫৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 16 17 18 19 20 · · · 23 24 25 26 পরের পাতা »