হজ উমরা ও যিয়ারত ইসলামহাউজ.কম ১৮২ টি
হজ উমরা ও যিয়ারত ইসলামহাউজ.কম ১৮২ টি

মুযদালিফায় অবস্থানের ফযীলত

মুযদালিফায় অবস্থানকারিদের ওপর আল্লাহ তা‘আলা অনুকম্পা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّ اللهَ تَطَوَّلَ عَلَيْكُمْ فِي جَمْعِكُمْ هَذَا، فَوَهَبَ مُسِيئَكُمْ، لِمُحْسِنِكُمْ، وَأَعْطَى مُحْسِنَكُمْ مَا سَأَلَ».

‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের এই (মুযদালিফার) সমাবেশে তোমাদের ওপর অনুকম্পা করেছেন, তাই তিনি গুনাহ্গারদেরকে নেককারদের কাছে সোপর্দ করেছেন। আর নেককাররা যা চেয়েছে তা তিনি দিয়েছেন।’[1]

মুযদালিফার পথে রওয়ানা

১. যিলহজের ৯ তারিখ সূর্য ডুবে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর হাজী সাহেব ধীরে-সুস্থে শান্তভাবে আরাফা থেকে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা করবেন। হাজীদেরকে কষ্ট দেয়া থেকে দূরে থাকবেন। চেঁচামেচি ও খুব দ্রুত হাঁটাচলা পরিহার করবেন। ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘তিনি আরাফার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আরাফা থেকে মুযদালিফা গিয়েছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেছনে উট হাঁকানোর ধমক ও চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তখন তিনি তাঁর বেত দিয়ে লোকদেরকে ইশারা করে বললেন,

«أَيُّهَا النَّاسُ عَلَيْكُمْ بِالسَّكِينَةِ ، فَإِنَّ الْبِرَّ لَيْسَ بِالإِيضَاعِ»

‘হে লোকসকল! তোমাদের শান্তভাবে চলা উচিত। কেননা দ্রুত চলাতে কোনো কল্যাণ নেই।’[2]

২. রাস্তায় জায়গা পাওয়া গেলে দ্রুতগতিতে চলাতে কোনো দোষ নেই। উরওয়া রহ. বলেন, ‘উসামা রা. কে জিজ্ঞেস করা হল, ‘বিদায় হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে পথ অতিক্রম করছিলেন? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মধ্যম গতিতে পথ অতিক্রম করছিলেন। আর যখন জায়গা পেয়েছেন তখন দ্রুত গতিতে চলেছেন।’[3]

৩. মাগরিবের সালাত আরাফার ময়দানে কিংবা মুযদালিফার সীমারেখায় প্রবেশের আগে কোথাও আদায় করবেন না।

৪. আরাফার সীমরেখা পার হয়ে প্রায় ৬ কি.মি. পথ অতিক্রম করার পর মুযদালিফা সীমারেখা শুরু হয়। মুযদালিফার শুরু ও শেষ নির্দেশকারী বোর্ড রয়েছে। বোর্ড দেখেই মুযদিলাফায় প্রবেশ করেছেন কিনা তা নিশ্চিত হবেন। তাছাড়া বড় বড় লাইটপোস্ট দিয়েও মুযদালিফা চিহ্নিত করা আছে। তা দেখেও নিশ্চিত হতে পারেন।

মুযদালিফায় করণীয়

১. মুযদালিফায় পৌঁছার পর ‘ইশার সময়ে বিলম্ব না করে মাগরিব ও ইশা এক সাথে আদায় করবেন। মাগরিব ও ইশা উভয়টা এক আযান ও দুই ইকামাতে আদায় করতে হবে। জাবের রা. বলেন,

«حَتَّى أَتَى الْمُزْدَلِفَةَ فَصَلَّى بِهَا الْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ بِأَذَانٍ وَاحِدٍ وَإِقَامَتَيْنِ وَلَمْ يُسَبِّحْ بَيْنَهُمَا شَيْئًا ثُمَّ اضْطَجَعَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَتَّى طَلَعَ الْفَجْرُ»

‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় এলেন, সেখানে তিনি মাগরিব ও ইশা এক আযান ও দুই ইকামতসহ আদায় করলেন। এ দুই সালাতের মাঝখানে কোনো তাসবীহ (সুন্নত বা নফল সালাত) পড়লেন না। অতঃপর তিনি শুয়ে পড়লেন। ফজর (সুবহে সাদেক) উদিত হওয়া পর্যন্ত তিনি শুয়ে থাকলেন।’[4]

আযান দেয়ার পর ইকামত দিয়ে প্রথমে মাগরিবের তিন রাক‘আত সালাত আদায় করতে হবে। এরপর সুন্নত-নফল না পড়েই ‘ইশার সালাতের ইকামত দিয়ে ‘ইশার দু’রাক‘আত কসর সালাত আদায় করতে হবে। ফরয সালাত আদায়ের পর বেতরের সালাতও আদায় করতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর ও মুকীম কোনো অবস্থায়ই এ সালাত ত্যাগ করতেন না।

২. সালাত আদায়ের পর বিলম্ব না করে বিশ্রাম নেবেন এবং শুয়ে পড়বেন। কেননা ওপরের হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় সুবহে সাদেক পর্যন্ত শুয়ে আরাম করেছেন। যেহেতু ১০ যিলহজ হাজী সাহেবকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফার রাতে আরাম করার বিধান রেখেছেন। সুতরাং হাজীদের জন্য মুযদালিফার রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সুন্নতের পরিপন্থি।

৩. মুযদালিফায় পৌঁছার পর যদি ইশার সালাতের সময় না হয় তবে অপেক্ষা করতে হবে। হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে,

«إِنَّ هَاتَيْنِ الصَّلاَتَيْنِ حُوِّلَتَا عَنْ وَقْتِهِمَا فِى هَذَا الْمَكَانِ الْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ»

‘এ স্থানে (মুযদালিফায়) এ সালাত দু’টি মাগরিব ও ইশাকে তাদের সময় থেকে পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে।’[5]

৪. সুন্নত হলো সুবহে সাদেক উদিত হলে আওয়াল ওয়াক্তে ফজরের সালাত আদায় করে কেবলামুখী হয়ে হাত তুলে দো‘আ করা। আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দো‘আ ও যিকরে মশগুল থাকা। আকাশ ফর্সা হবার পর সূর্যোদয়ের আগেই মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করা। জাবের রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে,

«فَلَمْ يَزَلْ وَاقِفًا حَتَّى أَسْفَرَ جِدًّا فَدَفَعَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ»

‘আকাশ ভালভাবে ফরসা হওয়া পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উকূফ (অবস্থান) করেছেন। অতঃপর সূর্যোদয়ের পূর্বে তিনি (মুযদালিফা থেকে মিনার দিকে) যাত্রা আরম্ভ করেছেন।’[6]

তাই প্রত্যেক হাজী সাহেবের উচিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে মুযদালিফায় রাতযাপন করেছেন, ফজরের পর উকূফ করেছেন, ঠিক সেভাবেই রাতযাপন ও উকূফ করা।

৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত আদায়ের পর ‘কুযা’ পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে উকূফ করেছেন। বর্তমানে এই পাহাড়ের পাশে মাশ‘আরুল হারাম মসজিদ অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَقَفْتُ هَاهُنَا وَجَمْعٌ كُلُّهَا مَوْقِفٌ»

‘আমি এখানে উকূফ করলাম তবে মুযদালিফা পুরোটাই উকূফের স্থান।’[7]

তাই সম্ভব হলে উক্ত মসজিদের কাছে গিয়ে উকূফ করা ভাল। সম্ভব না হলে যেস্থানে রয়েছেন সেটা মুযদালিফার সীমার ভেতরে কি না তা দেখে নিয়ে সেখানেই অবস্থান করুন।’

[1]. ইবন মাজাহ্‌ : ৩০২৩।

[2]. বুখারী : ১৬৭১।

[3]. প্রাগুক্ত।

[4]. মুসলিম ১২১৮।

[5]. বুখারী : ১৬৮৩।

[6]. মুসলিম: ১২১৮।

[7]. মুসলিম : ১২১৮।

১. মুযদালিফায় উকূফ করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ وَٱذۡكُرُوهُ كَمَا هَدَىٰكُمۡ وَإِن كُنتُم مِّن قَبۡلِهِۦ لَمِنَ ٱلضَّآلِّينَ ١٩٨ ﴾ [البقرة: ١٩٨]

‘তোমরা যখন আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করবে, মাশ‘আরুল হারামের নিকট পৌঁছে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং তিনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে তাঁকে স্মরণ করবে। যদিও তোমরা ইতিপূর্বে বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।’[1]

২. ইমাম আবূ হানীফা রহ. বলেছেন, ফজর থেকে মূলত মুযদালিফায় উকূফের সময় শুরু হয়। তাঁর মতানুসারে মুযদালিফায় রাত যাপন করা সুন্নত। আর ফজরের পরে অবস্থান করা ওয়াজিব। যদি কেউ ফজরের আগে উযর ছাড়া মুযদালিফা ত্যাগ করে, তার ওপর দম (পশু যবেহ করা) ওয়াজিব হবে। কুরআনুল কারীমের আদেশ এবং মুযদালিফায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের আমলের দিকে তাকালে ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর মতটি এখানে বিশুদ্ধতম মত হিসেবে প্রতীয়মান হয়।’[2]

৩. দুর্বল ব্যক্তি ও তার দায়িত্বশীল, মহিলা ও তার মাহরাম এবং হজ সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তির জন্য মধ্যরাতের পর চাঁদ ডুবে গেলে মুযদালিফা ত্যাগ করার অনুমতি রয়েছে। কারণ,

ক. ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে দুর্বল লোকদেরকে দিয়ে রাতেই মুযদালিফা থেকে পাঠিয়ে দিলেন।’[3]

খ. ইবন উমর রা. তাঁর পরিবারের মধ্যে যারা দুর্বল তাদেরকে আগে নিয়ে যেতেন। রাতের বেলায় তারা মুযদালিফায় মাশ‘আরুল হারামের নিকট উকূফ করতেন। সেখানে তারা যথেচ্ছা আল্লাহর যিকর করতেন। অতপর ইমামের উকূফ ও প্রস্থানের পূর্বেই তারা মুযদালিফা ত্যাগ করতেন। তাদের মধ্যে কেউ ফজরের সালাতের সময় মিনায় গিয়ে পৌঁছতেন। কেউ পৌঁছতেন তারও পরে। তারা মিনায় পৌঁছে কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। ইবন উমর রা. বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন।’[4]

গ. আসমা রা.-এর মুক্তদাস আবদুল্লাহ রহ. আসমা রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, আসমা রা. রাত্রি বেলায় মুযদালিফায় অবস্থান করলেন। অতঃপর সালাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর বললেন, ‘হে বৎস, চাঁদ কি ডুবে গেছে?’ আমি বললাম, না। অতপর আরো এক ঘন্টা সালাত পড়ার পর তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বৎস, চাঁদ কি ডুবে গেছে?’ আমি জবাব দিলাম, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, চল। তখন আমরা রওয়ানা হলাম। অতঃপর তিনি জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন এবং নিজ আবাসস্থলে পৌঁছে ফজরের সালাত আদায় করলেন। তখন আমি বললাম, ‘হে অমুক, আমরা তো অনেক প্রত্যুষে বের হয়ে গেছি। তিনি বললেন, হে বৎস, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহিলাদের জন্য এ ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন।’[5]

[1]. সূরা আল-বাকারা : ১৯৮।

[2]. ইমাম শাফেঈ রহ. ও ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রহ.-এর মতে মধ্যরাত পর্যন্ত উকূফ করা ওয়াজিব। মধ্য রাতের পূর্বে মুযদালিফা ত্যাগ করলে দম ওয়াজিব হবে। ইমাম মালেক রহ.-এর মতে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু সময় মুযদালিফায় অবস্থান করলেই উকূফ হয়ে যাবে। খালিসুল জুমান : পৃ.২১৪।

[3]. বুখারী : ১৬৭৮, মুসলিম : ১২৯৪।

[4]. বুখারী : ১৫৬৪।

[5]. বুখারী : ১৬৭৯, মুসলিস : ১২৯১।

১. হাজী সাহেবের যদি ভয় হয় যে, মুযদালিফায় পৌঁছে তিনি ইশার সময়ের মধ্যে মাগরিব ও ইশার সালাত আদায় করতে পারবেন না, তাহলে পথেই তিনি ইশার সময় থাকতেই মাগরিব ও ইশা একসাথে আদায় করে নেবেন।

২. বর্তমানে মুযদালিফার কিছু অংশ মিনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ননব্যালটি অধিকাংশ বাংলাদেশী হাজীর মিনার তাঁবু মুযদালিফায় অবস্থিত। এ জায়গাটুকু মিনা হিসেবে ব্যবহৃত হলেও যেহেতু মৌলিকভাবে তা মুযদালিফার অংশ তাই এ অংশে রাত্রিযাপন করলেও মুযদালিফায় রাত্রিযাপন হয়ে যাবে।

৩. অনেক হাজী সাহেব মনে করেন, মুযদালিফা থেকে কঙ্কর কুড়ানো ফযীলতপূর্ণ কাজ। এটা একেবারে ভুল ধারণা। বরং যেখান থেকে সহজ হয় সেখান থেকেই তা সংগ্রহ করা যাবে। তবে বর্তমানে মিনায় গিয়ে কঙ্কর খুঁজে পাওয়া রীতিমতো কষ্টের ব্যাপার। তাই মুযদালিফা থেকে তা কুড়িয়ে নিলে কোনো অসুবিধা নেই।

৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু প্রথম দিনের কঙ্করই মুযদালিফা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাই শুধু প্রথম দিনের সাতটি কঙ্কর কুড়িয়ে নিলেই হবে। পরবর্তীগুলো মিনা থেকে নিলে চলবে। আর যদি মনে করেন যে, একবারে সব দিনের পাথর নিয়ে নেবেন তবে তাও নিতে পারেন। সে হিসেবে যদি মিনায় ১৩ তারিখ থাকার ইচ্ছা থাকে তবে ৭০টি কঙ্কর নেবেন। নতুবা ৪৯টি পাথর নেবেন। তবে একেবারে সমান সমান না নিয়ে দু’একটি বেশি নেয়া ভাল। কারণ নিক্ষেপের সময় কোনটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তখন কম পড়ে যাবে। আর সেখানে কঙ্কর পাবেন না।

৫. বুটাকৃতির কঙ্কর নেবেন, যা আঙুল দিয়ে নিক্ষেপ করা যায়।

৬. কঙ্কর পানি দিয়ে ধুতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঙ্কর ধুয়েছেন বলে কোনো হাদীসে পাওয়া যায় না।

দশম দিবসের ফযীলত :

১. এই দিন ‘ইয়াওমুল হাজ্জিল আকবার’ অর্থাৎ মহান হজের দিন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَذَٰنٞ مِّنَ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦٓ إِلَى ٱلنَّاسِ يَوۡمَ ٱلۡحَجِّ ٱلۡأَكۡبَرِ أَنَّ ٱللَّهَ بَرِيٓءٞ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ وَرَسُولُهُۥۚ﴾ [التوبة: ٣]

‘আর মহান হজের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত এবং তাঁর রাসূলও।’[1]

ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর দিন বলেন,

«أَىُّ يَوْمٍ هَذَا، قَالُوا يَوْمُ النَّحْرِ. قَالَ هَذَا يَوْمُ الْحَجِّ الأَكْبَرِ».

‘এটা কোন দিন?’ তারা বলল, ‘কুরবানীর দিন।’ তিনি বললেন, ‘এটা বড় হজের দিন।’[2] কেননা এই দিনে হজের চারটি মৌলিক কাজ সম্পন্ন করতে হয়। কাজগুলো হলো, বড় জামরায় পাথর মারা; কুরবানী করা, হলক বা কসর করা এবং বায়তুল্লাহ্‌র ফরয তাওয়াফ করা।

২. এই দিন বছরের সবচে’ বড় তথা মহৎ দিন। আবদুল্লাহ ইবন কুর্ত রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ أَعْظَمَ الأَيَّامِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمُ النَّحْرِ ثُمَّ يَوْمُ الْقَرِّ»

‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট সবচে’ বড় দিন হল কুরবানীর দিন তারপর এগারো তারিখের দিন।’[3]

কেননা এই দিনে সালাত ও কুরবানী একত্রিত হয়েছে। এ দু’টি আমল সালাত ও সদকার চেয়ে উত্তম। এ-কারণে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই বলে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আমি তোমাকে কাওসার[4] দান করেছি, তাই তুমি তোমার রবের সন্তুষ্টি লাভের জন্য শুকরিয়া স্বরূপ সালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।[5]

[1]. সূরা আত-তাওবা : ৩।

[2]. আবূ দাঊদ : ১৯৪৫

[3]. আবূ দাউদ : ১৭৬৫; মুসনাদে আহমদ : ১৯০৯৮।

[4]. অনেক কল্যাণ ও জান্নাতের বিশেষ র্ঝণাধারা। (আদওয়াউল বায়ান তাফসীর গ্রন্থে সূরা কাউসারের ব্যাখ্যা)।

[5]. লাতাইফুল মা‘আরিফ : ২৮২-২৮৩।

১. আকাশ একেবারে ফর্সা হওয়ার পর সূর্যোদয়ের পূর্বেই মিনার দিকে রওয়ানা করবেন। উমর রা. মুযদালিফায় ফজরের সালাত আদায় করে বললেন, ‘মুশরিকরা সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত মুযদালিফা ত্যাগ করত না। আর তারা বলতো,

أَشْرِقْ ثَبِيرُ كَيْمَا نُغِيرُ وَكَانُوا لَا يُفِيضُونَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ فَخَالَفَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم «فَأَفَاضَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ»

‘হে ছাবীর[1] তুমি সূর্যের কিরণে আলোকিত হও, যাতে আমরা দ্রুত প্রস্থান করতে পারি, আর তারা সূর্যোদয়ের পূর্বে প্রস্থান করত না; কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিপরীত করেছেন এবং সূর্যোদয়ের পূর্বেই প্রস্থান করেছেন।’[2]

২. তালবিয়া ও তাকবীর পাঠ করা অবস্থায় মিনার দিকে চলতে থাকবেন। ওয়াদি মুহাস্‌সারে[3] পৌঁছলে একটু দ্রুত চলবেন। বর্তমানে মানুষ ও যানবাহনের ভিড়ের কারণে তা কঠিন হয়ে গেছে। তবে সুন্নতের অনুসরণের জন্য মনে মনে নিয়ত করবেন। সুযোগ হলে আমল করার চেষ্টা করবেন।

৩. বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ আরম্ভ না করা পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করতে থাকবেন। ফযল রা. বলেন,

«أَنَّ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم لَمْ يَزَلْ يُلَبِّى حَتَّى رَمَى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ».

‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামরাতুল আকাবায় (বড় জামরায়) কঙ্কর নিক্ষেপের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করছিলেন।’[4]

[1]. ছাবীর মুযদালিফায় অবস্থিত মক্কার সবচে’ বড় পাহাড়। সূর্যের আলো সে পাহাড়ে পড়লে সূর্য উদিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায় এবং মিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা সহজ হয়। এ জন্য তারা ছাবীরের ওপর সূর্যের কিরণ পড়ে আলোকিত হওয়ার আহবান জানাত।

[2]. ইবন মাজাহ্‌: ৩০২২।

[3]. মিনা ও মুযদালিফার মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। এ স্থানে আল্লাহ তা‘আলা আবরাহা ও তার হস্তি বাহিনীকে ধ্বংস করেছিলেন।

[4]. বুখারী ১৫৪৪, মুসলিম : ১২৮১।

১. জামরাতুল আকাবা বা বড় জামরায় ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করা।

২. হাদী বা পশু যবেহ করা।

৩. মাথা মুণ্ডন করা অথবা চুল ছোট করা।

৪. তাওয়াফে ইফাযা (তাওয়াফে যিয়ারত) বা ফরয তাওয়াফ করা।

এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা নিম্নে উল্লেখ করা হল।

১. প্রথম আমল : জামরাতুল আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপ

জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপের ফযীলত

১. কঙ্কর নিক্ষেপের সওয়াব আখিরাতের জন্য সঞ্চিত থাকবে। ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَأَمَّا رَمْيُكَ الْجِمَارَ فَإِنَّهُ مَذْخُورٌ لَكَ»

‘আর তোমার কঙ্কর নিক্ষেপ, তা তো তোমার জন্য সঞ্চিত করে রাখা হয়।[1]

২. কঙ্কর নিক্ষেপের সওয়াব চোখ জুড়ানো সওয়াব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«وَأَمَّا رَمِيْكَ الْجِمَارَ قَالَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ ( فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ)»

‘আর জামরায় পাথর নিক্ষেপ, এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নিম্নের বাণীটি প্রযোজ্য, ‘অতঃপর কোনো ব্যক্তি জানে না তাদের জন্য চোখ জুড়ানো কী জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তারা যা করত, তার বিনিময়স্বরূপ’[2],[3]

৩. নিক্ষিপ্ত প্রতিটি কঙ্কর এক একটা গুনাহে কাবীরা মোচন করবে।

«وَأَمَّا رَمْيُكَ الْجِمَارَ فَلَكَ بِكُلِّ حَصَاةٍ رَمَيْتَهَا تَكْفِيْرُ كَبِيْرَةٍ مِنَ الْمُوْبِقَاتِ»

‘আর জামরায় তোমার কঙ্কর নিক্ষেপ, এতে তোমার নিক্ষিপ্ত প্রতিটি কঙ্করের বিনিময়ে এক একটা ধ্বংসকারী কবীরা গুনাহ মোচন করা হবে।’[4]

৪. নিক্ষিপ্ত প্রতিটি কঙ্কর কিয়ামতের দিন নূর হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إذا رَمَيْتَ الجِمارَ كانَ لَكَ نُوراً يَوْمَ القِيامَةِ»

‘তুমি যখন কঙ্কর নিক্ষেপ কর, তোমার জন্য কিয়ামতের দিন নূর হবে।’[5]

[1]. মু’জামে কাবীর : ১৩৩৯০।

[2]. সাজদাহ : ১৭।

[3]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১১৩।

[4]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১১২।

[5]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১৫৫৭।

সূর্য উদয়ের সময় থেকে কঙ্কর নিক্ষেপের সময় আরম্ভ হয়। কিন্তু সুন্নত হচ্ছে, সূর্য উঠার কিছু সময় পর দিনের আলোতে বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা। জাবের রা. বলেন, ‘কুরবানীর দিবসের প্রথমভাগে (সূর্য উঠার কিছু পরে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উটের পিঠে জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন।’[1] সূর্য হেলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ-সুন্নত সময় থাকে। সূর্য হেলে যাওয়া থেকে শুরু করে ১১ তারিখের সুবহে সাদেকের পূর্ব পর্যন্ত কঙ্কর নিক্ষেপ জায়েয। দুর্বল ও যারা দুর্বলের শ্রেণীভুক্ত তাদের জন্য এবং মহিলার জন্য ১০ তারিখের রাতেই সূর্য উদয়ের পূর্বে ফজর হওয়ার পরে কঙ্কর নিক্ষেপের অবকাশ রয়েছে। মোদ্দাকথা, ১০ যিলহজ সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ১১ যিলহজ সুবহে সাদেক উদয়ের পূর্ব পর্যন্ত কঙ্কর মারা চলে, এ সময়ের মধ্যে যখন সহজে সুযোগ পাবেন তখনই কঙ্কর মারতে যাবেন।

[1]. আবূ দাউদ : ২/১৪৭।

যারা দুর্বল, হাঁটা-চলা করতে পারে না, তারা কঙ্কর মারার জন্য প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে পারবেন। প্রতিনিধিকে অবশ্যই হজ পালনরত হতে হবে। সে নিজের কঙ্কর প্রথমে মেরে, পরে অন্যের কঙ্কর মারবে।

মহিলা মাত্রই দুর্বল- এ কথা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সাথে উম্মাহাতুল মু’মিনীন সকলেই হজ করেছেন। তাঁরা সবাই নিজের কঙ্কর নিজেই মেরেছেন। কেবল সাওদা রা. মোটা শরীরের অধিকারী হওয়ায় ফজরের আগেই অনুমতি নিয়ে কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন। তারপরও তিনি নিজের কঙ্কর নিজেই মেরেছেন। তাই মহিলা হলেই প্রতিনিধি নিয়োগ করা যাবে, তেমন কোনো কথা নেই। যখন ভিড় কম থাকে, মহিলারা তখন গিয়ে কঙ্কর মারবেন। তারা নিজের কঙ্কর নিজেই মারবেন, এটাই নিয়ম। বর্তমানে জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপের ব্যবস্থাপনা খুব চমৎকার। তাতে যেকোনো হাজী সহজে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে পারবে। হাঁটা বা চলাফেরা করতে পারে, এরকম ব্যক্তির জন্য প্রতিনিধি নিয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই।

তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় জামরাতের দিকে এগিয়ে যাবেন। মিনার দিক থেকে তৃতীয় ও মক্কার দিক থেকে প্রথম জামরায়- যাকে জামরাতুল আকাবা বা জামরাতুল কুবরা (বড় জামরা) বলা হয়- ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। কা‘বা ঘর বাঁ দিকে ও মিনা ডান দিকে রেখে দাঁড়াবেন, এভাবে দাঁড়ানো সুন্নাত। অবশ্য অন্য সবদিকে দাঁড়িয়েও নিক্ষেপ করা জায়েয। আল্লাহু আকবার (اللَّهُ أَكْبَرُ) বলে প্রতিটি কঙ্কর ভিন্ন ভিন্নভাবে নিক্ষেপ করবেন। খুশূ-খুযূর সাথে কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। মনে রাখবেন, কঙ্করগুলো যেন লক্ষস্থল তথা স্তম্ভ বা হাউজের ভেতরে পড়ে। কঙ্কর নিক্ষেপ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢ ﴾ [الحج: ٣٢]

‘আর যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই।’[1] আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْىُ الْجِمَارِ لإِقَامَةِ ذِكْرِ اللهِ».

‘বাইতুল্লাহ্‌র তাওয়াফ, সাফা মারওয়ার সাঈ ও জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপের বিধান আল্লাহর যিকির কায়েমের উদ্দেশেই করা হয়েছে।’[2] তাই কঙ্কর নিক্ষেপের সময় ধীরস্থিরতা বজায় রাখা জরুরী, যাতে আল্লাহর নিদর্শনের অসম্মান না হয়। রাগ-আক্রোশ নিয়ে জুতো কিংবা বড় পাথর নিক্ষেপ করা কখনো উচিত নয়; বরং এটি মারাত্মক ভুল। জামরাতে শয়তান বাঁধা আছে বলে কেউ কেউ ধারণা করেন, তা ঠিক নয়। এ ধরনের কথার কোনো ভিত্তি নেই।

[1]. হজ : ৩২।

[2]. আবূ দাউদ : ১৮৯০।
দেখানো হচ্ছেঃ ৮১ থেকে ৯০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৮২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 6 7 8 9 10 · · · 16 17 18 19 পরের পাতা »