-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১. আলিফ লাম-মীম-রা, এগুলো কিতাবের আয়াত, আর যা আপনার রব হতে আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা সত্য(১); কিন্তু বেশীর ভাগ মানুষই ঈমান আনে না।(২)
(১) আয়াতের প্রথমে “এগুলো কিতাবের আয়াত আর যা আপনার রব হতে আপনার প্রতি নাযিল হয়েছে তা সত্য” বলে কি বুঝানো হয়েছে তাতে দুটি মত রয়েছে। এক. এখানে “এগুলো কিতাবের আয়াত” বলে কুরআনের পূর্বে নাযিলকৃত কিতাবসমূহকে বুঝানো হয়েছে, [তাবারী; বাগভী] আর তখন “আর যা আপনার রব হতে আপনার প্রতি নাযিল হয়েছে” বলে কুরআনকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে [তাবারী] দুই. এখানে “এগুলো কিতাবের আয়াত” বলে কুরআনুল করীম আল্লাহর কালাম এবং “আর যা আপনার রব এর পক্ষ হতে আপনার প্রতি নাযিল হয়েছে” বলে কুরআনই বুঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর] সে মতে আয়াতের অর্থ এই যে, এই কুরআনে যেসব বিধি-বিধান আপনার প্রতি নাযিল হয়, সেগুলো সব সত্য এবং সন্দেহের অবকাশমুক্ত। সেগুলোকে আঁকড়ে ধরুন। [বাগভী]
(২) যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, “আর আপনি যতই চান না কেন, বেশীর ভাগ লোকই ঈমান গ্রহণকারী নয়।” [সূরা ইউসুফঃ ১০৩]
তাফসীরে জাকারিয়া(১) আলিফ লা-ম মী-ম রা। এগুলি কুরআনের আয়াত; যা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে তাই সত্য। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এতে বিশ্বাস করে না।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২. আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ উপরে স্থাপন করেছেন খুঁটি ছাড়া(১), তোমরা তা দেখছ।(২) তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন(৩) এবং সূর্য ও চাঁদকে নিয়মাধীন করেছেন(৪); প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলবে।(৫) তিনি সব বিষয় পরিচালনা করেন, আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন(৬), যাতে তোমরা তোমাদের রবের সঙ্গে সাক্ষাত সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।(৭)
(১) আয়াতের এক অনুবাদ উপরে করা হয়েছে যে, আল্লাহ্ তা'আলা আসমানসমূহকে কোন খুঁটি ব্যতীত উপরে উঠিয়েছেন, তোমরা সে আসমানসমূহকে দেখতে পাচ্ছ। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] অর্থাৎ আল্লাহ এমন এক সত্তা, যিনি আসমানসমূহকে সুবিস্তৃত ও বিশাল গম্বুজাকার খুঁটি ব্যতীত উচ্চে উন্নীত রেখেছেন যেমন তোমরা আসমানসমূহকে এ অবস্থায়ই দেখ। এ অর্থের স্বপক্ষে আমরা পবিত্র কুরআনের অন্যত্র দেখতে পাই সেখানে বলা হয়েছে, “আর তিনিই আকাশকে স্থির রাখেন যাতে তা পড়ে না যায় পৃথিবীর উপর তার অনুমতি ছাড়া।” [সূরা আল-হাজ্জঃ ৬৫] তবে আয়াতের অন্য এক অনুবাদ হলো, আল্লাহ তা'আলা আসমানসমূহকে অদৃশ্য ও অননুভূত স্তম্ভসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ অনুবাদটি ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ, হাসান ও কাতাদা রাহেমাহুমুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর] তবে ইবন কাসীর প্রথম তাফসীরকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
(২) কুরআনুল কারীমের কতিপয় আয়াতে আকাশ দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে; যেমন এ আয়াতে تَرَوْنَهَا বলা হয়েছে এবং অন্য এক আয়াতে (وَإِلَى السَّمَاءِ كَيْفَ رُفِعَتْ) [সূরা আল-গাশিয়াহঃ ১৮] বলা হয়েছে। বিভিন্ন বর্ণনায় এটা এসেছে যে, যমীনের আশেপাশে যা আছে যেমনঃ বাতাস, পানি ইত্যাদি প্রথম আসমান এ সবগুলোকে সবদিক থেকে সমভাবে বেষ্টন করে আছে। যে কোন দিক থেকেই প্রথম আসমানের দিকে যাত্রা করা হউক না কেন তা পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বে রয়েছে। আবার প্রথম আসমান বা নিকটতম আসমানের দূরত্বও পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বের মত। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় আসমানও প্রথম আসমানকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে আছে। এ দুটোর দূরত্ব পাঁচশত বছরের পথের দূরত্বের মত। আবার দ্বিতীয় আসমানের পুরুত্বও পাঁচশত বছরের রাস্তার মত। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম আসমানও তদ্রুপ দূরত্ব ও পুরত্ব বিশিষ্ট।
এ আসমানসমূহকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজস্ব ক্ষমতাবলে কোন প্রকার বাহ্যিক খুঁটি ব্যতীতই ধারন করে রেখেছেন। সেগুলো একটির উপর আরেকটি পড়ে যাচ্ছেনা এটা একদিকে যেমন তাঁর মহা শক্তিধর ও ক্ষমতাবান হওয়া নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে অন্যদিকে আসমান ও যমীন যে কত প্রকাণ্ড সৃষ্টি তার এক প্রচ্ছন্ন ধারণা আমাদেরকে দেয়। [ইবন কাসীর] মহান আল্লাহ বলেন, “মানুষকে সৃষ্টি করা অপেক্ষা আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি তো কঠিনতর, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এটা জানে না।” [সূরা গাফেরঃ ৫৭] অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সাত আসমান এবং তাদের মত পৃথিবীও, তাদের মধ্যে নেমে আসে তার নির্দেশ; যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে আছেন।” [সূরা আত-তালাকঃ ১২] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সাত আসমান ও এর ভিতরে যা আছে এবং এর মাঝখানে যা আছে তা সবই কুরসীর মধ্যে যেন বিস্তীর্ণ যমীনের মধ্যে একটি আংটি আর কুরসী হলো মহান আরশের মধ্যে তদ্রুপ একটি আংটি স্বরূপ যা এক বিস্তীর্ণ যমীনে পড়ে আছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আর আরশ তার পরিমাণ তো মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ নির্ধারণ করে বলতে পারবে না। [তাবারী]
(৩) এর ব্যাখ্যা সূরা বাকারাহ এবং সূরা আল-আ'রাফে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে সংক্ষেপে এখানে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ আরশের উপর উঠার ব্যাপারটি তাঁর একটি বিশেষ গুণ। তিনি আরশের উপর উঠেছেন বলে আমরা স্বীকৃতি দেব। কিন্তু কিভাবে তিনি তা করেছেন তা আমাদের জ্ঞানের বাইরের বিষয়।
(৪) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা সূর্য ও চন্দ্রকে আজ্ঞাধীন করেছেন। প্রত্যেকটিই একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলে। আজ্ঞাধীন করার অর্থ এই যে, উভয়কে তিনি সৃষ্টিকুলের উপকারের জন্য, তার বান্দাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য নিয়োজিত করেছেন, মূলত: প্রতিটি সৃষ্টিই স্রষ্টার আজ্ঞাধীন। [কুরতুবী] যে কাজে তাদেরকে আল্লাহ নিয়োজিত করেছেন তারা অহর্নিশ তা করে যাচ্ছে। হাজারো বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে; কিন্তু কোন সময় তাদের গতি চুল পরিমাণও কম-বেশী হয়নি। তারা ক্লান্ত হয় না এবং কোন সময় নিজের নির্দিষ্ট কাজ ছেড়ে অন্য কাজে লিপ্ত হয় না। [কুরতুবী]
(৫) আয়াতে উল্লেখিত أجل শব্দটির মূল অর্থঃ সময়। তবে অন্যান্য অর্থেও এর ব্যবহার আছে। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ বর্ণনায় কয়েকটি মত রয়েছেঃ
এক. এখানে (أَجَلٍ مُسَمًّى) বা সুনির্দিষ্ট মেয়াদ বলতে বুঝানো হয়েছে যে, চাঁদ ও সূর্য কিয়ামত পর্যন্ত তাদের সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে চলতে থাকবে। যখন সূর্যকে গুটিয়ে নেয়া হবে, চাঁদকে নিষ্প্রভ করা হবে, তারকাসমূহ আলোহীন হয়ে পড়বে আর গ্রহ নক্ষত্রগুলো খসে পড়বে, তখন পর্যন্ত এগুলো চলবে। যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ।” [সূরা ইয়াসীনঃ ৩৮] এখানে গন্তব্য বলে সুনির্দিষ্ট সময়ও উদ্দেশ্য হতে পারে। [ইবন কাসীর; কুরতুবী]
দুই. কোন কোন মুফাসসির বলেন, এ আয়াতের অর্থ, আল্লাহ্ তা'আলা প্রত্যেক গ্রহের জন্যে একটি বিশেষ গতি ও বিশেষ কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তারা সব সময় নিজ নিজ কক্ষপথে নিধারিত গতিতে চলমান থাকে। চন্দ্র নিজ কক্ষপথ এক মাসে এবং সূর্য এক বছরে অতিক্রম করে। [কুরতুবী]
তিন. অথবা আয়াতের অর্থ, আল্লাহ সেগুলোকে সুনির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানের প্রতি ধাবিত করান। আর সে গন্তব্যস্থান হলো আরশের নীচে। এ ব্যাপারে সহীহ হাদীসে বিস্তারিত এসেছে সূরা ইয়াসীনে যার বর্ণনা আসবে। [ইবন কাসীর]
(৬) অর্থাৎ তিনি আয়াতসমূহকে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। এর মানে, আল্লাহ্ তাআলা অপার শক্তির নিদর্শনাবলী তিনি বর্ণনা করছেন। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ তিনি বিস্তারিত প্রমাণ পেশ করছেন যে, যিনি পূর্ব বর্ণিত কাজগুলো করতে পারেন তিনি অবশ্যই মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় আনতে সক্ষম। [কুরতুবী] এগুলো আরও প্রমাণ করছে যে, তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তিনি যখন ইচ্ছা তখনই তাঁর সৃষ্টিকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন। [ইবন কাসীর]
(৭) অর্থাৎ সমগ্র সৃষ্টজগৎ ও তার বিস্ময়কর পরিচালন-ব্যবস্থা আল্লাহ তা'আলা এজন্য কায়েম করেছেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে আখেরাত ও কেয়ামতে বিশ্বাসী হও এবং সত্য বলে মেনে নাও। [বাগভী] কেননা, এ বিস্ময়কর ব্যবস্থা ও সৃষ্টির প্রতি লক্ষ্য করার পর আখেরাতে মানুষকে পুনর্বার সৃষ্টি করাকে আল্লাহর শক্তি বহির্ভূত মনে করা সম্ভব হবে না।
তাফসীরে জাকারিয়া(২) আল্লাহই স্তম্ভ ছাড়া আকাশমন্ডলীকে ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছেন; তোমরা তা দেখছ। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হয়েছেন[1] এবং সূর্য ও চন্দ্রকে বশীভূত করেছেন; প্রত্যেকে নির্দিষ্ট মিয়াদে আবর্তন করে।[2] তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।
[1] استَوَى عَلَى العَرش এর ভাবার্থ ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে যে, এর অর্থ মহান আল্লাহর আরশে অবস্থান করা। হাদীস বিশারদদের তরীকা এটাই যে, তাঁরা আল্লাহর কোন গুণের তা‘বীল (অপব্যাখ্যা) করেন না, যেমন অন্যরা মহান আল্লাহর উক্ত গুণের এবং তাঁর অন্যান্য গুণের অপব্যাখ্যা করে থাকে। হাদীস বিশারদগণ এও বলেছেন যে, তাঁর গুণাবলীর কেমনত্বও বর্ণনা করা যাবে না এবং কোন কিছুর সাথে তুলনাও করা যাবে না। তিনি বলেন: ﴿لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ﴾ অর্থ, কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শূরা ১১)
[2] এর একটি অর্থ এই যে, ‘প্রত্যেকে নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত আবর্তন করবে।’ অর্থাৎ কিয়ামত অবধি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক চলতে থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَّهَا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ﴾ অর্থাৎ, সূর্য তার স্থির হওয়ার সময় পর্যন্ত চলছে, এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (সূরা ইয়াসীন ৩৮) দ্বিতীয় অর্থ এই যে, চন্দ্র এবং সূর্য উভয়েই নিজ নিজ কক্ষপথে আবর্তন করছে। সূর্য নিজের চক্র এক বছরে এবং চন্দ্র এক মাসে পূর্ণ করে নেয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ﴿وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ﴾ অর্থাৎ, চন্দ্রের জন্যে আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিনণ কক্ষপথ। (সূরা ইয়াসীন ৩৯) সাতটি বৃহৎ বৃহৎ গ্রহ রয়েছে, ওদের মধ্যে দু’টি হলো সূর্য এবং চন্দ্র। এখানে শুধু উক্ত দু’টি গ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন, কেননা এ দুটিই (মানুষের চক্ষুদৃষ্টিতে) সর্বাধিক বিশাল এবং মহত্বপূর্ণ। এ দুটিও যখন আল্লাহর নির্দেশাধীন, তাহলে অন্যগুলো নিশ্চিতরূপে তাঁর নির্দেশাধীন হবে। আর যখন এরা আল্লাহর হুকুমের অধীনে, তখন এরা মা‘বূদ (উপাস্য) হতে পারে না। মা‘বূদ তো তিনিই, যিনি এদেরকে অধীনস্থ করে রেখেছেন। তাই তিনি বলেন,﴿لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِله الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ﴾ অর্থাৎ, চন্দ্র-সূর্যকে সিজদা করো না, সেই আল্লাহকে সিজদা কর, যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করতে চাও। (সূরা ফুসস্বিলাত ৩৭) অন্যত্র বলেন, ﴿وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ﴾ অর্থাৎ, সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজি সবই তাঁর হুকুমের অনুগত। (সূরা আ‘রাফ ৫৪)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩. আর তিনিই যমীনকে বিস্তৃত করেছেন(১) এবং তাতে সুদৃঢ়পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন এবং সব রকমের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়(২)। তিনি দিনকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন(৩) নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।(৪)
(১) পূর্বের আয়াতে উপরস্থিত আসমানের নিদর্শনাবলী বর্ণনা করেছেন। আর এখানে নিচের বা যমীনের নিদর্শনাবলী বর্ণনা করছেন। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর] তিনিই ভূমণ্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে ভারী পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন। ভূমণ্ডলের বিস্তৃতি তার গোলাকৃতির পরিপন্থী নয়। কেননা, গোলাকার বস্তু যদি অনেক বড় হয়, তবে তার প্রত্যেকটি অংশ একটি বিস্তৃত পৃষ্ঠের মতই দৃষ্টিগোচর হয়। [ফাতহুল কাদীর] কুরআনুল কারীম সাধারণ মানুষকে তাদের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী সম্বোধন করে। বাহ্যদশী ব্যক্তি পৃথিবীকে একটি বিস্তৃত পৃষ্ঠরূপে দেখে। তাই একে বিস্তৃত করা শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে।
এরপর পৃথিবীর ভারসাম্য বজায় রাখা ও অন্যান্য অনেক উপকারিতার জন্য এর উপর সুউচ্চ ও ভারী পাহাড় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এসব পাহাড় একদিকে ভূ-পৃষ্ঠের ভারসাম্য বজায় রাখে এবং অন্যদিকে সমগ্র সৃষ্ট জীবকে পানি পৌঁছাবার ব্যবস্থা করে। পানির বিরাট ভাণ্ডার পর্বত-শৃঙ্গে বরফ আকারে সঞ্চিত রাখা হয়। এর জন্য কোন চৌবাচ্চা নেই এবং তা তৈরি করারও প্রয়োজন নেই। অপবিত্র বা দূষিত হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই। অতঃপর এ ফল্গুধারা থেকেই কোথাও প্রকাশ্য নদ-নদী ও খাল-বিল নির্গত হয় এবং কোথাও ভূগর্ভেই লুকিয়ে থাকে। অতঃপর কুপের মাধ্যমে এ ফল্গুধারার সন্ধান করে তা থেকে পানি উত্তোলন করা হয়।
(২) অর্থাৎ এ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নানাবিধ ফল-ফসল উৎপন্ন করছেন এবং প্রত্যেক ফলফসলের দু'প্রকার সৃষ্টি করছেনঃ লাল-হলুদ, টক-মিষ্টি। [বাগভী] তবে এর অর্থ দুই না হয়ে একাধিক হতে পারে যেগুলোর সংখ্যা কমপক্ষে দুই হবে। তাই বিষয়টি (زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ) শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি ফলই দু' প্রকার হয়, রঙের দিক থেকে যেমন, সাদা-কালো, অথবা স্বাদের দিক থেকে যেমন, মিষ্টি-টক, অথবা আকৃতির দিক থেকে যেমন, বড়-ছোট, অথবা অবস্থাগত দিক থেকে যেমন, গরম ও ঠাণ্ডা। [ফাতহুল কাদীর] কারও কারও মতে, زَوْجَيْنِ এর অর্থ নর ও মাদী হওয়া। [কুরতুবী]
(৩) আল্লাহ তা'আলাই রাত্রি দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। অর্থাৎ দিনের আলোর পর রাত্রি নিয়ে আসেন; যেমন কোন উজ্জ্বল বস্তুকে পর্দা দ্বারা আবৃত করে কালো করে দেয়া হয়। ফলে স্বচ্ছ শুভ্র উজ্জ্বল থাকার পর সেটা অন্ধকার কালোতে রূপান্তরিত হয়। [ফাতহুল কাদীর] আবার আরেক অর্থে, তিনি এ দু'টিকে এমন করেছেন যে, এর প্রত্যেকটি অপরটিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। [ইবন কাসীর] একটি যাওয়ার সাথে সাথে আরেকটি আসবেই। এভাবে আল্লাহ্ তা'আলা মানুষ ও তাদের বাসস্থান যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন তেমনি তিনি সময়ও নিয়ন্ত্রণ করেন।
(৪) উপরে বিশ্ব-জাহানের যে নিদর্শনাবলীকে সাক্ষী হিসেবে পেশ করা হয়েছে সেগুলোতে কেউ চিন্তাভাবনা করলে অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রমাণ পাবে যে, এ বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা ও পরিচালক একজনই আর মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন, আল্লাহর আদালতে মানুষের হাযির হওয়া এবং পুরষ্কার ও শাস্তি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেসব খবর দিয়েছেন সেগুলো সবই সত্য। [বাগভী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩) তিনিই ভূতলকে বিস্তৃত করেছেন এবং ওতে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন[1] এবং প্রত্যেক প্রকারের ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়।[2] তিনি দিনকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন; এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।
[1] পৃথিবীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের অনুমান করা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন। উঁচু ও বিশাল পর্বতমালাকে ভূপৃষ্ঠে কীলক স্বরূপ গেড়ে দেওয়া হয়েছে। নদী-নালা, সমুদ্র ও ঝর্ণাদির এমন ব্যবস্থাপনা রেখেছেন, যার দ্বারা মানুষ নিজেও উপকৃত হয় এবং ক্ষেত-বাগানও সেচন করে থাকে। ফলে বিভিন্ন প্রকারের শস্য ও ফল উৎপাদন হয়, যাদের আকার-প্রকারও ভিন্ন এবং স্বাদও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
[2] এর একটি অর্থ এই যে, নর-মাদী দুটোই বানিয়েছেন, যেমনটি আধুনিক আবিষ্কর্তারাও এর সত্যায়ন করেছেন। (জোড়ায় জোড়ায়)এর দ্বিতীয় অর্থ বিপরীতমুখী, যেমনঃ মিষ্টি-টক, ঠান্ডা-গরম, কালো-সাদা এবং সুস্বাদ-বিস্বাদ, এ ধরণের পারস্পরিক বিপরীতধর্মী বস্তু সৃষ্টি করেছেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৪. আর যমীনে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূখন্ড(১), আঙ্গুর বাগান, শস্যক্ষেত্র, একই মূল থেকে উদগত বা ভিন্ন ভিন্ন মূল থেকে উদগত খেজুর গাছ(২) যেগুলো একই পানি দ্বারা সেচ করা হয়, আর স্বাদ-রূপের ক্ষেত্রে সেগুলোর কিছু সংখ্যককে আমরা কিছু সংখ্যকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকি।(৩) নিশ্চয় বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।(৪)
(১) এখানে আল্লাহ তা'আলা নতুন করে অন্য আরেক প্রকার নিদর্শন পেশ করছেন। [ফাতহুল কাদীর] অর্থাৎ সারা পৃথিবীকে তিনি একই ধরনের একটি ভূখণ্ড বানিয়ে রেখে দেননি। বরং তার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য ভূখণ্ড, এ ভূখণ্ডগুলো পরস্পর সংলগ্ন থাকা সত্ত্বেও আকার-আকৃতি, রং, গঠন, উপাদান, বৈশিষ্ট, শক্তি ও যোগ্যতা এবং উৎপাদনে পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। এ গুলোর কোনটি এমন যে, তাতে শস্য উৎপন্ন হয় আবার কোন কোনটি একেবারে অকেজো ভূমি যাতে কোন কিছুই উৎপন্ন হয়না অথচ এ দু'ধরনের ভূমিই পাশাপাশি অবস্থিত। [দেখুন, ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
এ বিভিন্ন ভূখণ্ডের সৃষ্টি এবং তাদের মধ্যে নানা প্রকার বিভিন্নতার অস্তিত্ব এত বিপুল পরিমান জ্ঞান ও কল্যাণে পরিপূর্ণ যে, তা গণনা করে শেষ করা যেতে পারে না। এ ভুখণ্ড লাল, অপরটি সাদা, কোনটি হলুদ, কোনটি মিহি, অথচ সবগুলোই পাশাপাশি। প্রতিটি তার গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আছে। এসব কিছুই প্রমাণ করছে যে, একজন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ক্ষমতাধর সত্তা রয়েছেন যিনি এগুলো করেছেন। তিনিই একমাত্র ইলাহ, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনিই একমাত্র রব, তিনি ব্যতীত আর কোন রব নেই। [ইবন কাসীর] তাছাড়া কোন কোন ভূমি পাশাপাশি নয় অথচ তাদের মধ্যে একই ধরণের শক্তি, যোগ্যতা পাওয়া যায়। এখানে পাশাপাশি নয় এ কথাটি উহ্য থাকতে পারে। [ফাতহুল কাদীর]
(২) কিছু কিছু খেজুর গাছের মূল থেকে একটি খেজুর গাছ বের হয় আবার কিছু কিছুর মূল থেকে একাধিক গাছ বের হয়। [ফাতহুল কাদীর]
(৩) এ আয়াতে আল্লাহর তাওহীদ এবং তাঁর শক্তি ও জ্ঞানের নিদর্শনাবলী দেখানো ছাড়া আরো একটি সত্যের দিকেও সূক্ষ্ম ইশারা করা হয়েছে। এ সত্যটি হচ্ছে, আল্লাহ এ বিশ্ব-জাহানের কোথাও এক রকম অবস্থা রাখেননি। একই পৃথিবী কিন্তু এর ভূখণ্ডগুলোর প্রত্যেকের বর্ণ, আকৃতি ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। একই জমি ও একই পানি, কিন্তু তা থেকে বিভিন্ন প্রকার ফল ও ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। একই গাছ কিন্তু তার প্রত্যেকটি ফল একই জাতের হওয়া সত্বেও তাদের আকৃতি, আয়তন, স্বাদ, গন্ধ, রূপ ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। একই মূল থেকে দুটি ভিন্ন গাছ বের হচ্ছে এবং তাদের প্রত্যেকেই নিজের একক বৈশিষ্টের অধিকারী। যে ব্যক্তি এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে সে অবশ্যই এতে একজন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন সত্তার কার্য সক্রিয় আছে দেখতে পাবে। যিনি তার অসীম ক্ষমতায় এগুলোর মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেছেন সেভাবে সৃষ্টি করেছেন। এজন্যই আল্লাহ্ তাআলা সবশেষে বলেছেন যে, নিশ্চয় বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য এতে রয়েছে প্রচুর নিদর্শন। [ইবন কাসীর]
(৪) বলা হচ্ছে, এই যে পরস্পর পাশাপাশি দুটি ভূমিতে আল্লাহ তা'আলা বিভিন্ন প্রকার ফল-ফলাদি উৎপন্ন করেন, তন্মধ্যে একই ফল একই জমিতে একই পানি দ্বারা উৎপন্ন করি তারপরও সেটার স্বাদ দু'রকমের হয়। একটি মিষ্ট অপরটি টক। একটি অত্যন্ত উন্নতমানের অপরটি অনুন্নত পর্যায়ের। একটি চিত্তাকর্ষক অপরটি তেমন নয়। এসব কিছুতে কেউ চিন্তা, গবেষণা ও বিবেক খাটালে যে কেউ অবশ্যই মেনে নিতে বাধ্য হবে যে, এর বিভিন্নতার প্রকৃত কারণ এক মহান প্রজ্ঞাময় সত্তার শক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা, সাধারণত: যে কারণে ফল-ফলাদিতে পার্থক্য সূচিত হয় তা দুটি। এক, উৎপন্নস্থানের ভিন্নতা, দুই পানির গড়মিল। কিন্তু যদি জমি ও পানি একই প্রকার হয়, তারপর যদি সেটাতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা ও ফল পরিলক্ষিত হয় তবে বিবেকবান মাত্রই এটা বলতে বাধ্য হবে যে, এটা সেই অপার শক্তি ও আশ্চর্যজনক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। [ফাতহুল কাদীর]
মুজাহিদ বলেন, এটা মূলত: আদম সন্তানদের জন্য একটি উদাহরণ, তাদের মধ্যে নেককার ও বদকার হয়েছে অথচ তাদের পিতা একজনই। হাসান বসরী বলেন, এ উদাহরণটি আল্লাহ তা'আলা আদম সন্তানদের হৃদয়ের জন্য পেশ করেছেন। কারণ, যমীন মহান আল্লাহর হাতে একটি কাদামাটির পিণ্ড ছিল। তিনি সেটাকে বিছিয়ে দিলেন, ফলে সেটা পরস্পর পাশাপাশি টুকরায় পরিণত হলো, তারপর তাতে আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হলো, ফলে তা থেকে বের হলো, ফুল, গাছ ফল ও উদ্ভিদ। আর এ মাটির কোনটি হল খারাপ, লবনাক্ত ও অস্বচ্ছ। অথচ এগুলো সবই একই পানি দিয়ে সিক্ত হয়েছে। অনুরূপভাবে মানুষও আদম আলাইহিস সালাম থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
অতঃপর আসমান থেকে তাদের জন্য স্মরণিকা (কিতাব) নাযিল হলো, কিছু অন্তর নরম হলো এবং বিনীত হলো, আর কিছু অন্তর কঠোর হলো এবং গাফেল হলো। হাসান বসরী বলেন, কুরআনের কাছে কেউ যখন বসে তখন সে সেখান থেকে বেশী বা কম কিছু না নিয়ে বের হয় না। আল্লাহ তা'আলা বলেন, “আর আমরা নাযিল করি কুরআন, যা মুমিনদের জন্য আরোগ্য ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করে।” [সূরা আল-ইসরাঃ ৮২] এতে অবশ্যই বিবেকবানদের জন্য প্রচুর নিদর্শন রয়েছে। [বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) পৃথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন ভূ-খন্ড;[1] ওতে আছে আঙ্গুর-কানন, শস্যক্ষেত্র, একাধিক ফেঁকড়া-বিশিষ্ট অথবা ফেঁকড়াহীন খেজুর বৃক্ষ,[2] যা একই পানিতে সিঞ্চিত হয়ে থাকে। ফল হিসাবে ওগুলির কতককে কতকের উপর আমি উৎকৃষ্টতা দিয়ে থাকি,[3] অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন।
[1] مُتَجَاوِرَاتٌ এক অপরের নিকটবর্তী ও পাশাপাশি। অর্থাৎ, ভূখন্ডের একটি ক্ষেত্র শস্য-শ্যামল ও উর্বর, যা অত্যধিক ফসল উৎপন্ন করে। আর তারই পাশাপাশি অনুর্বর ভূমি রয়েছে যাতে কোন প্রকারের ফসল উৎপন্ন হয় না।
[2] صِنْوَانٌ এর একটি অর্থ মিলিত এবং غَيْرُ صِنْوَانٍএর অর্থ পৃথক পৃথক করা হয়েছে। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, صِنْوَانٌ একটি বৃক্ষ যার শাখা ও ফেঁকড়া রয়েছে যেমন ডালিম, ডুমুর এবং কোন কোন খেজুর গাছ। আর غَيْرُ صِنْوَانٍ যা উক্ত প্রকারের নয় বরং একটিই কান্ড বিশিষ্ট (যেমনঃ খেজুর, তাল, সুপারী ইত্যাদি)।
[3] অর্থাৎ মাটিও এক, পানি ও আলো-বাতাসও এক; কিন্তু ফল ও শস্যাদি বিভিন্ন প্রকারের এবং স্বাদ ও আকার-প্রকারও এক অপর থেকে ভিন্ন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫. আর যদি আপনি বিস্মিত হন, তবে বিস্ময়ের বিষয় তাদের কথাঃ(১) মাটিতে পরিণত হওয়ার পরও কি আমরা নূতন জীবন লাভ করব?(২) এরাই তারা, যারা তাদের রবের সাথে কুফরী করেছে(৩) আর এরাই তারা, যাদের গলায় থাকবে শিকল(৪)। আর তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।
(১) এ আয়াত ও পরবর্তী দুটি আয়াতে কাফেরদের মৌলিক তিনটি সন্দেহ ও তার উত্তর দেয়া হয়েছে। সন্দেহগুলো হচ্ছে, এক. মৃত্যুর পর পুনর্জীবন এবং হাশরের হিসাব কিতাব অসম্ভব ও যুক্তিবিরুদ্ধ। কুরআনুল কারীমের অন্য এক আয়াতে তাদের এ সন্দেহ বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, “আর কাফিররা বলে, আমরা কি তোমাদেরকে এমন ব্যক্তির সন্ধান দেব যে তোমাদেরকে বলে, তোমাদের দেহ সম্পূর্ণ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়লেও অবশ্যই তোমরা হবে নতুনভাবে সৃষ্ট!” (সূরা সাবাঃ ৭] দুই. তাদের দ্বিতীয় সন্দেহটি হচ্ছে, যদি বাস্তবিকই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল হয়ে থাকেন, তবে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণের কারণে আপনি যেসব শাস্তির কথা শুনান, সেগুলো আসে না কেন? তিন. কাফেরদের তৃতীয় সন্দেহ ছিল এই যে, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেক মু'জিযা দেখেছি কিন্তু বিশেষ ধরনের যেসব মু'জিযা আমরা দেখতে চাই, সেগুলো তিনি প্রকাশ করেন না কেন? এ সন্দেহ তিনটির উত্তর আল্লাহ তা'আলা আলোচ্য ৫ নং আয়াত এবং পরবর্তী ৬ ও ৭ নং আয়াতে প্রদান করেছেন।
(২) এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, কাফেররা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তার নিদর্শনাবলী ও তাঁর প্রমাণসমূহ দেখে তিনি যা ইচ্ছে করতে সক্ষম এটার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য, তারপর তারা স্বীকার করছে যে, তিনিই সবকিছু প্রথম সৃষ্টি করেছেন, অথচ তিনি যখন প্রথম সৃষ্টি করেছেন তখন তারা কিছুই ছিল না। এতকিছুর পরও যদি কাফেররা প্রতিটি সৃষ্টিকে পুনর্জীবনের বিষয়টির উপর মিথ্যারোপ করে তবে আপনি অবশ্যই আশ্চর্য হবেন। কিন্তু তার চাইতে অধিক আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাদের এই উক্তি যে, আমরা মৃত্যুর পর যখন মাটি হয়ে যাব, তখন দ্বিতীয়বার আমাদেরকে কিরূপে সৃষ্টি করা হবে, এটা কি সম্ভবপর? [বাগভী; ইবন কাসীর]
কুরআনুল কারীম এ আশ্চর্যের কারণ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেনি। তবে যেটা অন্য আয়াত থেকে স্পষ্ট হয়েছে সেটা হচ্ছে, আসমান ও যমীন সৃষ্টি মানুষের সৃষ্টির চাইতে অনেক বড় ব্যাপার। আর যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করতে পারেন তার জন্য দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা অনেক সহজ। [ইবন কাসীর] অথবা আয়াতের অর্থ, আপনি আশ্চর্য হবেন যে, কাফেররা আপনার সুস্পষ্ট মু'জিযা এবং নবুওয়াতের প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী দেখা সত্ত্বেও আপনার নবুওয়াত স্বীকার করে না। পক্ষান্তরে তারা নিষ্প্রাণ ও চেতনাহীন পাথরকে উপাস্য মানে, যে পাথর নিজের উপকার ও ক্ষতি করতেও সক্ষম নয়, অপরের উপকার ও ক্ষতি কিরূপে করবে? কিন্তু এর চাইতে অধিক আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তাদের এই উক্তি যে, আমরা মৃত্যুর পর যখন মাটি হয়ে যাব, তখন দ্বিতীয়বার আমাদেরকে কিরূপে সৃষ্টি করা হবে, এটা কি সম্ভবপর? [বাগভী]
কেননা, পূর্ববর্তী আয়াতসমূহে আল্লাহর অপার শক্তির বিস্ময়কর বহিঃপ্রকাশ বর্ণনা করে প্রমাণ করা হয়েছে যে, তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি সমগ্র সৃষ্টজগতকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, অতঃপর প্রত্যেক বস্তুর অস্তিত্বের মধ্যে এমন রহস্য নিহিত রেখেছেন, যা অনুভব করাও মানুষের সাধ্যাতীত। বলাবাহুল্য, যে সত্তা প্রথমবার কোন বস্তুকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আনতে পারেন, তার পক্ষে পুনবার অস্তিত্বে আনা কিরূপে কঠিন হতে পারে? আশ্চর্যের বিষয়, কাফেররা একথা বিশ্বাস করে যে, প্রথমবার সমগ্র বিশ্বকে অসংখ্য হেকমতসহ আল্লাহ্ তা'আলাই সৃষ্টি করেছেন। এরপর পুনবার সৃষ্টি করাকে তারা কিরূপে অসম্ভব ও যুক্তিবিরুদ্ধ মনে করে? আল্লাহ বলেন, “আর তারা কি দেখে না যে, নিশ্চয় আল্লাহ, যিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং এসবের সৃষ্টিতে কোন ক্লান্তি বোধ করেননি, তিনি মৃতের জীবন দান করতেও সক্ষম? অবশ্যই হ্যাঁ, নিশ্চয় তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।” [সূরা আল-আহকাফ: ৩৩]
সত্যি বলতে কি, কাফেররা আল্লাহ্ তা'আলার শক্তি ও মহিমাকে চিনতেই পারেনি। তারা নিজেদের শক্তির নিরিখে আল্লাহর শক্তিকে বুঝে। অথচ নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব বস্তু আপন মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক সচেতন এবং আল্লাহ তা'আলার আজ্ঞাধীন। মোটকথা, সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দেখা সত্ত্বেও কাফেরদের পক্ষে নবুওয়াত অস্বীকার করা যেমন আশ্চর্যের বিষয়, তার চাইতেও অধিক আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কেয়ামতের পুনর্জীবন ও হাশরের দিনকে অস্বীকার করা।
(৩) তারপর আল্লাহ্ তা'আলা তাদের এ কথার পরিণতি সম্পর্কে জানাচ্ছেন যে, তারা এর মাধ্যমে তাদের রবের সাথে কুফরী করেছে। [ইবন কাসীর] কারণ, আখেরাতে মানুষকে পুনর্বার নিয়ে আসা আল্লাহর জ্ঞান ও শক্তির প্রমাণ। তাদের আখেরাত অস্বীকার ছিল মূলত আল্লাহ, তাঁর শক্তিমত্তা ও জ্ঞান অস্বীকারের নামান্তর। এজন্য তারা কাফের হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
(৪) দুনিয়াতে তারা যেহেতু কুফরী করেছে সেহেতু তাদেরকে আখেরাতে এর পরিণতি ভোগ করতেই হবে। আখেরাতে তাদের পরিণতি হচ্ছে, তাদের গলায় থাকবে শেকল পরানো। গলায় শেকল পরানো থাকা কয়েদী হবার আলামত। তাদের গলায় যে শেকল পরানো হবে তা হবে আগুনের শিকল। [মুয়াসসার] তাদেরকে তা দিয়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫) যদি তুমি বিস্মিত হও, তাহলে বিস্ময়ের বিষয় তাদের কথা, ‘(মৃত্যুর পর) মাটিতে পরিণত হওয়ার পরও কি আমরা নতুন জীবন লাভ করব?’[1] ওরাই ওদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে এবং ওদেরই গলদেশে থাকবে বেড়ি। ওরাই হবে দোযখবাসী, সেখানে ওরা চিরস্থায়ীভাবে বাস করবে।
[1] অর্থাৎ যে সত্তা প্রথম বার সৃষ্টি করেছেন, দ্বিতীয় বার উক্ত বস্তুর সৃজন তাঁর জন্য কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কাফেররা আশ্চর্য কথা বলছে যে, দ্বিতীয় বার আমাদেরকে কিভাবে সৃষ্টি করা হবে?
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬. আর তারা ভালোর পূর্বেই মন্দের জন্য তাড়াহুড়ো করছে। অথচ তাদের আগে শাস্তির অনুরূপ বহু (শিক্ষণীয়) দৃষ্টান্ত গত হয়েছে(১)। আর নিশ্চয় আপনার রব মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল তাদের যুলুম সত্ত্বেও এবং নিশ্চয় আপনার রব শাস্তি দানে কঠোর।(২)
(১) কাফেরদের দ্বিতীয় সন্দেহ ছিল, যদি বাস্তবিকই আপনি আল্লাহ্র রাসূল হয়ে থাকেন, তবে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণের কারণে আপনি যেসব শাস্তির কথা শুনান, সেগুলো আসে না কেন? কখনো তারা চ্যালেঞ্জের ভঙ্গীতে বলতে থাকেঃ “হে আমাদের রব! এখনই তুমি আমাদের হিসেব নিকেশ চুকিয়ে দাও। কিয়ামতের জন্য তাকে ঠেকিয়ে রেখো না।” [সূরা সোয়াদঃ ১৬]। আবার কখনো বলতে থাকেঃ “হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথাগুলো পেশ করছে এগুলো যদি সত্যি হয় এবং তোমারই পক্ষ থেকে হয় তাহলে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ করো অথবা অন্য কোন যন্ত্রণাদায়ক আযাব নাযিল করো।” [সূরা আল-আনফালঃ ৩২] আবার কখনো তারা রাসূলকেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে বলতে থাকেঃ “তারা বলে, ‘ওহে যার প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছে! তুমি তো নিশ্চয় উন্মাদ। তুমি সত্যবাদী হলে আমাদের কাছে ফিরিশতাদেরকে উপস্থিত করছ না কেন? আমরা ফিরিশতাদেরকে যথার্থ কারণ ছাড়া নাযিল করি না; ফিরিশতারা উপস্থিত হলে তারা অবকাশ পাবে না।” [সূরা আল-হিজরঃ ৬–৮]
এ আয়াতে কাফেরদের পূর্বোক্ত কথাগুলোর জবাব দিয়ে বলা হয়েছেঃ এ মূর্খের দল কল্যাণের আগে অকল্যাণ চেয়ে নিচ্ছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এদেরকে যে অবকাশ দেয়া হচ্ছে তার সুযোগ গ্রহণ করার পরিবর্তে এরা এ অবকাশকে দ্রুত খতম করে দেয়ার এবং এদের বিদ্রোহাত্মক কর্মনীতির কারণে এদেরকে অনতিবিলম্বে পাকড়াও করার দাবী জানাচ্ছে। অন্যত্র বলা হয়েছেঃ “তারা আপনাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে। যদি নির্ধারিত কাল না থাকত তবে শাস্তি অবশ্যই তাদের উপর আসত। নিশ্চয়ই তাদের উপর শাস্তি আসবে আকস্মিকভাবে, তাদের অজ্ঞাতসারে। তারা আপনাকে শাস্তি ত্বরান্বিত করতে বলে, জাহান্নাম তো কাফিরদেরকে পরিবেষ্টন করবেই।” [সূরা আল-আনকাবুতঃ ৫৩–৫৪]
আরো এসেছে, “যারা এটা বিশ্বাস করে না তারাই এটা ত্বরান্বিত করতে চায় [সূরা আশ-শূরাঃ ১৮]। মোটকথাঃ তারা বিপদমুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই আপনার কাছে বিপদ নাযিল হওয়ার তাগাদা করে যে, আপনি নবী হয়ে থাকলে তাৎক্ষণিক আযাব এনে দিন। এতে বুঝা যায় যে, তারা আযাব আসাকে খুবই অবাস্তব অথবা অসম্ভব মনে করে। এটা ছিল তাদের অবিশ্বাস, কুফরি, অবাধ্যতা, বিরোধিতা ও অস্বীকৃতির চরম পর্যায়। তাই আল্লাহ তা'আলা বলছেন, অথচ তাদের পূর্বে অন্য কাফেরদের উপর অনেক আযাব এসেছে। সবাই তা প্রত্যক্ষ করেছে। তাদেরকে এর মাধ্যমে আল্লাহ পরবর্তীদের জন্য উদাহরণ, উপদেশ হিসেবে রেখে দিয়েছেন। [ইবন কাসীর] এমতাবস্থায় তাদের উপর আযাব অবাস্তব হল কিরূপে? এখানে مثلاث শব্দটি مثله এর বহুবচন। এর অর্থ অপমানকর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। [ফাতহুল কাদীর]
(২) বলা হয়েছে, “মানুষের সীমালংঘন সত্বেও আপনার রব তো মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল”। মানুষের শত অন্যায়কেও তিনি ক্ষমা করেন। যদি তিনি ক্ষমাশীল না হতেন তবে কারোই রেহাই ছিল না। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, “আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে ভূ-পৃষ্ঠে কোন জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না, কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের নির্দিষ্ট কাল এসে গেলে আল্লাহ তো আছেন তার বান্দাদের সম্যক দ্রষ্টা।” [সূরা ফাতিরঃ ৪৫]
আয়াতের শেষে আল্লাহ্ তা'আলা বলছেন যে, তিনি যে শুধু ক্ষমাশীল তা-ই নয় বরং তিনি কঠোর শাস্তিদাতাও। এভাবে আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে তাঁর বান্দাকে আশা ও ভীতির মধ্যে রাখেন। [যেমন, সূরা আল-আনআমঃ ১৪৭, সূরা আল-আরাফঃ ১৬৭, সূরা আল-হিজরঃ ৪৯–৫০] যাতে করে মানুষের জীবনে ভারসাম্য বজায় থাকে। শুধু আশার বাণী শুনতে শুনতে মানুষ সীমালঙ্ঘন করতে দ্বিধা করবে না। আবার শুধু ভয়-ভীতির কথা শুনতে শুনতে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে না। এটাই আল্লাহ তা'আলা চান। সে জন্য তিনি যখনই কোন আশার কথা শুনিয়েছেন সাথে সাথেই ভয়ের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। মূলতঃ আশা ও ভীতির মাঝেই হলো ঈমানের অবস্থান। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬) মঙ্গলের পূর্বে তারা তোমাকে অমঙ্গল ত্বরান্বিত করতে বলে; অথচ তাদের পূর্বে এর বহু দৃষ্টান্ত গত হয়েছে।[1] নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক মানুষের সীমালংঘন সত্ত্বেও তাদের প্রতি ক্ষমাশীল[2] এবং নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক শাস্তি দানেও কঠোর। [3]
[1] অর্থাৎ আল্লাহর আযাবে বহু সম্প্রদায় ও জনপদ ধ্বংসের অনেক উদাহরণ পূর্বে এসেছে, তা সত্ত্বেও তারা আযাব শীঘ্র প্রার্থনা করে? এ কথা কাফেরদের জবাবে বলা হয়েছে, যারা বলেছিল যে, হে নবী! যদি তুমি সত্য হও, তাহলে আমাদের উপর সেই আযাব আনয়ন কর, যার ভয় তুমি আমাদেরকে দেখাচ্ছ।
[2] অর্থাৎ মানুষের অন্যায়-অত্যাচার ও অবাধ্যতার পরও তিনি আযাবে শীঘ্র গ্রেপ্তার না করে অবকাশ দিয়ে থাকেন। কখনো কখনো আযাবের ব্যাপারটা কিয়ামত অবধি বিলম্বিত করেন। এটা তাঁর দয়া, কৃপা, করুণা ও ক্ষমাশীলতার পরিণাম। নচেৎ তিনি যদি তাদেরকে আযাবে শীঘ্রই গ্রেপ্তার করতেন, তাহলে পৃথিবীতে কোন মানুষ অবশিষ্ট থাকতো না। তিনি এরশাদ করেন, ﴿وَلَوْ يُؤَاخِذُ اللهُ النَّاسَ بِمَا كَسَبُوا مَا تَرَكَ عَلَى ظَهْرِهَا مِن دَابَّةٍ﴾ অর্থাৎ, যদি আল্লাহ মানুষদেরকে তাদের কার্যকলাপের কারণে পাকড়াও করতেন, তাহলে ভূ-পৃষ্ঠে একটি জীবকেও রেহাই দিতেন না। (সূরা ফাত্বির ৪৫)
[3] এখানে মহান আল্লাহর দ্বিতীয় গুণের কথা উল্লেখ হয়েছে, যেন মানুষ শুধু একটিই দিকের প্রতি দৃষ্টি না রাখে, বরং অন্য দিকের প্রতিও লক্ষ্য রাখে। কেননা একটিই দিকের প্রতি ধারাবাহিক দৃষ্টি রাখলে অনেক কিছু অদৃশ্য থেকে যায়। সঙ্গত কারণেই কুরআন মাজীদে যেখানে আল্লাহর করুণা ও ক্ষমাবিশিষ্ট গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে তার সঙ্গে তাঁর ক্রোধ ও প্রবলতাবিশিষ্ট গুণেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন এখানেও রয়েছে। যেন বান্দার মনে আশা ও ভয় দুটো দিকই সক্রিয় থাকে। কেননা আশা আর আশাই যদি সক্রিয় থাকে, তাহলে মানুষ আল্লাহর অবাধ্যতার ব্যাপারে ভয়শূন্য ও দুঃসাহসিক হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যদি সব সময় মস্তিষ্কে ভয় আর ভয়ই ঢুকে থাকে, তাহলে সে তাঁর রহমত ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ে যায়। উক্ত দুটো দিকই ভুল এবং মানুষের জন্য সর্বনাশী। এই জন্য বলা হয়, الْإِيْمَانُ بَيْنَ الْخَوْفِ وَالرَّجَاءِ ঈমান ভয় ও আশার মধ্যে। অর্থাৎ, উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার নাম ঈমান। যেন মানুষ তাঁর আযাব থেকে না নির্ভয় হয় আর না তাঁর রহমত থেকে নিরাশ।
(উক্ত বিষয়ের জন্য দেখুনঃ সূরা আনআম ৪৭নং আয়াত, সূরা আ‘রাফ: ১৬৭নং আয়াত, সূরা হিজর ৪৯-৫০নং আয়াত।)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭. আর যারা কুফরী করেছে তারা বলে, তার রবের কাছ থেকে তার উপর কোন নিদর্শন নাযিল হয় না কেন?(১) আপনি তো শুধু সতর্ককারী, আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য আছে পথ প্রদর্শক।(২)
(১) কাফেরদের তৃতীয় সন্দেহ ছিল এই যে, আমরা রাসূলের কাছে বিশেষ ধরনের যেসব মু'জিযা দেখতে চাই, সেগুলো তিনি প্রকাশ করেন না কেন? এখানে তারা এমন নিশানীর কথা বলতে চাচ্ছিল যা দেখে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আল্লাহর রাসূল হবার উপর ঈমান আনতে পারে। এটা ছিল মূলতঃ তাদের গোঁড়ামী। যেমন এর পূর্বেও তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সাফা পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করার অযথা আব্দার করেছিল। তারা আরও বলেছিল যে, আপনি মক্কার পাহাড়গুলোকে সরিয়ে দিন।
সে পাহাড়ের জায়গায় নদী-নালার ব্যবস্থা করে দিন। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আর আমাদেরকে নিদর্শন প্রেরণ করা থেকে শুধু এটাই বিরত রেখেছে যে, তাদের পূর্ববর্তীগণ তাতে মিথ্যারোপ করেছিল।” [সূরা আল-ইসরাঃ ৫৯] [ইবন কাসীর] মু'জিযা প্রকাশ করা সরাসরি আল্লাহর কাজ। তিনি যখন যে ধরনের মু'জিযা প্রকাশ করতে চান, তাই করেন। তিনি কারো দাবী ও ইচ্ছা পূরণ করতে বাধ্য নন। এ জন্যই বলা হয়েছেঃ (إِنَّمَا أَنْتَ مُنْذِرٌ) অর্থাৎ আপনার কাজ শুধু আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ভয় প্রদর্শন করা।
(২) আয়াতের কয়েকটি অর্থ করা হয়ে থাকে। এক. আপনি তো একজন ভীতিপ্রদর্শনকারী আর প্রতিটি কাওমের জন্য রয়েছে হিদায়াতকারী নবী, যিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করবেন। [বাগভী; ইবন কাসীর] দুই. আপনি তো একজন ভীতিপ্রদর্শনকারী এবং প্রতিটি কাওমের জন্যও আপনি হিদায়াতকারী অর্থাৎ আহবানকারী। [বাগভী; ইবন কাসীর] তিন. সাঈদ ইবন জুবাইর বলেন, এর অর্থ আপনি তো একজন ভীতিপ্রদর্শনকারী। আর সত্যিকার হিদায়াতকারী তো আল্লাহ তা'আলাই। [বাগভী; ইবন কাসীর]
প্রথম মতটিকে ইমাম শানকীতী প্রাধান্য দিয়ে বলেন, এর সমার্থে অন্যত্র এসেছে, “আর প্রত্যেক উম্মতের জন্য আছে একজন রাসূল।” [সূরা ইউনুস: ৪৭] আরও এসেছে, “আর এমন কোন উম্মত নেই যার কাছে গত হয়নি সতর্ককারী।” [সূরা ফাতির: ২৪] আরও এসেছে, “আর অবশ্যই আমরা প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছিলাম।” [সূরা আন-নাহ্ল: ৩৬] [আদওয়াউল বায়ান]
তাফসীরে জাকারিয়া(৭) যারা অবিশ্বাস করেছে তারা বলে, ‘তার প্রতিপালকের নিকট হতে তার নিকট কোন নিদর্শন অবতীর্ণ করা হয় না কেন?’ তুমি তো শুধুমাত্র একজন সতর্ককারী।[1] আর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পথ প্রদর্শক রয়েছে। [2]
[1] প্রত্যেক নবীকে মহান আল্লাহ অবস্থা, প্রয়োজন এবং স্বীয় ইচ্ছা ও হিকমত মোতাবেক কিছু নিদর্শন ও মু’জিযা দান করেছেন। কিন্তু কাফেররা নিজ খেয়াল-খুশি অনুযায়ী মু’জিযা তলব করতে থাকে। যেমন মক্কার কাফেররা নবী (সাঃ)-কে বলত যে, সাফা পর্বতকে সোনার বানিয়ে দেওয়া হোক অথবা পর্বতের স্থানে নদী ও ঝর্ণা প্রবাহিত করে দেওয়া হোক ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের মন মত মু’জিযা না দেখানো হলে তারা বলতে আরম্ভ করত যে, এর উপর কোন মু’জিযা কেন অবতীর্ণ করা হলো না? মহান আল্লাহ বলেন, হে নবী! তোমার কাজ শুধু সতর্ক করা এবং পৌঁছে দেওয়া। এটা তুমি করতে থাক। কেউ মানুক বা না মানুক, সেটা তোমার দেখার নয়। কেননা হিদায়াত দান করা আমার কাজ। তোমার কাজ পথ দেখানো। তাকে উক্ত পথে চালানো তোমার কাজ নয়, সে কাজ আমার।
[2] প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট মহান আল্লাহ তাদের নির্দেশনার জন্য পথপ্রদর্শক অবশ্যই পাঠিয়েছেন। এটা ভিন্ন কথা যে, সম্প্রদায়ের মানুষেরা হিদায়াতের পথ অবলম্বন করল বা করল না। কিন্তু সঠিক পথ দেখাবার জন্য পয়গম্বর অবশ্যই এসেছেন। মহান আল্লাহ বলেন: ﴿وَإنْ مِنْ أُمَّةٍ إلَّا خَلَا فِيْهَا نَذِيْرٌ﴾ অর্থাৎ, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট সতর্ককারী অবশ্যই এসেছে। (সূরা ফাতির: ২৪)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৮. প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে এবং গর্ভাশয়ে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ তা জানেন(১) এবং তার নিকট প্রত্যেক বস্তুরই এক নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে।
(১) এর অর্থ হচ্ছে, মায়ের গর্ভাশয়ে ক্রণের অংগ-প্রত্যংগ, শক্তি-সামর্থ, যোগ্যতা ও মানসিক ক্ষমতার যাবতীয় হ্রাস-বৃদ্ধি আল্লাহর সরাসরি তত্ত্বাবধানে সাধিত হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক নারী যা গর্ভধারণ করে, তা ছেলে কি মেয়ে, সুশ্রী কি কুশ্রী, সৎ কি অসৎ তা সবই আল্লাহ জানেন এবং নারীদের গর্ভাশয়ে যে হ্রাসবৃদ্ধি হয়, অর্থাৎ কোন সময় এক বা একাধিক সন্তান জন্মগ্রহণ করে, কোন সময় দ্রুত কোন সময় দেরীতে তাও আল্লাহ তা'আলা জানেন। [আদওয়াউল বায়ান]
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলার একটি বিশেষ গুণ বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি আলেমুল গায়েব। সৃষ্টিজগতের প্রতিটি অণু-পরমাণু ও সেসবের পরিবর্তনশীল অবস্থা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিফহাল। এর সাথেই মানব সৃষ্টির প্রতিটি স্তর, প্রতিটি পরিবর্তন ও প্রতিটি চিহ্ন সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর সত্যিকার ও নিশ্চিত জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা'আলাই রাখেন। এ বিষয়টিই অন্য এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছেঃ (وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলাই জানেন যা কিছু গভাশয়ে রয়েছে। [সূরা লোকমানঃ ৩৪] আমরা যদি সূরা লোকমান এর এ আয়াতটির সাথে আলোচ্যসূরার (وَمَا تَغِيضُ الْأَرْحَامُ وَمَا تَزْدَادُ) আয়াতকে একসাথে মিলিয়ে তাফসীর করি তাহলে বর্তমান কালের এ আয়াত সংক্রান্ত অনেক সন্দেহের জবাব দেয়া সহজ হয়ে যাবে। কারণ সূরা লোকমানের আয়াতে যা বলা হয়েছে এ আয়াত তার তাফসীর হতে পারে।
ফলে গর্ভাশয়ে অবস্থিত সন্তানের অবস্থা বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেলেও তা সূরা লোকমান এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত পাঁচটি গায়েব এর জ্ঞানের দাবী কেউ করতে পারবে না। বিশেষ করে সহীহ হাদীসে গায়েবের পাঁচটি বস্তু বর্ণনায় যে শব্দ ব্যবহার হয়েছে তাও এ তাফসীর সমর্থন করছে। হাদীসে এসেছে, “পাঁচটি বিষয় হলো সমস্ত গায়েবের চাবিকাঠি, আল্লাহ ব্যতীত কেউ তা জানে না ... আল্লাহ ব্যতীত কেউ গর্ভাশয়ে যা কিছু হ্রাস হয় তা জানে না।” [বুখারীঃ ৪৬৯৭] আর এটা সর্বজনবিদিত যে, গর্ভাশয়ে যা কিছু হ্রাস-বৃদ্ধি হয় বা হবে তা কেউ কোন দিন বলে দিতে পারবে না। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “তিনি তোমাদের সম্পর্কে সম্যক অবগত—যখন তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি হতে এবং যখন তোমরা মাতৃগর্ভে ভ্রণরূপে ছিলে। [সূরা আন-নাজম: ৩২] আরও বলেন, “তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন।” [সূরা আলে ইমরান: ৬] আয়াতের আরেক অর্থ হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহই জানেন কোন মহিলা কোন ধরণের সন্তান গর্ভে ধারণ করবে। তখন ما টি হবে موصولة [আদওয়াউল বায়ান]
তাফসীরে জাকারিয়া(৮) প্রত্যেক নারী যা গর্ভে ধারণ করে[1] এবং জরায়ুতে যা কিছু কমে ও বাড়ে আল্লাহ তা জানেন[2] এবং তাঁর নিকটে প্রত্যেক বস্তুই নির্দিষ্ট পরিমাণে আছে। [3]
[1] মাতৃগর্ভে কি আছে; ছেলে না মেয়ে, সুশ্রী না কুশ্রী, সুজন না কুজন, দীর্ঘায়ু না অল্পায়ু? এসব শুধু মহান আল্লাহই জানেন।
[2] এ থেকে উদ্দিষ্ট গর্ভের সময়কাল; যা সাধারণতঃ নয় মাস হয়ে থাকে। কিন্তু তাতে কমা-বাড়াও হয়; কখনো দশ মাস, কখনো সাত মাস, কখনো আট মাস। এর জ্ঞানও মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে নেই।
[3] অর্থাৎ কার জীবনকাল কত দিন? সে রুযীর কত অংশ পাবে? এর পূর্ণ জ্ঞান আল্লাহর কাছেই আছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯. তিনি গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানী, মহান, সর্বোচ্চ।(১)
(১) আয়াতের অর্থ এই যে, এটা আল্লাহ তা'আলার বিশেষ গুণ যে, তিনি প্রত্যেক অনুপস্থিতকে এমনিভাবে জানেন, যেমন উপস্থিত ও বিদ্যমানকে জেনে থাকেন।
الْكَبِيرُ শব্দের অর্থ বড় এবং الْمُتَعَال-এর অর্থ উচ্চ তিনি মান মর্যাদার দিক থেকে যেমন সবার উপরে, ক্ষমতার দিক থেকেও সবার উপরে। অনুরূপভাবে তিনি অবস্থানের দিক থেকেও সবার উপরে। [ইবনুল কাইয়েম, মাদারিজুস সালেকীন: ১/৫৫] উভয় শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, তিনি সবার চেয়ে বড়, তিনি সবকিছুর উপরে। [ইবন কাসীর] অনুরূপভাবে তিনি সৃষ্ট বস্তুসমূহের গুণাবলীর উর্ধ্বে। কাফের ও মুশরিকরা আল্লাহ তা'আলার মহত্ব ও উচ্চমর্যাদা স্বীকার করত, কিন্তু উপলদ্ধি-দোষে তারা আল্লাহকে সাধারণ মানুষের সমতুল্য জ্ঞান করে তার জন্যএমন সবগুণাবলী সাব্যস্ত করত, যেগুলো তার মর্যাদার পক্ষে খুবই অসম্ভব। তিনি সেগুলো থেকে অনেক উর্ধ্বে। [ফাতহুল কাদীর]
উদাহরণতঃ ইয়াহুদী ও নাসারাগণ আল্লাহর জন্য পুত্র সাব্যস্ত করেছে। আরবের মুশরিকগণ আল্লাহর জন্য কন্যা সাব্যস্ত করেছে। অথচ তিনি এসব অবস্থা ও গুণ থেকে উচ্চে, উর্ধ্বে ও পবিত্র। কুরআনুল কারীম তাদের বর্ণিত গুণাবলী থেকে পবিত্রতা প্রকাশের জন্য বার বার বলেছেঃ (سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ) [সূরা আল-মু'মিনূনঃ ৯১] -অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা ঐসব গুণ থেকে পবিত্র যেগুলো তারা বর্ণনা করে। প্রথম (عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ) এবং তৎপূর্ববর্তী (اللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَحْمِلُ كُلُّ أُنْثَىٰ) বাক্যে আল্লাহ্ তা'আলার জ্ঞানগত পরাকাষ্ঠা বর্ণিত হয়েছিল। দ্বিতীয় (الْكَبِيرُ الْمُتَعَالِ) বাক্যে শক্তি ও মাহাত্যের পরাকাষ্ঠা বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ তার শক্তি ও সামর্থ্য মানুষের কল্পনার উর্ধ্বে। এর পরবর্তী আয়াতেও এ জ্ঞান ও শক্তির পরাকাষ্ঠা একটি বিশেষ আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে।
তাফসীরে জাকারিয়া(৯) অদৃশ্য ও দৃশ্যমান সম্বন্ধে তিনি অবগত; তিনি সুমহান, সর্বোচ্চ।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১০. তোমাদের মধ্যে যে কথা গোপন রাখে বা যে তা প্রকাশ করে, রাতে যে আত্মগোপন করে এবং দিনে যে প্রকাশ্যে বিচরণ করে, তারা সবাই আল্লাহর নিকট সমান।(১)
(১) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা প্রকাশ্য ও গোপন সবকিছু সম্পর্কে পূর্ণভাবে জানেন। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য স্থানেও এ বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তর্যামী। যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদশী, সম্যক অবগত।” [সূরা আল-মুলকঃ ১৩–১৪] আরো বলেছেনঃ “যদি আপনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন, তবে তিনি তো যা গুপ্ত ও অব্যক্ত সবই জানেন।” [সূরা ত্বা-হাঃ ৭] অন্য আয়াতে বলেছেনঃ “এবং তিনি জানেন যা তোমরা গোপন কর আর যা প্রকাশ কর।” [সূরা আন-নামলঃ ২৫]
অন্যত্র বলেছেনঃ “সাবধান! নিশ্চয়ই ওরা তার কাছে গোপন রাখার জন্য ওদের বক্ষ দ্বিভাঁজ করে। সাবধান! ওরা যখন নিজেদেরকে বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে তখন ওরা যা গোপন করে ও প্রকাশ করে, তিনি তা জানেন। অন্তরে যা আছে, নিশ্চয়ই তিনি তা সবিশেষ অবহিত [সূরা হুদঃ ৫] আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ্ তা'আলার জ্ঞান সর্বব্যাপী। কাজেই যে ব্যক্তি আস্তে কথা বলে এবং যে ব্যক্তি উচ্চঃস্বরে কথা বলে, তারা উভয়ই আল্লাহর কাছে সমান। তিনি উভয়ের কথা সমভাবে শোনেন এবং জানেন। এমনিভাবে যে ব্যক্তি রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দেয় এবং যে ব্যক্তি দিবালোকে প্রকাশ্য রাস্তায় চলে, তারা উভয়ই আল্লাহ তা'আলার জ্ঞান ও শক্তির দিক দিয়ে সমান। উভয়ের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অবস্থা তিনি সমভাবে জানেন এবং উভয়ের উপর তার শক্তি সমভাবে পরিব্যপ্ত। কেউ তার ক্ষমতার আওতাবহির্ভূত নয়।
তাফসীরে জাকারিয়া(১০) তোমাদের মধ্যে যে গোপনে কথা বলে এবং যে তা প্রকাশ্যে বলে, যে রাত্রে আত্মগোপন করে এবং যে দিবসে প্রকাশ্যে বিচরণ করে, তারা (আল্লাহর জ্ঞানে) সবাই সমান।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান