পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ

الصومالصيام-এর আভিধানিক অর্থ হলো সাধারণভাবে বিরত থাকা। অর্থাৎ- সহবাস, কথা বলা, খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকা। আরো বলা হয়ে থাকে, সূর্য গতিহীন হয়ে পড়লে দিনও গতিহীন হয়ে পড়ে। আর বাতাস বন্ধ হয়ে যায় তখন তার গতিশীলতা থাকে না। আল্লাহ তা’আলা মারইয়াম সম্পর্কে বলেনঃ ’’মারইয়াম-এর কথা হলো, আমি মানুষের সাথে কথা বলা থেকে বিরত থাকার জন্য মানৎ করেছি রহমানের নিকটে।’’ (সূরা মারইয়াম ১৯ঃ ২৬)

صيام ’’সিয়াম’’-এর পরিভাষায় ইমাম নাবাবী ও হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) বলেনঃ

إمساك مخصوص في زمن مخصوص عن شيء مخصوص بشرائط مخصوصة.

অর্থাৎ- নির্দিষ্ট শর্তের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কাজ থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিরত থাকাকে সিয়াম বলে।

ইমাম ত্বীবী বলেনঃ এমন কিছু গুণ যা ইতিবাচক এবং যা ’আমল করা জায়িয তা ব্যতিরেকে সকল নিষিদ্ধ কাজ হারাম।

আমীর ইয়ামানী বলেনঃ নির্দিষ্ট কাজ থেকে বিরত থাকা। আর তা হলো খাওয়া, পান করা ও সহবাস।


১৯৫৬-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মাহে রমাযান (রমজান) শুরু হলে আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। অন্য এক বর্ণনায় আছে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। শয়তানকে শিকলবন্দী করা হয়। অন্য এক বর্ণনায় আছে, ’রহমতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়’। (বুখারী, মুসলিম)[1]

اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «إِذا دخل شهر رَمَضَانُ فُتِحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ» . وَفِي رِوَايَةٍ: «فُتِّحَتْ أَبْوَابُ الْجَنَّةِ وَغُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ وَسُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ» . وَفِي رِوَايَةٍ: «فُتِحَتْ أَبْوَابُ الرَّحْمَةِ»

وعن ابي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذا دخل شهر رمضان فتحت ابواب السماء وفي رواية فتحت ابواب الجنة وغلقت ابواب جهنم وسلسلت الشياطين وفي رواية فتحت ابواب الرحمة

ব্যাখ্যা: (فُتِحَتْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ) ‘‘আকাশের দরজাসমূহ খুলো দেয়া হয়। এখানে আকাশের দরজাসমূহ দ্বারা জান্নাতের দরজা উদ্দেশ্য। কেননা এর বিপরীতে বলা হয়েছে যে, (غُلّقَتْ أبواب النار) জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। অতএব বুঝা গেল যে, আকাশের দরজা দ্বারা উদ্দেশ্য জান্নাতের দরজা। ইবনু বাত্ত্বাল-এর বক্তব্যও তাই।

(غُلِّقَتْ أَبْوَابُ جَهَنَّمَ) ‘‘জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়।’’ সিন্দী (রহঃ) বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য বান্দা থেকে শাস্তি দূর করা। হাদীসের এ অংশ থেকে এটাও জানা যায় যে, জাহান্নামের দরজা খোলা থাকে। হাদীসের এ বক্তব্য সূরা আয্ যুমারে আল্লাহর বাণী ‘‘তারা (জাহান্নামীরা) যখন সেখানে আসবে তখন তা খুলে দেয়া হবে’’- সূরা আয্ যুমার আয়াত নং ৭১-এর বিরোধী নয়। কেননা এটা সম্ভব যে, জাহান্নামীদের তাতে নিক্ষেপ করার পূর্বে তা বন্ধ করা হবে। পরে তা আবার খুলে দেয়া হবে। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়ার কারণে কোন কাফির রমাযানে মৃত্যুবরণ করলে তাকে শাস্তি দেয়ায় কোন প্রতিবন্ধক হবে না। কারণ শাস্তি প্রদানের জন্য কবরের সাথে জাহান্নামের কোন একটি ছোট দরজার সংযোগ স্থাপনই যথেষ্ট, যদিও জাহান্নামের বড় ফটক বন্ধ থাকে।

(سُلْسِلَتِ الشَّيَاطِينُ) ‘‘শয়তানদের শিকলবন্দী করা হয়’’ অর্থাৎ- তাদেরকে প্রকৃত শিকল দ্বারাই আটকে ফেলা হয়। আর এখানে ঐ সমস্ত শয়তান উদ্দেশ্য যারা আকাশ থেকে সংবাদ চুরি করার কাজে লিপ্ত থাকে। অথবা এর দ্বারা সকল শয়তান উদ্দেশ্য, তবে এর অর্থ রূপক অর্থাৎ- শয়তান কর্তৃক মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রবণতা কমে যায়।

যদি প্রশ্ন করা হয় যে, শয়তানকে যদি রমাযান (রমজান) মাসে বন্দী করেই ফেলা হয় তা হলে রমাযানে অপরাধ সংগঠিত হয় কিভাবে? এর জওয়ার এই যে, অপরাধের প্রবণতা ঐ সমস্ত মুসলিমদের থেকে কমে যায় যারা সিয়ামের শর্তাবলী পালনের মাধ্যমে সিয়ামকে সংরক্ষণ করে। অথবা এর দ্বারা উদ্দেশ্য রমাযানে অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে দেয়া আর তা প্রকাশ্যভাবেই দৃশ্যমান। এটা সর্বজনবিদিত যে, রমাযান (রমজান) মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় অপরাধ অনেক কর্ম সংঘটিত হয়, আর শয়তান বন্দী করে ফেলার কারণে অপরাধ একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়া জরুরী নয়। কেননা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অনেক কারণ বিদ্যমান, তন্মধ্যে খারাপ অন্তর ও মানবরূপী শয়তান এর অন্তর্ভুক্ত।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৭: সওম (রোযা) (كتاب الصوم) 7. Fasting

পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ

১৯৫৭-[২] সাহল ইবনু সা’দ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ’রইয়্যান’ নামে একটি দরজা রয়েছে। সিয়াম পালনকারীগণ ছাড়া এ দরজা দিয়ে অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)[1]

اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ

وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فِي الْجَنَّةِ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابٍ مِنْهَا: بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانَ لَا يدْخلهُ إِلَّا الصائمون

وعن سهل بن سعد قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم في الجنة ثمانية ابواب منها باب يسمى الريان لا يدخله الا الصاىمون

ব্যাখ্যা: জান্নাতের আটটি দরজার মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রইয়্যান’-এর নামকরণ করার কারণ এটাও হতে পরে যে, এ জান্নাত স্বয়ং তৃপ্ত তাতে অধিক নালা ও তাজা ফুলে ফলে তা সমৃদ্ধ। অথবা তাতে যারা প্রবেশ করবে তাদের তৃষ্ণা মিটে থাকে এবং স্থায়ী নিবাসে তাদের এ তৃপ্তি স্থায়িত্ব পাবে।

(لَا يَدْخُلُه إِلَّا الصَّائِمُوْنَ) তাতে শুধু সিয়াম পালনকারীগণই প্রবেশ করবে। অর্থাৎ- যাদের ‘ইবাদাতের মধ্যে সিয়াম প্রাধান্য পেয়েছে তারা তাতে প্রবেশ করবে যদিও তাদের অন্যান্য ‘ইবাদাতেও কোন ঘাটতি নেই।

‘আল্লামা সিন্দী (রহঃ) বলেনঃ صَائِمُوْنَ দ্বারা উদ্দেশ্য যারা অধিক পরিমাণে সিয়াম পালন করে। যেমন العادل ন্যায়পরায়ণ, অর্থাৎ- ন্যায়ানুগ কাজ করা যার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, অনুরূপভাবে الظالم (যালিম) অর্থাৎ- যুলম করা যার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মাত্র একবার ন্যায়সঙ্গত করলে তাকে ন্যায়পরায়ণ বলা হয় না। অনুরূপ শুধুমাত্র একবার যুলম করলেই তাকে যালিম বলা হয় না।

কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যে, অত্র হাদীস এবং সহীহ মুসলিমে ‘উমার  থেকে বর্ণিত মারফূ‘ হাদীস যাতে বলা হয়েছে তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে উত্তমরূপে উযূ করবে, অতঃপর বলবে (أَشْهَدُ أَنْ لَّاۤ إِلٰهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُه وَرَسُوْلُه)। তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে। সে এর যে কোন দরজা দিয়ে স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী প্রবেশ করবে। এখানে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ সে ব্যক্তি তার ইচ্ছানুযায়ী যে কোন একটি দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে অথচ এই উযূকারী ব্যক্তি অধিক সিয়াম পালনকারী নাও হতে পারে; তা হলে তো এ দুই হাদীসের মধ্যে বৈপরীত্য হয়ে গেল।

দু’ভাবে এ প্রশ্নের জওয়াব দেয়া যেতে পারে।

১. সায়িমদের দরজা ‘রইয়্যান’ থেকে তার মনকে ঘুরিয়ে দেয়া হবে ফলে সে এই ‘রইয়্যান’ দরজা ব্যতীত অন্য যে কোন দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।

২. ‘উমার এর হাদীসটি বর্ণনার ক্ষেত্রে শব্দের ভিন্নতা রয়েছে। তিরমিযীর বর্ণনায় রয়েছে, জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্যে থেকে তার জন্য আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে। এতে বুঝা যায় যে, জান্নাতের দরজা আটেরও অধিক। আর ঐ ব্যক্তির খুলে দেয়া আটটি দরজা সিয়াম পালনকারীদের জন্য নির্দিষ্ট দরজা ‘রইয়্যান’ ব্যতীত অন্য যে কোন আটটি দরজা খুলে দেয়া হবে। অতএব দু’ হাদীসের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৭: সওম (রোযা) (كتاب الصوم) 7. Fasting

পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ

১৯৫৮-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় রমাযান (রমজান) মাসে সিয়াম পালন করবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় ’ইবাদাতে রাত কাটাবে, তার আগের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াব লাভের আশায় লায়লাতুল কদরে ’ইবাদাতে কাটাবে তারও আগের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে। (বুখারী, মুসলিম)[1]

اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ. وَمَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ. وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»

وعن ابي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من صام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ومن قام رمضان ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ومن قام ليلة القدر ايمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه

ব্যাখ্যা: (مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا) ‘‘বিশ্বাসের সাথে সিয়াম পালন করে’’ অর্থাৎ- এ বিশ্বাস রাখে যে, রমাযানের সিয়াম পালন করা তার জন্য বাধ্যতামূলক এবং তা ইসলামের অন্যতম একটি রূকন, আর তা পালনকারীর জন্য পুরস্কার রয়েছে।

(احْتِسَابًا) ‘‘সাওয়াবের আশায়’’, অর্থাৎ- এ কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে সে আল্লাহ তা‘আলার নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির আশা করে। মানুষের ভয়ে বা সিয়াম পালন না করলে লজ্জিত হতে হবে এমন আশংকা থেকে নয় অথবা সিয়াম পালনের মাধ্যমে সুখ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্য না থাকে বরং ‘‘খালিস লিওয়াজহিল্লা-হ’’ অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, সিয়াম পালন করে (غُفِرَ لَه مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه وَمَا تَأَخَّرَ) তার পূর্বাপর সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। এতে বুঝা যায় যে, তার সগীরাহ্ কাবীরাহ্ সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। তবে জমহূর ‘আলিমদের মতে শুধু সগীরাহ্ গুনাহ উদ্দেশ্য অর্থাৎ তার সকল প্রকার সগীরাহ্ গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। কেননা কাবীরাহ্ গুনাহ তাওবাহ্ ব্যতীত ক্ষমা করা হয় না।

(وَمَا تَأَخَّرَ) ‘‘তার পরবর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়’’ হাদীসের এ অংশটুকু প্রশ্নের সৃষ্টি করে যে, ক্ষমা করা বিষয়টি কৃত অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত। যে অপরাধ এখনও সংঘটিত হয়নি তা ক্ষমা করা হয় কিভাবে?

জওয়াবঃ

১. তার গুনাহ সংঘটিত হয় ক্ষমাকৃত অবস্থায় অর্থাৎ তার দ্বারা কোন গুনাহ সংঘটিত হলে তা ক্ষমা করে দেয়া হবে।

২. আল্লাহ তাকে ভবিষ্যতে গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে সংরক্ষণ করবেন। ফলে তার দ্বারা কোন কাবীরাহ্ গুনাহ সংঘটিত হবে না।

(قَامَ رَمَضَانَ) ‘‘রমাযানে কিয়াম করে’’ অর্থাৎ- রমাযানের পূর্ণরাত বা রাতের অধিকাংশ সময় সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত ও যিকিরের মাধ্যমে অতিবাহিত করে। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য রমাযানের রাতে তারাবীহের সালাত আদায় করা। অর্থাৎ তারাবীহের সালাত দ্বারা قيام الليل (কিয়ামুল লায়ল)-এর উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়। এর অর্থ এমন নয় যে, তারাবীহ ব্যতীত قيام الليل হয় না।

(مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ) ‘‘যে ব্যক্তি কদরের রাতে কিয়াম করে’’ অর্থাৎ- এ রাতে জেগে ‘ইবাদাত করে। চাই সে তা অবহিত হোক বা না হোক।

(غُفِرَ لَهٗ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه) ‘‘তার পূর্বের কৃতগুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়’’ অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির যদি সগীরাহ্ গুনাহ থেকে থাকে তবে তা মুছে ফেলা হয়। আর যদি তার কাবীরাহ্ গুনাহ থাকে তবে তা হালকা করে দেয়া হয়। তার যদি কোন গুনাহ না তাকে তবে জান্নাতে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়া হয়।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৭: সওম (রোযা) (كتاب الصوم) 7. Fasting

পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ

১৯৫৯-[৪] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আদম সন্তানের প্রত্যেকটি নেক ’আমল দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলো সওম। কেননা, সওম আমার জন্যে রাখা হয় এবং আমিই এর প্রতিদান দিব। কারণ সায়িম (রোযাদার) ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির তাড়না ও খাবার-দাবার শুধু আমার জন্য পরিহার করে। সায়িমের জন্য দু’টি খুশী রয়েছে। একটি ইফতার করার সময় আর অপরটি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। সায়িমের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিশকের সুগন্ধির চেয়েও বেশী পবিত্র ও পছন্দনীয় এবং সিয়াম ঢাল স্বরূপ (জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা কবচ)। তাই তোমাদের যে কেউ যেদিন সায়িম হবে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে আর শোরগোল বা উচ্চবাচ্য না করে। তাকে কেউ যদি গালি দেয় বা কটু কথা বলে অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন বলে দেয়, ’আমি একজন সায়িম’। (বুখারী, মুসলিম)[1]

اَلْفَصْلُ الْأَوَّلُ

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ يُضَاعَفُ الْحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا إِلَى سَبْعِمِائَةِ ضِعْفٍ قَالَ اللَّهُ تَعَالَى: إِلَّا الصَّوْمَ فَإِنَّهُ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِهِ يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلِي لِلصَّائِمِ فَرْحَتَانِ: فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِهِ وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّهِ وَلَخُلُوفِ فَمِ الصَّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ رِيحِ الْمِسْكِ وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ فَلَا يَرْفُثْ وَلَا يصخب وفإن سَابَّهُ أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِم

وعن ابي هريرة رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم كل عمل ابن ادم يضاعف الحسنة بعشر امثالها الى سبعماىة ضعف قال الله تعالى الا الصوم فانه لي وانا اجزي به يدع شهوته وطعامه من اجلي للصاىم فرحتان فرحة عند فطره وفرحة عند لقاء ربه ولخلوف فم الصاىم اطيب عند الله من ريح المسك والصيام جنة واذا كان يوم صوم احدكم فلا يرفث ولا يصخب وفان سابه احد او قاتله فليقل اني امرو صاىم

ব্যাখ্যা: (إِلَّا الصَّوْمَ) ‘‘তবে সওমের প্রতিদান, অর্থাৎ- যে কোন সৎকাজের প্রতিদান দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। সিয়াম এর ব্যতিক্রম তা শুধুমাত্র সাতশত গুণ পর্যন্তই বৃদ্ধি করা হয় না। এর প্রতিদানের কোন সীমারেখা নেই। বরং তার প্রতিদান কি পরিমাণ দেয়া হবে তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন।

(فَإِنَّهٗ لِي وَأَنَا أَجْزِي بِه) ‘‘তা (সিয়াম) আমারই জন্য এবং তার প্রতিদান আমিই দিব।’’ অর্থাৎ- সিয়াম আল্লাহর তা‘আলা ও তার বান্দার মাঝে একটি গোপনীয় বিষয়। যা বান্দা শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই পালন করে থাকে। যা কোন বান্দা অবহিত হতে পারে না। কেননা এ সিয়ামের বাহ্যিক কোন রূপ নেই যেমনটি অন্যান্য ‘ইবাদাতের বাহ্যিক রূপ রয়েছে। যা বান্দা দেখতে পায়। যেহেতু এ সিয়ামের বিষয়টি আমি ব্যতীত অন্য কেউ অবহিত হতে পারে না তাই এর প্রতিদানও আমিই দিব। এর প্রতিদানের বিষয়টি অন্য কারো উপর ন্যস্ত করব না। এতে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে, সিয়ামের পুরস্কার খুবই বড় আর তা হিসাববিহীন।

একটি প্রশ্নঃ সকল ‘ইবাদাতই একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং তার প্রতিদানও একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই দিয়ে থাকেন। তাহলে ‘সওম শুধুমাত্র আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দিব’ এর উদ্দেশ্য কি?

জওয়াবঃ সিয়ামের মধ্যে রিয়া তথা লোকজনকে দেখানো সম্ভব নয় যা অন্যান্য ‘ইবাদাতের প্রযোজ্য। কেননা সিয়ামের কোন বাহ্যিক আকার আকৃতি নেই যা লোকজন দেখতে পাবে যা অন্যত্র ‘ইবাদাতের মধ্যে আছে। যেমন সালাত তার রুকূ' সিজদা্ রয়েছে। সালাত আদায়কারীর এ কাজ অন্যান্য লোকেরা দেখতে পায়। কিন্তু সিয়ামের মধ্যে এমন কিছু নেই। যা লোকেরা দেখবে বরং তা শুধু নিয়্যাতের সাথে সম্পৃক্ত যা মানুষের দৃষ্টির অগোচরে। তাই এটা বলা যুক্তিযুক্ত যে, সিয়াম শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য। আর এ ‘ইবাদাত যেহেতু শুধু আল্লাহর জন্য, তাই এর পুরস্কারও আল্লাহ স্বয়ং নিজ হাতে প্রদান করবেন। কিন্তু অন্যান্য কাজের পুরস্কার মালায়িকাহ্ (ফেরেশতা) (ফেরেশতাগণ) লিখে থাকেন।

(يَدَعُ شَهْوَتَه) ‘‘স্বীয় প্রবৃত্তির চাহিদাকে পরিত্যাগ করে’’ অর্থাৎ- সে প্রবৃত্তির এমন চাহিদাকে পরিত্যাগ করে যা সিয়াম ভঙ্গের কারণ হয়। شَهْوَتَه এর পরে طَعَامَ এর উল্লেখ দ্বারা বুঝা যায় যে, شَهْوَتَه দ্বারা উদ্দেশ্য স্ত্রী সঙ্গম এবং طَعَامَ দ্বারা সিয়াম ভঙ্গের অন্যান্য কারণ উদ্দেশ্য।

(مِنْ أَجْلِيْ) ‘‘আমার কারণে’’ অর্থাৎ- আমার নির্দেশ পালনার্থে এবং সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে।

(فَرْحَةٌ عِنْدَ فِطْرِه) একটি খুশী তার ইফতার করার সময়। কুরতুবী বলেন, এর অর্থ হলো ইফতারের মাধ্যমে তার ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর হওয়ার কারণে খুশী হয়। অনুরূপভাবে খুশী হওয়ার আরেকটি কারণ এই যে, সে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদাত সম্পন্ন করতে পেরেছে যার পুরস্কার অসীম।

(وَفَرْحَةٌ عِنْدَ لِقَاءِ رَبِّه) ‘‘আরেকটি খুশী তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়’’, অর্থাৎ- পুরস্কার প্রাপ্তির খুশী অথবা স্বীয় প্রভুর সাক্ষাত লাভের খুশী।

সিয়াম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ তা‘আলার নিকট মিস্কের সুগন্ধির চেয়েও প্রিয়, এতে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, সুগন্ধির মাধ্যমে সন্তুষ্ট হওয়া এবং দুর্গন্ধের কারণে অসন্তুষ্ট হওয়া থেকে আল্লাহর তা‘আলা পবিত্র। কেননা এটি বান্দার গুণ।

উত্তরঃ এটি একটি তুলনা মাত্র মানুষের অভ্যাস এই যে, সে সুগন্ধিকে ভালবাসে এবং তা তার নিকটবর্তী করে নেয়। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলা সিয়াম পালনকারীকে তার নিকটবর্তী করে নেয়।

অথবা এর অর্থ এই যে, মিসকের সুগন্ধ তোমাদের নিকট যে রকম পছন্দনীয় আল্লাহর নিকট সিয়াম পালনকারীর মুখের দুর্গন্ধ তার চেয়ে অধিক পছন্দনীয়।

(وَالصِّيَامُ جُنَّةٌ) ‘‘সিয়াম ঢালস্বরূপ’’ অর্থাৎ- ঢাল যেমন মানুষকে তরবারির আঘাত থেকে রক্ষা করে, অনুরূপ সিয়াম মানুষকে অপরাধে লিপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে।

(فَلَا يَرْفُثْ) ‘‘অশ্লীল কাজ করবে না’’ الرفث শব্দ দ্বারা বিভিন্ন অর্থ উদ্দেশ্য হয়। যেমন যৌনসঙ্গম, সঙ্গমের আবেদনমূলক কথাবার্তা। অধিকাংশ ‘আলিমদের মতে অত্র হাদীসে الرفث শব্দ দ্বারা অশ্লীল ও খারাপ কথাবার্তা উদ্দেশ্য। لَا يَصْخَبْ চিৎকার করবে না, অর্থাৎ- মূর্খদের মতো আচরণ করবে না। যেমন চিৎকার করা, ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, বোকার মতো আচরণ করা, ঝগড়া-বিবাদ করা- এ সকল কাজ থেকে বিরত থাকবে।

(فَإِنْ سَابَّه أَحَدٌ أَوْ قَاتَلَه) ‘‘যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে ঝগড়া করতে চায়।’’ এখানে প্রশ্ন উত্থাপন হয় যে, قاتل শব্দটি বাবে مُفَاعَلَةٌ থেকে এসেছে যার অর্থ হল উভয় পক্ষ কোন কাজে শারীক হওয়া। অথচ সিয়াম পালনকারীকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। অতএব তার পক্ষ থেকে এমন কিছু সংঘটিত হবে না যা দ্বারা বুঝা যায় যে, সে এ কাজে অংশগ্রহণ করেছে।

জওয়াবঃ এখানে مُفَاعَلَةٌ দ্বারা উদ্দেশ্য এ কাজের জন্য প্রস্ত্তত হওয়া। অর্থাৎ- একপক্ষ যখন গালি দিবে অথবা অভিসম্পাত করবে তখন সায়িম বলবে, ‘আমি সায়িম’।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-৭: সওম (রোযা) (كتاب الصوم) 7. Fasting
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে