-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১. আলিফ-লাম-রা; এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত।(১)
(১) অর্থাৎ এগুলো কুরআনের আয়াত। [ইবন কাসীর] সে গ্রন্থ যা হালাল ও হারামের বিধি-বিধান এবং প্রত্যেক কাজের সীমা ও শর্ত বর্ণনা করে। মানুষকে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রের জন্য হেদায়াত ও সঠিক পথের দিশা জানিয়ে দেয়। [বাগভী; মুয়াসসার] কাতাদা বলেন, এ কুরআন অবশ্যই সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী। আল্লাহ্ তাঁর হেদায়াত ও পথের দিশা তাতে বর্ণনা করেছেন। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১) আলিফ লা-ম রা। এগুলো সুস্পষ্ট কিতাবের আয়াত।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২. নিশ্চয় আমরা এটা নাযিল করেছি(১) কুরআন হিসেবে আরবী ভাষায় যাতে তোমরা বুঝতে পার।(২)
(১) হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কুরআন নাযিল হয়েছে রামাদান মাসের চব্বিশ দিন গত হওয়ার পর। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/১০৭]
(২) অর্থাৎ আমি একে আরবী কুরআন হিসেবে নাযিল করেছি, হয়ত এতে তোমরা বুঝতে পারবে। আল্লাহ তা'আলা আরবদের ভাষায় এ কাহিনী নাযিল করেছেন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সততা ও সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করে এবং কাহিনীতে বর্ণিত বিধান ও নির্দেশাবলীকে চলার পথের আলোকবর্তিকা হিসেবে গ্রহণ করে। আরবী ভাষায় নাযিল হওয়ার পেছনে একটি কারণ হচ্ছে, আরবী ভাষা সবচেয়ে প্রাঞ্জল ভাষা এবং সবচেয়ে প্রশস্ত ভাষা।
তাই আল্লাহ্ চাইলেন যে, তার সবচেয়ে সম্মানিত কিতাবটি সবচেয়ে মহৎ মাধ্যমে। আর তাও সংঘটিত হয়েছিল সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ভূমিতে। অনুরূপভাবে তার নাযিল হওয়াও শুরু হয়েছিল বছরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মাসে। আর তা হচ্ছে রামাদান। তাই এ কুরআন সবদিক থেকেই পরিপূর্ণ। তাই এরপরই আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন যে, “আমরা আপনার কাছে উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি, ওহীর মাধ্যমে আপনার কাছে এ কুরআন পাঠিয়ে” অর্থাৎ এ কুরআন আপনার কাছে ওহী করার কারণেই তা বলা সম্ভব হয়েছে। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(২) নিশ্চয় আমি এটি অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় কুরআনরূপে, যাতে তোমরা বুঝতে পার। [1]
[1] আসমানী গ্রন্থসমূহকে অবতীর্ণ করার উদ্দেশ্য হল, মানুষকে হিদায়াত ও পথ প্রদর্শন করা। আর উক্ত উদ্দেশ্য তখনই অর্জন হবে, যখন সেই গ্রন্থ এমন ভাষায় হবে, যে ভাষা তারা বুঝতে পারবে। এই জন্যই সমস্ত আসমানী গ্রন্থ যে জাতির হিদায়াতের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে সে জাতির ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। কুরআন কারীম যেহেতু সর্বপ্রথম আরববাসীদেরকে লক্ষ্য করে অবতীর্ণ করা হয়েছে, সেহেতু তা আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। তাছাড়া আরবী ভাষা সাহিত্য- শৈলী, শব্দালঙ্কার, অলৌকিকতা ও অর্থ প্রকাশের দিক থেকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষা। এই জন্য আল্লাহ তাআলা এই সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ (কুরআন মাজীদ)-কে সর্বশ্রেষ্ঠ (আরবী) ভাষাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ রসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি, সর্বশ্রেষ্ঠ ফিরিশতা (জিবরীল)এর মাধ্যমে অবতীর্ণ করেছেন এবং মক্কা যেখানে অবতীর্ণ হতে আরম্ভ হয়েছে, তা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান, যে মাসে অবতীর্ণ হয়েছে, সে মাসটিও সর্বশ্রেষ্ঠ মাস রমযান মাস এবং যে রাতে অবতীর্ণ হয়েছে, সে রাতও সর্বশ্রেষ্ঠ রাত শবেকদরের রাত।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩. আমরা আপনার কাছে উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি(১), ওহীর মাধ্যমে আপনার কাছে এ কুরআন পাঠিয়ে; যদিও এর আগে আপনি ছিলেন অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত।(২)
(১) সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এ আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর অনেকদিন থেকে বিভিন্ন আয়াত নাযিল করছিল, তখন সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি আমাদেরকে কোন কিছছা শোনাতেন। তখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করেন এবং ইউসুফ আলাইহিস সালামের কাহিনী শোনান।” [ইতহাফ আল খিয়ারাহঃ ১/২৩৮, ১৬২ মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ২/৩৪৫, ইবনে হিব্বান–আল ইহসান- ৬২০৯, দিয়া আল মাকদেসীঃ আল-মুখতারাহঃ ১০৬৯]
এ কাহিনীকে উত্তম কাহিনী বলার কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন মত বর্ণিত হয়েছে। কারও কারও মতে, কারণ এতে রয়েছে শিক্ষা, উপদেশ, হিকমত বা প্রজ্ঞা যা অন্য কোন কাহিনীতে নেই। কারও কারও মতে, কারণ এতে রয়েছে উত্তম কথোপকথন, ইউসুফ আলাইহিস সালামের উপর তার ভাইদের অত্যাচারের বিপরীতে সবর ও তাদেরকে ক্ষমার বর্ণনা। কারও কারও মতে, কারণ এতে রয়েছে নবীদের কথা, সৎলোকদের কথা, ফিরিশতাদের কথা, শয়তানের কথা, জিন, মানব, জন্তু জানোয়ার, পাখি, রাজা-বাদশাহের চরিত, ব্যবসায়ী, আলেম, জাহেল, পুরুষ, মহিলাদের কথা। মহিলাদের বাহানা ও তাদের ষড়যন্ত্রের কথা। [ফাতহুল কাদীর]
(২) অর্থাৎ আমি এ কুরআনকে ওহীর মাধ্যমে আপনার প্রতি নাযিল করে আপনার কাছে সর্বোত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছি। নিঃসন্দেহে আপনি ইতিপূর্বে এসব ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। যেমন অন্য আয়াতে বলেছেন, “আর এভাবে আমরা আপনার প্রতি আমাদের নির্দেশ থেকে রূহ ওহী করেছি; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি এবং ঈমান কি! কিন্তু আমরা এটাকে করেছি আলো যা দ্বারা আমরা আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে হেদায়াত দান করি।” [সূরা আশ-শূরা: ৫২] [সা’দী] এতে নবুওয়াতের দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ রয়েছে। কেননা, তিনি পূর্ব থেকে নিরক্ষর এবং বিশ্ব ইতিহাস সম্পর্কে অনভিজ্ঞও ছিলেন। সুতরাং তিনি এখন যে বিজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছেন, তার মাধ্যম আল্লাহর শিক্ষা ও ওহী ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আল্লামা ইবন কাসীর এ আয়াত থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যনির্দেশ করেছেন। তা হচ্ছে, যেহেতু এ কুরআনে আল্লাহ তা'আলা সর্বোত্তম কাহিনী বর্ণনা করেছেন সেহেতু এ কিতাব নাযিল হওয়ার পর অন্য কোন কিতাবের প্রয়োজন নেই।
কারণ, একবার উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কোন এক কিতাবী লোক থেকে একটি প্রাচীন গ্রন্থ পেয়ে তা নিয়ে এসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পাঠ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত ক্রোধাম্বিত হলেন এবং বললেন, হে ইবনুল খাত্তাব! তোমরা কি পেরেশান হয়ে গেছ? পরিণাম বিবেচনা না করে যা-তা করে বেড়াবে? যত্র-তত্র ঢুকে যাবে? যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ, অবশ্যই আমি এটাকে শুভ্র,স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন হিসেবে নিয়ে এসেছি। তোমরা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করো না, ফলে তারা তোমাদেরকে কোন হক কথা জানাবে আর তোমরা মিথ্যা মনে করবে, আবার কোন বাতিল কথা জানাবে আর তোমরা সেটাকে সত্য মনে করবে। যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ, যদি মূসা জীবিত থাকতেন তবে আমার অনুসরণ ছাড়া তার গত্যন্তর ছিল না। [ইবন আবী আসেম: আস-সুন্নাহ ১/২৭]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩) আমি তোমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী[1] বর্ণনা করছি, অহীর মাধ্যমে তোমার কাছে এই কুরআন প্রেরণ করে; যদিও এর পূর্বে তুমি ছিলে অনবহিতদের অন্তর্ভুক্ত। [2]
[1] قصص শব্দটি মাসদার (ক্রিয়া-বিশেষণ)। অর্থ হল কোন বস্তুর পেছনে লাগা। উদ্দেশ্য চমৎকার ঘটনা। কেচ্ছা, শুধু কোন কল্পিত কাহিনী বা মনোরঞ্জন উপন্যাসকে বলা হয় না; বরং অতীতে ঘটে গেছে এমন ঘটনার বর্ণনাকে (অর্থাৎ, তার পিছনে লাগাকে আরবীতে কিসসা) ‘কেচ্ছা’ বলা হয়। (ইউসুফ (আঃ)-এর) এ ঘটনা ঠিক অতীতে সংঘটিত ইতিহাসের বাস্তব বর্ণনা এবং এতে হিংসা ও শত্রুতার পরিণতি, আল্লাহর সাহায্যের আজব পদ্ধতি, মন্দ-প্রবণ মনের পাপাচরণের কুফল এবং মানুষের বিভিন্ন অবস্থার সুন্দর বর্ণনা এবং বড় গুরুতত্ত্বপূর্ণ শিক্ষামূলক দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যার জন্য কুরআন একে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ কাহিনী’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
[2] কুরআন কারীমের এই শব্দাবলী দ্বারাও পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, নবী করীম (সাঃ) ‘আ-লিমুল গায়েব’ ছিলেন না, নচেৎ আল্লাহ তাআলা তাঁকে উক্ত ঘটনা সম্পর্কে ‘অনবহিত’ আখ্যায়িত করতেন না। দ্বিতীয় কথা এও বুঝা গেল যে, তিনি আল্লাহর সত্য নবী। কারণ তাঁর প্রতি ওহী অবতীর্ণ করেই এই সত্য ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি কোন শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন না যে, তাঁর নিকট থেকে শিক্ষা করে বর্ণনা করে দিয়েছেন। আর না অন্য কারোর সাথে তাঁর এমন সম্পর্ক ছিল যে, তার নিকট থেকে শ্রবণ করে এরূপ ঐতিহাসিক ঘটনা তার গুরুতত্ত্বপূর্ণ খুঁটিনাটি অংশ সহ বর্ণনা করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা নিঃসন্দেহে তা অহীর মাধ্যমে তাঁর প্রতি অবতীর্ণ করেছেন। যেমন এখানে সে কথা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৪. স্মরণ করুন, যখন ইউসুফ তার পিতাকে বলেছিলেন, হে আমার পিতা! আমি তো দেখেছি এগার নক্ষত্র, সূর্য এবং চাঁদকে, দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়।(১)
(১) ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ”কারীম ইবনে করীম ইবনে কারীম ইবনে কারীম হল ইউসুফ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইসহাক ইবনে ইবরাহীম আলাইহিমুস সালাম। অর্থাৎ চার পুরুষ ধরে সম্মানিত হচ্ছেন ইউসুফ আলাইহিস সালাম। [বুখারীঃ ৩৩৯০, ৪৬৮৮] অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, সবচেয়ে সম্মানিত কে? তিনি বললেনঃ তাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত হল যে বেশী তাকওয়ার অধিকারী। লোকেরা বললঃ আমরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করছি না, তখন তিনি বললেনঃ তাহলে সবচেয়ে সম্মানিত হলেন আল্লাহর নবী ইউসুফ। তার পিতা একজন নবী ছিলেন, আর তার দাদাও একজন নবী, যেমনিভাবে তার পরদাদাও নবী। [বুখারী ৩৩৫০, মুসলিমঃ ২৩৭৮]
ইউসুফ আলাইহিস সালাম তার পিতাকে বললেনঃ পিতা! আমি স্বপ্নে এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্রকে দেখেছি। আরো দেখেছি যে, তারা আমাকে সিজদা করছে। এটা ছিল ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর স্বপ্ন। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ এগারটি নক্ষত্রের অর্থ হচ্ছে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর এগার ভাই, সূর্য ও চন্দ্রের অর্থ পিতা ও মাতা। তিনি আরো বলেনঃ নবীদের স্বপ্ন ছিল ওহীর নামান্তর। [তাবারী; ইবন কাসীর] হাদীসে এসেছে, ‘নেক স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর খারাপ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ স্বপ্ন দেখবে তখন সে যেন তা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় এবং তার বাম দিকে থুথু ফেলে। ফলে সেটা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। [বুখারী: ৬৯৮৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) যখন ইউসুফ[1] তার পিতাকে বলল, ‘হে আমার পিতা! আমি (স্বপ্নে) এগারটি নক্ষত্র, সূর্য এবং চন্দ্র দেখলাম;[2] দেখলাম ওরা আমাকে সিজদাহ করছে।’
[1] অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ! তোমার সম্প্রদায়ের নিকট ইউসুফ (আঃ)-এর ঘটনা বর্ণনা কর, যখন সে তার পিতাকে বলল---। ইউসুফ (আঃ)-এর পিতা ছিলেন ইয়াকূব (আঃ); যেমন অন্য জায়গায় স্পষ্টভাবে তা উল্লিখিত হয়েছে। আর হাদীসেও উক্ত সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়েছে, কারীম (সম্মানিত) বিন কারীম বিন কারীম, ইউসুফ বিন ইয়াকূব বিন ইবরাহীম (আলাইহিমুস সালাম)। (আহমাদ ২/৯৬)
[2] কোন কোন তফসীরবিদ বলেছেন যে, এগারটি নক্ষত্র থেকে উদ্দেশ্য হল, ইউসুফ (আঃ)-এর এগার ভাই। আর চাঁদ ও সূর্য থেকে উদ্দেশ্য হল, তাঁর পিতা-মাতা। এ স্বপ্নের তা’বীর (ব্যাখ্যা) ৪০ অথবা ৮০ বছর পর যখন তাঁর পিতা-মাতা সহ সমস্ত ভায়েরা মিসরে গিয়ে তাঁর সামনে সিজদাবনত হয়েছিলেন, তখন বাস্তব রূপ পেয়েছিল। যেমন এ কথা সূরার শেষের দিকে (১০০নং আয়াতে) আসবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫. তিনি বললেন, হে আমার বৎস! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বলো না(১); বললে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে(২)। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।(৩)
(১) আয়াতে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে স্বীয় স্বপ্ন ভাইদের কাছে বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, হিতাকাংখী ও সহানুভূতিশীল নয়- এরূপ লোকের কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করা উচিত নয়। এছাড়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে পারদর্শী নয়- এমন ব্যক্তির কাছেও স্বপ্ন ব্যক্ত করা সঙ্গত নয়। এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কষ্টদায়ক বিপজ্জনক স্বপ্ন কারো কাছে বর্ণনা করতে নেই। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘স্বপ্ন পাখির পায়ের সাথে থাকে যতক্ষণ না সেটার ব্যাখ্যা করা হয়। যখনই সেটার ব্যাখ্যা করা হয়, তখনই সেটা পড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, স্বপ্ন হচ্ছে নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। তিনি আরও বলেছেন, স্বপ্নকে যেন কোন বন্ধু বা বুদ্ধিমান ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও কাছে বিবৃত করা না হয়। [ইবন মাজাহ ৩৯১৪; মুসনাদ: ৪/১০]
অন্য হাদীসে এসেছে, তোমাদের কেউ যখন কোন পছন্দনীয় স্বপ্ন দেখে তখন সে যেন যাকে মহব্বত করে তার নিকট বলে। আর যখন কোন খারাপ স্বপ্ন দেখে তখন সে যেন তার অন্য পার্শ্বে শয়ন করে এবং বামদিকে তিনবার থুথু ফেলে, আল্লাহর কাছে এর অনিষ্ট হতে আশ্রয় চায়, কাউকে এ সম্পর্কে কিছু না বলে, ফলে এ স্বপ্ন তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। [মুসলিম: ২২৬২]
অন্যান্য হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী বুঝা যায় যে, এ নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র দয়া ও সহানুভূতির উপর ভিত্তিশীল- আইনগত হারাম নয়। সহীহ হাদীসসমূহে বলা হয়েছে, ওহুদ যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমি স্বপ্নে দেখেছি আমার তরবারী ‘যুলফিকার’ ভেঙ্গে গেছে এবং আরো কিছু গাভীকে জবাই হতে দেখেছি। এর ব্যাখ্যা ছিল হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু-সহ অনেক মুসলিমের শাহাদাত বরণ। এটা একটা আশু মারাত্মক বিপর্যয় সম্পর্কিত ইঙ্গিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাহাবীদের কাছে এ স্বপ্ন বর্ণনা করেছিলেন। [মুস্তাদরাক হাকেমঃ ২৫৮৮, মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৭১]
(২) এ আয়াত থেকে আরো জানা যায় যে, মুসলিমকে অপরের অনিষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য অপরের কোন মন্দ অভ্যাস কিংবা খারাপ উদ্দেশ্য প্রকাশ করা জায়েয। এটা গীবত কিংবা অসাক্ষাতে পরনিন্দার অন্তর্ভুক্ত নয়। এ আয়াতে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে বলে দিয়েছেন যে, ভাইদের পক্ষ থেকে তার প্রতি শক্রতার আশংকা রয়েছে। [কুরতুবী]
(৩) অর্থাৎ বৎস! তুমি এ স্বপ্ন ভাইদের কাছে বর্ণনা করো না। আল্লাহ না করুন, তারা এ স্বপ্ন শুনে তোমার মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত হয়ে তোমাকে বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। কেননা, শয়তান হল মানুষের প্রকাশ্য শক্র। সে পার্থিব প্রভাব প্রতিপত্তি ও অর্থকড়ির লোভ দেখিয়ে মানুষকে এহেন অপকর্মে লিপ্ত করে দেয়। নবীগণের সব স্বপ্ন ওহীর সমপর্যায়ভুক্ত। সাধারণ মুসলিমদের স্বপ্নে নানাবিধ সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। তাই তা কারো জন্য প্রমাণ হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যখন সময় ঘনিয়ে আসবে (কেয়ামত নিকটবর্তী হবে) তখন মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন প্রায়ই সত্য হবে। আর মুমিনের স্বপ্ন নবুয়তের চল্লিশতম অংশ, আর যা নবুওয়াতের এ অংশের স্বপ্ন, তা মিথ্যা হবে না। বলা হয়ে থাকে, স্বপ্ন তিন প্রকার। এক প্রকার হচ্ছে মনের ভাষ্য, আরেক প্রকার হচ্ছে শয়তানের পক্ষ থেকে ভীতি জাগ্রত করে দেয়া। আর তৃতীয় প্রকার স্বপ্ন হচ্ছে- আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অপছন্দনীয় কিছু দেখে তবে সে যেন তা কারো কাছে বিবৃত না করে; বরং উঠে এবং সালাত আদায় করে। [বুখারীঃ ৭০১৭]
অপর হাদীসে এসেছে, “যতক্ষন পর্যন্ত স্বপ্নের তা'বীর করা না হয় ততক্ষণ তা উড়ন্ত অবস্থায় থাকে, তারপর যখনি তা’বীর করা হয় তখনি তা পতিত হয় বা ঘটে যায়”। [মুসনাদে আহমাদ ৪/১০, আবু দাউদঃ ৫০২০, তিরমিযীঃ ২২৭৮, ইবনে মাজাহঃ ৩৯১৪]
এখানে এ বিষয়টি চিন্তাসাপেক্ষ যে, সত্য স্বপ্ন নবুয়তের অংশ-এর অর্থ কি? এর তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে তেইশ বৎসর পর্যন্ত ওহী আগমন করতে থাকে। তন্মধ্যে প্রথম ছ'মাস স্বপ্লের আকারে এ ওহী আগমন করে। অবশিষ্ট পয়তাল্লিশ ষান্মাসিকে জিবরীলের মধ্যস্থতায় ওহী আগমন করে। এ হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় যে, সত্য স্বপ্ন নুবয়তের ৪৬তম অংশ। [কুরতুবী] এখানে আরও জানা আবশ্যক যে, হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী সত্য স্বপ্ন অবশ্যই নবুয়তের অংশ, কিন্তু নবুওয়াত নয়। নবুওয়াত আখেরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত এসে শেষ হয়ে গেছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ভবিষ্যতে মুবাশশিরাত ব্যতীত নবুয়তের কোন অংশ বাকী নেই। সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ ‘মুবাশশিরাত’ বলতে কি বুঝায়? উত্তর হলঃ সত্য স্বপ্ন। [বুখারীঃ ৬৯৯০]
এতে প্রমাণিত হয় যে, নবুওয়াত কোন প্রকারে অথবা কোন আকারেই অবশিষ্ট নেই। শুধুমাত্র এর একটি ক্ষুদ্রতম অংশ অবশিষ্ট আছে যাকে মুবাশশিরাত অথবা সত্য স্বপ্ন বলা হয়। তবে সত্য স্বপ্ন দেখা এবং তদনুরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া এটুকু বিষয়ই কারো সৎ, দ্বীনী এমনকি মুসলিম হওয়ারও প্রমাণ নয়। তবে এটা ঠিক যে, সৎ ও নেক লোকদের স্বপ্ন সাধারণতঃ সত্য হবে -এটাই আল্লাহর সাধারণ রীতি। ফাসেক ও পাপাচারীদের সাধারণতঃ মনের সংলাপ ও শয়তানী প্ররোচনা ধরণের মিথ্যা স্বপ্ন হয়ে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে এর বিপরীতও হওয়া সম্ভব। মোটকথা, সত্য স্বপ্ন সাধারণ মুসলিমদের জন্য হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী সুসংবাদ কিংবা হুশিয়ারীর চাইতে অধিক মর্যাদা রাখে না। এটা স্বয়ং তাদের জন্য কোন ব্যাপারে প্রমাণরূপে গণ্য নয় এবং অন্যের জন্যও নয়।
তাফসীরে জাকারিয়া(৫) (পিতা ইয়াকূব) বলল, ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের নিকট বর্ণনা করো না, করলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে।[1] শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।[2]
[1] ইয়াকূব (আঃ) সপ্ন শুনে অনুমান করলেন যে, তাঁর এই পুত্র মহা সম্মানের অধিকারী হবে। ফলে তিনি ভয় করছিলেন যে, এই স্বপ্ন শুনে তাঁর অন্য ভাইরাও তাঁর মর্যাদার কথা বুঝতে পেরে তাঁর কোন ক্ষতি না করে বসে। তাই তিনি এই স্বপ্নের কথা বর্ণনা করতে নিষেধ করলেন।
[2] তিনি ভাইদের চক্রান্তের কারণও বলে দিলেন যে, শয়তান যেহেতু মানুষের চিরশত্রু সেহেতু সে মানুষকে ভ্রষ্ট ও হিংসা-বিদ্বেষে নিমজ্জিত করার সর্বদা সুযোগ খোঁজে। বলা বাহুল্য, এটা শয়তানের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল যে, ইউসুফ (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ভাইদের মনে হিংসা ও বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। যেমন পরে সত্য সত্যই সে তাই করেছিল এবং ইয়াকূব (আঃ)-এর আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬. আর এভাবে আপনার রব আপনাকে মনোনীত করবেন এবং আপনাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা(১) শিক্ষা দেবেন(২) এবং আপনার প্রতি ইয়াকূবের পরিবার-পরিজনদের উপর তার অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন(৩), যেভাবে তিনি এটা আগে পূর্ণ করেছিলেন আপনার পিতৃ-পুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের উপর।(৪) নিশ্চয় আপনার রব সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়ত।(৫)
(১) উপরে বর্ণিত অর্থটি মুজাহিদ ও অন্যান্য তাফসীরকারক বর্ণনা করেছেন। [ইবন কাসীর] কোন কোন মুফাসসির বলেন, এর অর্থ সত্য কথার ব্যাখ্যা। সে হিসেবে আসমানী কিতাবসমূহের সঠিক ব্যাখ্যাও হতে পারে। [সা'দী]
(২) অধিকাংশ মুফাসসির বলেন, আয়াতটি ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর পূর্ব কথার পরিপূরক বাক্য অর্থাৎ ইয়াকুব আলাইহিস সালাম নিজেই বলছেন, হে ইউসুফ! তুমি তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের বলো না। কেননা, তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে। যেভাবে তুমি স্বপ্নে তোমাকে সম্মানিত দেখেছ, এভাবে আল্লাহ তোমাকে মনোনীত করবেন নবী হিসেবে এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে। অনুরূপভাবে তোমার উপর তার নেয়ামত পরিপূর্ণ করবেন। [বাগভী; ইবন কাসীর]
অথবা এ আয়াতটি আল্লাহর পক্ষ থেকে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর প্রতি প্রদত্ত সুসংবাদ অর্থাৎ এখানে আল্লাহ্ তা'আলা ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে কতিপয় নেয়ামত দানের ওয়াদা করেছেন। প্রথম, আল্লাহ স্বীয় নেয়ামত ও অনুগ্রহরাজির জন্য আপনাকে মনোনীত করবেন। মিসর দেশে রাজ্য, সম্মান ধন-সম্পদ লাভের মাধ্যমে এ ওয়াদা পূর্ণতা লাভ করেছে। দ্বিতীয়, আল্লাহ্ তা'আলা আপনাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত জ্ঞান শিক্ষা দেবেন। [কুরতুবী] তবে প্রথম তাফসীরটি বেশী যুক্তিযুক্ত। এ আয়াত থেকে আরো জানা গেল যে, স্বপ্নের ব্যাখ্যা একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র, যা আল্লাহ তা'আলা কোন কোন ব্যক্তিকে দান করেন। সবাই এর যোগ্য নয়। ইমাম মালেক রাহিমাহুল্লাহ এ ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। [দেখুন, কুরতুবী]
(৩) তৃতীয় ওয়াদা (وَيُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ) অর্থাৎ আল্লাহ আপনার প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করবেন। এতে নবুওয়াত দানের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে এবং পরবর্তী বাক্যসমূহেও এর প্রতি ইঙ্গিত আছে। [কুরতুবী; ইবন কাসীর] কেউ কেউ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনার ভাইদেরকে আপনার প্রতি মুখাপেক্ষী বানাব। আবার কেউ কেউ অর্থ করেছেন, আপনাকে প্রতিটি বিপদ থেকে উদ্ধার করব। [কুরতুবী] তবে আয়াতের পরবর্তী অংশ থেকে বুঝা যায় যে, এখানে নবুওয়াতই বুঝানো হয়েছে।
(৪) অর্থাৎ যেভাবে আমি স্বীয় নবুওয়াতের নেয়ামত আপনার পিতৃ-পুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতি ইতিপূর্বে পূর্ণ করেছি। এখানে নেয়ামত বলতে অন্যান্য নেয়ামতের সাথে সাথে নবুওয়াত ও রেসালাতই উদ্দেশ্য। [ইবন কাসীর]
(৫) আয়াতের শেষে বলা হয়েছে (إِنَّ رَبَّكَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ) অর্থাৎ আপনার পালনকর্তা অত্যন্ত জ্ঞানবান, সুবিজ্ঞ। তিনি ভাল করেই জানেন কার কাছে ওহী পাঠাবেন, কাকে রাসূল বানাবেন। কে নবুওয়াত ও রিসালাতের অধিক উপযুক্ত। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬) এভাবে[1] তোমার প্রতিপালক তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তোমাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দেবেন, আর তোমার প্রতি[2] ও ইয়াকূবের পরিবার-পরিজনের প্রতি[3] তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন, যেভাবে তিনি তোমার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম ও ইসহাকের প্রতি পূর্বে তা পূর্ণ করেছিলেন। তোমার প্রতিপালক সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।’
[1] অর্থাৎ যেভাবে তোমাকে তোমার প্রভু বড় মহত্তপূর্ণ স্বপ্ন দেখানোর জন্য বেছে নিয়েছেন, সেইভাবে তোমার প্রভু তোমাকে সম্মান দানে মনোনীত করবেন এবং স্বপ্নের তা’বীর (ব্যাখ্যা) শিখাবেন। تأويل الأحاديث এর প্রকৃত অর্থ হল কথার গভীরে পৌঁছনো। এখানে উদ্দেশ্য হল, স্বপ্নের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য।
[2] এর উদ্দেশ্য হল নবুঅত; যা ইউসুফ (আঃ)-কে প্রদান করা হয়েছিল। অথবা সেই নেয়ামতসমূহ যা ইউসুফ (আঃ)-কে মিশরে প্রদান করা হয়েছিল।
[3] এর দ্বারা ইউসুফ (আঃ)-এর ভাই, তাঁদের সন্তানাদিকে বুঝানো হয়েছে। যারা পরে আল্লাহর অনুগ্রহের অধিকারী হয়েছিলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭. অবশ্যই ইউসুফ এবং তার ভাইদের(১) ঘটনায় জিজ্ঞাসুদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।(২)
(১) আলোচ্য আয়াতে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর ভাইদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইউসুফসহ ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর বারজন পুত্র সন্তান ছিল। তাদের প্রত্যেকেরই সন্তান-সন্ততি হয় এবং বংশ বিস্তার লাভ করে। ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-এর উপাধি ছিল ইসরাঈল। তাই বারটি পরিবার সবাই ‘বনী-ইসরাঈল’ নামে খ্যাত হয়। ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর একমাত্র সহোদর ভাই ছিলেন বিনইয়ামীন এবং অবশিষ্ট দশজন বৈমাত্রেয় ভাই। [বাগভী; কুরতুবী; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ১/৪৫৫]
(২) এ আয়াতে বর্ণিত নিদর্শনসমূহ কি? এ ব্যাপারে কয়েকটি মত রয়েছে। এক. এতে রয়েছে উপদেশ ও শিক্ষা। দুই. আশ্চর্যজনক কথাসমূহ। তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের প্রমাণ। কারণ, তিনি এ ঘটনা জানতেন না, যদি তার কাছে ওহী না আসে তো তিনি তা কিভাবে জানালেন? চার. এর অর্থ হচ্ছে, যারা প্রশ্ন করে জানতে চায় এবং যারা জানতে চায় না তাদের সবার জন্যই রয়েছে নিদর্শন। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য এ কাহিনীর মধ্যে অনেক প্রকার শিক্ষা রয়েছে। যেমন, এতে রয়েছে ভাইদের হিংসা, তাদের হিংসার পরিণতি, ইউসুফের স্বপ্ন এবং এর বাস্তবায়ন, কুপ্রবৃত্তি থেকে, দাসত্ব অবস্থা, বন্দিত্ব অবস্থা ইত্যাদিতে ইউসুফের সবর, বাদশাহী প্রাপ্তি, ইয়াকুবের পেরেশনী, তার ধৈর্য। শেষ পর্যন্ত প্রার্থিত অবস্থায় উপনীত হওয়া ইত্যাদি সবই এখানে নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে। [বাগভী] তাই এ সূরায় বর্ণিত ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর কাহিনীকে শুধুমাত্র একটি কাহিনীর নিরিখে দেখা উচিত নয়; বরং এতে জিজ্ঞাসু ও অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিবর্গের জন্য আল্লাহ তা'আলার অপার শক্তির বড় বড় নিদর্শন ও নির্দেশাবলী রয়েছে।
তাফসীরে জাকারিয়া(৭) নিশ্চয়ই ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের কাহিনীতে জিজ্ঞাসুদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে। [1]
[1] অর্থাৎ, এই ঘটনাতে আল্লাহর অসীম ক্ষমতা এবং নবী (সাঃ)-এর নবুঅতের সত্যবাদিতার বড় নিদর্শন রয়েছে। কোন কোন তফসীরবিদ এখানে ইউসুফ (আঃ)-এর ভাইদের নাম এবং তাঁদের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৮. স্মরণ করুন, তারা বলেছিল, আমাদের পিতার কাছে ইউসুফ এবং তার ভাই তো আমাদের চেয়ে বেশী প্রিয়, অথচ আমরা একটি সংহত দল; আমাদের পিতা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই আছে।(১)
(১) এখানে ضلال বলে পথভ্রষ্টতা বুঝানো হয়নি। বরং কোন বিষয়ের আসল জ্ঞানের অভাব বুঝানো উদ্দেশ্য। কুরআনের অন্যত্রও এ শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন ইউসুফ আলাইহিস সালামের ভ্রাতারা তার পিতাকে এ সূরার অন্যত্র বলেছিল, “আল্লাহর শপথ! আপনি তো পুরাতন জ্ঞানহীনতাতেই আছেন।” [৯৫] তাছাড়া অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ বলেছেন যে, “আর আপনাকে তিনি (আল্লাহ) পেয়েছেন (এ বিষয়ে) জ্ঞানহীন, তারপর তিনি আপনাকে পথ দেখিয়েছেন [সূরা আদ-দোহাঃ ৭] এখানে অর্থ হবে, যে সমস্ত জ্ঞান ওহী ব্যতীত পাওয়া যায় না সেগুলোতে আপনি জ্ঞানী ছিলেন না। তারপর আল্লাহ আপনাকে এ কুরআন ওহী করার মাধ্যমে সেগুলোর প্রতি দিক-নির্দেশ করেছেন এবং আপনাকে তা জানিয়েছেন। সে হিসেবে আলোচ্য আয়াতের অর্থ এ নয় যে, তারা ইয়াকুব আলাইহিস সালামকে দ্বীনীভাবে ভ্রষ্ট বলছেন, কারণ এটা বললে কাফের হয়ে যাবে। বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো, তাদের পিতা তাদের ধারণা মতে বাস্তব অবস্থা বুঝতে অক্ষম, প্রতিটি বস্তুকে তার সঠিক স্থানে স্থান দেন নি। নতুবা কিভাবে তিনি দশজনকে ভাল না বেসে দু’জনকে ভালবাসলেন? দশজন তো দু’জনের চেয়ে বেশী উপকারী ও তার কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বেশী দক্ষ। [আদওয়াউল বায়ান]
এ আয়াত থেকে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর কাহিনী শুরু হয়েছে। ইউসুফ 'আলাইহিস সালাম-এর ভ্রাতারা পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম-কে দেখল যে, তিনি ইউসুফের প্রতি অসাধারণ মহব্বত রাখেন। ফলে তাদের মনে হিংসা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তারা পরস্পর বলাবলি করলঃ আমরা পিতাকে দেখি যে, তিনি আমাদের তুলনায় ইউসুফ ও তার অনুজ বিনইয়ামীনকে অধিক ভালবাসেন। অথচ আমরা দশজন এবং তাদের জ্যেষ্ঠ হওয়ার কারণে গৃহের কাজকর্ম করতে সক্ষম। তারা উভয়েই ছোট বালক বিধায় গৃহস্থালীর কাজ করার শক্তি রাখে না। আমাদের পিতার উচিত হল এ বিষয় অনুধাবন করা এবং আমাদেরকে অধিক মহব্বত করা। আমাদের পিতা আসলে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে মোটেই ওয়াকিবহাল নন। তার উচিত আমাদেরকে প্রাধান্য দেয়া। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে অবিচার করে যাচ্ছেন। তাই তোমরা হয় ইউসুফকে হত্যা কর, না হয় এমন দূর দেশে নির্বাসিত কর, যেখান থেকে সে আর ফিরে আসতে না পারে।
তাফসীরে জাকারিয়া(৮) (স্মরণ কর) যখন তারা (তার ভাইরা) বলেছিল, ‘আমাদের পিতার নিকট ইউসুফ এবং তার (সহোদর) ভাই[1] (বিনয়ামীন)ই আমাদের চেয়ে অধিক প্রিয়, অথচ আমরা একটি (সংহত) দল,[2] আমাদের পিতা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছেন। [3]
[1] ‘তার (সহোদর) ভাই’ বলে বিনয়্যামীনকে বুঝানো হয়েছে।
[2] অর্থাৎ, আমরা দশ ভাই শক্তিশালী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর ইউসুফ ও বিনয়্যামীন মাত্র দুইজন। এর পরেও তারা আমাদের পিতার চক্ষুর শীতলতা ও মনের প্রফুল্লতা!
[3] এখানে বিভ্রান্তির অর্থ হল ভুল; যা তাঁদের ধারণা অনুযায়ী তাঁদের পিতা ইউসুফ ও বিনয়্যামীনকে অধিক ভালবেসে করেছিলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯. তোমরা ইউসুফকে হত্যা কর অথবা কোন স্থানে তাকে ফেলে আস, তাহলে তোমাদের পিতার দৃষ্টি শুধু তোমাদের দিকেই নিবিষ্ট হবে এবং তারপর তোমরা ভাল লোক হয়ে যাবে।(১)
(১) এ আয়াতে ভাইদের পরামর্শ বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ মত প্রকাশ করল যে, ইউসুফকে হত্যা করা হোক। কেউ বললঃ তাকে কোন অন্ধকূপের গভীরে নিক্ষেপ করা হোক- যাতে মাঝখান থেকে এ কন্টক দূর হয়ে যায় এবং পিতার সমগ্র মনোযোগ তোমাদের প্রতিই নিবদ্ধ হয়ে যায়। হত্যা কিংবা কুপে নিক্ষেপ করার কারণে যে গোনাহ হবে, তার প্রতিকার এই যে, পরবর্তীকালে তাওবা করে তোমরা সাধু হয়ে যেতে পারবে। আয়াতের (وَتَكُونُوا مِنْ بَعْدِهِ قَوْمًا صَالِحِينَ) বাক্যের এক অর্থ তাই বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া এরূপ অর্থও হতে পারে যে, ইউসুফকে হত্যা করার পর তোমাদের অবস্থা ঠিক হয়ে যাবে। [কুরতুবী] অথবা অর্থ এই যে, হত্যার পর পিতা-মাতার কাছে তোমরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে। কাউকে আর প্রাধান্য দেয়ার বিষয় থাকবে না। [কুরতুবী]
ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর ভ্রাতারা যে নবী ছিল না, উপরোক্ত পরামর্শ তার প্রমাণ। কেননা, এ ঘটনায় তারা অনেকগুলো কবীরা গোনাহ করেছে। একজন নিরপরাধকে হত্যার সংকল্প, পিতার অবাধ্যতা এবং তাকে কষ্ট প্রদান, চুক্তির বিরুদ্ধাচরণ ও অসৎ চক্রান্ত ইত্যাদি। [কুরতুবী; ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯) ইউসুফকে হত্যা কর অথবা তাকে কোন (দূরবর্তী) স্থানে ফেলে এস, তাহলে তোমাদের পিতার দৃষ্টি শুধু তোমাদের প্রতিই নিবিষ্ট হবে এবং তারপরে তোমরা (তওবা করে) ভাল লোক হয়ে যাবে।’ [1]
[1] অর্থাৎ, তওবা করে নেবে। অর্থাৎ, কূপে নিক্ষেপ করা অথবা হত্যা করার পর সেই গোনাহ থেকে আল্লাহর নিকট তওবা করে নেবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১০. তাদের মধ্যে একজন বলল, তোমরা ইউসুফকে হত্যা করো না এবং যদি কিছু করতেই চাও তবে তাকে কোন কূপের গভীরে নিক্ষেপ কর, যাত্রীদলের কেউ তাকে তুলে নিয়ে যাবে।(১)
(১) এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ ভ্রাতাদের মধ্যেই একজন সমস্ত কথাবার্তা শুনে বললঃ ইউসুফকে হত্যা করো না। যদি কিছু করতেই হয় তবে, কুপের গভীরে এমন জায়গায় নিক্ষেপ কর, যেখানে সে জীবিত থাকে এবং পথিক যখন কুপে আসে, তখন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে একদিকে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে এবং অপরদিকে তাকে নিয়ে তোমাদেরকে কোন দূরদেশে যেতে হবে না। কোন কাফেলা আসবে, তারা স্বয়ং তাকে সাথে করে দূর-দূরান্তে পৌছে দেবে। কারো কারো মতে এ অভিমত প্রকাশকারী সম্পর্কেই পরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মিসরে যখন ইউসুফ আলাইহিস সালাম-এর ছোট ভাই বিনইয়ামীনকে আটক করা হয়, তখন সে বলেছিলঃ আমি ফিরে গিয়ে পিতাকে কিভাবে মুখ দেখাব? তাই আমি কেনানে ফিরে যাব না। [তাবারী; কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০) তাদের মধ্যে একজন বলল, ‘ইউসুফকে হত্যা করো না, বরং যদি তোমরা কিছু করতেই চাও, তাহলে তাকে কোন গভীর কূপে[1] নিক্ষেপ কর, যাত্রীদলের কেউ তাকে তুলে নিয়ে যাবে।’ [2]
[1] جبٌ কূপকে ও غِيابَةٌ কূপের গভীরতাকে বলা হয়। কূপ এমনিতেই গভীর হয় এবং তাতে নিক্ষিপ্ত বস্তুকে দেখতে পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও কূপের গভীরতার কথা উল্লেখ করে অতিশয়োক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে।
[2] অর্থাৎ, পথচারী মুসাফির, যখন পানির খোঁজে কূপের নিকট আসবে, তখন হয়তো কেউ জানতে পারবে যে, কূপে কোন মানুষ পড়ে আছে এবং সে তাকে তুলে নিজের সাথে নিয়ে যাবে। ইউসুফ (আঃ)-এর এক ভাই এই বুদ্ধি দয়াবশতঃ পেশ করলেন। হত্যার পরিবর্তে উক্ত বুদ্ধিতে সত্যই সহানুভূতির আর্দ্রতা ছিল। ভাইদের মনে হিংসার আগুন এমনভাবে জ্বলে উঠেছিল যে, উক্ত অভিমত তিনি ভয়ে ভয়ে পেশ করে বলেছিলেন যে, যদি তোমাদেরকে কিছু করতেই হয়, তবে এরূপ কর।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান