অন্তরের জীবন, মরণ, রোগ ও সুস্থতা

ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে যে, অন্তরের রোগ দু’প্রকার: مَرَضُ شَهْوَةٍ বা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করার রোগ[1] এবং ومرض شبهة বা দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ ও وأردؤها مَرَضُ الشُّبْهَةِ শির্ক-বিদআতে লিপ্ত হওয়ার রোগ।

প্রবৃত্তির অনুসরণের রোগের চেয়ে দ্বীনের মধ্যে সন্দেহ পোষণ ও শির্ক-বিদ‘আতে লিপ্ত হওয়ার রোগ অধিক নিকৃষ্ট। আর সন্দেহের রোগসমূহের মধ্যে নিকৃষ্টতম হলো তাকদীরের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা। অন্তরের রোগ বৃদ্ধি পেতে পেতে কখনো কখনো এমন জটিল আকার ধারণ করে যে, মানুষ তা অনুভব করতে পারে না। অন্তরের সুস্থতা ও অসুস্থতা এবং তার কারণসমূহ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণেই অন্তরের রোগ বাড়তে থাকে। কখনো কখনো মানুষের অজামেত্মই অন্তর মারা যায়। মৃত অন্তর ওয়ালা মানুষের আলামত হলো, খারাপ কাজ করার পরও তার অন্তর ব্যথিত হয় না এবং সত্য সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা ও বাতিল আক্বীদাহ পোষণ করেও কষ্ট অনুভব করে না।

জীবন্ত অন্তরের জীবনী শক্তি অনুপাতে তার মধ্যে খারাপ জিনিস প্রবেশ করার কারণে উহা কষ্ট পায় এবং হক সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণেও অন্তর ব্যথিত হয়। কিন্তু মরা অন্তর কিছুতেই ব্যথিত হয় না।

আরবী প্রবাদে বলা হয়েছে ما لجرح بميت إيلام মৃত ব্যক্তির শরীর আহত হলেও ব্যথা অনুভব করে না। যাদের অন্তর রোগাক্রান্ত তারা তাদের রোগ সম্পর্কে অনুভব করতে পারলেও এর সুস্থতার জন্য তিক্ত ঔষধ গ্রহণ করা এবং তার উপর ধৈর্যধারণ করা অত্যন্ত কষ্টকর। রোগাক্রান্ত অন্তরের চিকিৎসার জন্য ঔষধ সেবন করা খুবই কষ্টকর। কারণ এর ঔষধ সেবন করতে গেলে তার প্রবৃত্তির বিরোধিতা করা আবশ্যক। এ ঔষধ গ্রহণ করা নফ্সের জন্য সর্বাধিক কষ্টকর। তবে এর চেয়ে অধিক উপকারী ঔষধ আর নেই।

অন্তরের রোগে আক্রান্ত লোকেরা কখনো ধৈর্যসহকারে তিতা ঔষধ সেবন করে। অতঃপর তাদের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যায়। ফলে তারা চিকিৎসা গ্রহণের উপর স্থির থাকতে পারে না। কেননা তার ইলম, দূরদর্শিতা ও সবর খুবই দুর্বল। যেমন কেউ এমন পথ অবলম্বন করলো, যা অত্যন্ত ভীতিকর। কিন্তু এ পথ তাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি স্থানে নিয়ে যাবে। সে ভালো করেই জানে, সে যদি সবর করে এবং যাত্রা অব্যাহত রাখে, তাহলে অচিরেই ভয় চলে যাবে। ভয়ের পরেই সে নিরাপত্তা লাভ করবে। সুতরাং গন্তব্য স্থানে পৌঁছার জন্য প্রচুর ধৈর্যধারণ করা এবং সফলতা সম্পর্কে সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখা আবশ্যক। তার ধৈর্য যদি কমে যায় এবং ঈমান যদি দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে সে মাঝ পথ থেকে ফিরে আসবে। সে পথ চলার কষ্ট স্বীকার করতে পারবে না। বিশেষ করে যখন যাত্রা পথে যখন ভালো বন্ধু পাবে না বা চলার পথে একাকীত্ব অনুভব করবে। সে যদি বলতে থাকে বাকী লোকেরা কোথায় গেল? তারা যেদিকে চলে গেছে, আমারও সেদিকে যাওয়া উচিত। অধিকাংশ মানুষেরই এ অবস্থা। এটিই তাদেরকে ধ্বংস করেছে।

কিন্তু পর্বত প্রমাণ ধৈর্যশীল ও সত্যান্বেষী মুমিন কখনো সত্যের পথের সাথী কম হওয়ার কারণে একাকীত্ব অনুভব করে না। সাথী না থাকলেও সে বিচলিত হয় না। বিশেষ করে যখন সে উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রথম সারির লোকদের সঙ্গী-সাথী ও সমর্থক হওয়ার দিকে নযর দিবে, তখন সে মনোবল ও সৎ সাহস ফিরে পাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا

‘‘আর যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা ঐ সমস্ত লোকের সাথে থাকবে, যাদের উপর আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন; তারা হলেন নাবীগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মশীলগণ। কতইনা উত্তম বন্ধু তারা’’ (সূরা আন নিসা ৪:৬৯)।

আবূ মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান ইবনে ইসমাঈল আবূ শামা রহিমাহুল্লাহ الْحَوَادِثُ وَالْبِدَعُ "আল হাওয়াদিছু ওয়াল বিদা" নামক গ্রন্থে কতই না সুন্দর বলেছেন। তিনি বলেছেন, মুসলিমদেরকে জামা‘আতবদ্ধ থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেখানে জামা‘আত বলতে হক তথা সত্যকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং তার অনুসরণ করা উদ্দেশ্য। হকপন্থীদের সংখ্যা যদিও কম হয় এবং তাদের বিরোধীদের সংখ্যা বেশী হলেও তারা জামা‘আত। কেননা এ হকের উপরই ছিলেন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ছাহাবীগণ। তারাই উম্মতে মুহাম্মাদীর হকপন্থী প্রথম জামাআত। ছাহাবীদের যুগের পরে বাতিলপন্থীদের সংখ্যা বেশী হলেও সেদিকে দৃষ্টিপাত করা যাবে না।

ইমাম হাসান বসরী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহর শপথ! বাড়াবাড়ি ও কট্টরপন্থার মাঝখানেই সুন্নাত। সুতরাং আপনারা সুন্নাতের উপর সবর করুন। আল্লাহ আপনাদের উপর রহম করুন। পূর্ববর্তী কালে আহলে সুন্নাতের সংখ্যা একদম কম ছিল এবং এখনো তাদের সংখ্যা খুব কম। তারা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে মত্ত লোকদের সাথে ছিলেন না এবং বিদ‘আতীদের বিদ‘আতের সাথেও শরীক ছিলেন না। তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাত করার পূর্ব পর্যন্ত সুন্নাতের উপর ধৈর্যধারণ করেছেন। সুতরাং আপনারাও তাদের মত হয়ে যান।

অন্তর রোগাক্রান্ত হওয়ার আলামত হলো তা উপকারী খাদ্য বাদ দিয়ে ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণ করে এবং উপকারী ঔষধ বর্জন করে ক্ষতিকর ঔষধ সেবন করে। সুতরাং এখানে চারটি জিনিস রয়েছে।

(ক) উপকারী খাদ্য, (খ) শিফা দানকারী ঔষধ, (গ) ক্ষতিকর খাদ্য, (ঘ) ক্ষতিকর ঔষধ।

পরিশুদ্ধ অন্তর উপকারী খাদ্য ও শিফা দানকারী ঔষধ গ্রহণ করে এবং ক্ষতিকর খাদ্য ও ক্ষতিকর ঔষধ পরিহার করে। অসুস্থ অন্তর এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

অন্তরের জন্য ঈমানের খোরাকই সর্বোত্তম খোরাক, কুরআনের চিকিৎসাই সর্বোত্তম চিকিৎসা। ঈমান ও কুরআন -এ দু’টির মধ্যেই খাদ্য ও চিকিৎসা রয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে অন্যত্র চিকিৎসা অনুসন্ধান করবে সে সর্বাধিক মুর্খ ও গোমরাহ বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى أُولَٰئِكَ يُنَادَوْنَ مِن مَّكَانٍ بَعِيدٍ

‘‘এদের বলো, এ কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রোগ মুক্তি স্বরূপ। কিন্তু যারা ঈমান আনে না এটা তাদের জন্য পর্দা ও চোখের আবরণ। তাদের অবস্থা হচ্ছে এমন যেন দূর থেকে তাদেরকে ডাকা হচ্ছে’’ (সূরা হা-মীম সাজদা ৪১:৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا

‘‘আমি এ কুরআনের অবতরণ প্রক্রিয়ায় এমন সব বিষয় অবতীর্ণ করছি যা মুমিনদের জন্য নিরাময় ও রহমত এবং যালেমদের জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করে না’’। (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭:৮২)

এখানে من হরফে জারটি পূর্বোক্ত বিষয়ের পূর্ণ ব্বিরণের জন্য এসেছে; কিয়দাংশ বর্ণনার জন্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ

‘‘হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নসীহত এসে গেছে। এটি এমন জিনিস যা অন্তরের রোগের নিরাময় এবং যে তা গ্রহণ করে নেয় তার জন্য পথনির্দেশনা ও রহমত’’ (সূরা ইউনূস ১০:৫৭)।

শরীর ও অন্তরের সকল রোগ থেকে মুক্তি লাভের জন্য কুরআন হলো পরিপূর্ণ চিকিৎসা। কুরআনের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল রোগ ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। তবে সব মানুষই কুরআনের চিকিৎসা দ্বারা আরোগ্য লাভ করার যোগ্য নয়।

রোগী যখন ঔষধ সেবন করার সর্বোত্তম পন্থা ব্যবহার করতে শিখবে, অতঃপর পরিপূর্ণ সত্যায়ন, বিশ্বাস, কবুল ও শর্তসমূহ বাস্তবায়ন করার পর নিজের জন্য উহা ব্যবহার করবে, তখন কোনো রোগই তার মোকাবেলা করতে পারবে না। রোগ-ব্যাধির পক্ষে আসমান-যমীনের প্রভুর কালামের মোকাবেলা করা কিভাবে সম্ভব!! আল্লাহর কালাম যদি পাহাড়ের উপর নাযিল হতো, তাহলে উহা পাহাড়কে বিদীর্ণ করে ফেলতো, যমীনের উপর নাযিল হলে যমীনকে ফাটিয়ে ফেলতো। অন্তর ও শরীরের রোগসমূহের প্রত্যেক রোগের চিকিৎসার নির্দেশনা কুরআনে রয়েছে। যাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কুরআনের জ্ঞান দিয়েছেন তার জন্য কুরআনের মধ্যেই সকল রোগ ও তার কারণ থেকে বাঁচার ব্যবস্থাও রয়েছে। ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

لقد التمس بوهمه في فحص الغيب سرا كتيما

নিশ্চয়ই সে স্বীয় ধারণা অনুসারে গায়েবের একটি গুপ্ত রহস্য সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছে। অর্থাৎ ধারণার বশবতী হয়ে গায়েবী বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে সে একটি গুপ্ত গায়েবী বিষয় উন্মোচন করার চেষ্টা করেছে। কেননা তাকদীরের বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির মধ্যে একটি গুপ্ত বিষয় হিসাবে স্বীকৃত। যে এ বিষয়ে গবেষণা করতে যাবে, সে গায়েবী বিষয় অবগত হওয়ার চেষ্টাকারী হিসাবে গণ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ

‘‘তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। তিনি অদৃশ্য বিষয় কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তার মনোনীত কোন রসূল ব্যতীত। (সূরা আল জিন ৭২ : ২৬-২৭) সুতরাং তাকদীর তথা গায়েবী বিষয়ে মন্তব্যকারী মিথ্যাবাদী ও পাপাচারী হিসাবে পরিগণিত হবে।

[1]. শাহওয়াত বা প্রবৃত্তির রোগে আক্রান্ত অন্তর ওয়ালা লোকেরা সবসময় অশ্লীল কাজের প্রতি আসক্ত থাকে এবং পরনারীর কণ্ঠ শুনলেই তাদের অন্তর সেদিকে ঝুকে পড়ে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে বলেন,

فَلَا تَخْضَعْنَ بِالْقَوْلِ فَيَطْمَعَ الَّذِي فِي قَلْبِهِ مَرَضٌ وَقُلْنَ قَوْلًا مَّعْرُوفًا

‘‘হে নারীগণ! তোমরা চিকন কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না, যাতে অন্তরে যার ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে। আর তোমরা স্বাভাবিকভাবে কথা বলো’’ (সূরা আহযাব ৩৩:৩২)। আর যাদের অন্তরে শুবুহাত তথা নিফাকি, শির্ক-বিদআত ও দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহের রোগে আক্রান্ত তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন, فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٌ فَزَادَهُمُ اللَّهُ مَرَضًا وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ بِمَا كَانُوا يَكْذِبُونَ ‘‘তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরো বেশী বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময় তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’’। (সূরা আল বাকারা ২:১০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَأَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَى رِجْسِهِمْ وَمَاتُوا وَهُمْ كَافِرُونَ

‘‘তবে যাদের অন্তরে রোগ রয়েছে তাদের পূর্ব অপবিত্রতার সাথে আরো অপবিত্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং তারা কাফের অবস্থাতেই মৃত্যু বরণ করেছে’’ (সূরা আত-তাওবা ৯:১২৫) এই আয়াত দু’টিতে অন্তরের সন্দেহের রোগের কথা বলা হয়েছে। এটি সর্বাধিক নিকৃষ্ট রোগ।