পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৮৩-[১৯] ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) এ আয়াতটি পাঠ করলেন, (اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُم مُسلمُونَ) “...তোমরা আল্লাহকে যথার্থ ভয় কর এবং পূর্ণ মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না”- (সূরাহ আ-লি ’ইমরান ৩ : ১০২)। (অতঃপর) রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যদি ’যাক্কুম’ গাছের এক ফোঁটা এ দুনিয়ায় পড়ে, তবে সমস্ত দুনিয়াবাসীর জীবনধারণের উপকরণসমূহ ধ্বংস হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় ঐ সমস্ত লোকদের দুর্দশা কিরূপ হবে, এটা যাদের খাদ্য হবে? [ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ) হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং তিনি বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ]
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَرَأَ هَذِهِ الْآيَةَ: (اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُم مُسلمُونَ) قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَو أَن قَطْرَة من الزقوم قطرات فِي دَارِ الدُّنْيَا لَأَفْسَدَتْ عَلَى أَهْلِ الْأَرْضِ مَعَايِشَهُمْ فَكَيْفَ بِمَنْ يَكُونُ طَعَامَهُ؟» رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَقَالَ: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ
صحیح ، رواہ الترمذی (2585) [و ابن ماجہ (4325) و صححہ ابن حبان (الموارد : 2611 ، الاحسان : 7427) و الحاکم علی شرط الشیخین (2 / 294 ، 451) و وافقہ الذھبی]
ব্যাখ্যা: (اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ...) অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় করা ওয়াজিব ফরযগুলো আদায়ের মাধ্যমে এবং গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। 'আবদুল্লাহ ইবনু মাস্'উদ (রাঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন যে, তার আনুগত্য করা এবং অবাধ্যতা না করা, কৃতজ্ঞতা আদায় করা, কুফরী না করা এবং তাকে স্মরণ করা, ভুলে না যাওয়া।
(مُسلمُونَ) অর্থাৎ একত্ববাদী, নিবেদিত, বশীভূত, অনুতপ্ত এবং ভয় এবং আশার সমন্বয়কারী এবং আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা পোষণকারী। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
(الزقوم) এক প্রকারের গাছের পানি যে গাছ জাহান্নামের গোড়া থেকে একাকি বলে হবে। কেউ বলেছেন, যাক্কুম হলো একটি তিক্ত ও দুর্গন্ধময় খবীস গাছ, যা জাহান্নামীরা ভক্ষণ করতে অপছন্দ করবে।
কেউ কেউ বলেন যে, (الزقوم) হলো এক প্রকারের খাদ্য যা খেজুর ও মাখন দ্বারা তৈরি করা হত এবং তা গিলে খেতে হত। অতএব যখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করলেন, (اِنَّ شَجَرَتَ الزَّقُّوۡمِ ﴿ۙ۴۳﴾ طَعَامُ الۡاَثِیۡمِ ﴿ۖۛۚ۴۴﴾) অর্থাৎ নিশ্চয় যাক্কুম বৃক্ষ গুনাহগারদের খাদ্য”- (সূরা আদ দুখা-ন ৪৪ : ৪৩-৪৪)। তখন আবূ জাহল বলল যে, মাখন দিয়ে খেজুর গিলে খাব সমস্যা কি? তখন আল্লাহ উক্ত আয়াত নাযিল করলেন যে, এটা জাহান্নামের গোড়া থেকে গজায় এটা দুনিয়ার মতো নয়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/২৫৮৫)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৮৪-[২০] আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: আল্লাহর বাণী- (وهم فِيهَا كَالِحُونَ) “আগুন তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে”- (সূরাহ্ আল মুমিনূন ২৩ : ১০৪); এর অর্থ হলো, জাহান্নামী লোকের অবস্থা এই হবে যে, আগুনের প্রচণ্ড তাপে তার মুখ ভাঁজা-পোড়া হয়ে উপরের ঠোট সঙ্কুচিত হয়ে মাথার মধ্যস্থলে পৌছবে এবং নিচের ঠোট ঝুলে নাভির সাথে এসে লাগবে। (তিরমিযী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: (وهم فِيهَا كَالِحُونَ) قَالَ: «تَشْوِيهِ النَّارُ فَتَقَلَّصُ شَفَتُهُ الْعُلْيَا حَتَّى تَبْلُغَ وَسْطَ رَأْسِهِ وَتَسْتَرْخِي شَفَتُهُ السُّفْلَى حَتَّى تضرب سُرَّتَهُ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
اسنادہ حسن ، رواہ الترمذی (2587 وقال : حسن صحیح غریب) ۔
(ضَعِيف)
ব্যাখ্যা: (كَالِحُونَ) বিভৎস চেহারাবিশিষ্ট, এমনকি আগুন তাদের চেহারাগুলো জ্বালিয়ে দিবে। কেউ বলেছেন, তাদের দাঁতগুলো বেড়িয়ে যাবে আর এটাই রাসূল (সা.) -এর ব্যাখ্যার উপযোগী।
(মিরক্বাতুল মাফাতীহ, তুহফাতুল আহওয়াযী হা, ২৫৮৭)।
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৮৫-[২১] আনাস (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেনঃ হে মানুষ সকল! তোমরা (আল্লাহর ভয়ে) খুব বেশি বেশি ক্রন্দন কর। যদি কাঁদতে ব্যর্থ হও, তাহলে ক্রন্দনের রূপ ধারণ কর। কেননা জাহান্নামী জাহান্নামের মধ্যে কাঁদতে থাকবে, এমনকি পানির নালার মতো তাদের চেহারার অশ্রু প্রবাহিত হবে। এমন সময় অশ্রুও শেষ হয়ে যাবে এবং রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে, তাতে তার চক্ষুসমূহে এমন গভীরভাবে ক্ষত হবে যে, যদি তাতে নৌকা চালাতে হয় তবে তাও চলবে। (শারহুস্ সুন্নাহ্)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَا أَيُّهَا النَّاسُ ابْكُوا فَإِنْ لَمْ تَسْتَطِيعُوا فَتَبَاكَوْا فَإِنَّ أَهْلَ النَّارِ يَبْكُونَ فِي النَّارِ حَتَّى تَسِيلَ دُمُوعُهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ كَأَنَّهَا جَدَاوِلُ حَتَّى تَنْقَطِعَ الدُّمُوعُ فَتَسِيلَ الدِّمَاءُ فَتَقَرَّحَ الْعُيُونُ فَلَوْ أَنَّ سُفُنًا أُزْجِيَتْ فِيهَا لجَرَتْ» . رَوَاهُ فِي «شرح السّنة»
اسنادہ ضعیف ، رواہ البغوی فی شرح السنۃ (15 / 253 ح 4418) * فیہ یزید الرقاشی : ضعیف و عمران بن زید التغلبی : لین و للحدیث لون آخر عند ابن ماجہ (4324) و سندہ ضعیف ۔
(ضَعِيف)
ব্যাখ্যাঃ (ابْكُوا) তোমরা তোমাদের গুনাহের উপর অনুতপ্ত হয়ে কাঁদো এবং তোমাদের রবের থেকে ক্ষমার আকাক্ষা করে কাঁদো।
‘আইন বর্ণমালায় পেশ দিয়ে এটা বহুবচন, একবচন হলো ‘আইন, যার অর্থ চোখ। অর্থাৎ চোখ অশ্রুশিক্ত হয়ে যাবে বা রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাবে। (سُفُن) এটা (سَفِينَة) এর বহুবচন অর্থ হলো নৌকা। (أُزْجِيَتْ) এটা (الْإِزْجَاءِ) থেকে অর্থ পাঠানো। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৮৬-[২২] আবুদ দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামবাসীদের ভীষণ ক্ষুধায় লিপ্ত করা হবে এবং ক্ষুধার কষ্ট সেই ’আযাবের সমান হবে, যা তারা পূর্ব হতে জাহান্নামে ভোগ করছিল। তারা প্রার্থনা করবে। এর প্রেক্ষিতে তাদেরকে যরী’ নামক এক প্রকার কাঁটাযুক্ত দুর্গন্ধময় খাদ্য দেয়া হবে। তা তাদেরকে তৃপ্ত করবে না এবং ক্ষুধা নিবারণ করবে না। অতঃপর পুনরায় খাদ্যের জন্য প্রার্থনা করবে, এবার এমন খাদ্য দেয়া হবে, যা তাদের গলায় আটকে যাবে। তখন তাদের দুনিয়ার ঐ কথাটি স্মরণে আসবে যে, এভাবে গলায় কোন খাদ্য আটকে গেলে তখন পানি পান করে তাকে নীচের দিকে ঢুকানো হত, অতএব তারা পানির জন্য ফরিয়াদ করবে, তখন তপ্ত গরম পানি লোহার কড়া দ্বারা উঠিয়ে কাছে ধরা হবে, যখন তা তাদের মুখের কাছাকাছি করা হবে, তখন তাদের মুখের গোস্ত ভাজা-পোড়া হয়ে যাবে, আর যখনই সে পানি তাদের পেটের ভিতরে ঢুকবে, তা তাদের পেটের ভিতরে যা কিছু আছে, তা খণ্ডবিখণ্ড করে ফেলবে। এবার জাহান্নামীগণ একে অপরে বলবে, জাহান্নামের রক্ষীদেরকে আহ্বান কর; (যেন আমাদের শাস্তি হ্রাস করা হয়) তখন রক্ষীগণ বলবেন, তোমাদের কাছে কি আল্লাহর রাসূল (সা.) স্পষ্ট দলীল-প্রমাণ নিয়ে উপস্থিত হননি? তারা বলবে, হ্যা, এসেছিলেন।
তখন প্রহরীরা বলবেন, তোমাদের প্রার্থনা তোমরা নিজেরাই কর। অথচ কাফিরদের প্রার্থনা অর্থহীন (কবুল করবেন না) তিনি (সা.) বলেন, এবার জাহান্নামীগণ বলাবলি করবে, (জাহান্নামের দারোগা) মালিককে ডাক। তখন তারা বলবে, হে মালিক! তুমি আমাদের জন্য তোমার রবের কাছে এই আবেদন কর, তিনি যেন আমাদেরকে মৃত্যু দান করেন। উত্তরে মালিক বলবেন, তোমরা সর্বদার জন্য এখানে এ অবস্থাতেই থাকবে। অধস্তন রাবী আমাশ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমাকে বর্ণনা করা হয়েছে, জাহান্নামীদের আহ্বান বা ফরিয়াদ আর মালিকের উত্তরের মাঝখানে একহাজার বছর অতিবাহিত হবে। তিনি (সা.) বললেন, জাহান্নামীগণ সর্বদিক হতে নিরাশ হয়ে অতঃপর তারা পরস্পরে বলবে, এবার তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে সরাসরি ফরিয়াদ কর। তোমাদের রবের চেয়ে উত্তম আর কেউ নেই। তখন তারা বলবে, হে আমাদের পরোয়ারদিগার! আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের ওপর প্রবল হয়ে গেছে, ফলে আমরা গোমরাহ সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছি। হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এ জাহান্নাম হতে বের করে দাও। এরপরও যদি আমরা আবার অবাধ্যতায় লিপ্ত হই, তাহলে আমরাই হব নিজেদের উপর অত্যাচারী।
তিনি (সা.) বলেন, তখন আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে উত্তর দেবেন, (হে হতভাগার দল!) দূর হও, জাহান্নামেই পড়ে থাক, তোমরা আমার সাথে আর কথা বলবে না। তিনি (সা.) বলেন, এ সময় তারা আল্লাহ তা’আলার সর্বপ্রকারের কল্যাণ হতে নিরাশ হয়ে পড়বে এবং এরপর হতে তারা (জাহান্নামের মধ্যে থেকে) বিকটভাবে চিৎকার ও হা-হুতাশ এবং নিজেদের ওপর ধিক্কার করতে থাকবে। আবদুল্লাহ ইবনু আবদুর রহমান (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, লোকেরা এ হাদীসটি মারফু’রূপে বর্ণনা করেন না। (তিরমিযী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يُلْقَى عَلَى أَهْلِ النَّارِ الْجُوعُ فَيَعْدِلُ مَا هُمْ فِيهِ مِنَ الْعَذَابِ فَيَسْتَغِيثُونَ فَيُغَاثُونَ بِطَعَامٍ مِنْ ضَرِيعٍ لَا يُسْمِنُ وَلَا يُغْنِي مِنْ جُوعٍ فَيَسْتَغِيثُونَ بِالطَّعَامِ فَيُغَاثُونَ بِطَعَامٍ ذِي غُصَّةٍ فَيَذْكُرُونَ أَنَّهُمْ كَانُوا يُجِيزُونَ الْغُصَصَ فِي الدُّنْيَا بِالشَّرَابِ فَيَسْتَغِيثُونَ بِالشَّرَابِ فَيُرْفَعُ إِلَيْهِمُ الْحَمِيمُ بِكَلَالِيبِ الْحَدِيدِ فَإِذَا دَنَتْ مِنْ وُجُوهِهِمْ شَوَتْ وُجُوهَهُمْ فَإِذَا دَخَلَتْ بُطُونَهُمْ قطعتْ مَا فِي بطونِهم فيقولونَ: ادْعوا خَزَنَةَ جهنمَ فيقولونَ: أَلمْ تَكُ تَأْتِيكُمْ رُسُلُكُمْ بِالْبَيِّنَاتِ؟ قَالُوا: بَلَى. قَالُوا: فَادْعُوا وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ قَالَ: فيقولونَ: ادْعوا مَالِكًا فيقولونَ: يَا مالكُ ليَقْضِ علَينا ربُّكَ قَالَ: «فيُجيبُهم إِنَّكم ماكِثونَ» . قَالَ الْأَعْمَشُ: نُبِّئْتُ أَنَّ بَيْنَ دُعَائِهِمْ وَإِجَابَةِ مَالِكٍ إِيَّاهُمْ أَلْفَ عَامٍ. قَالَ: فَيَقُولُونَ: ادْعُوا رَبَّكُمْ فَلَا أَحَدَ خَيْرٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَيَقُولُونَ: رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَيْنَا شِقْوَتُنَا وَكُنَّا قَوْمًا ضَالِّينَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ قَالَ: فيُجيبُهم: اخْسَؤوا فِيهَا وَلَا تُكلمونِ قَالَ: «فَعِنْدَ ذَلِكَ يَئِسُوا مِنْ كُلِّ خَيْرٍ وَعِنْدَ ذَلِكَ يَأْخُذُونَ فِي الزَّفِيرِ وَالْحَسْرَةِ وَالْوَيْلِ» . قَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ: وَالنَّاسُ لَا يرفعونَ هَذَا الحديثَ. رَوَاهُ الترمذيُّ
اسنادہ ضعیف ، رواہ الترمذی (2586) * الاعمش مدلس و عنعن و قال احمد :’’ الاعمش لم یسمع من شمر بن عطیۃ ‘‘ (المراسیل لابن ابی حاتم ص 82) ۔
(ضعيفٌ)
ব্যাখ্যা: (فَيَعْدِلُ مَا هُمْ فِيهِ) অর্থাৎ তাদের ওপর এমন ক্ষুধা লাগিয়ে দেয়া হবে যে, তারা আর সমস্ত শাস্তি থেকে এই ‘আযাবকেই অধিক কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক মনে করবে বা অন্য সমস্ত শাস্তির সমান মনে করবে শুধু ক্ষুধার শাস্তিটাকেই।
(ضَرِيعٍ) এটা হিজাযের একটি উদ্ভিত যার কাটা রয়েছে এবং কোন প্রাণী এর নিকটে যায় না তার দুর্গন্ধের কারণে আর যদি কোন প্রাণী তা ভক্ষণ করে তাহলে মারা যায়। এখানে উদ্দেশ্য হলো আগুনের কাটা যা এক প্রকার তিক্ত গাছের রসের থেকেও তিক্ত এবং মৃত প্রাণী থেকেও দুর্গন্ধ এবং আগুনের চেয়েও গরম।
(ذِي غُصَّةٍ) যা গলার মধ্যে আটকে যাবে এবং গিলতে পারবে না হাড্ডি বা অন্য কোন কিছুর কারণে যা উপরেও উঠবে না নিচেও নামবে না। (غُصَّة) এটা এক বচন এর বহুবচন (غُصَص) অর্থ হলো কাঁটা।
(كَلَالِيبِ)এটা বহুবচন একবচন হলো (كَلَاب) অর্থ লোহার বাঁকা পেরেক।
(الزَّفِيرِ وَالْحَسْرَةِ وَالْوَيْلِ)বলা হয় নিজেকে জালিয়ে দেয়া কঠোরতার কারণে। আর (الْحَسْرَةِ) হলো লজ্জা (الْوَيْلِ) হলো ধ্বংস ও শাস্তির কঠোরতা। কেউ বলেছেন, এটা জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৮৭-[২৩] নু’মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছি, ’আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে ভীতি প্রদর্শন করেছি, আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন হতে ভীতি প্রদর্শন করেছি।’ তিনি এ বাক্যগুলো বারংবার এমনভাবে উচ্চৈঃস্বরে বলতে থাকলেন যে, বর্তমানে আমি যে স্থানে বসে আছি, যদি তিনি (সা.) এ স্থান হতে উক্ত বাক্যগুলো বলতেন, তবে তা বাজারের লোকেরাও শুনতে পারত। আর তিনি এমনভাবে (হেলে দুলে) বাক্যগুলো বলেছেন যে, তার কাঁধের উপর রক্ষিত চাদরটি পায়ের উপরে গড়িয়ে পড়েছিল। (দারিমী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «أَنْذَرْتُكُمُ النَّارَ أَنْذَرْتُكُمُ النَّارَ» فَمَا زَالَ يَقُولُهَا حَتَّى لَوْ كَانَ فِي مَقَامِي هَذَا سَمِعَهُ أَهْلُ السُّوقِ وَحَتَّى سَقَطَتْ خَمِيصَةٌ كَانَتْ عَلَيْهِ عِنْدَ رجلَيْهِ. رَوَاهُ الدَّارمِيّ
اسنادہ حسن ، رواہ الدارمی (2 / 330 ح 2815 ، نسخۃ محققۃ : 2854) [و صححہ الحاکم (1 / 287) و وافقہ الذھبی] ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (أَنْذَرْتُكُمُ النَّارَ) আমি তোমাদেরকে জানিয়েছি যার দ্বারা তোমরা আগুন থেকে বাঁচতে পার, এমনকি বলেছি আগুন থেকে বাঁচ যদিও খেজুরের বিচির দ্বারা হোক।
(خَمِيصَةٌ) এক প্রকারের কাপড় যা চাদরের পরিবর্তে পরিধান করা হত। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৮৮-[২৪] ’আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: যদি একখানা সীসা দ্বারা নির্মিত গোলা- এ কথা বলে তিনি মাথার খুলির মতো গোল জিনিসের দিকে ইঙ্গিত করলেন- আকাশ হতে জমিনের দিকে ছেড়ে দেয়া হয়, তখন তা একটি রাত্র অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই জমিনে পৌছে যাবে, অথচ এ দুয়ের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানটি পাঁচশত বছরের পথ। কিন্তু যদি তাকে ঐ শিকল বা জিঞ্জিরের এক পার্শ্ব হতে ছেড়ে দেয়া হয়, যার দ্বারা জাহান্নামীদেরকে বাধা হবে, তখন তা দিবারাত্রি অতিক্রম করতে করতে চল্লিশ বছর পর্যন্তও তার মূলে অথবা বলেছেন, তার গভীর তলদেশে পৌছতে পারবে না। (তিরমিযী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَوْ أَنَّ رَصَاصَةً مِثْلَ هَذِهِ - وَأَشَارَ إِلَى مِثْلِ الْجُمْجُمَةِ - أُرْسِلَتْ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ وَهِيَ مَسِيرَةُ خَمْسِمِائَةِ سَنَةٍ لَبَلَغَتِ الْأَرْضَ قَبْلَ اللَّيْلِ وَلَوْ أَنَّهَا أُرْسِلَتْ مِنْ رَأْسِ السِّلْسِلَةِ لَسَارَتْ أَرْبَعِينَ خَرِيفًا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ قَبْلَ أنْ تبلع أَصْلهَا أَو قعرها» رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
اسنادہ حسن ، رواہ الترمذی (2588 وقال : حسن صحیح) ۔
(ضَعِيف)
ব্যাখ্যা: (رَصَاصَةً) সীসার একটা টুকরা আবার ছোট ছোট পাথরকেও (رَصَاصَةً) বলা হয় যেগুলোর কাজ করে এবং এটা আধুনিক অর্থ হলো গুলি বুলেট।
(جُمْجُمَةِ) এর অর্থ হলো মাথায় খুলি। কেউ বলেছেন, এটার দ্বারা একটি ছোট পেয়ালা বুঝানো হয়েছে। তবে প্রথমটাই অধিক সহীহ।
(سِّلْسِلَةِ) এটা একটি শিকলের নাম যা দ্বারা জাহান্নামীদেরকে বেঁধে রাখা হবে। এ হাদীসের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) জাহান্নামের গভীরতা বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, তুহফাতুল আহ্ওয়াযী হা. ২৫৮৮)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৮৯-[২৫] আবূ বুরদাহ্ (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন। নবী (সা.) বলেছেন: জাহান্নামের মধ্যে এমন একটি নালা বা গর্ত আছে, যার নাম ’হাবহাব’। প্রত্যেক স্বৈরাচারী অহংকারীকে সেখানে রাখা হবে। (তিরমিযী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَن أبي بُردةَ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ فِي جَهَنَّمَ لَوَادِيًا يُقَالُ لَهُ: هَبْهَبُ يسكنُه كلُّ جبَّارٍ رَوَاهُ الدَّارمِيّ
اسنادہ ضعیف ، رواہ الدارمی (2 / 331 ح 2819 ، نسخۃ محققۃ : 2858) * فیہ ازھر بن سنان : ضعیف ۔
ব্যাখ্যা: (وَادِيًا) এটা একবচন, বহুবচন হলো (أوديه) অর্থ হলো উপত্যকা। (هَبْهَبُ) এটা একটি নাম। কেউ বলেছেন, এখানে (أَمْرٌ) এর সীগাকে দু’বার আনা হয়েছে (هَبْهَبُ), কেননা যে উপস্থিত হবে সে বলবে (كلُّ جبَّارٍ) هَبْهَبُ প্রত্যেক অহংকারী বিদ্বেষী যে সত্য থেকে দূরে অবস্থানকারী সৃষ্টিজীবের উপর কঠোর।
ইবনু মারদাওয়াইহ ইবনু উমার থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, (فَلَق) জাহান্নামের একটি জেলখানার নাম। এর মধ্যে বন্দি করা হবে প্রত্যেক অহংকারী, প্রতাপশালী এবং স্বেচ্ছাচারীদেরকে। এখানে উল্লেখিত হয়েছে যে, জাহান্নামও এই জেলখানা থেকে আশ্রয় চায়। অনুরূপ আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, (الْفَلَقُ) হলো জাহান্নামের একটি গভীর গর্তের নাম যা ঢাকা থাকবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৯০-[২৬] ইবনু উমার (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: জাহান্নামে জাহান্নামীদের দেহ হবে প্রকাণ্ড ও বিরাট বিরাট। এমনকি তাদের কানের লতি হতে ঘাড় পর্যন্ত দূরত্ব হবে সাতশত বছরের দূরত্ব, গায়ের চামড়া হবে সত্তর গজ মোটা এবং এক একটি দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের মতো।
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَعْظُمُ أَهْلُ النَّارِ فِي النَّارِ حَتَّى إِنَّ بَيْنَ شَحْمَةِ أُذُنِ أَحَدِهِمْ إِلَى عَاتِقِهِ مَسِيرَةَ سبعمائةِ عامٍ وإِنَّ غِلَظَ جلدِه سَبْعُونَ ذراعان وَإِن ضرسه مثل أحد»
اسنادہ ضعیف ، رواہ احمد (2 / 26 ح 4800) * فیہ ابو یحیی : لین الحدیث و انظر النھایۃ بتحقیقی (1076) لمزید التحقیق ۔
(ضَعِيف)
ব্যাখ্যা: (يَعْظُمُ أَهْلُ النَّارِ) জাহান্নামীদের শরীর অনেক বড় করে দেয়া হবে যাতে তারা তাদের শাস্তি ভালো করে আস্বাদন করতে পারে। তবে তাদেরকে জাহান্নামের ভিতরে বড় করে দেয়া হবে কিন্তু হাশরের ময়দানে তাদেরকে একদম ছোট ছোট করে একত্রিত করা হবে, যেমন পূর্বেও এর আলোচনা গেছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৯১-[২৭] ’আবদুল্লাহ ইবনু হারিস ইবনু জাযই (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জাহান্নামের মধ্যে খুরাসানী উটের মতো বিরাট বিরাট সাপ আছে, সেই সাপের একটি একবার দংশন করলে তার বিষ ও ব্যথার ক্রিয়া চল্লিশ বছর পর্যন্ত অনুভব করবে। আর জাহান্নামের মাঝে এমন সব কিছু আছে, যা পালান বাঁধা খচ্চরের মতো। এর একটি একবার দংশন করলে তার বিষ বেদনার ক্রিয়াও চল্লিশ বছর পর্যন্ত অনুভব করবে। (হাদীস দু’টি আহমাদ রিওয়ায়াত করেছেন)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْحَارِثِ بْنِ جَزْءٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّ فِي النَّارِ حَيَّاتٍ كَأَمْثَالِ الْبُخْتِ تَلْسَعُ إِحْدَاهُنَّ اللَّسْعَةَ فَيَجِدُ حَمْوَتَهَا أَرْبَعِينَ خَرِيفًا وَإِنَّ فِي النَّارِ عَقَارِبَ كَأَمْثَالِ الْبِغَالِ الْمُؤْكَفَةِ تَلْسَعُ إِحْدَاهُنَّ اللَّسْعَةَ فَيَجِدُ حَمْوَتَهَا أَرْبَعِينَ خَرِيفًا» . رَوَاهُمَا أَحْمد
حسن ، رواہ احمد (4 / 191 ح 17864) [و صححہ ابن حبان (7471 نسخۃ محققۃ) و الحاکم (4 / 593) و وافقہ الذھبی و سندہ حسن]
ব্যাখ্যা: (الْبُخْتِ) খোরাসানী উটকে (بُخْت) বলা হয়। সেই সাপগুলো এত বড় বড় হবে যে, খোরাসানী উটের মতো দেখা যাবে।
(الْبِغَالِ الْمُؤْكَفَةِ) এটা বহুবচন, একবচন হলো (بِغْلَةٌ) অর্থ খচ্চর। আর এখানে (بِغَال) অর্থ হলো সিটওয়ালা বা গদিবিশিষ্ট, অর্থাৎ জাহান্নামের বিচ্ছুগুলোর শরীর এতটাই বড় হবে যে, তাদের পিঠের উপর বসা যাবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৯২-[২৮] হাসান বাসরী (রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে আমাদেরকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন সূর্য ও চাঁদকে দুটি পনীরের আকৃতি বানিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তখন হাসান (রহিমাহুল্লাহ) প্রশ্ন করলেন, তাদের অপরাধ কী? উত্তরে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে এ সম্পর্কে যা কিছু শুনেছি, তাই বর্ণনা করলাম (এর অধিক কিছু আমি জানি না)। এ কথা শুনার পর হাসান (রহিমাহুল্লাহ) নীরব হয়ে গেলেন। (বায়হাক্বী কিতাবুল বা’সি ওয়ান্ নুশূর)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَن الحسنِ قَالَ: حَدَّثَنَا أَبُو هُرَيْرَةَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ ثَوْرَانِ مُكَوَّرَانِ فِي النَّارِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ» . فَقَالَ الْحَسَنُ: وَمَا ذَنْبُهُمَا؟ فَقَالَ: أُحَدِّثُكَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَسَكَتَ الْحَسَنُ. رَوَاهُ البيهقيُّ فِي «كتاب الْبَعْث والنشور»
صحیح ، رواہ البیھقی فی البعث و النشور (ذکرہ السیوطی فی اللآلی المصنوعۃ 1 / 82) ولہ شاھد عند الطحاوی فی مشکل الآثار (1 / 66 ۔ 67) و سندہ صحیح] ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (ثَوْرَانِ مُكَوَّرَانِ فِي النَّارِ) ثَوْرَانِ অর্থ হলো চন্দ্র ও সূর্য প্রত্যেককেই নিক্ষেপ করা হবে তার আপন কক্ষপথ থেকে জাহান্নামের মধ্যে ভাঁজ করে আলোকহীন অবস্থায়। এটা করা হবে জাহান্নামীদের শাস্তি বাড়ানোর জন্য, কেননা ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) বলেন যে, সূর্য ও চন্দ্রের চেহারা আরশের নিচে আর তার পিটটা হলো দুনিয়ার দিকে, হাদীসটি দায়লামী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর কিতাব মুসনাদুন ফিরদাওসে উল্লেখ করেছেন। অতএব স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যদি সূর্য ও চন্দ্রের মুখটা দুনিয়ার দিকে করা হত তাহলে দুনিয়াবাসীরা তার তাপ সহ্য করতে পারত না। ইবনুল মালিক (রহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, এই দুটোকে ভাঁজ করা হবে এবং একত্রিত করা হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
(فَقَالَ الْحَسَنُ: وَمَا ذَنْبُهُمَا؟) অর্থাৎ হাসান (রহিমাহুল্লাহ) তাদের অপরাধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, উত্তরে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বললেন যে, রাসূল (সা.) থেকে আমি হাদীস বর্ণনা করেছি। এখানে কোন যুক্তি খাটানো যাবে না। অতএব তিনি চুপ হয়ে গেছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - জাহান্নাম ও জাহান্নামীদের বর্ণনা
৫৬৯৩-[২৯] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: হতভাগ্য ছাড়া কোন লোক জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! হতভাগ্য কে? তিনি (সা.) বললেন, যে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আনুগত্য করে না এবং তাঁর অবাধ্যতার কাজ পরিত্যাগ করে না। (ইবনু মাজাহ)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَاب صفةالنار وَأَهْلهَا)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَدْخُلُ النَّارَ إِلَّا شَقِيٌّ» . قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَنِ الشَّقِيُّ؟ قَالَ: «مَنْ لَمْ يَعْمَلْ لِلَّهِ بِطَاعَةٍ وَلم يتركْ لَهُ مَعْصِيّة» . رَوَاهُ ابْنُ مَاجَهْ
اسنادہ ضعیف ، رواہ ابن ماجہ (4298) * ابن لھیعۃ مدلس و عنعن ۔
(ضَعِيفٌ)
ব্যাখ্যা: (مَنْ لَمْ يَعْمَلْ لِلَّهِ) যে একমাত্র আল্লাহর জন্য কোন ‘ইবাদাত করে না এবং কোন গুনাহ ছাড়ে না সেই হলো দুর্ভাগা। এ বিষয়ে কুরআনে ইঙ্গিত করা হয়েছে,
وَ اَمَّا مَنۡ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ وَ نَهَی النَّفۡسَ عَنِ الۡهَوٰی ﴿ۙ۴۰﴾ فَاِنَّ الۡجَنَّۃَ هِیَ الۡمَاۡوٰی ﴿ؕ۴۱﴾ “আর যে ব্যক্তি তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকে তারই ঠিকানা হলো জান্নাত।” (সূরা আন্ না-যি'আত ৭৯ : ৪০-৪১) অনুরূপ অন্য আয়াতে আসছে,
لَا یَصۡلٰىهَاۤ اِلَّا الۡاَشۡقَی ﴿ۙ۱۵﴾ الَّذِیۡ کَذَّبَ وَ تَوَلّٰی ﴿ؕ۱۶﴾ অর্থাৎ “জাহান্নামে একমাত্র দুর্ভাগাই ঢুকবে যে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং সত্য পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।” (সূরা আল লায়ল ৯২: ১৫-১৬) অতএব এই দুর্ভাগা ব্যক্তি কাফির এবং ফাসিক গুনাহগার মু'মিন যে কেউ হতে পারে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টি
৫৬৯৪-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: জান্নাত ও জাহান্নাম উভয়ে (তাদের রবের কাছে) অভিযোগ করল। জাহান্নাম বলল, ব্যাপার কি? আমাকে শুধু অহংকারী ও স্বৈরাচারীদের জন্য ধার্য করা হয়েছে? আর জান্নাত বলল, ব্যাপার কি? আমার মধ্যে শুধুমাত্র দুর্বল, নিম্নস্তরের ও বোকা লোকেরাই প্রবেশ করবে? তখন আল্লাহ তা’আলা জান্নাতকে বললেন, তুমি আমার রহমতের বিকাশ। অতএব আমার বান্দাদের হতে যাকে চাই, আমি তোমার দ্বারা তার প্রতি অনুগ্রহ করব। আর জাহান্নামকে বললেন, তুমি আমার শাস্তির বিকাশ। অতএব আমার বান্দাদের যাকে চাই, আমি তোমার দ্বারা তাকে ’আযাব ও শাস্তি দেব এবং তোমাদের প্রত্যেককে পরিপূর্ণ করা হবে।
অবশ্য জাহান্নাম তখন পর্যন্ত পূর্ণ হবে না; যতক্ষণ না আল্লাহ তা’আলা তাঁর পবিত্র পা তার মধ্যে স্থাপন করবেন। তখন জাহান্নাম বলবে, যথেষ্ট, যথেষ্ট, যথেষ্ট হয়েছে। এ সময় জাহান্নাম পরিপূর্ণ হয়ে যাবে এবং তার এক অংশকে আরেক অংশের সাথে চাপিয়ে দেয়া হবে। মূলত আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৃষ্টিজীবের কারো প্রতি সামান্য পরিমাণও অন্যায় করবেন না। আর জান্নাতের ব্যাপার হলো, তার (খালি অংশ পূরণের) জন্য আল্লাহ তা’আলা নতুন নতুন সৃষ্টজীব সৃষ্টি করবেন। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول ( بَاب خلق الْجنَّة وَالنَّار)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَحَاجَّتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ فَقَالَتِ النَّارُ: أُوثِرْتُ بِالْمُتَكَبِّرِينَ وَالْمُتَجَبِّرِينَ وَقَالَتِ الْجَنَّةُ: فَمَا لِي لَا يَدْخُلُنِي إِلَّا ضُعَفَاءُ النَّاسِ وَسَقَطُهُمْ وَغِرَّتُهُمْ. قَالَ اللَّهُ تَعَالَى لِلْجَنَّةِ: إِنَّمَا أَنْتِ رَحْمَتِي أَرْحَمُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ مِنْ عِبَادِي وَقَالَ لِلنَّارِ: إِنَّمَا أَنْتِ عَذَابِي أُعَذِّبُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ مِنْ عِبَادِي وَلِكُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْكُمَا مِلْؤُهَا فَأَمَّا النَّارُ فَلَا تَمْتَلِئُ حَتَّى يَضَعَ اللَّهُ رِجْلَهُ. تَقُولُ: قَطْ قَطْ قَطْ فَهُنَالِكَ تَمْتَلِئُ وَيُزْوَى بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ فَلَا يَظْلِمُ اللَّهُ مِنْ خَلْقِهِ أَحَدًا وَأَمَّا الْجَنَّةُ فإِنَّ اللَّهَ ينشئ لَهَا خلقا . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4850) و مسلم (36 / 2846)، (7173 و 7175) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: এ অধ্যায়টি জান্নাত ও জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে এই বিষয়ে হাদীস আনা হবে যেমনটিই আহলুস সুন্নাহর মাযহাব, যদিও এর বিপরীত মত পোষণ করে মু'তাযিলা এবং জাহমিয়ারা কিন্তু তাদের এ বিষয়ে কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
(تَحَاجَّتِ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ) ‘আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, জান্নাত জাহান্নামের এই ঝগড়া বাস্তবে সরাসরি হয়েছে, কেননা আল্লাহ তা'আলা সমস্ত জড়বস্তুকে কথা বলাতে সক্ষম এটা কোন উদাহরণস্বরূপ কথা নয়।
মুল্লা আলী ক্বারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, অবশ্যই ত্বীবী ঠিক বলেছেন; কেননা দুনিয়ার সমস্ত বস্তুর কথা আল্লাহ তা'আলা বুঝেন যা আমরা বুঝি না। যেমন আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন স্থানে বলেছেন যে, দুনিয়ার সমস্ত জড়বস্তু ও জীব বস্তু যা আছে সকলেই তাসবীহ পড়ে, সালাত আদায় করে এবং তারা আল্লাহকে ভয় করে, যা তোমরা বুঝ না। অতএব এখানে এ রকম ব্যাখ্যা করার কোন দরকার নেই যে, এটা একটা উদাহরণমাত্র। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
(سَقَطُهُمْ) যারা নিম্ন শ্রেণির হয় এবং অগ্রহণযোগ্য তুচ্ছ মানুষের নজরে পড়ে যায় বা ছোট নজরে দেখা হয়, তবে এটা অধিকাংশ মানুষের চোখে তারা এমন নগণ্য হবে, কিন্তু আল্লাহর নিকটে তারাই সবচেয়ে বড় হবে।
(وَغِرَّتُهُمْ) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যাদের দুনিয়াবী বিষয়ে গাফিলতি রয়েছে এবং কোন অভিজ্ঞতা নেই এবং কোন গুরুত্বও নেই। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, দুনিয়াবী বিষয়ে অধিকাংশ জান্নাতবাসীরা হবে বোকা হাবা। আর কাফিরদের ব্যপারে আল্লাহ বলেছেন, “তারা দুনিয়াবী জীবনের বাহ্যিকটা খুব ভালো জানে অথচ তারা আখিরাত থেকে গাফিল”- (সূরা আর রূম ৩০ : ৭)। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; তুহফাতুল আহওয়াযী হা. ২৫৬১, শারহুন নাবাবী হা, ২৮৪৬)
(كُلِّ وَاحِدَةٍ مِنْكُمَا مِلْؤُهَا) অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই ভর্তি করে দেয়া হবে কিন্তু জাহান্নাম সে ক্ষান্ত হবে না বরং বলতে থাকবে আরো কিছু আছে? যখন আল্লাহ তার পা দিবেন তখন জাহান্নাম বলবে, ব্যস ব্যস হয়েছে হয়েছে।
শারহুস্ সুন্নাতে আছে যে, এ হাদীসে কদম পা যা কিছু উল্লেখ করা হলো সবই আল্লাহর সিফাত, যার কোন ব্যাখ্যা করা যাবে না, বিশ্বাস করতে হবে এবং অবস্থা বর্ণনা করা যাবে না। আবার আল্লাহ তা'আলার হাত, পা আঙ্গুল, চোখ, এগুলোর অস্তিত্বও অস্বীকার করা যাবে না। যেমনটি মু'তাযিলা এবং জাহমিয়্যারা করে। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী হা. ৪৮৫০)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টি
৫৬৯৫-[২] আনাস (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: জাহান্নামে অবিরাম (জিন-ইনসানকে) নিক্ষেপ করা হবে। তখন জাহান্নাম বলতে থাকবে, আরো বেশি কিছু আছে কি? এভাবে ততক্ষণ পর্যন্ত বলতে থাকবে, যতক্ষণ না মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তার মধ্যে নিজের পবিত্র পা রাখবেন। তখন জাহান্নামের একাংশ অপর অংশের সাথে চেপে যাবে এবং বলবে, তোমার মর্যাদা ও অনুগ্রহের শপথ। যথেষ্ট হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে। আর জান্নাতের মধ্যে লোকেদের প্রবেশের পরও অতিরিক্ত স্থান থেকে যাবে, এমনকি আল্লাহ তা’আলা তার জন্য নতুন নতুন সৃষ্টজীব সৃষ্টি করে তাদেরকে জান্নাতের সেই সমস্ত খালি স্থানে অবস্থান করাবেন। (বুখারী ও মুসলিম)
আর এ প্রসঙ্গে আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস (حُفَّتِ الجنَّةُ بالمكارِه) “জান্নাতকে কষ্টদায়ক জিনিস দ্বারা ঘিরে দেয়া হয়েছে” ’রিকাক’ (সদয় হওয়া) অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।
الفصل الاول ( بَاب خلق الْجنَّة وَالنَّار)
وَعَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا تَزَالُ جَهَنَّمَ يُلْقَى فِيهَا وَتَقُولُ: هَلْ مِنْ مَزِيدٍ؟ حَتَّى يَضَعَ رَبُّ العزَّةِ فِيهَا قدَمَه فينزَوي بَعْضُهَا إِلَى بَعْضٍ فَتَقُولُ: قَطْ قَطْ بِعِزَّتِكَ وَكَرَمِكَ وَلَا يَزَالُ فِي الْجَنَّةِ فَضْلٌ حَتَّى يُنْشِئَ اللَّهُ لَهَا خَلْقًا فَيُسْكِنُهُمْ فَضْلَ الْجَنَّةِ . مُتَّفق عَلَيْهِ وذكرَ حَدِيث أنسٍ: «حُفَّتِ الجنَّةُ بالمكارِه» فِي «كتاب الرقَاق»
متفق علیہ ، رواہ البخاری (7384) و مسلم (38 / 2848)، (7179) 0 حدیث ’’ حفت الجنۃ بالمکارہ ‘‘ تقدم (5160) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (وَلَا يَزَالُ فِي الْجَنَّةِ فَضْلٌ) জান্নাত সংস্কারের কাজ বাড়তেই থাকবে এমনকি আল্লাহ তার জন্য নতুন সৃষ্টজীব সৃষ্টি করবেন আর তারা জান্নাতের অতিরিক্ত অংশে বসবাস করাবেন।
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসটির হলো দলীল আহলুস সুন্নাহর নিকট সাওয়াব বা প্রতিদান আ'মালের উপর নির্ভরশীল নয়, বরং কিছু লোককে সৃষ্টি করা হবে এবং কোন আ'মাল ছাড়াই জান্নাতে ঢুকানো হবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী হা, ৪৮৪৮, শাহুন নাবাবী হা, ৩৭, ১৭/২৮৪৮)
পরিচ্ছেদঃ দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টি
৫৬৯৬-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) নবী (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা যখন জান্নাত তৈরি করলেন, তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম-কে বললেন, যাও জান্নাতখানা দেখে আসো। তিনি গিয়ে তা এবং তার অধিবাসীদের জন্য যে সকল জিনিস আল্লাহ তা’আলা তৈরি করে রেখেছেন, সবকিছু দেখে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তোমার সম্মানের শপথ! যে কেউ এ জান্নাতের সম্পর্কে শুনবে, সে অবশ্যই তাতে প্রবেশ ( আকাঙ্ক্ষা ) করবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা জান্নাতের চতুষ্পর্শ কষ্টসমূহ দ্বারা বেষ্টন করে দিলেন, অতঃপর আবার জিবরীল আলায়হিস সালাম-কে বললেন, হে জিবরীল! আবার যাও এবং পুনরায় জান্নাত দেখে আসো। তিনি গিয়ে তা দেখে এসে বললেন, হে আমার প্রভু! এখন যা কিছু দেখলাম, তার প্রবেশপথ যে,
কষ্টকর। এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে যে, কেউই তাতে প্রবেশ করবে না। তিনি (সা.) বলেন, অতঃপর আলাহ তা’আলা যখন জাহান্নামকে তৈরি করলেন, তখন বললেন, হে জিবরীল! যাও জাহান্নামটি দেখে আসো, তিনি গিয়ে দেখলেন, অতঃপর এসে বললেন, হে প্রভু! তোমার সম্মানের শপথ! যে কেউ এ জাহান্নামের ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা শুনবে, সে কখনো তাতে প্রবেশ করবে না। অতঃপর জাহান্নামের চতুষ্পর্শ্বে আল্লাহ তা’আলা বেষ্টন করলেন প্রবৃত্তির আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা এবং পুনরায় জিবরীল আলায়হিস সালাম -কে বললেন, আবার যাও এবং দ্বিতীয়বার তা দেখে আসো। তিনি গেলেন এবং এবার দেখে এসে বললেন, হে প্রভু! তোমার সম্মানের শপথ করে বলছি, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, একজন লোকও তাতে প্রবেশ ব্যতীত অবশিষ্ট থাকবে না। (তিরমিযী, আবূ দাউদ ও নাসায়ী)
اَلْفصْلُ الثَّنِفْ ( بَاب خلق الْجنَّة وَالنَّار)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَمَّا خَلَقَ اللَّهُ الْجَنَّةَ قَالَ لِجِبْرِيلَ: اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَذَهَبَ فَنَظَرَ إِلَيْهَا وَإِلَى مَا أَعَدَّ اللَّهُ لِأَهْلِهَا فِيهَا ثُمَّ جَاءَ فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَا يَسْمَعُ بِهَا أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَهَا ثُمَّ حَفَّهَا بالمكارِه ثُمَّ قَالَ: يَا جِبْرِيلُ اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَذَهَبَ فَنَظَرَ إِلَيْهَا ثُمَّ جَاءَ فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَقَدْ خَشِيتُ أَنْ لَا يَدْخُلَهَا أَحَدٌ . قَالَ: فَلَمَّا خَلَقَ اللَّهُ النَّارَ قَالَ: يَا جبريلُ اذهبْ فانظرْ إِليها فذهبَ فنظرَ إِليها فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَا يَسْمَعُ بِهَا أَحَدٌ فَيَدْخُلُهَا فَحَفَّهَا بِالشَّهَوَاتِ ثُمَّ قَالَ: يَا جبريلُ اذهبْ فانظرْ إِليها فذهبَ فَنَظَرَ إِلَيْهَا فَقَالَ: أَيْ رَبِّ وَعِزَّتِكَ لَقَدْ خَشِيتُ أَنْ لَا يَبْقَى أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَهَا . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ
اسنادہ حسن ، رواہ الترمذی (2560 وقال : حسن صحیح) و ابوداؤد (4744) و النسائی (7 / 3 ح 3794) ۔
(حسن)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসটি পূর্ববর্তী সহীহ হাদীসটির ব্যাখ্যা, যে জান্নাতকে বেষ্টন করে রাখা হয়েছে। অপছন্দনীয় বস্তু দ্বারা আর জাহান্নামকে বেষ্টন করে রাখা হয়েছে আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ, তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬/২৫৬০)
পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - জান্নাত ও জাহান্নামের সৃষ্টি
৫৬৯৭-[8] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে সালাত আদায় করালেন। অতঃপর মিম্বারে উঠলেন এবং মসজিদের কিবলার দিকে হাত দ্বারা ইঙ্গিত করে বললেন, আমি এখন তোমাদেরকে সালাত আদায় করার সময় জান্নাত ও জাহান্নামকে এ দেয়ালের সামনে এক বিশেষ বিশেষ রূপ ও আকৃতিতে দেখতে পেয়েছি, কিন্তু আজকের মতো এত উত্তম এবং এত নিকৃষ্ট এর আগে আর কখনো দেখতে পাইনি। (বুখারী)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ ( بَاب خلق الْجنَّة وَالنَّار)
عَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صلى بِنَا يَوْمًا الصَّلَاةَ ثُمَّ رَقِيَ الْمِنْبَرَ فَأَشَارَ بِيَدِهِ قِبَلَ قِبْلَةِ الْمَسْجِدِ فَقَالَ: «قَدْ أُرِيتُ الْآنَ مُذْ صَلَّيْتُ لَكُمُ الصَّلَاةَ الْجَنَّةَ وَالنَّارَ مُمَثَّلَتَيْنِ فِي قِبَلِ هَذَا الْجِدَارِ فَلَمْ أَرَ كَالْيَوْمِ فِي الْخَيْر وَالشَّر» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (749) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (مُمَثَّلَتَيْنِ) অর্থাৎ জান্নাত জাহান্নামের সামগ্রিক রূপ এবং বিশ্লেষণমূলক দুটি রূপই দেখেছি।
(فَلَمْ أَرَ كَالْيَوْمِ) অর্থাৎ আজকের মতো ভালোভাবে আর কোন দিন দেখিনি, ভালো ও মন্দ সবকিছু আজকে স্পষ্টভাবে বিস্তারিত দেখেছি। (মিরকাতুল মাফাতীহ, ফাতহুল বারী হা. ৪৭১৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৬৯৮-[১] ’ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে উপস্থিত ছিলাম। তখন তাঁর কাছে বানূ তামীম-এর কিছু লোক আসলো। তিনি (সা.) বললেন, হে বানূ তামীম! তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। উত্তরে তারা বলল, আপনি শুভ সংবাদ তো শুনিয়েছেন, এবার আমাদেরকে কিছু দান করুন। পরক্ষণে তাঁর কাছে ইয়ামানের কিছু লোক আসলো। তিনি তাদেরকে বললেন, হে ইয়ামানবাসী! শুভ সংবাদ গ্রহণ কর। কেননা বানূ তামীম তা গ্রহণ করেনি। তারা উত্তর দিল, আমরা তা কবুল করলাম। অবশ্য আমরা দীনের বিধান সম্পর্কে কিছু অবহিত হওয়ার জন্য আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি। আমরা এ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে কিছু অবগত হওয়ার জন্য আপনার কাছে উপস্থিত হয়েছি। আমরা আপনাকে এ সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে প্রশ্ন করতে চাই, সর্বপ্রথম কি ছিল? উত্তরে তিনি (সা.) বললেন, আদিতে একমাত্র আল্লাহই ছিলেন এবং তার আগে কিছুই ছিল না। আর তার আরশ স্থাপিত ছিল পানির উপরে।
অতঃপর তিনি আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেন এবং লাওহে মাহফুযে প্রত্যেক জিনিসের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) বলেন, এ সময় এক লোক এসে আমাকে বলল, হে ’ইমরান! তুমি তোমার উষ্ট্রীর খোঁজ কর, তা তো পালিয়েছে। অতএব আমি তার খোঁজে চলে গেলাম। আল্লাহর শপথ! যদি উষ্ট্রীটি চলে যেত আর আমি তথা হতে উঠে না যেতাম, তাই আমার কাছে প্রিয় ছিল। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب بدءالخلق وَذِكْرِ الْأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ)
عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ قَالَ: إِنِّي كُنْتُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ جَاءَ قومٌ منْ بَني تميمٍ فَقَالَ: «اقْبَلُوا الْبُشْرَى يَا بَنِي تَمِيمٍ» قَالُوا: بَشَّرْتَنَا فَأَعْطِنَا فَدَخَلَ نَاسٌ مِنْ أَهْلِ الْيَمَنِ فَقَالَ: «اقْبَلُوا الْبُشْرَى يَا أَهْلَ الْيَمَنِ إِذْ لَمْ يَقْبَلْهَا بَنُو تَمِيمٍ» . قَالُوا: قَبِلْنَا جِئْنَاكَ لِنَتَفَقَّهَ فِي الدِّينِ وَلِنَسْأَلَكَ عَنْ أَوَّلِ هَذَا الْأَمْرِ مَا كَانَ؟ قَالَ: «كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ قَبْلَهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كلَّ شيءٍ» ثُمَّ أَتَانِي رَجُلٌ فَقَالَ: يَا عِمْرَانُ أَدْرِكْ ناقتَكَ فقدْ ذهبتْ فانطلقتُ أطلبُها وايمُ اللَّهِ لَوَدِدْتُ أَنَّهَا قَدْ ذَهَبَتْ وَلَمْ أَقُمْ. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (7418) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: বানূ তামীম আরবের একটি বড় প্রসিদ্ধ গোত্র। তাদের একটি দল রাসূল (সা.) -এর কাছে এলে তিনি তাদেরকে সুসংবাদ গ্রহণের উপদেশ দেন। কিন্তু তারা এই সুসংবাদের প্রকৃত মর্ম বুঝে উঠতে পারেনি। তাই তারা বলে উঠে, সুসংবাদ তো দিলেন, এখন আমাদের দান করুন। তারা সুসংবাদ দ্বারা জাগতিক ও আর্থিক কোন দান বুঝেছে। তাই তারা বাহ্যিক দান চেয়েছে। এটা তাদের দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও আগ্রহ এবং আখিরাত থেকে উদাসীন থাকার প্রমাণ বহন করে। প্রবাদে বলা হয়ে থাকে, প্রত্যেক পাত্র তাই ছিটায় যা তার মাঝে থাকে। কুরআনে এই প্রবাদের মর্ম যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে- অর্থাৎ- “প্রত্যেকে তার নিজ নিজ পানি সংগ্রহের স্থান চিনে নিলো”- (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২: ৬০)। আরেকটি আয়াতে বলেন- অর্থাৎ “প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত”- (সূরাহ্ আল মু'মিনূন ২৩: ৬০), (সূরাহ্ আবূ রূম ৩০: ৩২)। আল্লামাহ্ ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, হাদীসের অর্থ হলো, তোমরা আমার নিকট হতে এমন জিনিস গ্রহণ করো যা গ্রহণ করলে জান্নাত লাভ করে আনন্দিত হবে। এই জিনিস হলো দীনের বুঝ ও তদনুযায়ী ‘আমাল। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “সুসংবাদ তো দিলেন”; এতে বুঝা যায় তারা মুসলিম ছিল। তবে তারা দুনিয়া কামানোর আশা করেছে এবং আখিরাত কামানো থেকে উদাসীন রয়েছে। তবে নবী (সা.) তাদের ওপর রাগ এবং সুসংবাদ গ্রহণ করাকে অস্বীকৃতির কারণ হলো, রাসূল (সা.) তাদের জ্ঞানের অভাব এবং যোগ্যতার অভাব টের পেয়েছেন; কেননা তারা তাদের আশাকে অস্থায়ী দুনিয়ার সাথে জুড়ে দিয়েছে এবং দীন অর্জন করে আখিরাতের স্থায়ী বিনিময় গ্রহণ করা থেকে পিছু হটেছে।
কিরমানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তাদের কথা “সুসংবাদ তো দিলেনই”; এর দ্বারা বুঝা যায়, তারা রাসূল (সা.) -এর কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছে এমন নয়। বরং মোটামুটিভাবে তা গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর সাথে তারা কিছু দুনিয়ার বস্তু চেয়েছে। তাই তাদের গ্রহণ করাকে ঢালাওভাবে নাকচ করা নয়। তারপরও রাসূল (সা.)-এর রাগ করার কারণ হলো, তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণাঙ্গরূপে কবুল করেনি। যার কারণে তারা মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন করার বেলায় গুরুত্ব দেয়নি। অথচ তাদের উচিত ছিল কালিমায়ে তাওহীদের তাৎপর্য, ইহকাল, পরকাল এবং তার ওয়াজিব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা এবং এগুলো ধারণ করা। (ফাতহুল বারী, অধ্যায়: তাওহীদ, হা. ৬৯৮২)
(اقْبَلُوا الْبُشْرَى يَا أَهْلَ الْيَمَنِ...) “তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো হে ইয়ামানবাসী...।” বানূ তামীম-এর উত্তর রাসূল (সা.)-এর পছন্দ না হওয়াতে তিনি ইয়ামানবাসীদের প্রতি লক্ষ্য করে বলেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ করো। তারা উত্তরে বলল, আমরা গ্রহণ করলাম। আমরা তো এসেছি দীনের জ্ঞান অর্জনের জন্য এ বিষয়ের সূচনা সম্পর্কে আপনার কাছে জিজ্ঞাসার জন্য। অর্থাৎ তাদের আসার কারণ ছিল দুটি। [এক] দীনী জ্ঞান অর্জন, [দুই] পৃথিবীর সূচনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ। দীনী জ্ঞান অর্জনের প্রতি উৎসাহিতকারী আয়াত তাদের আগমনের কারণ হতে পারে। কেননা আল্লাহ তা'আলা বলেন
(فَلَوۡ لَا نَفَرَ مِنۡ کُلِّ فِرۡقَۃٍ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَۃٌ لِّیَتَفَقَّهُوۡا فِی الدِّیۡنِ وَ لِیُنۡذِرُوۡا قَوۡمَهُمۡ اِذَا رَجَعُوۡۤا اِلَیۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ یَحۡذَرُوۡنَ) “তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে তারা দীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে।” (সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্ ৯: ১২২)
অর্থাৎ এ আয়াত আমাদেরকে আপনার কাছে আসতে উদ্বুদ্ধ করেছে। দীনী জ্ঞান অর্জনের বেলায় তাদের নিয়্যাত বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল ছিল। দুনিয়ার কোন লোভ তাদের মাঝে ছিল না। তাই তাদের জন্য সুসংবাদ, দীন কবুল, দীনের জ্ঞান, তদনুযায়ী আমাল ও লক্ষ্যে পৌছা সবই হয়েছে। আর প্রথম দল সুসংবাদ থেকে বঞ্চিত থাকার সাথে সাথে দুনিয়ার তুচ্ছ স্বার্থ অর্জন থেকেও বঞ্চিত থেকেছে। অতএব উচ্চ সাহস ও নিয়্যাতই মানুষকে উচ্চ মর্যাদায় পৌছায়। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
তাদের আসার দ্বিতীয় কারণটি ছিল, পৃথিবীর সূচনা ও সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে জানা। অর্থাৎ সূচনালগ্নে এই পৃথিবীর অবস্থা ও সৃষ্টির অবস্থা কী ছিল? রাসূল (সা.) এর উত্তরে বলেন, আল্লাহ তা'আলা ছিলেন এবং তার পূর্বে কিছুই ছিল না। অর্থাৎ অনাদি অনন্তকাল থেকে তিনি ছিলেন। তাঁর কোন সূচনা ও শেষ নেই। তিনি সর্বদা আছেন এবং সর্বদা থাকবেন। সৃষ্টি ও পরিবর্তনের গুণ তার মাঝে নেই। বরং এগুলো বান্দা ও সৃষ্টির গুণ। তার পূর্বে কিছু ছিল না। কেননা তিনি প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা এবং অস্তিত্বের ধারণকারী। অতএব কোন বস্তু তার পূর্বে বিদ্যমান থাকা সম্ভব নয়। মোটকথা, প্রত্যেক বস্তুর পূর্বে যিনি ছিলেন তিনি মহান আল্লাহ তা'আলা। তার পূর্বে না কিছু ছিল, আর না কোন কিছু থাকা সম্ভব। তিনি অনাদি তার শুরু নেই। তিনি সর্বশেষ তার সমাপ্তি নেই। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
কুরআনে এ মর্মটি যেভাবে তুলে ধরা হয়েছে
(هُوَ الۡاَوَّلُ وَ الۡاٰخِرُ وَ الظَّاهِرُ وَ الۡبَاطِنُ ۚ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ) “তিনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সব বিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।” (সূরা আল হাদীদ ৫৭ : ৩)
(وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ) “তার ‘আরশ পানির উপর ছিল।” এটা হলো সৃষ্টির সূচনা। আল্লাহ তা'আলার পূর্বে কোন সৃষ্টি ছিল না। আবার তার কোন পূর্ব নেই। তিনি অনাদি অনন্ত। তবে তিনি সর্বপ্রথম সৃষ্টির সূচনা করেন ‘আরশ ও পানির দ্বারা। আসমান জমিন সৃষ্টির পূর্বেই এ দুইয়ের সৃষ্টি করেছেন। তবে এ দুয়ের মাঝে পানি আগে সৃষ্টি বলে ইঙ্গিত বহন করে। তবে সহীহ সনদে তিরমিযীতে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে- (إنَّ أَوَّلَمَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ لَهُ اكْتُبْ) “আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, লিখ।” (তিরমিযী- অধ্যায়: তাফসীর, সূরাহ্ কলমের তাফসীর অনুচ্ছেদ)
এ হাদীসে বুঝা যায় প্রথম সৃষ্টি কলম। উভয় হাদীসের সমন্বয়ে ‘উলামায়ে কিরাম বলেন, কলমের প্রথম সৃষ্টি তুলনামূলক। অর্থাৎ ‘আরশ ও পানির পর সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করা হয়েছে। অথবা এ হাদীসে কলম প্রথম সৃষ্টি তা বলা হয়নি। বরং প্রথম সৃষ্টির পর সর্বপ্রথম তাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেটি ছিল, লিখ। আবূল আ'লা আল হামদানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, প্রথম সৃষ্টি ‘আরশ নাকি কলম; এ ব্যাপারে ‘উলামাদের দুটি মত রয়েছে অধিকাংশের মতে ‘আরশ প্রথমে সৃষ্টি করা হয়েছে। (ফাতহুল বারী ৬/২৮৯)
(لَوَدِدْتُ أَنَّهَا قَدْ ذَهَبَتْ وَلَمْ أَقُمْ) “আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল যদি একেবারে চলে যেত আর আমি উঠতাম না।”
উষ্ট্রির রশি ছুটে উষ্ট্রি চলে গেছে। তাকে পাওয়ার আশায় আমাকে রাসূল (সা.)-এর মাজলিস ছেড়ে আসতে হলো। এর চেয়ে যদি উষ্ট্রিটি একেবারে চলে যেত এবং পাওয়ার আশা থাকত না, সেটাই ভালো হত। কেননা পাওয়ার আশা না থাকলে উঠতাম না এবং ইয়ামানবাসীদের সাথে রাসূল (সা.) ও বাকী কথাগুলো শুনা থেকে বঞ্চিত থাকতাম না।
(بَشَّرْتَنَا فَأَعْطِنَا) তারা এ কথা বলার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তারা আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছে, তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়ামানবাসীদেরকে বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর যেহেতু বানূ তামীম গ্রহণ করল না।
(كَانَ اللَّهُ) আল্লাহ অনন্তকাল থেকেই ছিলেন এবং থাকবেন কোন প্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধন ছাড়াই।
(وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ) এ কথাটি স্পষ্ট দলীল বহন করে যে, ‘আরশ এবং পানি আসমান জমিন সৃষ্টির পূর্বেই তিনি সৃষ্টি করেছেন।
ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, এখানে পানি দ্বারা সমুদ্রের পানি উদ্দেশ্য নয় বরং এটা ‘আরশের নিচের পানি, আল্লাহ ভালো জানেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৬৯৯-[২] ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন, এতে তিনি সৃষ্টির সূচনা হতে জান্নাতবাসীদের তাদের বাসস্থানে প্রবেশ এবং জাহান্নামীদের তাদের শাস্তির স্থলে প্রবেশ পর্যন্ত আলোচনা করলেন। সে আলোচনা যে স্মরণ রাখার সে স্মরণ রেখেছে, আর যে ভোলার সে ভুলে গেছে। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب بدءالخلق وَذِكْرِ الْأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ)
وَعَن عمر قَالَ: قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَامًا فَأَخْبَرَنَا عَنْ بَدْءِ الْخَلْقِ حَتَّى دَخَلَ أَهْلُ الْجَنَّةِ مَنَازِلَهُمْ وَأَهْلُ النَّارِ مَنَازِلَهُمْ حَفِظَ ذَلِكَ مَنْ حَفِظَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نسيَه . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (3192) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَقَامًا) “রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন।” (مَقَامًا) শব্দটি ব্যাকরণে মাসদার। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, রাসূল (সা.)-এর দাঁড়ানোটা বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি দাঁড়িয়ে সৃষ্টির সূচনা ও সমাপ্তির বর্ণনা দিলেন। অর্থাৎ জান্নাত প্রবেশ পর্যন্ত তার সমস্ত উম্মাতের অবস্থা তুলে ধরলেন। উম্মতের মাঝে কাদের জন্য কল্যাণ এবং কাদের জন্য অকল্যাণ লেখা হয়েছে, কারা কল্যাণ নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং অকল্যাণ নিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে তাদেরকে নির্দিষ্ট করে দিলেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (فَأَخْبَرَنَا عَنْ بَدْءِ الْخَلْقِ حَتَّى) “আমাদেরকে খবর দিলেন এমনকি...” অর্থাৎ পৃথিবীর সূচনার কথা একের পর এক বলতে থাকলেন। এমনকি মানুষের সর্বশেষ ঠিকানা ও অবস্থান জান্নাত ও জাহান্নামের কথা বলে শেষ করলেন। কারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং কারা জাহান্নামে; ভবিষ্যতের এ কথাকে (دخل) তথা অতিতকালের ক্রিয়া দিয়ে ব্যক্ত করার কারণ হলো নিশ্চয়তা বুঝানো। কেননা ভবিষ্যতের নিশ্চিত কর্মকে অতিতকালের ক্রিয়া দ্বারা ব্যক্ত করার প্রচলন রয়েছে এবং এতে নিশ্চয়তার অর্থ রয়েছে। (ফাতহুল বারী হা. ৬/২৯০)
(فَأَخْبَرَنَا عَنْ بَدْءِ الْخَلْقِ) তিনি শুরু এবং শেষের সমস্ত বর্ণনা দিলেন। এমনকি জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করার আগ পর্যন্ত আর জাহান্নামীগণ জাহান্নামে প্রবেশ করা এবং সেখানকার অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, একই মাজলিসে সৃষ্টিজীবের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত বর্ণনা দেয়াটা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মু'জিযা মাত্র। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৭০০-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা’আলা সমস্ত সৃষ্টজীব সৃষ্টি করার পূর্বে এটা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন যে, আমার রহমত আমার গজবের উপর সর্বদাই অগ্রগামী। আর এ বাক্যটি তাঁর কাছে আরশের উপরে লিখিতভাবে রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب بدءالخلق وَذِكْرِ الْأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ)
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى كَتَبَ كِتَابًا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ الْخَلْقَ: إِنَّ رَحْمَتِي سَبَقَتْ غَضَبِي فَهُوَ مَكْتُوب عِنْده فَوق الْعَرْش . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (7554) و مسلم (14 / 2751)، (6969) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (إِنَّ اللَّهَ تَعَالَى كَتَبَ كِتَابًا) “আল্লাহ তা'আলা একটি কিতাব লিখেন মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে।” এই কিতাব বা লিখনি দ্বারা লাওহে মাহফুয উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মাখলুক সৃষ্টির পূর্বে তিনি লাওহে মাহফুযে যে কথাটি লিখে রাখেন সেটি হচ্ছে, আমার রহমত রাগের উপর প্রাধান্য পেয়েছে। অর্থাৎ রাগের তুলনায় রহমতের সংখ্যা ও রহমত সংশ্লিষ্ট বস্তু বেশি।
সারকথা; বান্দার প্রতি তাঁর কল্যাণের ইচ্ছা, নি'আমাত প্রদান, প্রতিদান দান, বান্দার জন্য অকল্যাণ কামনা ও শাস্তি প্রদানের তুলনায় বেশি। কেননা তাঁর রহমত ব্যাপক ও বিস্তৃত। অপরদিকে তাঁর বিশেষ রহমত বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজিত। যেমন ‘আর রহমানুর রহীম’-এর বেলায় বলা হয়, তাঁর ‘রহমান’ গুণের রহমত বা দয়া মু'মিন কাফির সবার জন্য বিস্তৃত। এমনকি সমস্ত সৃষ্টির জন্য তার এই রহমত। এ কারণেই ‘রহমান' শব্দকে আল্লাহ তা'আলা ছাড়া কারো বেলায় প্রয়োগ করা বৈধ নয়।
(فَهُوَ مَكْتُوب عِنْده فَوق الْعَرْش) “তা আল্লাহর কাছে ‘আরশের উপর লিখিত।” ফাতহুল বারীতে রয়েছে, এর দ্বারা ইঙ্গিত হলো লাওহে মাহফুযের অবস্থান ‘আরশের উপরে। (১৩/৫২৬)
মিরকাত প্রণেতা বলেন, এর মর্ম হলো, লাওহে মাহফুযের লিখনি ও বর্ণনা সমস্ত সৃষ্টির আড়ালে এবং তা বুঝা মানুষের ক্ষমতার বাহিরে। কেউ কেউ বলেন, এর উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা'আলার জ্ঞানে এই বাক্য লিপিবদ্ধ। তবে লাওহে মাহফুযের কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা তার বান্দার মাঝে যাকে ইচ্ছা তাকে অবগত করেন। যেমন মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ), নবীগণ, বিশেষ বিশেষ ওয়ালীদেরকে কিছু কিছু বিষয় অবগত করানো হয়ে থাকে। বিশেষ করে ইসরাফীল (আঃ)। কেননা তিনি এর দায়িত্বশীল। তিনি লাওহে মাহফুযের বিষয়কে নিয়ে জিবরীল, মীকাঈল এবং মালাকুল মাওতকে নির্দেশ দেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
(إِنَّ رَحْمَتِي سَبَقَتْ) নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন যে, আল্লাহর রাগ ও তার সন্তুষ্টি আনুগত্যশীলদেরকে প্রতিদান দেয়া আর গুনাহগারদেরকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করেন। অতএব এখানে দয়া রাগের উপর প্রাধান্য পাওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যে, তার দয়াটা অধিক এবং ব্যাপক। আর তা ছাড়াও আল্লাহর দয়া দুনিয়াতে ব্যাপক, তিনি কাফির মুশরিক সকলকে রিযক দান করছেন, অনুরূপভাবে তিনি সকলকে বাতাস পানি ইত্যাদি সকলকে সমানভাবে দিচ্ছেন। অতএব স্পষ্ট হলো যে, তার দয়া তার রাগের উপর প্রাধান্য পেয়েছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৭০১-[8] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি (সা.) বলেছেন: মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাদের)-কে নূরের দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর জিন্ জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়া মিশ্রিত অগ্নিশিখা হতে এবং আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে ঐ বস্তু দ্বারা, যার বর্ণনা (কুরআনে) তোমাদেরকে বলা হয়েছে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب بدءالخلق وَذِكْرِ الْأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ)
وَعَنْ عَائِشَةَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «خُلِقَتِ الْمَلَائِكَةُ مِنْ نُورٍ وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وصف لكم» . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (60 / 2996)، (7495) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (خُلِقَتِ الْمَلَائِكَةُ مِنْ نُورٍ) “মালায়িকাহ্ সৃষ্টি করা হয়েছে নূর দিয়ে”। মালাক (ফেরেশতা) আল্লাহ তা'আলার এক মহান সৃষ্টি যারা না পুরুষ, না মহিলা। তারা খায় না, পান করে না, বিবাহ করে না, তাদের সন্তান হয় না। মালায়িকা’র আলোচনা নবীর আগে নিয়ে আসার অর্থ এই নয় যে, মালায়িকাহ নবীদের থেকে উত্তম। বরং সৃষ্টির ক্ষেত্রে তারা আগের এবং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে নবীদের আগে তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন –
( ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ) (وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ) (وَ لٰکِنَّ الۡبِرَّ مَنۡ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ وَ الۡکِتٰبِ وَ النَّبِیّٖنَ ۚ) “...তারা সবাই আল্লাহর ওপর, তাঁর মালায়িকাহ্'র (ফেরেশতাদের) ওপর, তাঁর কিতাবসমূহের ওপর এবং রাসূলগণের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে...”- (সূরাহ্ আল বাকারাহ্ ২: ২৮৫)। “...যে ব্যক্তি আল্লাহকে ও তার মালায়িকাহ্’কে, তাঁর কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলগণকে এবং শেষ দিবসকে অস্বীকার করে...”- (সূরা আন্ নিসা ৪: ১৩৬)। “...বরং কল্যাণ আছে এতে যে, কোন ব্যক্তি ঈমান আনবে আল্লাহ, শেষ দিবস, মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ), কিতাবসমূহ ও নবীগণের প্রতি...”- (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২:১৭৭)।
আর জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত হজ্জের বিবরণের দীর্ঘ হাদীসে রাসূল (সা.) ও বলেছেন- (اِبْرَؤُوابِمَابَدَأَ اللَّهُ بِهِ) অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা যা দিয়ে শুরু করেছেন তোমরাও তা দিয়ে শুরু করো।”
(সহীহ মুসলিম অধ্যায়: হজ্জ, অনুচ্ছেদ: নবী (সা.) এ-এর হজ্জ, হা. ২১৩৭)
তাছাড়া তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের মাঝে খবর আদান প্রদানের মাধ্যম। তাই আল্লাহ তা'আলার পর তাদের নাম এবং পরে নবীদের নাম আসাটা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু এর দ্বারা তারা নবী ও রাসূলদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এটা আবশ্যক হয় না। (ফাতহুল বারী হা. ৬/৩০৬)
কুরআনের বিবরণ মতে, মালাক ডানাবিশিষ্ট। আল্লাহ তা'আলা বলেন (اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ فَاطِرِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ جَاعِلِ الۡمَلٰٓئِکَۃِ رُسُلًا اُولِیۡۤ اَجۡنِحَۃٍ مَّثۡنٰی وَ ثُلٰثَ وَ رُبٰعَ ؕ)
“সমস্ত প্রংসা আল্লাহর, যিনি আসমান ও জমিনের স্রষ্টা এবং মালায়িকাকে করেছেন বার্তাবাহক যারা দুই, তিন ও চার পাখাবিশিষ্ট।” (সূরা আল ফা-ত্বির ৩৫ : ১)।
তারা পাখা দিয়ে উড়তে পারে আবার মানবরূপ ধারণ করতে পারে। তারা কোন পাপ করে না। আল্লাহ তাদেরকে যা নির্দেশ দেন তারা তাই করে। আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে বিভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। এই মালাক নূরের সৃষ্টি আমরা কেবল এটুকু জানি। নূরের অবস্থা বা ধরণ সম্পর্কে আমাদেরকে জানানো হয়নি।
(وَخُلِقَ الْجَانُّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ) الْجَانُّ অর্থাৎ জিন্। জিন্ দ্বারা জিন জাতি উদ্দেশ্য। কারো কারো মতে, জিনদের পিতা উদ্দেশ্য। আদমের বিপরীতে এই অর্থই উপযুক্ত। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (الْجَانُّ) অর্থাৎ জিন্। আর (مَارِجٍ) কালো ধোঁয়া মিশ্রিত অগ্নি।
(নবাবীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ)।
সূরা আর রহমানে রয়েছে, (وَ خَلَقَ الۡجَآنَّ مِنۡ مَّارِجٍ مِّنۡ نَّارٍ) অর্থাৎ “তিনি জিনকে অগ্নিশিখা থেকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আর রহমান ৫৫ : ১৫)।
অন্য আয়াতে রয়েছে, (وَ الۡجَآنَّ خَلَقۡنٰهُ مِنۡ قَبۡلُ مِنۡ نَّارِ السَّمُوۡمِ) অর্থাৎ “আর আমি জিনকে আগুনের লেলিহান শিখা থেকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরাহ আল হিজর ১৫ :২৭)।
(وَخُلِقَ آدَمُ مِمَّا وصف لكم) “আর আদম-এর সৃষ্টি যেভাবে তোমাদেরকে বিবরণ দেয়া হয়েছে।” অর্থাৎ আদম মাটির সৃষ্টি এটা তোমাদের জানা। আল্লাহ তোমাদেরকে কুরআনে এর বিবরণ যেভাবে দিয়েছেন তা দিয়েই আদমের সৃষ্টি। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন- (خَلَقَهٗ مِنۡ تُرَابٍ) “তিনি তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন”- (সূরাহ আ-লি ইমরান ৩ : ৫৯)। অন্য আয়াতে রয়েছে, (خَلَقَ الۡاِنۡسَانَ مِنۡ صَلۡصَالٍ کَالۡفَخَّارِ) “তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পোড়া মাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে”- (সূরা আর রহমান ৫৫ : ১৪)। আরেক আয়াতে রয়েছে, (وَ لَقَدۡ خَلَقۡنَا الۡاِنۡسَانَ مِنۡ صَلۡصَالٍ مِّنۡ حَمَاٍ مَّسۡنُوۡنٍ) “আমি মানবকে পচা কর্দম থেকে তৈরি বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছি”- (সূরাহ্ আল হিজর ১৫ : ২৬)। অন্য আয়াতে রয়েছে, (اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ طِیۡنٍ) “নিশ্চয় আমি মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করছি”- (সূরাহ্ আস্ সোয়াদ ৩৮ : ৭১)।
এভাবে কুরআনে বিষয়টি অনেক বেশি বর্ণনা হওয়া ও সবার কাছে স্পষ্ট থাকার দরুন নবী (সা.) এ বিষয়টি অস্পষ্ট রেখেছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - সৃষ্টির সূচনা ও নবী-রাসূলদের আলোচনা
৫৭০২-[৫] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তা’আলা যখন জান্নাতে আদম (আঃ)-এর দেহ আকৃতি তৈরি করলেন এবং যতদিন ইচ্ছা তিনি এ অবস্থায় রেখে দিলেন, তখন ইবলীস উক্ত আকৃতির চতুস্পার্শ্বে ঘোরাফেরা করত এবং তার প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। অতঃপর যখন সে দেখতে পেল তার মধ্যস্থল শূন্য, তখন সে বুঝতে পারল যে, এটা এমন একটি সৃষ্টিজীব যে নিজেকে আয়ত্তে রাখতে পারবে না। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب بدءالخلق وَذِكْرِ الْأَنْبِيَاءِ عَلَيْهِمُ الصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ)
وَعَنْ أَنَسٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَمَّا صَوَّرَ اللَّهُ آدَمَ فِي الْجَنَّةِ تَرَكَهُ مَا شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ فَجَعَلَ إِبْلِيسُ يُطِيفُ بِهِ يَنْظُرُ مَا هُوَ فَلَمَّا رَآهُ أَجْوَفَ عَرَفَ أَنَّهُ خُلِقَ خَلْقًا لَا يتمالَكُ» . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (111 / 2611)، (6649) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: “যখন আল্লাহ তা'আলা আদমকে জান্নাতে সৃষ্টি করলেন।” তূরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, আমার কাছে হাদীসটি অত্যন্ত জটিল মনে হয়; কেননা কুরআন ও হাদীস থেকে প্রমাণিত যে, আল্লাহ তা'আলা আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর যখন তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন তখন তিনি একজন জীবন্ত মানুষ। কুরআনের স্পষ্ট বাণী এ কথার সমর্থন করে। আল্লাহ তা'আলা বলেন (وَ قُلۡنَا یٰۤاٰدَمُ اسۡکُنۡ اَنۡتَ وَ زَوۡجُکَ الۡجَنَّۃَ) “আর আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো”- (সূরাহ্ আল-বাকারা ২ : ৩৫)। তবে মাটি থেকে সৃষ্টি ও জান্নাতে আকৃতি প্রদানের মধ্যে মূলত কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা মাটি থেকে অংশ নেয়া হয়েছে, তারপর তাকে খামীরের মতো করা হয়েছে, তারপর শুকানোর জন্য আরো কিছু দিন রাখা হয়েছে, এভাবে কয়েকটি ধাপ যাওয়ার পর যখন মানবিক রূপ গ্রহণের উপযুক্ত হয়েছে তখন তাকে জান্নাতে নিয়ে আকৃতি দেয়া ও তার মাঝে আত্মা ফুকা হয়েছে। আর উপরোক্ত আয়াত অর্থাৎ “আর আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো।” এখানে এমন কিছু বুঝায় না যে, তার মাঝে আত্মা ফুকার পর তাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
(تَرَكَهُ مَا شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ) অর্থাৎ জান্নাতের যে কোন জায়গায় তাকে বিচরণ করতে ছেড়ে দিলেন। তবে নির্দিষ্ট গাছের কাছে যাওয়া নিষেধের ঘটনা আমাদের কাছে প্রসিদ্ধ। তাই প্রকৃত অর্থ হবে, নিষিদ্ধ সেই গাছ ব্যতীত জান্নাতের যে কোন জায়গায় তার বিচরণের অনুমোদন ছিল।
(فَجَعَلَ إِبْلِيسُ يُطِيفُ بِهِ يَنْظُرُ مَا هُوَ) অর্থাৎ ইবলীস প্রথমে আদমকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করল; যাতে তার ষড়যন্ত্র বিফলে না হয়ে যায়।
(فَلَمَّا رَآهُ أَجْوَفَ عَرَفَ أَنَّهُ خُلِقَ خَلْقًا لَا يتمالَكُ) অর্থাৎ যখন দেখলো আদম পেটবিশিষ্ট, তখনই সে বুঝে নিলো তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তার মাঝে শক্তি ও দঢ়তা থাকবে না। বরং প্রতিজ্ঞা নড়বড়ে হবে, অবস্থা পরিবর্তনশীল হবে এবং বিপদ আপদের সম্মুখীন হবে। কেউ কেউ বলেন, ইবলীস বুঝে নিলো, এই সৃষ্টি প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কারো কারো মতে এর অর্থ: এই সৃষ্টি প্ররোচনা বারণ করতে পারবে না। কেউ কেউ বলেন, রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।