মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) সর্বমোট হাদিসঃ ৬২৯৩ টি

পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬১-[৫] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু’আগুলোর মধ্যে এটাও ছিল, ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন্ যাওয়া-লি নি’মাতিকা ওয়া তাহাওউলি ’আ-ফিয়াতিকা ওয়া ফুজা-আতি নিকমাতিকা ওয়া জামী’ই সাখাত্বিকা’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই [আমার ওপর] তোমার নিয়ামতের ঘাটতি, [আমার ওপর হতে] তোমার নিরাপত্তার ধারাবাহিকতা, [আমার ওপর] তোমার শাস্তির অকস্মাৎ আক্রমণ এবং তোমার সমস্ত অসন্তুষ্ট হতে।)। (মুসলিম)[1]

بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ

وَعَن عبد بنِ عمرَ قَالَ: كَانَ مِنْ دُعَاءِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ سوسلم: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ زَوَالِ نِعْمَتِكَ وَتَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ وَفُجَاءَةِ نِقْمَتِكَ وَجَمِيعِ سَخَطِكَ» . رَوَاهُ مُسلم

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে বান্দার ওপর আল্লাহর দেয়া দীনী ও পার্থিব অনুগ্রহ যেগুলো আখিরাতের কাজের জন্য উপকারী এবং সেগুলোর পরিবর্তে ভাল কিছু দেয়া ছাড়া তা উঠিয়ে নেয়া থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ অনুগ্রহ প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য হতে পারে। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর অনুগ্রহ চলে যাওয়া থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এরূপ অবস্থা তখনই হয় যখন বান্দা নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না এবং যে কাজ করলে নিয়ামত আসে তার চর্চা করে না। (এটা খুবই খারাপ অবস্থা।)

(تَحَوُّلِ عَافِيَتِكَ)-এর অর্থ হলো- কান, চোখসহ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থতা চলে গিয়ে সেগুলো অসুস্থ হয়ে যাওয়া।

হঠাৎ শাস্তি বলতে এমন অবস্থায় শাস্তি আসা যে, যার ওপর শাস্তি আসছে সে শাস্তি আসার পূর্বে জানছে না যে, তার ওপর শাস্তি আসছে। এখানে শাস্তি বলতে সাধারণভাবে আল্লাহর অসন্তোষ ও শাস্তি বুঝানো হলেও বিশেষভাবে ‘‘হঠাৎ শাস্তি’’ শব্দের উল্লেখের মাধ্যমে এটা বুঝানো হচ্ছে যে, ধীরে ধীরে শাস্তি আসার থেকে হঠাৎ শাস্তি চলে আসা বেশি বিপজ্জনক।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হঠাৎ শাস্তি থেকে এজন্য আশ্রয় চেয়েছেন যে, শাস্তি হঠাৎ চলে আসলে সে ব্যক্তি তাওবাহ্ করার কোন সুযোগ পায় না। আল্লাহ যখন কোন বান্দা থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চান তখন তিনি ঐ বান্দার ওপর এমন শাস্তি দেন যা প্রতিরোধ করার কোন ক্ষমতা কারো থাকে না। এমনকি সারা দুনিয়ার সমস্ত সৃষ্টি মিলে চেষ্টা করলেও তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। যেমন কথা সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহর রাগ থেকে আশ্রয় চাওয়ার মাধ্যমে ঐ সমস্ত কাজ থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে যেগুলো আল্লাহর রাগের কারণ হয়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর রাগের প্রভাব থেকে আশ্রয় চাওয়া। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাগ থেকে এজন্য আশ্রয় চেয়েছেন যে, আল্লাহ সুবহানাহূ ওয়াতা‘আলা যখন কোন বান্দার ওপর রাগান্বিত হন তখন ঐ বান্দার ধ্বংস অনিবার্য। যদিও তা কোন তুচ্ছ বিষয়ে অথবা কোন ছোট কারণে হয়ে থাকে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬২-[৬] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে দু’আ করতেন, ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন শাররি মা- ’আমিলতু ওয়ামিন্ শাররি মা-লাম আ’মাল’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই যা আমি করেছি এবং যা আমি করিনি তার অনিষ্টতা বা অপকারিতা হতে)। (মুসলিম)[1]

بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ

وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أعمَلْ» . رَوَاهُ مُسلم

ব্যাখ্যা: ইমাম ত্বীবী (রহঃ) বলেন, যেসব জিনিস থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মুক্ত রাখা হয়েছে সেসব জিনিস থেকে আশ্রয় চাওয়ার কারণ হলো, এর দ্বারা তিনি বুঝাচ্ছেন যে, আল্লাহকে যেন ভয় করা হয়, তাঁর মহত্ব ঘোষণা করা হয়, তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী হয়, তাকে যেন অনুসরণ করা হয় এবং আল্লাহর নিকট কিভাবে, কোন্ দু‘আ করতে হয় তা বর্ণনা করা।

ইমাম শাওকানীও বলেছেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দু‘আগুলো এজন্য বলেছেন যে, তিনি তাঁর উম্মাতকে দু‘আ শিক্ষা দিচ্ছেন। তাছাড়া তার সমস্ত ‘আমলের মধ্যেই ভাল রয়েছে; কোন খারাপ নেই।

হাদীসে ব্যক্তির কৃতকর্মের মধ্য থেকে যেসব কাজ থেকে আল্লাহর নিকট মাফ চাওয়া প্রয়োজন হয় সেগুলো থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে।

তারপর আল্লাহর অসন্তুষ্টিমূলক যেসব কাজ ভবিষ্যতে করা হবে তার অনিষ্ট থেকেও আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে। যাতে করে ভবিষ্যতে করা হবে এমন খারাপ কাজ থেকে আল্লাহ হিফাযাত করেন। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ছাড়া কেউ নিজেকে আল্লাহর কৌশল থেকে নিরাপদ মনে করে না। তাই প্রত্যেকের উচিত অতীত ও ভবিষ্যতের খারাপ কাজ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া। ইমাম সিন্দী (রহঃ) বলেনঃ ‘‘কৃতকর্মের খারাপী থেকে’’ বলতে অতীতে যেসব গুনাহের কাজ করা হয়েছে এবং যেসব সাওয়াবের কাজ বর্জন করেছে তার অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. প্রথম অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬৩-[৭] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আ) বলতেন,

’’আল্ল-হুম্মা লাকা আস্‌লাম্‌তু, ওয়াবিকা আ-মান্‌তু, ওয়া ’আলায়কা তাওয়াক্কালতু, ওয়া ইলায়কা আনাবতু, ওয়াবিকা খ-সমতু, আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযু বি’ইয্যাতিকা লা- ইলা-হা ইল্লা- আন্‌তা, আন্ তুযিল্লানী। আন্‌তাল হাইয়্যুল্লাযী লা- ইয়ামূতু, ওয়াল জিন্‌নু ওয়াল ইন্‌সু ইয়ামূতূনা’’

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমারই কাছে সমর্পণ করলাম, তোমারই ওপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম, তোমারই ওপর ভরসা করলাম এবং তোমারই দিকে নিজকে ফিরালাম এবং তোমারই সাহায্যে [শত্রুর সাথে] লড়লাম। হে আল্লাহ! আমি পথভ্রষ্টতা হতে তোমার মর্যাদার আশ্রয় গ্রহণ করছি। তুমি ছাড়া সত্য আর কোন মা’বূদ নেই, তুমি চিরঞ্জীব, তুমি মৃত্যুবরণ করবে না, আর মানুষ আর জিন্ মৃত্যুবরণ করবে।)। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ الْإِسْتِعَاذَةِ

وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِعِزَّتِكَ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَنْ تُضِلَّنِي أَنْتَ الْحَيُّ الَّذِي لَا يَمُوتُ وَالْجِنُّ وَالْإِنْسُ يموتون»

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে আল্লাহ কর্তৃক পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো দীনের সরল, সঠিক পথ তথা হিদায়াতের পথ থেকে ও ভ্রষ্ট হওয়া থেকে আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে। ইমাম কারী বলেনঃ এ দু‘আর অর্থ হলো ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হিদায়াত দেয়ার পর এবং তোমার বিধি-বিধান ও সিদ্ধান্তসমূহের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের তাওফীক দেয়ার পর তা থেকে ভ্রষ্ট হওয়া থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’’ এদিকেই ইশারা দেয়া হয়েছে কুরআনে বর্ণিত নিম্নোক্ত দু‘আতে। আল্লাহ বলেনঃ

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا

‘‘হে আমাদের রব! তুমি আমাদের হিদায়াত দেয়ার পর আমাদের অন্তরকে বক্র করে দিও না।’’ (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ৮)

‘‘জিন্ ও মানুষ মৃত্যুবরণ করবে’’- এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এজন্য যে, এ দু’ জাতিই শারী‘আতের বিধান পালনে দায়িত্বপ্রাপ্ত। অনেকে এর দ্বারা দলীল পেশ করেন যে, মালাক (ফেরেশতা) মারা যাবেন না। তবে এখানে মালায়িকাহর (ফেরেশতাদের) কথা পৃথকভাবে উল্লেখ না করা হলেও আল্লাহর বাণী ‘‘আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুই ধ্বংসশীল’’- (সূরা আল কাসাস ২৮ : ২৮৮) দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মালায়িকাহ্ও (ফেরেশতাগণও) মারা যাবেন।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬৪-[৮] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আ) বলতেন,

’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল আরবা’ই: মিন্ ’ইলমিন লা- ইয়ানফা’উ মিন্ কলবিন লা- ইয়াখশা’উ ওয়ামিন্ নাফসিন লা- তাশবা’উ ওয়ামিন দু’আ-য়িন লা- ইউসমা’উ’’

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি চারটি বিষয়ে তোমার কাছে আশ্রয় চাইঃ যে জ্ঞান কোন উপকারে আসে না, যে অন্তর ভীত-সন্ত্রস্ত হয় না, যে আত্মা তৃপ্ত হয় না এবং যে দু’আ কবূল হয় না।)। (আহমাদ, আবূ দাঊদ ও ইবনু মাজাহ)[1]

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْأَرْبَعِ: مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ وَمِنْ دُعَاءٍ لَا يُسْمَعُ . رَوَاهُ أحمدُ وَأَبُو دَاوُد وابنُ مَاجَه

ব্যাখ্যা: ‘জ্ঞান উপকারে না আসা’ অর্থ হচ্ছে যে, জ্ঞান নিজের বা অপরের উপকারে আসে না; ঐ জ্ঞান অনুযায়ী ‘আমলের মাধ্যমে দুনিয়ায়ও সে উপকৃত হতে পারে না আর আখিরাতেও ঐ জ্ঞান অনুযায়ী ‘আমলের সাওয়াব দ্বারা উপকৃত হবে না। আর অনুপকারী জ্ঞান হলো ঐ জ্ঞান যা আল্লাহর উদ্দেশে অর্জিত হয় না এবং যে জ্ঞানের সাথে তাকওয়া সম্পৃক্ত থাকে না, সে জ্ঞান।

দুনিয়ার প্রতি লোভী অন্তর কখনো পরিতৃপ্ত হয় না। তবে জ্ঞান অর্জন ও উত্তম কাজের প্রতি আগ্রহ প্রশংসিত। এজন্যই আল্লাহ দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন,وَقُلْ رَّبِّ زِدْنِيْ عِلْمًا ‘‘বলো, হে রব! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও’’- (সূরা ত্ব-হা- ২০ : ১১৪)।

জ্ঞানের দাবী হলো, তা থেকে উপকৃত হতে হবে। যদি ঐ জ্ঞান দ্বারা উপকৃত না হওয়া যায় তাহলে ঐ জ্ঞান জ্ঞানীর জন্য বিপদের কারণ হবে। তাই তা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া উচিত। অন্তরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এ উদ্দেশে যে, তা তার স্রষ্টার ভয়ে ভীত হবে, তার জন্যে প্রসারিত হবে এবং আলো বিচ্ছুরণ ঘটাবে। যদি কোন অন্তর এরূপ না করে তাহলে বুঝতে হবে ঐ অন্তর কঠোর হয়ে গেছে। তাই প্রত্যেকের উচিত এমন অন্তর থেকে আশ্রয় চাওয়া।

আত্মাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এজন্যে যে, তা প্রতারণাপূর্ণ এ দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে স্থায়ী বাসস্থান (জান্নাত)-এর দিকে ধাবিত হবে। যখন এ আত্মা দুনিয়ার প্রতি লোভী হয় এবং অতৃপ্ত হয় তখন ঐ আত্মা মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুতে রূপান্তরিত হয়। তখন এ জাতীয় আত্মা থেকে আশ্রয় চাওয়া কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।

আর যখন কোন দু‘আকারীর দু‘আ কবূল করা হয় না তখন প্রমাণিত হয় যে, তার জ্ঞান ও ‘আমল দ্বারা সে উপকৃত হতে পারেনি এবং তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়নি এবং পরিতৃপ্তও হয়নি।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬৫-[৯] তিরমিযী ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর (রাঃ) হতে এবং নাসায়ী উভয় হতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।[1]

وَرَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو. وَالنَّسَائِيّ عَنْهُمَا


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬৬-[১০] ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচটি বিষয় হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতেনঃ ভীরুতা, কৃপণতা, বয়সের অনিষ্টতা, অন্তরের কুমন্ত্রণা ও কবরের ’আযাব। (আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]

وَعَنْ عُمَرَ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَعَوَّذُ مِنْ خَمْسٍ: مِنَ الْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَسُوءِ الْعُمُرِ وَفِتْنَةِ الصَّدْرِ وَعَذَابِ القَبرِ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে যে পাঁচটি বিষয় থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর তিনটি সম্পর্কে ইতোপূর্বে আলোচনা হয়েছে। এখানে বাড়তি দু’টির প্রথমটি হলো বয়সের অনিষ্টতা। এখানে বয়সের অনিষ্টতা বলতে বৃদ্ধাবস্থা বা বৃদ্ধাবস্থার শেষ স্তরের কথা বলা হচ্ছে যখন ঐ বৃদ্ধ ব্যক্তির বুদ্ধি-বিবেচনা লোপ পায়, বুঝ-ব্যবস্থা হ্রাস পায়, শারীরিক শক্তি কমে, তখন সে শিশুর মতো আচরণ করে। এ বয়সটির জীবন কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। এ বয়স থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা এজন্যও বলা হতে পারে যে, তখন ঐ ব্যক্তির পক্ষে ‘আমলে সালিহ করা সম্ভব হয় না।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি তা হলো অন্তরের ফিতনা। অন্তরের ফিতনা বলতে শয়তান যার দ্বারা ব্যক্তির অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয় তা বুঝানো হয়েছে। কারো মতে এর দ্বারা অন্তরের কাঠিন্যতা, কঠোরতা, দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি বুঝাচ্ছে। কারো মতে অন্তরের মৃত্যু, ভ্রান্তি, হিংসা, খারাপ চরিত্র, বাতিল ‘আক্বীদাহ্ পোষণ, সত্য গ্রহণে বাধা দেয়া, দুনিয়ার প্রতি আসক্তি ও আখিরাত থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি বুঝানো হচ্ছে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬৭-[১১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আয়) বলতেনঃ ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল ফাকরি, ওয়াল কিল্লাতি ওয়ায্ যিল্লাতি ওয়া মিন্ আন্ আযলিমা আও উযলামা’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অস্বচ্ছলতা, স্বল্পতা, অপমান-অপদস্ত হতে আশ্রয় প্রার্থনা করি এবং আমি অত্যাচারী অথবা অত্যাচারিত হওয়া হতেও তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। (আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْفَقْرِ وَالْقِلَّةِ وَالذِّلَّةِ وَأَعُوذُ مِنْ أَنْ أَظْلِمَ أَوْ أُظْلَمَ» رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ

ব্যাখ্যা: (الْفَقْرِ) ‘‘আল ফাকর’’ বা দরিদ্রতা বলতে এখানে সম্পদহীনতা বা সম্পদের স্বল্পতাকে বুঝানো হচ্ছে। সম্পদ না থাকলে বা কম থাকলে ধৈর্য ধারণ করতে না পারা এক ধরনের ফিতনা। তাই এ থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। তবে কারো মতে এখানে অন্তরের দারিদ্র্যতাকে বুঝানো হয়েছে। সম্পদশালী ব্যক্তি যখন সম্পদের প্রতি লোভী হয়ে আরো বেশি অর্থ-সম্পদ অর্জনে ঝাপিয়ে পড়ে তখন সে মূলত ধনী হলেও অন্তরের দিক থেকে ফকীর।

(الْقِلَّةِ) ‘‘আল কিল্লাহ্’’ বা স্বল্পতা দ্বারা এখানে সম্পদের এমন স্বল্পতা বুঝানো হয়েছে যতটুকু সম্পদ না থাকায় সে সঠিকভাবে ‘ইবাদাত পালন করতে পারে না। কারো মতে এর দ্বারা ধৈর্যের স্বল্পতা বা সাহায্যকারীর স্বল্পতা বুঝাচ্ছে। কারো কারো মতে, এর দ্বারা সৎ কাজের সুযোগের ও উত্তম স্বভাবের স্বল্পতা বুঝানো হচ্ছে।

(الذِّلَّةِ) ‘‘আয্ যিল্লাহ্’’ বা অপমান হতে আশ্রয় চাওয়া অর্থাৎ মানুষের চোখে অপমানিত ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হওয়া থেকে আশ্রয় চাওয়া। কারো কারো মতে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে গুনাহের কারণে যে অপমানের সম্মুখীন হতে হয় তা।

উল্লেখ্য যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ‘‘হে আল্লাহ! আমাকে মিসকীন হিসেবে বাঁচিয়ে রাখুন’’- এর সাথে অত্র হাদীসে দারিদ্র্যতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কোন বিরোধ নেই। কারণ ঐ হাদীসে মিসকীন বলতে বিনয়, নম্রতা, অহংকারী না হওয়াকে বুঝানো হয়েছে; ফকীর হওয়াকে নয়।

এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য মূল গ্রন্থ ‘‘মির্‘আত’’-এ সংশিস্নষ্ট হাদীসের আলোচনা দেখুন।

অত্যাচার করা বলতে যে কোন ধরনের অত্যাচার (যুলম) হোক তা নিজের ওপর কিংবা অপরের ওপর। আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে নিজের ওপর যে যুলম করা হয় তাও এর অন্তর্ভুক্ত। যুলম বলতে মূলত কোন বস্ত্তকে ঐ বস্ত্তর জন্যে নির্ধারিত স্থানে না রাখা অথবা অন্য কারো অধিকার লঙ্ঘন করা। নিজে অত্যাচারিত হওয়া বলতে অন্য কারো দ্বারা যুল্মের শিকার হওয়া। (অত্যাচার করা যেমন অন্যায় অত্যাচারিত হওয়াও ঠিক তেমনই অন্যায়।)


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬৮-[১২] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আয়) বলতেন, ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাশ্ শিকা-কি, ওয়ান্ নিফা-কি ওয়া সূয়িল আখলা-ক’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি সত্যের বিরুদ্ধাচরণ, মুনাফিক্বী ও চরিত্রহীনতা হতে তোমার কাছে আশ্রয় চাই)। (আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]

وَعَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الشِّقَاقِ وَالنِّفَاقِ وَسُوءِ الْأَخْلَاقِ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ

ব্যাখ্যা: (شِقَاقِ) ‘শিকা-ক’ বলতে এখানে সত্যের বিরোধিতা করাকে বুঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

بَلِ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي عِزَّةٍ وَشِقَاقٍ

‘‘কিন্তু কাফিরগণ ঔদ্ধত্য ও বিরোধিতায় ডুবে আছে।’’ (সূরা সাদ ৩৮ : ০২)

(النِّفَاقِ) ‘‘আন্ নিফাক’’ অর্থ অন্তরে কুফরকে গোপন রেখে বাহ্যিকভাবে ইসলাম প্রকাশ করা। এখানে ‘নিফাক’ বলতে বেশি বেশি মিথ্যা কথা বলা, আমানাতের খিয়ানাত করা, ওয়া‘দা ভঙ্গ করা, ঝগড়ার সময় গালি-গালাজ করাকেও বুঝানো হতে পারে।

‘‘চরিত্রের অসাধুতা’’ (سُوْءِ الْأَخْلَاقِ) দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে উদারতা ও চেহারার প্রফুল্লতার বিপরীত কিছু। ইবনুল মালিক-এর মতে এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, সত্যানুসারীদের কষ্ট দেয়া, পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের কষ্ট দেয়া, তাদের ক্ষেত্রে অন্যায়ভাবে কঠোর আচরণ করা এবং তাদের থেকে কোন ভুল বা পাপ প্রকাশিত হলে তা ক্ষমাসুন্দর চোখে না দেখা।

উল্লেখ্য যে, অত্র হাদীসে উল্লিখিত প্রথম দু’টি বিষয়ও তৃতীয় বিষয়টির অন্তর্ভুক্ত মনে হলেও তৃতীয় বিষয়টি দ্বারা গোপন গুণাবলী বুঝানো হচ্ছে আর প্রথম দু’টি প্রকাশ্য খারাপ গুণ।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৬৯-[১৩] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আয়) বলতেনঃ

’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা, মিনাল জূ’ই ফাইন্নাহূ বি’সায্ যজী’উ, ওয়া আ’ঊযুবিকা মিনাল খিয়া-নাতি ফাইন্নাহা- বি’সাতিল বিত্বা-নাহ্’’

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অভুক্ত হতে আশ্রয় চাই, কেননা তা মানুষের কতই না খারাপ নিদ্রা-সাথী এবং তোমার কাছে আশ্রয় চাই বিশ্বাসঘাতকতা হতে, কেননা বিশ্বাসঘাতকতা কতই না মন্দ অদৃশ্য স্বভাব।)। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহ)[1]

وَعَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْجُوعِ فَإِنَّهُ بِئْسَ الضَّجِيعُ وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْخِيَانَةِ فَإِنَّهَا بِئْسَتِ الْبِطَانَةُ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ وَابْن مَاجَه

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসের প্রথমে ক্ষুধা থেকে আশ্রয় চাওয়া অর্থ হচ্ছে পেটে খাবার না থাকার কারণে প্রাণীরা যে কষ্ট অনুভব করে সে কষ্ট থেকে আশ্রয় চাওয়া। এর থেকে আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে এ জন্যে যে, ব্যক্তির শরীরের উপর ক্ষুধার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ক্ষুধাহীনতা ব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে ও অভ্যন্তরীণভাবে শক্তিশালী করে এবং ক্ষুধা আল্লাহর আনুগত্যমূলক ও কল্যাণ কাজ থেকে বিরত রাখে। ক্ষুধাকে ঘুমের মন্দ সাথী বলা হয়েছে এজন্য যে, এটি ব্যক্তিকে ‘ইবাদাত পালনে বাধা দেয়, মস্তিষ্ককে বিশৃঙ্খল করে, বিভ্রান্তিমূলক চিন্তা ও বাতিল ধ্যান-ধারণার উদ্রেক ঘটায় এবং সর্বোপরি রাতে ঘুমাতে দেয় না।

খিয়ানাত হলো আমানাতের বিপরীত। ইমাম ত্বীবী বলেনঃ খিয়ানাত হলো গোপনে অঙ্গীকার ভঙ্গের মাধ্যমে সত্যের বিরোধিতা করা। বাহ্যিকভাবে এটি সমস্ত শার‘ঈ দায়িত্বকে শামিল করে। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে বলেছেন। (দেখুন: সূরা আল আহযা-ব ৩৩ : ৭২, সূরা আল আনফাল ৮ : ২৭)

যখন মানুষ থেকে খিয়ানাতকে আড়াল রাখা হয়, প্রকাশ করা হয় না। তখন তাকে (بِطَانَةُ) ‘‘বিত্বা-নাহ্’’ বলে। ইমাম ত্বীবী বলেন, ‘‘বিত্বা-নাহ্’’ হলো প্রকাশ্যের বিপরীত।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭০-[১৪] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আয়) বলতেনঃ

’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুযা-মি, ওয়াল জুনূনি, ওয়ামিন্ সাইয়্যিয়িল আসক্বা-ম’’

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি শ্বেতরোগ, কুষ্ঠরোগ, উম্মাদনা ও কঠিন রোগসমূহ হতে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি)। (আবূ দাঊদ ও নাসায়ী)[1]

وَعَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبَرَصِ وَالْجُذَامِ وَالْجُنُونِ وَمِنْ سَيِّئِ الأسقام» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالنَّسَائِيّ

ব্যাখ্যা: এ হাদীসে খারাপ রোগ দ্বারা সকল নিকৃষ্ট রোগকে বুঝানো হয়েছে। সেসব রোগ থেকে মানুষ পলায়ন করে। যেমন- শোথ (স্ফীতিরোগ), পক্ষাঘাত, যক্ষ্মা বা দীর্ঘ কোন রোগ।

হাদীসে উল্লিখিত তিনটি রোগ যদিও শেষোক্ত নিকৃষ্ট রোগের অন্তর্ভুক্ত তারপরও ঐ রোগগুলো শুধু ‘আরবদের নিকট নয়, বরং সকল মানুষের নিকট নিকৃষ্ট রোগ হিসেবে পরিচিত বিধায় সেগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সকল রোগ থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়নি, বরং ঐ সকল রোগ থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে যেগুলো নিকৃষ্ট। তাছাড়া এ নিকৃষ্ট রোগগুলো হলে কাছের সাথীও ছেড়ে চলে যায়। যেমন- কোন ব্যক্তি পাগল হলে তার সাথীকে সে হত্যাও করে ফেলতে পারে। সে ভয়ে সে তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। তাই এ ধরনের রোগ থেকে আশ্রয় চাওয়ার দু‘আ শিখানো হয়েছে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭১-[১৫] কুত্ববাহ্ ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (দু’আ) বলতেন, ’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন্ মুনকারা-তিল আখলা-কি, ওয়াল আ’মা-লি, ওয়াল আহ্ওয়া-য়ি’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে মন্দ স্বভাব, অসৎ কাজ ও খারাপ আশা-আকাঙ্খা হতে আশ্রয় চাই)। (তিরমিযী)[1]

وَعَن قُطْبةَ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ مُنْكَرَاتِ الْأَخْلَاق والأعمال والأهواء» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ

ব্যাখ্যা: ‘‘মুনকার’’ বলা হয় ঐ কথা ও কাজকে শারী‘আতের দৃষ্টিতে যার কোন ভাল গুণ নেই অথবা শারী‘আতের দৃষ্টিতে যার খারাপ দিক স্পষ্ট। ‘‘আখলাক’’ বলতে অপ্রকাশ্য কর্মকে বুঝায়। যেমন- বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা, কৃপণতা, কাপুরুষতা বা এ জাতীয় কোন কর্মকান্ড। মন্দ চরিত্র থেকে আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে এজন্যে যে, এগুলো সকল খারাপকে টেনে আনে এবং সকল ভালকে দূরে ঠেলে দেয়।

মন্দ কাজ বলতে সকল সগীরাহ্ ও কাবীরাহ্ গুনাহের কাজ। যেমন- হত্যা, ব্যভিচার, মদপান, চুরি ইত্যাদি বুঝানো হচ্ছে।

মন্দ আকাঙ্খা বা মন্দ প্রবৃত্তি বলতে কুরআন ও সুন্নাহ বর্জিত যে কোন ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ্-বিশ্বাসকে বুঝানো হচ্ছে। যেমন- জাবারিয়্যাহ্, কদারিয়্যাহ্, খারিজী, শী‘আ বা তাদের মতো অন্যান্য প্রবৃত্তির অনুসারীদের ‘আক্বীদাহ্। এগুলো থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হচ্ছে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭২-[১৬] শুতায়র ইবনু শাকাল ইবনু হুমায়দ (রহঃ) তাঁর পিতা শাকাল (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি একদিন বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমাকে এমন একটি দু’আ শিখিয়ে দিন, যা দিয়ে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে পারি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, পড়-

’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিন্ শাররি সাম্’ঈ, ওয়ামিন্ শাররি বাসারী, ওয়া শাররি লিসা-নী ওয়া শাররি কলবী ওয়া শাররি মানিয়্যি’’

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই- আমার কানের [মন্দ শোনার] অনিষ্টতা, চোখের [দেখার] অনিষ্টতা, আমার মুখের [বলার] অনিষ্টতা, আমার কলবের [অন্তরের চিন্তা-ভাবনার] অনিষ্টতা ও বীর্যের [যিনা-ব্যভিচারের] অনিষ্টতা হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য।)। (আবূ দাঊদ, তিরমিযী ও নাসায়ী)[1]

وَعَنْ شُتَيْرِ بْنِ شَكَلِ بْنِ حُمَيْدٍ عَنْ أَبِيه قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللَّهِ عَلِّمْنِي تَعْوِيذًا أَتَعَوَّذُ بِهِ قَالَ: «قُلِ اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بك من شَرّ سَمْعِي وَمن شَرّ بَصَرِي وَشَرِّ لِسَانِي وَشَرِّ قَلْبِي وَشَرِّ مَنِيِّي» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد وَالتِّرْمِذِيّ وَالنَّسَائِيّ

ব্যাখ্যা: দু‘আটির ব্যাখ্যা এরূপ হতে পারে যে, হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই আমার কানের অনিষ্টতা থেকে যাতে আমি এমন কিছু না শুনি যা শুনা অপছন্দনীয়। যেমন- মিথ্যা কথা, অপবাদ, গীবত সহ যে কোন অবাধ্যতামূলক (গুনাহের) কথা। আবার যা শুনা উচিত। যেমন- সত্য কথা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ ইত্যাদি শোনা থেকে যেন বঞ্চিত না হই।

চোখের অনিষ্টতা বলতে অপছন্দনীয় কিছু দেখা। যেমন- হারাম কিছু দেখা। মুখের অনিষ্টতা বলতে অনুপকারী কিছু বলা, কারণ বেশিরভাগ ভুল মুখের দ্বারাই সংঘটিত হয়। উপরোক্ত অঙ্গসমূহের অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা এজন্যে বলা হয়েছে যে, এগুলো হচ্ছে সকল স্বাদ ও যৌন আসক্তির উৎস মূল।

অন্তরে অনিষ্টতা বলতে কোন ভ্রান্ত বিশ্বাস লালন করা বা হিংসা, বিদ্বেষ, দুনিয়ার প্রতি আসক্তি, সৃষ্টিকে ভয় করা, জীবিকা বন্ধ হওয়ার ভয় ইত্যাদি বুঝায়।

বীর্যের অনিষ্টতা বলতে যিনার প্রাথমিক স্তরসমূহ যেমন দেখা, স্পর্শ, চুমু দেয়া, একসাথে পথ চলা ইত্যাদির কোনটিতে সম্পৃক্ত হওয়া এবং এর মাধ্যমে ক্রমশ যিনা পর্যন্ত পৌঁছা।

বিশেষ করে উপর্যুক্ত জিনিসগুলো থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে এজন্য যে, এগুলো সকল অনিষ্টের মূল বা কর্মসূচি।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭৩-[১৭] আবূল ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে দু’আ করতেন,

’’আল্ল-হুম্মা ইন্নী আ’ঊযুবিকা মিনাল হাদমি ওয়া আ’ঊযুবিকা মিনাত্ তারাদ্দী ওয়ামিনাল গরাকি ওয়াল হারক্বি ওয়াল হারামি ওয়া আ’ঊযুবিকা মিন্ আন্ ইয়াতাখব্বাত্বানিশ্ শায়ত্ব-নু ’ইন্‌দাল মাওতি ওয়া আ’ঊযুবিকা মিন্ আন্ আমূতু ফী সাবীলিকা মুদবিরান ওয়া আ’ঊযুবিকা মিন্ আন্ আমূতা লাদীগা-’’

(অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই [আমার ওপর] কিছু ধসে পড়া হতে। হে আল্লাহ! উপর হতে পড়া, পানিতে ডুবা, আগুনে পোড়া ও বার্ধক্য হতেও আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই। আরো আশ্রয় চাই তোমার কাছে মৃত্যুর সময় শয়তানের প্ররোচনায় নিমজ্জিত হওয়া হতে। আর তোমার পথ হতে পৃষ্ঠপ্রদর্শনরত [জিহাদের ময়দান হতে পিছ পা] অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা হতেও আশ্রয় চাই। আরো আশ্রয় চাই দংশিত হয়ে মৃত্যুবরণ করা হতে।)। (আবূ দাঊদ, নাসায়ী; নাসায়ীর অপর এক বর্ণনায় আরো রয়েছে ’’এবং শোক’’ হতে)[1]

وَعَن أبي الْيُسْر أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَدْعُو: «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَدْمِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ التَّرَدِّي وَمِنَ الْغَرَقِ وَالْحَرْقِ وَالْهَرَمِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ يَتَخَبَّطَنِي الشَّيْطَانُ عِنْدَ الْمَوْتِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ أَمُوتَ فِي سَبِيلِكَ مُدْبِرًا وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ أَمُوتَ لَدِيغًا»
رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ وَزَادَ فِي رِوَايَةٍ أُخْرَى «الْغم»

ব্যাখ্যা: (هَدْمِ) ‘‘হাদম’’ অর্থ হচ্ছে কোন কিছু যেমন বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়া। (تَرَدِّىْ) ‘‘তারদ্দী’’ অর্থ হচ্ছে কোন উঁচু স্থান হতে নিচে পতিত হওয়া। যেমন উঁচু পাহাড় বা সুউচ্চ ছাদ থেকে নিচে পড়া। এর দ্বারা কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়াও বুঝায়।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্র হাদীসে উল্লিখিত প্রথম চারটি বিষয় থেকে আশ্রয় চেয়েছেন এজন্য যে, এগুলো ব্যক্তির উপর হঠাৎ করে চলে আসে। এমতাবস্থায় হয়তো ঐ ব্যক্তি ওয়াসিয়্যাত, দান কিছুই করার সুযোগ পায় না।

শয়তানের গোমরাহী বলতে শয়তান কর্তৃক দীনী ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিভ্রাট তৈরি করা। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, শয়তান কারো মৃত্যুর সময় ঐ ব্যক্তিকে ফিতনায় ফেলার চেষ্টা করে, তার জন্য যা খারাপ তাকে তার সামনে ভাল হিসেবে এবং তার জন্যে ভালকে খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করে। খাত্ত্বাবীর মতে শয়তান কারো মৃত্যুর সময় তাকে পথভ্রষ্ট করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। ঐ ব্যক্তি যেন তাওবাহ্ না করতে পারে এবং সংশোধন না হতে পারে সে চেষ্টা করে। তাকে আল্লাহর রহমাত থেকে নিরাশ করে অথবা মৃত্যুকে তার নিকট অপ্রিয় করে তোলে, দুনিয়ার জীবনের প্রতি বিতশ্রুদ্ধ হয়। দুনিয়া ছেড়ে আখিরাতের পানে চলে যাওয়ার আল্লাহর সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারে না। ফলে তার জীবনটি শেষ হয় খারাপভাবে এবং আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাৎ ঘটে এমতাবস্থায় যে, আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট থাকেন।

যুদ্ধের ময়দানে কাফিরদের সাথে যুদ্ধরত অবস্থায় সেখান থেকে পিঠ ফিরিয়ে পালিয়ে যাওয়া হারাম। তাই এরূপ হারাম কাজ থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়েছে। এখানে হক থেকে মুখ ফিরানোও উদ্দেশ্য হতে পারে।

দংশিত হওয়া বলতে সাপ, বিচ্ছু বা এ জাতীয় যেসব প্রাণীর দংশনে বিষ থাকে সেসব প্রাণীর দংশনে মৃত্যু হওয়া থেকেও আশ্রয় চাওয়া উচিত। কারণ এরূপ হঠাৎ মৃত্যু কাম্য নয়।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭৪-[১৮] মু’আয (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা আল্লাহর কাছে লোভ-লালসা হতে আশ্রয় চাও, যে লোভ-লালসা মানুষকে দোষ-ত্রুটির দিকে এগিয়ে দেয়। (আহমাদ, বায়হাক্বী- দা’ওয়াতুল কাবীর)[1]

وَعَنْ مُعَاذٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أستعيذُ بِاللَّهِ مِنْ طَمَعٍ يَهْدِي إِلَى طَبَعٍ)
رَوَاهُ أَحْمد وَالْبَيْهَقِيّ فِي الدَّعْوَات الْكَبِير

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে লালসা বলতে কোন জিনিসের প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক, আগ্রহ, লোভকে বুঝানো হয়েছে। এর থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে এজন্যে যে, এ লালসা ব্যক্তিকে ক্রমশ প্রবৃত্তির অনুসরণ, দোষ-ত্রুটি, গুনাহের কাজ, গোপন খারাপ কাজের দিকে নিয়ে যায়। যেমন- দুনিয়ার বিনয়ী হওয়া, মানুষকে শুনানোর জন্যে ও দেখানোর জন্যে কাজ করা ইত্যাদি যা মানুষ তার প্রবৃত্তির লোভের বশবর্তী হয়ে করে। এজন্যই বলা হয়,  الطمع فساد الدين والورع صلاحه

অর্থাৎ- ‘‘লালসা দীনকে ধ্বংস করে আর পরহেজগারিতা দীনকে সংরক্ষণ করে।’’


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭৫-[১৯] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ’’হে ’আয়িশাহ্! আল্লাহর কাছে এর অনিষ্টতা হতে আশ্রয় চাও। কারণ এটা হলো সেই গ-সিক বা অস্তগামী যখন তা অন্ধকার হয়ে যায়।’’ (তিরমিযী)[1]

وَعَنْ عَائِشَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ فَقَالَ: «يَا عَائِشَةُ اسْتَعِيذِي بِاللَّهِ مِنْ شَرِّ هَذَا فَإِنَّ هَذَا هُوَ الْغَاسِقُ إِذا وَقب» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে (غَاسِقُ) ‘‘গ-সিক’’ তথা অন্ধকারাচ্ছন্ন চাঁদ থেকে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ‘‘গ-সিক’’ বলতে দু’টি জিনিস বুঝানো হতে পারে। প্রথমত চন্দ্র গ্রহণের সময়, চন্দ্র যখন নিস্প্রভ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় সে সময়, দ্বিতীয়ত চন্দ্র ডুবে গেলে, পৃথিবী যখন অন্ধকারাচ্ছনণ হয়ে যায় সে সময়। এখানে যে গা-সিক থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে তা থেকেই সূরা আল ফালাক-এর তৃতীয় আয়াতে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে। সেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ

‘‘(আমি আশ্রয় চাই) রাতের অন্ধকারের অনিষ্ট হতে, যখন তা গভীর হয়।’’ (সূরা আল ফালাক ১১৩ : ৩)

এখানে মূলত গ-সিক বলতে অন্ধকার রাতকে বুঝানো হয়েছে। অন্ধকার রাত থেকে আশ্রয় চাওয়ার নির্দেশ এজন্য দেয়া হয়েছে যে, ঐ সময় যাদু করা হয়, রোগ-বিপদ ছড়িয়ে পড়ে। এখানে ঐ অন্ধকার রাতের অনিষ্ট থেকে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭৬-[২০] ’ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পিতা হুসায়নকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কতজন মা’বূদের পূজা করছো? আমার পিতা বললেন, সাতজনের- তন্মধ্যে ছয়জন মাটিতে আর একজন আকাশে। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আশা-নিরাশার ও ভয়-ভীতির সময় কাকে মানো (কোন্ মা’বূদকে ডাকো)? আমার পিতা বললেন, যিনি আকাশে আছেন তাকে মানি। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তবে শুন হুসায়ন! যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ করো, আমি তোমাকে দু’টি কালিমা শিখাবো, যা তোমার উপকারে (পরকালীন মুক্তি) আসবে। বর্ণনাকারী [’ইমরান (রাঃ)] বলেন, আমার পিতা হুসায়ন ইসলাম গ্রহণ করার পর বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমাকে ঐ কালিমা দু’টি শিখিয়ে দিন, যার কথা আপনি আমাকে ওয়া’দা দিয়েছিলেন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তুমি (সেই আসমানের মা’বূদকে) বলো, ’’আল্ল-হুম্মা আলহিম্‌নী রুশদী, ওয়া আ’ইযনী মিন শাররি নাফসী’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে সত্য পথের সন্ধান দাও এবং আমার নাফসের অপকারিতা হতে রক্ষা করো)। (তিরমিযী)[1]

وَعَن عمرانَ بنِ حُصينٍ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لأبي: «يَا حُصَيْن كم تعبد الْيَوْم إِلَهًا؟» قَالَ أَبِي: سَبْعَةً: سِتًّا فِي الْأَرْضِ وواحداً فِي السَّماءِ قَالَ: «فَأَيُّهُمْ تَعُدُّ لِرَغْبَتِكَ وَرَهْبَتِكَ؟» قَالَ: الَّذِي فِي السَّمَاءِ قَالَ: «يَا حُصَيْنُ أَمَا إِنَّكَ لَوْ أَسْلَمْتَ عَلَّمْتُكَ كَلِمَتَيْنِ تَنْفَعَانِكَ» قَالَ: فَلَمَّا أَسْلَمَ حُصينٌ قَالَ: يَا رسولَ الله علِّمني الكلمتينِ اللَّتينِ وَعَدتنِي فَقَالَ: «قل اللَّهُمَّ أَلْهِمْنِي رُشْدِي وَأَعِذْنِي مِنْ شَرِّ نَفْسِي» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী ‘ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ)-কে যে ছোট দু‘আটি শিক্ষা দিয়েছেন তার প্রথম অংশের (الرُشْدِ) ‘‘রুশ্দ’’ বলতে মূলত সত্যের পথকে শক্তভাবে ধরে তার উপর দৃঢ় থাকা। ‘আল্লামা কারী বলেনঃ প্রথম অংশের অর্থ হলোঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে রুশ্দ তথা সততার অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন।

দু‘আটির দ্বিতীয় অংশের অর্থ হলো, ‘হে আল্লাহ! অন্তরের অনিষ্ট বা অপকারিতা থেকে আমাকে রক্ষা করো’, নিশ্চয়ই অন্তরই হচ্ছে সকল অনিষ্টের মূল বা উৎস। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেনঃ এ হাদীসটি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘‘জাওয়ামি‘উল কালিম’’ (স্বল্প কথায় বেশি অর্থবোধক বাক্য)-এর অন্যতম। এ ছোট দু‘আটিতে তিনি রুশদ তথা সত্য পথের নির্দেশনা চেয়েছেন। যার মাধ্যমে সকল ভ্রান্তি, পথভ্রষ্টতা থেকে নিরাপদ থাকা যায় এবং তিনি অন্তর থেকে উৎসারিত অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন। যার মাধ্যমে অধিকাংশ আল্লাহদ্রোহী কাজ সংঘটিত হয়। আর অধিকাংশ আল্লাহদ্রোহী কাজ খারাপ কাজের আদেশদাতা অন্তর (النفس الأمارة بالسوء) ‘‘আন নাফ্সুল আম্মারাহ্ বিস্সূয়ি’’ এর দ্বারা প্ররোচনা লাভ করে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭৭-[২১] ’আমর ইবনু শু’আয়ব তাঁর পিতার মাধ্যমে তার দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে কেউ যখন ঘুমের মধ্যে ভয় পায় সে যেন বলে,

’’আ’ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত্ তা-ম্মা-তি মিন্ গাযাবিহী ওয়া ’ইকাবিহী ওয়া শার্‌রি ’ইবা-দিহী ওয়ামিন্ হামাযা-তিশ্ শায়া-ত্বীনি ওয়া আন্ ইয়াহ্‌যুরূন’’

(অর্থাৎ- আমি আল্লাহর পূর্ণ বাক্যসমূহের মাধ্যমে আশ্রয় চাই, আল্লাহর ক্রোধ ও তার শাস্তি হতে, তাঁর বান্দাদের অপকারিতা হতে এবং শয়তানের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হতে। আর তারা যেন আমার কাছে উপস্থিত হতে না পারে।)। এতে শয়তানের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তার ক্ষতি করতে পারবে না। বর্ণনাকারী বলেনঃ ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আমর তাঁর সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হতেন তাদেরকে এই দু’আ শিখিয়ে দিতেন, আর যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক এ দু’আ কাগজে লিখে তাদের গলায় লটকিয়ে দিতেন। (আবূ দাঊদ, তিরমিযী; হাদীসটি তিরমিযীর ভাষ্য)[1]

وَعَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِذَا فَزِعَ أَحَدُكُمْ فِي النَّوْمِ فَلْيَقُلْ: أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونَ فَإِنَّهَا لَنْ تَضُرَّهُ «وَكَانَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَمْرٍو يُعَلِّمُهَا مَنْ بَلَغَ مِنْ وَلَدِهِ وَمَنْ لَمْ يَبْلُغْ مِنْهُمْ كَتَبَهَا فِي صَكٍّ ثُمَّ عَلَّقَهَا فِي عُنُقِهِ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُدَ وَالتِّرْمِذِيّ وَهَذَا لَفظه

ব্যাখ্যা: এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নামসহ রক্ষাকবচ শিশুদের গলায় ঝুলানো জায়িয। তবে এ ব্যাপারে আরো কথা রয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে যেসব রক্ষাকবচ ও তাবীয জাহিলী যুগের কুসংস্কার হিসেবে ঝুলানো হয় সেগুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই। তবে যেসব তাবীযে আল্লাহর নাম, তাঁর গুণাবলী, কুরআনের আয়াত এবং হাদীসে বর্ণিত দু‘আসমূহ থাকে তা ঝুলানোর ক্ষেত্রে ‘আলিমগণ মতানৈক্য করেছেন। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু ‘আবদুল ওয়াহ্ব (রহঃ)-এর নাতি ‘আল্লামা শায়খ ‘আবদুর রহমান ইবনু হাসান (রহঃ) তার ‘‘ফাতহুল মাজীদ শারহি কিতাবুত্ তাওহীদ’’ গ্রন্থে বলেছেন,

‘‘জেনে রাখো! সাহাবী, তাবি‘ঈ ও তাদের পরবর্তী ‘আলিমগণ কুরআন এবং আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সমেত তাবীয ঝুলানো বৈধ হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন। তাদের একদলের মত হচ্ছে এরূপ তাবীয জায়িয। যারা এ মত দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ)। এ মতের পক্ষের দলীল হলো ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) বর্ণিত হাদীস, যেখানে তিনি বলেছেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, (إن الرقى والتولة والتمائم شرك)

অর্থাৎ- ‘‘নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক, তাবীয-কবয শির্ক।’’ (আবূ দাঊদ, ইবনু মাজাহ্, ইবনু হিব্বান, হাকিম)

তাদের মতে এ হাদীসে উল্লিখিত তাবীয বলতে শির্কযুক্ত তাবীয উদ্দেশ্য, যা হারাম।

অপরপক্ষের মত হলো, এরূপ তাবীয ঝুলানোও জায়িয নয়। এ মতের অন্যতম হলেন ইবনু মাস্‘ঊদ, ইবনু ‘আব্বাস, হুযায়ফাহ্, ‘উকবাহ্ ইবনু ‘আমির ইবনু ‘উকায়ম (রাঃ), তাবি‘ঈদের একটি বিশাল দল, ইমাম আহমাদ এবং পরবর্তী ‘উলামায়ে কিরাম (রহঃ)। তারা উপরোক্ত হাদীসও এ অর্থ প্রকাশ করে এমন অন্যান্য হাদীস (যেমন- ইবনু হিব্বানে বর্ণিত ‘উকবাহ্ ইবনু ‘আমির-এর হাদীস, আহমাদ, তিরমিযী, আবূ দাঊদ ও হাকিমে বর্ণিত ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উকায়ম -এর হাদীস) দ্বারা দলীল পেশ করেন।

শায়খ ‘আবদুর রহমান ইবনু হাসান বলেনঃ তিনটি কারণে এ শেষোক্ত মতটিই বিশুদ্ধ।

[এক] হাদীসে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞা ব্যাপকার্থক (‘আম)। এ নিষেধাজ্ঞার কোন বিশেষ (খাস) হুকম নেই।

[দুই] অন্যায়ের পথ বন্ধ করা। কারণ এ পথ খুলে রাখলে এ শর্ত না মেনে অন্যকিছু মানুষ ঝুলাবে যা বৈধ নয়।

[তিন] যদি কেউ এগুলো ঝুলায়ও তাহলে তাকে ঐ জিনিসকে অপমান করতে হয় যেমন সে ঐ তাবীযসহ বাথরুম, প্রসাবখানাসহ এরূপ অপবিত্র স্থানে যায়। যার মাধ্যমে সে প্রকারন্তরে আল্লাহর নাম ও কুরআনকে অপমানিত করে।

লেখক বলেনঃ ঐ উপরোক্ত তিনটি কারণের সাথে কেউ কেউ চতুর্থ একটি কারণ যুক্ত করেছেন যে, কুরআনের আয়াত যদি কেউ তাবীয হিসেবে ঝুলায় তাহলে সে মূলত আল্লাহর আয়াত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করল এবং কুরআন যে বিধান নিয়ে এসেছে তার বিপরীত কাজ করল।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআন অবতীর্ণ করেছেন মানবজাতির হিদায়াতের জন্য, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী হিসেবে এবং মানুষের অন্তরের ব্যাধি দূর করার জন্য। এ কুরআন মুত্তাক্বীদের জন্য স্মরণিকাও বটে। কুরআন এজন্য অবতীর্ণ হয়নি যে, এ কুরআনকে মানুষ তাবীয-কবয হিসেবে ব্যবহার করবে। আর কিছু ব্যবসায়ী এর দ্বারা অর্থ উপার্জন করবে। কবরস্থানে এটি পাঠ করা হবে এবং এ জাতীয় অন্যান্য কাজ করা হবে যেগুলো কুরআনের সম্মানের/মর্যাদার বিরোধী। ‘উলামায়ে কিরাম তাবীয ঝুলানোর পক্ষে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-এর হাদীসের জবাবে কিছু কথা বলেছেনঃ

[এক] এ হাদীসটির সানাদ য‘ঈফ। কারণ এ সানাদে মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক নামক ব্যক্তি রয়েছেন; যিনি মুদাল্লাস। যদিও এ সানাদকে ইমাম তিরমিযী হাসান এবং ইমাম হাকিম সহীহ বলেছেন।

[দুই] এ হাদীস যদি সহীহ হিসেবে ধরেও নেই তাহলে এর দ্বারা দলীল সাব্যস্ত হয় না। কারণ এ হাদীসে এ প্রমাণ নেই যে, ঐ কাজ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখেছেন এবং সমর্থন করেছেন।

[তিন] এটি ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-এর ব্যক্তিগত ‘আমল। তার এ একক ‘আমলের মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ও প্রধান সাহাবীগণের ‘আমলকে বর্জন করা যাবে না; যারা ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-এর ‘আমল অনুসরণ করেননি।

ইমাম শাওকানী ‘‘তুহফাতুয্ যাকিরীন’’ গ্রন্থে (পৃঃ ৮৯) ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-এর এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, তাবীয ঝুলানো বৈধ হওয়ার বিপক্ষে যে দলীল বর্ণিত হয়েছে তার বিপরীতে ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ)-এর হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

উপরোক্ত জবাবগুলো ছাড়াও লেখক বেশকিছু জবাব-যুক্তি-মত উল্লেখ করে শেষে বলেছেনঃ যদিও কিছু ‘আলিম আল্লাহর নাম ও কুরআনের আয়াতওয়ালা তাবীয ঝুলানো জায়িয বলেছেন তারপরও ইখলাসের দাবী ও অধিক উত্তম হলো সকল রকমের তাবীজ বর্জন করা। কারণ হাদীসে ৭০,০০০ (সত্তর হাজার) লোক হিসাব ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করবে বলে যাদের কথা বলা হয়েছে তাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা ঝাড়ফুঁক করেনি এবং করায়নি। অথচ ঝাড়ফুঁক ইসলামে জায়িয। যে ব্যাপারে হাদীস এবং আসার বর্ণিত হয়েছে। সঠিক মত সম্পর্কে আল্লাহই অধিক জানেন।


পরিচ্ছেদঃ ৬. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭৮-[২২] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তিনবার আল্লাহর কাছে জান্নাতের প্রত্যাশা করে; জান্নাত বলবে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাও। আর যে ব্যক্তি তিনবার জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা করবে; জাহান্নাম বলবে, হে আল্লাহ! তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দাও। (তিরমিযী ও নাসায়ী)[1]

وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَنْ سَأَلَ اللَّهَ الْجَنَّةَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ قَالَتِ الْجَنَّةُ: اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ الْجَنَّةَ وَمَنِ اسْتَجَارَ مِنَ النَّارِ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ قَالَتِ النَّارُ: اللَّهُمَّ أَجِرْهُ مِنَ النَّارِ رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيّ

ব্যাখ্যা: যে ব্যক্তি আল্লাহর নিকট জান্নাত কামনা করল, অর্থাৎ- সততা, নিশ্চিত বিশ্বাস ও উত্তম নিয়্যাত সহকারে তিনবার আল্লাহর নিকট জান্নাতে প্রবেশ করতে চাইল। জান্নাত চাওয়ার জন্য এভাবে দু‘আ করতে পারে (اَللّٰهُمَّ إِنِّىْ أَسْاَلُكَ الْجَنَّةَ) ‘‘আল্ল-হুম্মা ইন্নী আস্ আলুকাল জান্নাহ্’’। অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট জান্নাত চাই। অথবা বলতে পারে, (اَللّٰهُمَّ أَدْخِلْنِى الْجَنَّةَ) ‘‘আল্ল-হুম্মা আদখিলনিল জান্নাহ্’’। অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করান।

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যে কোন দু‘আ তিনবার করে বলা উত্তম ও দু‘আর আদবের অন্তর্ভুক্ত। এ হাদীস দ্বারা আরো প্রমাণ হয় যে, জড়বস্ত্তও কথা বলতে পারে। তবে এখানে কারো মতে, জান্নাত বলতে জান্নাতের অধিবাসী যেমন- হূর, শিশু, রক্ষীগণকে বুঝানো হয়েছে।

জাহান্নাম থেকে আশ্রয় বা পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য এ দু‘আ পড়া যেতে পারে, (اَللّٰهُمَّ أَجِرْنِىْ مِنَ النَّارِ) ‘‘আল্ল-হুম্মা আজিরনী মিনান্না-র’’। অর্থাৎ- হে আল্লাহ! তুমি আমাকে আগুন থেকে রক্ষা কর। আগুন থেকে রক্ষা করা অর্থ হচ্ছে এতে প্রবেশ করা ও স্থায়ী হওয়া থেকে রক্ষা করা। এ হাদীসে বেশি বেশি জান্নাত চাওয়ার প্রতি এবং জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রতি উৎসাহ দেয়া হয়েছে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৭৯-[২৩] ক’ক’ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কা’ব আল আহবার বলেছেন, যদি আমি এ বাক্যগুলো না বলতাম, তবে ইয়াহূদীরা নিশ্চয়ই আমাকে গাধা বানিয়ে ফেলতো। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, সে বাক্যগুলো কি? তিনি বলেন,

’’আ’ঊযু বিওয়াজ্ হিল্লা-হিল ’আযীম আল্লাযী লায়সা শাইউন আ’যমা মিনহু, ওয়াবিকালিমা-তিল্লা-হিত্ তা-ম্মা-তিল্লাতি লা- ইউজা-বিযুহুন্না বাররুন ওয়ালা- ফা-জিরুন, ওয়াবি আসমা-য়িল্লা-হিল হুসনা-, মা- ’আলিমতু মিনহা-, ওয়ামা- লাম্ আ’লাম মিন্ শাররি মা- খলাকা ওয়া যারাআ ওয়া বারাআ’’

(অর্থাৎ- আমি মহান আল্লাহর সত্তার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তাঁর অপেক্ষা মহান আর কেউ নেই এবং আমি আল্লাহর পূর্ণ বাক্যসমূহের আশ্রয় নিচ্ছি যা অতিক্রম করার শক্তি ভালো-মন্দ কোন লোকের নেই। আমি আরো আশ্রয় চাচ্ছি আল্লাহর ’আসমা-য়ি হুসনা-’ বা উত্তম নামসমূহের, যা আমি জানি আর যা আমি জানি না তাঁর সৃষ্টির অনিষ্টতা হতে যাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেছেন ও পৃথিবীতে ছড়িয়ে রেখেছেন।)। (মালিক)[1]

عَنِ الْقَعْقَاعِ: أَنَّ كَعْبَ الْأَحْبَارِ قَالَ: لَوْلَا كَلِمَاتٌ أَقُولُهُنَّ لَجَعَلَتْنِي يَهُودُ حِمَارًا فَقِيلَ لَهُ: مَا هُنَّ؟ قَالَ: أَعُوذُ بِوَجْهِ اللَّهِ الْعَظِيمِ الَّذِي لَيْسَ شَيْءٌ أَعْظَمَ مِنْهُ وَبِكَلِمَاتِ اللَّهِ التامَّاتِ الَّتِي لَا يُجاوزُهنَّ بَرٌّ وَلَا فاجرٌ وَبِأَسْمَاءِ اللَّهِ الْحُسْنَى مَا عَلِمْتُ مِنْهَا وَمَا لَمْ أَعْلَمْ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ وَذَرَأَ وبرأ. رَوَاهُ مَالك

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে কা‘ব আল আহবার-এর উক্তি ইয়াহূদীরা আমাকে গাধা বানাবে বলে তিনি ইয়াহূদী কর্তৃক অপমানিত হওয়ার কথা বুঝিয়েছেন। কারণ গাধার সাথে কাউকে তুলনা করা মানে তাকে অপমানিত করা। তাছাড়া এর ব্যাখ্যা এমনও হতে পারে যে, ইয়াহূদীরা আমাকে যাদু করে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করত। এমনকি যাদুর প্রভাবে আমি গাধার মতো আচরণ করতাম (এমন আচরণ যে কিছুই বুঝতে পারছি না)। বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায় যে, ইয়াহূদীরা যাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল।

এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যাদু সত্য। যখন কাউকে যাদু করা হয় তখন তার খেয়াল, বুদ্ধি-বিবেচনা নষ্ট হয়ে যায়, মাথার মধ্যে খারাপ, ভ্রষ্ট চিন্তা আসে।

এ হাদীসে বর্ণিত দু‘আটি যাদুর হাত থেকে বাঁচার জন্য ও অপমানিত হওয়ার থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।


পরিচ্ছেদঃ ৬. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - আশ্রয় প্রার্থনা করা

২৪৮০-[২৪] মুসলিম ইবনু আবূ বকরা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার পিতা আবূ বকরা (রাঃ) সালাত আদায় শেষে বলতেন, ’’আল্ল-হুম্মা ইন্ আ’ঊযুবিকা মিনাল কুফরি ওয়াল ফাকরি ওয়া ’আযা-বিল কবরি’’ (অর্থাৎ- হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে কুফরী, পরমুখাপেক্ষিতা ও কবর ’আযাব হতে আশ্রয় চাই)। আর আমিও তাই বলতাম। একবার তিনি আমাকে বললেন, হে বৎস! তুমি এটা (দু’আটি) কার থেকে গ্রহণ করেছো? আমি বললাম, আপনার কাছে থেকেই তো। তখন তিনি বললেন, তবে শুন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বাক্য সালাত শেষ হবার পর বলতেন। (তিরমিযী; নাসায়ী ’সালাত শেষে’ শব্দ ছাড়া, আহমাদ শুধু দু’আটি বর্ণনা করেছেন, তবে তাঁর বর্ণনায় রয়েছে ’প্রতিটি সালাত শেষে’)[1]

وَعَن مُسلم بن أبي بَكرةَ قَالَ: كَانَ أَبِي يَقُولُ فِي دُبُرِ الصَّلَاةِ: اللَّهُمَّ إِن أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكُفْرِ وَالْفَقْرِ وَعَذَابِ الْقَبْرِ فَكُنْتُ أَقُولُهُنَّ فَقَالَ: أَيْ بُنَيَّ عَمَّنْ أَخَذْتَ هَذَا؟ قُلْتُ: عَنْكَ قَالَ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يقولهُنَّ فِي دُبرِ الصَّلاةِ. رَوَاهُ النَّسَائِيّ وَالتِّرْمِذِيّ إِلَّا أَنَّهُ لَمْ يُذْكَرْ فِي دُبُرِ الصَّلَاةِ
وَرَوَى أَحْمَدُ لَفْظَ الْحَدِيثِ وَعِنْدَهُ: فِي دُبُرِ كل صَلَاة

ব্যাখ্যা: অত্র হাদীসে কুফর বলতে সকল প্রকার কুফরকে (ছোট বা বড়, প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য) বুঝানো হচ্ছে। ফাকর বা দারিদ্র্য বলতে এমন দারিদ্র্য যার মধ্যে কোন কল্যাণ বা পরহেজগারিতা নেই। এ জন্যই বর্ণিত হয়েছে, (كاد الفقر أن يكون كفرًا) অর্থাৎ- দারিদ্র্য কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। হাদীসটি আবূ না‘ঈম তার ‘‘আল হুলিয়্যাহ্’’ গ্রন্থে এবং ইমাম বায়হাক্বী তার ‘‘শু‘আবূল ঈমান’’ গ্রন্থে আনাস (রাঃ) থেকে মারফূ' সূত্রে বর্ণনা করেছেন। হাদীসটির সানাদ য‘ঈফ। ‘আল্লামা সান্‘আনী বলেন, এ মর্মে আবূ সা‘ঈদ (রাঃ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, দারিদ্র্য ব্যক্তিকে কুফরীতে পতিত হওয়ার নিকটবর্তী করে দেয়। কারণ দারিদ্র্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্যের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করায় এবং আল্লাহ প্রদত্ত রিযক্বের প্রতি অসন্তুষ্ট করে। এভাবে ক্রমশ তা কুফরীর দিকে নিয়ে যায়- না‘ঊযুবিল্লাহ।

‘আল্লামা কারী বলেন, এখানে দারিদ্রের ফিতনা থেকে অথবা অন্তরের দারিদ্র্যতা; যা আল্লাহর অনুগ্রহকে অস্বীকার করার দিকে ব্যক্তিকে নিয়ে যায়; তা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে দারিদ্র্যকে কুফরীর সাথে একত্রে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এ হতে পারে যে, দারিদ্রের ফলে দরিদ্র ব্যক্তি তার প্রতি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বণ্টনের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারে না এবং আল্লাহ তাকে যে নিয়ামত (অনুগ্রহ) দিয়েছেন তার জন্যে তাঁর শুকরিয়া আদায় করে না। ফলে তার এ দারিদ্র্যতা তাকে ক্রমশ কুফরীর দিকে নিয়ে যায়। এক সময় সে আল্লাহকে অস্বীকার করে বসে- না‘ঊযুবিল্লাহ।

অত্র হাদীসে উল্লিখিত দু‘আটি প্রত্যেক ফরয বা নফল সালাতের সালাম ফিরানোর পূর্বে বা পরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়তেন।


দেখানো হচ্ছেঃ ২৪৬১ থেকে ২৪৮০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৬২৯৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 121 122 123 124 125 · · · 312 313 314 315 পরের পাতা »