-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১. এটা একটি সূরা, এটা আমরা নাযিল করেছি এবং এর বিধানকে আমরা অবশ্য পালনীয় করেছি, আর এতে আমরা নাযিল করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাতে তোমরা উপদেশ গ্ৰহণ কর।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(১) এ একটি সূরা; যা আমি অবতীর্ণ করেছি[1] এবং এতে দিয়েছি অবশ্য পালনীয় বিধান, এতে আমি সুস্পষ্ট বাক্যসমূহ অবতীর্ণ করেছি; যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।
[1] কুরআন কারীমের সমস্ত সূরাই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই সূরার ব্যাপারে বিশেষভাবে এ কথা বলার তাৎপর্য হল, এ সূরায় আলোচিত বিধি-বিধানের বিশেষ গুরুত্ব আছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২. ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী— তাদের প্ৰত্যেককে একশত বেত্ৰাঘাত করবে(১), আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে(২), যদি তোমরা আল্লাহ্ এবং আখেরাতের উপর ঈমানদার হও; আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্ৰত্যক্ষ করে।(৩)
(১) جلد শব্দের অর্থ মারা। [ফাতহুল কাদীর] جلد শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করার মধ্যে ইঙ্গিত আছে যে, এই বেত্ৰাঘাতের প্রতিক্রিয়া চামড়া পর্যন্তই সীমিত থাকা চাই এবং মাংস পর্যন্ত না পৌছা চাই। [বাগভী] একশ বোত্রাঘাতের উল্লেখিত শাস্তি শুধু অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য নির্দিষ্ট; বিবাহিতদের শাস্তি প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা। [সা’দী] হাদীসে এসেছে, দু’জন লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বিবাদে লিপ্ত হলো। তাদের একজন বললঃ আপনি আমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব দিয়ে ফয়সালা করে দিন। অপরজন (যে তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে জ্ঞানী ছিল সে) বললো: হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদের মাঝে ফয়সালা করে দিন এবং আমাকে কথা বলার অনুমতি দিন। তিনি বললেনঃ বল।
লোকটি বললঃ আমার ছেলে এ লোকের কাজ করতো। তারপর সে তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করে বসে। লোকেরা আমাকে বললো যে, আমার ছেলের উপর পাথর মেরে হত্যা করার হুকুম রয়েছে। তখন আমি একশত ছাগল এবং একটি দাসীর বিনিময়ে আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে আনি। তারপর আমি জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করলে তারা বললো যে, আমার সন্তানের উপর ১০০ বেত্ৰাঘাত এবং একবছরের দেশান্তর। পাথর মেরে হত্যা তো তার স্ত্রীর উপরই। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার ছাগল ও দাসী তোমার কাছে ফেরৎ যাবে। তারপর তিনি তার ছেলেকে ১০০ বেত্ৰাঘাত এবং এক বছরের দেশান্তরের শাস্তি দিলেন এবং উনাইস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেনঃ এ দ্বিতীয় ব্যক্তির স্ত্রীর নিকট যাও। যদি সে স্বীকারোক্তি দেয় তবে তাকে পাথর মেরে হত্যা কর। পরে মহিলা স্বীকারোক্তি করলে তাকে পাথর মেরে হত্যা করা হয়। [বুখারী: ৬৬৩৩, ৬৬৩৪, মুসলিম: ১৬৯৭, ১৬৯৮]
অনুরূপভাবে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিম্বরে উপবিষ্ট অবস্থায় বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যসহ প্রেরণ করেন এবং তার প্রতি কিতাব নাযিল করেন। কিতাবে যেসব বিষয় নাযিল করা হয়, তন্মধ্যে প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধানও ছিল, যা আমরা পাঠ করেছি, স্মরণ রেখেছি এবং হৃদয়ঙ্গম করেছি। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও প্রস্তরাঘাতে হত্যা করেছেন এবং তার পরে আমরাও করেছি। এখন আমি আশংকা করছি যে, সময়ের চাকা আবর্তিত হওয়ার পর কেউ একথা বলতে না শুরু করে যে, আমরা প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে পাই না। ফলে সে একটি দ্বীনী কর্তব্য পরিত্যাগ করার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে, যা আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেছেন। মনে রেখো, প্রস্তরাঘাতে হত্যার বিধান আল্লাহর কিতাবে সত্য এবং বিবাহিত পুরুষ ও নারীর প্রতি প্রযোজ্য- যদি ব্যভিচারের শরীয়তসম্মত সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থিত হয় অথবা গর্ভ ও স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়৷ [বুখারীঃ ৬৮২৯, মুসলিমঃ ১৬৯১]
(২) ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর বিধায় শাস্তি প্রয়োগকারীদের তরফ থেকে দয়াপরবশ হয়ে শাস্তি ছেড়ে দেয়ার কিংবা হ্রাস করার সম্ভাবনা আছে। [সা’দী] তাই সাথে সাথে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, দ্বীনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান কার্যকর কারণে অপরাধীদের প্রতি দয়াপরবশ হওয়া বৈধ নয়। [দেখুন: ইবন কাসীর, বাগভী, তাবারী]
(৩) অর্থাৎ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ লোকের সামনে শাস্তি দিতে হবে। এর ফলে একদিকে অপরাধী অপদস্ত হবে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষ শিক্ষা লাভ করবে। [ফাতহুল কাদীর, কুরতুবী সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(২) ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী -- ওদের প্রত্যেককে একশো কশাঘাত কর।[1] আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে ওদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে অভিভূত না করে; যদি তোমরা আল্লাহতে এবং পরকালে বিশ্বাসী হও।[2] আর বিশ্বাসীদের একটি দল যেন ওদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। [3]
[1] ব্যভিচারের প্রারম্ভিক শাস্তি; যা ইসলামে অস্থায়ীভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল তা সূরা নিসার ১৫নং আয়াতে আলোচিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ এ ব্যাপারে কোন স্থায়ী শাস্তি নির্ধারিত করা না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই সমস্ত ব্যভিচারিণী মহিলাদেরকে ঘরে আবদ্ধ রাখা হোক। কিন্তু যখন সূরা নূরের এই আয়াত অবতীর্ণ হল, তখন নবী (সাঃ) বললেন যে, ‘আল্লাহ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই মত ব্যভিচারী পুরুষ ও নারীর স্থায়ী শাস্তি নির্ধারিত করে দিয়েছেন, তা তোমরা আমার কাছ হতে শিখে নাও। আর তা হল, অবিবাহিত পুরুষ ও নারীর জন্য একশত বেত্রাঘাত ও বিবাহিত নারী-পুরুষের জন্য একশত বেত ও পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা।’ (সহীহ মুসলিম, দন্ডবিধি অধ্যায়) অতঃপর বাস্তবে তিনি বিবাহিত (ব্যভিচারী)-দের শাস্তি দিয়েছেন পাথর মেরে, আর একশত বেত্রাঘাত (যা ছোট শাস্তি) বড় শাস্তির সাথে একত্রীভূত করে বিলুপ্ত করেছেন। অতএব এখন বিবাহিত নারী-পুরুষের ব্যভিচারের একমাত্র শাস্তি পাথর মেরে শেষ করে ফেলা। নবী (সাঃ)-এর যুগের পর খোলাফায়ে রাশেদীন তথা সাহাবাদের যুগেও উক্ত শাস্তিই দেওয়া হত। পরবর্তীকালের ফকীহগণ ও উলামাবৃন্দ এ ব্যাপারে একমত ছিলেন এবং এখনো একমত আছেন। শুধুমাত্র খাওয়ারিজ সম্প্রদায় পাথর ছুঁড়ে মারার এই শাস্তিকে অস্বীকার করে। ভারত উপমহাদেশেও আজকাল এমন কিছু মানুষ আছে, যারা উক্ত শাস্তির কথা মানতে অস্বীকার করে থাকে। এই অস্বীকার করার মূল কারণ হাদীস অস্বীকার করা। কারণ পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার শাস্তি সহীহ ও শক্তিশালী হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং সেই সমস্ত হাদীসের বর্ণনাকারীর সংখ্যাও এত বেশি যে, উলামাবৃন্দ সেগুলোকে ‘মুতাওয়াতির’ (বর্ণনা-পরম্পরা-বহুল) হাদীস বলে গণ্য করেছেন। বলা বাহুল্য, হাদীসের প্রামাণিকতা ও তা শরীয়তের একটি উৎস হওয়ার কথা যাঁরা স্বীকার করেন, তাঁরা উক্ত শাস্তির বিধানকে অস্বীকার করতে পারেন না।
[2] এর অর্থ এই যে, দয়ার উদ্রেক হওয়ার কারণে শাস্তির বিধান কার্যকর করতে বিরত থেকো না। তবে প্রাকৃতিকভাবে দয়ার উদ্রেক হওয়া ঈমানের প্রতিকুল নয়। দয়া মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব।
[3] যাতে মানুষের শিক্ষা গ্রহণ যা শাস্তিদানের আসল উদ্দেশ্য তা ব্যাপকতা লাভ করে। (শাস্তি দেখে অন্যরা উপদেশ নিতে পারে এবং এমন কাজে পা বাড়াতে ভয় পায়।) ভাগ্যচক্রে আজকাল জন-সমক্ষে শাস্তি দেওয়াকে মানবাধিকার বিরোধী বলে প্রচার করা হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণ মূর্খতা, আল্লাহর আদেশের প্রতি বিদ্রোহ এবং তাদের ধারণা মতে তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর থেকে বেশি মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষী ও মঙ্গলকামী হতে চাওয়া। অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহ অপেক্ষা অধিক করুণাময় ও দয়াবান আর কেউ নেই।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩. ব্যভিচারী পুরুষ-ব্যভিচারিণীকে অথবা মুশরিক নারীকে ছাড়া বিয়ে করে না এবং ব্যভিচারিণী নারী, তাকে ব্যভিচারী অথবা মুশরিক ছাড়া কেউ বিয়ে করে না(১), আর মুমিনদের জন্য এটা হারাম করা হয়েছে।(২)
(১) আলোচ্য আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তাফসীরবিদদের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। কোন কোন তাফসীরকারক আয়াতটিকে মনসূখ তথা রহিত বলেন। তাদের মতে আয়াতের ভাষ্য হলো, ব্যভিচারী মহিলাকে বিয়ে করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। [বাগভী] কোন কোন মুফাস্সির এ হুকুমকে সুনির্দিষ্ট ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত মনে করেন। [দেখুন: ইবন কাসীর, কুরতুবী, বাগভী, ফাতহুল কাদীর] আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেনঃ সে যুগে এক মহিলার নাম ছিল উম্মে মাহযুল। সে যিনা করত। (বেশ্যা ছিল)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক সাহাবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [মুসনাদে আহমাদ ২/১৫৯, ২/২২৫, নাসায়ী, কিতাবুত্-তাফসীর, হাদীস নং ৩৭৯, মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/১৯৩-১৯৪, বায়হাকী ৭/১৫৩] অনুরূপ অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, সে যুগে ‘আনাক’ নাম্নী এক বেশ্যা ছিল, মারসাদ নামীয় এক সাহাবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে এ আয়াত নাযিল হয়। [তিরমিযীঃ ৩১৭৭, আবু দাউদঃ ২০৫১, মুস্তাদরাকে হাকোমঃ ২/১৬৬]
(২) আয়াতের ذَٰلِكَ শব্দ দ্বারা ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর বিয়ে এবং মুশরিক ও মুশরিকার বিয়ের দিকে ইশারা করা হয়েছে [দেখুন: কুরতুবী] কোন নারী বা কোন পুরুষ যিনাকারী হিসাবে পরিচিত হলে যদি সেই কাজ থেকে তাওবাহ না করে তবে তাকে বিয়ে করা জায়েয নাই। [আয়সারুত-তাফসির, সা’দী] রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘তিন ধরনের লোক জান্নাতে যাবে না। আল্লাহ তাদের দিকে কেয়ামতের দিন তাকাবেন না। (এক) পিতামাতার অবাধ্য, (দুই) পুরুষের মত চলাফেরাকারিণী মহিলা এবং (তিন) দায়্যূস (যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে অপকর্ম হতে দেখেও তার আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত হয় না)। [মুসনাদে আহমাদঃ ২/১৩৪, ইবনে হিব্বানঃ ৭৩৪০]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩) ব্যভিচারী কেবল ব্যভিচারিণী অথবা অংশীবাদিনীকেই বিবাহ করবে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা অংশীবাদীই বিবাহ করবে। বিশ্বাসীদের জন্য এ বিবাহ অবৈধ। [1]
[1] এ ব্যাপারে ব্যাখ্যাকারিগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, অধিক সময় এ রকমই ঘটে থাকে বলে এ রকম বলা হয়েছে। আয়াতের অর্থ হল, সাধারণতঃ ব্যভিচারী ব্যক্তি বিবাহের জন্য নিজের মত ব্যভিচারিণীর দিকেই রুজু করে থাকে। সেই জন্য দেখা যায় অধিকাংশ ব্যভিচারী নারী-পুরুষ তাদেরই অনুরূপ ব্যভিচারী নারী-পুরুষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করতে পছন্দ করে। আর এ কথা বলার আসল লক্ষ্য হল, মু’মিনদেরকে সতর্ক করা যে, যেমন ব্যভিচার একটি জঘন্যতম কর্ম ও মহাপাপ, তেমনি ব্যভিচারী ব্যক্তির সাথে বিবাহ ও দাম্পত্য জীবনের সম্পর্ক গড়াও অবৈধ। ইমাম শাওকানী (রঃ) এই মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এবং হাদীসসমূহে এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার যে কারণ বলা হয়েছে, তাতেও উক্ত মতের সমর্থন হয়। যে কোন এক সাহাবী নবী (সাঃ)-এর কাছে (আনাক বা উম্মে মাহযূল নামক) ব্যভিচারিণীকে বিবাহ করার অনুমতি চাইলে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ, তাঁদেরকে এ রকম করতে নিষেধ করা হল। এখান হতে দলীল গ্রহণ করে উলামাগণ বলেছেন যে, কোন পুরুষ কোন মহিলার সাথে বা কোন মহিলা কোন পুরুষের সাথে ব্যভিচার করে বসলে তাদের আপোসে বিবাহ হারাম। তবে তারা যদি বিশুদ্ধভাবে তওবা করে নেয়, তাহলে বিবাহ বৈধ। (তাফসীর ইবনে কাসীর)
আবার কেউ কেউ বলেন, এখানে نِكاح বলতে বিবাহ উদ্দেশ্য নয়। বরং তা মিলন বা সঙ্গম (মূল) অর্থে ব্যবহার হয়েছে। উদ্দেশ্য হল, ব্যভিচার ও যিনার নিকৃষ্টতা ও জঘন্যতা বর্ণনা করা। আর আয়াতের অর্থ এই যে, ব্যভিচারী ব্যক্তি নিজ যৌনকামনা চরিতার্থ করার জন্য অবৈধ রাস্তা অবলম্বন করে ব্যভিচারিণী মহিলার প্রতি রুজু করে থাকে, অনুরূপ ব্যভিচারিণী মহিলাও ব্যভিচারী পুরুষের প্রতি রুজু করে। কিন্তু মু’মিনদের জন্য এ রকম করা হারাম। অর্থাৎ, ব্যভিচার হারাম। এখানে ব্যভিচারীর সাথে মুশরিক নারী-পুরুষের আলোচনা এই জন্য করা হয়েছে যে, শিরকের সাথে ব্যভিচারের বেশ সামঞ্জস্য আছে। একজন মুশরিক যেরূপ আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে অন্যের নিকট মাথা নত করে, অনুরূপ একজন ব্যভিচারী পুরুষ নিজের স্ত্রীকে বাদ দিয়ে বা একজন ব্যভিচারিণী নিজের স্বামীকে ছেড়ে অন্যের সাথে যৌনমিলন করে নিজের মুখে কালিমা লেপন করে। এইভাবে মুশরিক ও ব্যভিচারীর মাঝে এক ধরনের নৈতিক সামঞ্জস্য পাওয়া যায়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৪. আর যারা সচ্চরিত্রা নারীর(১) প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপর তারা চারজন সাক্ষী নিয়ে না আসে, তাদেরকে তোমরা আশিটি বেত্ৰাঘাত কর এবং তোমরা কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্ৰহণ করবে না; এরাই তো ফাসেক।(২)
(১) محصنات শব্দটি إحصان থেকে উদ্ভূত। শরীয়তের পরিভাষায় إحصان 'ইহসান' দুই প্রকার। একটি ব্যভিচারের শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং অপরটি অপবাদ আরোপের শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ব্যভিচারের শাস্তির ক্ষেত্রে إحصان এই যে, যার বিরুদ্ধে ব্যভিচার প্রমাণিত হয়, তাকে জ্ঞান সম্পন্ন, বালেগ, মুক্ত ও মুসলিম হতে হবে এবং শরীয়ত সম্মত পন্থায় কোন নারীকে বিয়ে করে তার সাথে সঙ্গমও হতে হবে। এরূপ ব্যক্তি যিনা করলে তার প্রতি রজম তথা প্রস্তরাঘাতে হত্যার শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। পক্ষান্তরে অপবাদ আরোপের শাস্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য إحصان এই যে, যে ব্যক্তির প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করা হয়, তাকে জ্ঞান সম্পন্ন বালেগ, মুক্ত ও মুসলিম হতে হবে, সৎ হতে হবে অর্থাৎ পূর্বে কখনো তার বিরুদ্ধে ব্যভিচার প্রমাণিত হয়নি। [দেখুন: কুরতুবী, বাগভী, সাদী, যাদুল মাসির]
(২) যে ব্যক্তি অন্যের বিরুদ্ধে যিনার অভিযোগ আনে, সে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে নিজের অভিযোগ প্রমাণ করবে। আর যদি প্রমাণ করতে না পারে তাহলে তাকে আশি ঘা বেত্ৰাঘাত করো, যাতে ভবিষ্যতে আর সে কখনো এ ধরনের কোন কথা বিনা প্রমাণে নিজের মুখ থেকে বের করার সাহস না করে। আর তাদের সাক্ষ্য কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। [ইবন কাসীর, মুয়াসসার]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) যারা সাধ্বী রমণীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে, অতঃপর স্বপক্ষে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশি বার কশাঘাত করবে এবং কখনও তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না; এরাই তো সত্যত্যাগী।[1]
[1] এই আয়াতে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার শাস্তির কথা বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোন সতী-সাধ্বী পবিত্রা মহিলার বা সচ্চরিত্র পুরুষের উপর ব্যভিচারের অপবাদ আরোপ করে (অনুরূপ যে মহিলা কোন সতী-সাধ্বী মহিলা বা সচ্চরিত্র পুরুষের উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেয়) সে প্রমাণ স্বরূপ চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে না পারলে তার ব্যাপারে তিন প্রকার বিধান দেওয়া হয়েছে। (ক) তাকে আশি বার বেত্রাঘাত করা হবে। (খ) তাদের সাক্ষ্য কখনই গ্রহণ করা হবে না। (গ) তারা আল্লাহ ও মানুষের নিকট ফাসেক বলে গণ্য হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫. তবে যারা এরপর তাওবা করে ও নিজেদেরকে সংশোধন করে, তাহলে আল্লাহ তো অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৫) যদি এর পর ওরা তওবা করে ও নিজেদের কার্য সংশোধন করে,[1] তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[1] তওবার কারণে বেত্রাঘাতের শাস্তি তো ক্ষমা হবে না, সে তওবা করুক বা না করুক বেত্রাঘাতের শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে। তবে অন্য দুই বিধান (সাক্ষ্য গ্রহণ না করা ও ফাসেক হওয়া) সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। কিছু উলামা বলেছেন যে, তওবার পর সে ফাসেক থাকবে না; তবে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। আবার কিছু উলামা বলেছেন, তওবার পর ফাসেক থাকবে না এবং তার সাক্ষ্যও গ্রহণযোগ্য হবে। ইমাম শাওকানী (রঃ) দ্বিতীয় মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আর أَبَدًا (কখনও) শব্দের অর্থ বলেছেন, যতক্ষণ সে অপবাদ দেওয়ার কাজে সক্রিয় থাকবে। যেমন বলা হয়, কাফেরের সাক্ষ্য কখনই গ্রহণীয় নয়। এখানে ‘কখনই’ বলতে সে যতক্ষণ কাফের থাকবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬. আর যারা নিজেদের স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজেরা ছাড়া তাদের কোন সাক্ষী নেই, তাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য এ হবে যে, সে আল্লাহর নামে চারবার শপথ করে বলবে যে, সে নিশ্চয় সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত,
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬) আর যারা নিজেদের স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজেরা ব্যতীত তাদের কোন সাক্ষী নেই, তাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য এই হবে যে, সে আল্লাহর নামে চারবার শপথ করে বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭. এবং পঞ্চমবারে বলবে যে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার উপর নেমে আসবে আল্লাহর লা’নত।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৭) এবং পঞ্চমবার বলবে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসবে। [1]
[1] এখানে ‘লিআন’এর বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। যার অর্থ হলঃ কোন পুরুষ নিজ স্ত্রীকে নিজের চোখে অন্য কোন পুরুষের সাথে কুকর্মে লিপ্ত দেখে, যার প্রতক্ষ্যদর্শী সে নিজেই। কিন্তু ব্যভিচারের শাস্তি সাব্যস্ত করার জন্য চারজন সাক্ষীর প্রয়োজন। সেই কারণে নিজের সঙ্গে অতিরিক্ত তিনজন সাক্ষী সংগ্রহ না করতে পারলে স্ত্রীর উপর ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু নিজের চোখে দেখার পর এ রকম অসতী স্ত্রী নিয়ে সংসার করাও সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় শরীয়তে এর সমাধান দিয়েছে যে, স্বামী আদালতে কাযীর সামনে চারবার আল্লাহর নামে কসম (শপথ) করে বলবে যে, সে তার স্ত্রী উপর ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়ায় সত্যবাদী। অথবা স্ত্রীর এই সন্তান বা গর্ভ তার নয়। আর পঞ্চমবারে বলবে যে, ‘আমি যদি এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী হই, তাহলে আমার উপর আল্লাহর অভিশাপ হোক।’ (অনুরূপ স্ত্রীও নিজের উপর লা’নত বা অভিশাপ দেবে। আর স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের এই লা’নত দেওয়ার নামই ‘লিআন’।)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৮. আর স্ত্রী লোকটির শাস্তি রহিত হবে যদি সে চারবার আল্লাহ্র নামে শপথ করে সাক্ষ্য দেয় যে, নিশ্চয় তার স্বামীই মিথ্যাবাদী,
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৮) তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত করা হবে; যদি সে চারবার আল্লাহর নামে শপথ করে সাক্ষ্য দেয় যে, তার স্বামীই মিথ্যাবাদী।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯. এবং পঞ্চমবারে বলবে যে, তার স্বামী সত্যবাদী হলে তার নিজের উপর নেমে আসবে আল্লাহর গযব।(১)
(১) যখন কোন স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয় অথবা সন্তান সম্পর্কে বলে যে, সে আমার শুক্রজাত নয়, অপরপক্ষে স্ত্রী স্বামীকে মিথ্যাবাদী অভিহিত করে দাবী করে যে, তাকে মিথ্যা অপবাদের শাস্তি আশিটি বেত্ৰাঘাত প্ৰদান করা হোক, তখন স্বামীকে স্বপক্ষে চার জন সাক্ষী উপস্থিত করাতে বলা হবে। সে যদি যথাবিহিত চার জন সাক্ষী পেশ করে যারা স্ত্রীর ব্যভিচারের পক্ষে এমনভাবে সাক্ষ্য দিবে যে স্ত্রীর ব্যভিচার বিচারকের কাছে প্রমাণিত হয়ে পড়ে, তখন স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের হদ প্রয়োগ করা হবে। পক্ষান্তরে সে চার জন সাক্ষী পেশ করতে না পারলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে লি’আন করানো হবে। প্রথমে স্বামীকে বলা হবে যে, সে কুরআনে উল্লেখিত ভাষায় চার বার সাক্ষ্যদান করুক যে, সে এ ব্যাপারে সত্যবাদী এবং পঞ্চম বার বলুক যে, সে মিথ্যাবাদী হলে তার প্রতি আল্লাহর লা'নত বা অভিশাপ বৰ্ষিত হবে।
স্বামী যদি এসব কথা থেকে বিরত থাকে, তবে যে পর্যন্ত নিজের মিথ্যাবাদী হওয়ার কথা স্বীকার না করে অথবা উপরোক্ত ভাষায় পাঁচ বার কসম না করে, সে পর্যন্ত তাকে আটক রাখা হবে। সে যদি মিথ্যাবাদী হওয়ার কথা স্বীকার করে, তবে তার উপর অপবাদের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে। পক্ষান্তরে যদি পাঁচ বার কসম করে নেয়, তবে স্ত্রীর কাছ থেকেও কুরআনে বর্ণিত ভাষায় পাঁচ বার কসম করিয়ে নেয়া হবে। যদি সে কসম করতে অস্বীকার করে, তবে যে পর্যন্ত সে স্বামীর কথার সত্যতা স্বীকার না করে এবং নিজের ব্যভিচারের অপরাধ স্বীকার না করে, সে পর্যন্ত তাকে আটক রাখা হবে। আর এরূপ স্বীকারোক্তি করলে তার উপর ব্যভিচারের শাস্তি প্রয়োগ করা হবে।
পক্ষান্তরে যদি উপরোক্ত ভাষায় কসম করতে সম্মত হয়ে যায় এবং কসম করে নেয়, তবে লি'আন পূর্ণতা লাভ করবে। এর ফলশ্রুতিতে দুনিয়ার শাস্তির কবল থেকে উভয়েই বেঁচে যাবে। আখেরাতের ব্যাপার আল্লাহ তা'আলাই জানেন যে, তাদের মধ্যে কে মিথ্যাবাদী। মিথ্যাবাদী আখেরাতের শাস্তি ভোগ করবে। কিন্তু দুনিয়াতেও যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে লি’আন হয়ে গেল, তখন তারা একে অপরের জন্য চিরতরে হারাম হয়ে যাবে। বিচারক উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবেন। এটা তালাকেরই অনুরূপ হবে। এখন তাদের মধ্যে পুনর্বিবাহও হতে পারবে না। [ইবন কাসীর, কুরতুবী, সাদী]
হাদীসের কিতাবাদিতে লি'আন সংক্রান্ত দু’টি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। একটি ঘটনা হেলাল ইবন উমাইয়া ও তার স্ত্রীর, যা সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমার বর্ণনায় রয়েছে। এ ঘটনার প্রাথমিক অংশ ইবনে আব্বাসেরই বর্ণনায় মুসনাদে আহমাদে এভাবে রয়েছে- ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ যখন কুরআনে অপবাদের হদ সম্পর্কিত (وَالَّذِينَ يَرْمُونَ الْمُحْصَنَاتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا بِأَرْبَعَةِ شُهَدَاءَ فَاجْلِدُوهُمْ ثَمَانِينَ جَلْدَةً) আয়াত নাযিল হল, তখন মুসলিমদের মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা দিল। কারণ এতে কোন নারীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরোপকারী পুরুষের জন্য জরুরী করা হয়েছে যে, হয় সে স্বপক্ষে চার জন সাক্ষী উপস্থিত করবে, তন্মধ্যে এক জন সে নিজে হবে, না হয় তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে আশিটি বেত্ৰাঘাত করা হবে এবং চিরতরে তার সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত হবে। এ আয়াত শুনে আনসারদের সর্দার সা'দ ইবনে উবাদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, এ আয়াতগুলো ঠিক এভাবেই নাযিল হয়েছে?
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা'দ ইবনে উবাদার মুখে এরূপ কথা শুনে বিস্মিত হলেন। তিনি আনসারদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ তোমরা কি শুনলে, তোমাদের সর্দার কি কথা বলছেন? আনসারগণ বললঃ হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তাকে তিরস্কার করবেন না। তার একথা বলার কারণ তার তীব্ৰ আত্মমর্যাদাবোধ। অতঃপর সা’দ ইবনে উবাদা নিজেই বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গ, আমার পুরোপুরি বিশ্বাস রয়েছে যে, আয়াতগুলো সত্য এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেই নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু আমি আশ্চর্য বোধ করি যে, যদি আমি লজ্জাহীনা স্ত্রীকে এমতাবস্থায় দেখি যে, তার উপর ভিন্ন পুরুষ সওয়ার হয়ে আছে, তখন কি আমার জন্য বৈধ হবে না যে, আমি তাকে শাসন করি এবং সেখান থেকে সরিয়ে দেই; না আমার জন্য এটা জরুরী যে, আমি চার জন লোক এনে এটা দেখাই এবং সাক্ষী করি? যতক্ষণে আমি সাক্ষী সংগ্ৰহ করব, ততক্ষণে কি তারা উদ্দেশ্য সাধন করে পলায়ণ করবে না?
সাদ ইবনে উবাদার এ কথাবার্তার অল্পদিন পরেই একটি ঘটনা সংঘটিত হল। হেলাল ইবনে উমাইয়া এশার সময় ক্ষেত থেকে ফিরে এসে স্ত্রীর সাথে এক জন পুরুষকে স্বচক্ষে দেখলেন এবং তাদের কথাবার্তা নিজ কানে শুনলেন। কিন্তু কিছুই বললেন না। সকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ঘটনা বর্ণনা করলে তিনি খুব দুঃখিত হলেন এবং ব্যাপারটিকে গুরুতর মনে করলেন। এদিকে আনসারগণ একত্রিত হয়ে বলতে লাগল যে, আমাদের সর্দার সা'দ যে কথা বলেছিলেন, এক্ষণে আমরা তাতেই লিপ্ত হয়ে পড়লাম। এখন শরীয়তের আইন অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলাল ইবনে উমাইয়াকে আশিটি বেত্ৰাঘাত করবেন এবং জনগণের মধ্যে চিরতরে তার সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যাত হবে। কিন্তু হেলাল ইবনে উমাইয়া জোর দিয়ে বললেনঃ আল্লাহর কসম! আমার পূর্ণ বিশ্বাস যে, আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।
বুখারীর বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলালের ব্যাপার শুনে কুরআনের বিধান মোতাবেক তাকে বলেও দিয়েছিলেন যে, হয় দাবীর স্বপক্ষে চার জন সাক্ষী উপস্থিত কর, না হয় তোমার পিঠে অপবাদের শাস্তিস্বরূপ আশিটি বেত্ৰাঘাত পড়বে। হেলাল উত্তরে বললেনঃ যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর কসম, আমি আমার কথায় সত্যবাদী এবং আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই এমন কোন বিধান নাযিল করবেন, যা আমার পিঠকে অপবাদের শাস্তি থেকে মুক্ত করে দেবে। [বুখারীঃ ৪৭৪৭, ৫৩০৭] এই কথাবার্তা চলছিল এমতাবস্থায় জিবরীল আলাইহিস সালাম লি'আনের আইন সম্বলিত আয়াত নিয়ে নাযিল হলেন’ অর্থাৎ (وَالَّذِينَ يَرْمُونَ أَزْوَاجَهُمْ)।
আবু ইয়ালা এই বর্ণনাটিই আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। এতে আরো বলা হয়েছে যে, লি’আনের আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলাল ইবনে উমাইয়াকে সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ্ তা'আলা তোমার সমস্যার সমাধান নাযিল করেছেন। হেলাল বললেনঃ আমি আল্লাহ তা'আলার কাছে এই আশাই পোষণ করেছিলাম। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলালের স্ত্রীকে ডেকে আনলেন। স্বামী-স্ত্রীর উপস্থিতিতে স্ত্রীর জবানবন্দী নেয়া হল। সে বললঃ আমার স্বামী হেলাল ইবনে উমাইয়া আমার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমাদের মধ্যে একজন যে মিথ্যাবাদী, তা আল্লাহ তা’আলা জানেন। জিজ্ঞাস্য এই যে, তোমাদের কেউ কি আল্লাহর আযাবের ভয়ে তাওবাহ করবে এবং সত্য কথা প্রকাশ করবে? হেলাল বললেনঃ আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গ, আমি সম্পূর্ণ সত্য কথা বলছি।
তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াত অনুযায়ী উভয়কে লি’আন করানোর আদেশ দিলেন। প্রথমে হেলালকে বলা হল যে, তুমি কুরআনের বর্ণিত ভাষায় চার বার সাক্ষ্য দাও; অর্থাৎ আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বিশ্বাস করে বলছি যে, আমি সত্যবাদী। হেলাল আদেশ অনুযায়ী চার বার সাক্ষ্য দিলেন। পঞ্চম সাক্ষ্যর কুরআনী ভাষা এরূপঃ “যদি আমি মিথ্যা বলি, তবে আমার প্রতি আল্লাহর লা'নত বর্ষিত হবে।” এই সাক্ষ্যের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলালকে বললেনঃ দেখা হেলাল, আল্লাহকে ভয় কর। কেননা, দুনিয়ার শাস্তি আখেরাতের শাস্তির তুলনায় অনেক হাল্কা। আল্লাহর আযাব মানুষের দেয়া শাস্তির চাইতে অনেক কঠোর। এই পঞ্চম সাক্ষ্যই শেষ সাক্ষ্য। এর ভিত্তিতেই ফয়সালা হবে। কিন্তু হেলাল বললেনঃ আমি কসম করে বলতে পারি যে, আল্লাহ্ তাআলা আমাকে এই সাক্ষ্যের কারণে আখেরাতের আযাব দেবেন না।
এরপর তিনি পঞ্চম সাক্ষ্যর শব্দগুলোও উচ্চারণ করে দিলেন। অতঃপর হেলালের স্ত্রীর কাছ থেকেও এমনি ধরণের চার সাক্ষ্য অথবা কসম নেয়া হল। পঞ্চম সাক্ষ্যর সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ একটু থাম। আল্লাহকে ভয় কর। এই সাক্ষ্যই শেষ সাক্ষ্য। আল্লাহর আযাব মানুষের আযাব অর্থাৎ ব্যভিচারের শাস্তির চাইতেও অনেক কঠোর। এ কথা শুনে সে কসম করতে ইতস্ততঃ করতে লাগিল। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলে অবশেষে সে বললঃ আল্লাহর কসম আমি আমার গোত্রকে চিরদিনের জন্য লাঞ্ছিত করব না। অতঃপর সে পঞ্চম সাক্ষ্যও একথা বলে দিয়ে দিল যে, আমার স্বামী সত্যবাদী হলে আমার উপর আল্লাহর গজব বা ক্ৰোধ আপতিত হবে।
এভাবে লিআনের কার্যধারা সমাপ্ত হয়ে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বামী-স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন অর্থাৎ তাদের বিয়ে নাকচ করে দিলেন। তিনি আরো ফয়সালা দিলেন যে, এই গৰ্ভ থেকে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সে এই স্ত্রীর সন্তান বলে কথিত হবে- পিতার সাথে সম্বন্ধযুক্ত হবে না। কিন্তু সন্তানটিকে ধিকৃতও করা হবে না। [মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৩৮-২৩৯, আবু দাউদঃ ২২৫৬, আবু ইয়া'লাঃ ২৭৪০]
বুখারী ও মুসলিমে সাহল ইবনে সা'দ সায়েদীর বর্ণনা এভাবে আছে যে, ওয়াইমের আজলানী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, যদি কেউ তার স্ত্রীকে ভিন্ন পুরুষের সাথে দেখে, তবে সে কি তাকে হত্যা করবে, যার ফলে তাকেও হত্যা করা হবে? বা তার কি করা উচিত? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা তোমার এবং তোমার স্ত্রীর ব্যাপারে বিধান নাযিল করেছেন। যাও স্ত্রীকে নিয়ে এস। বর্ণনাকারী সাহল বলেনঃ তাদেরকে এনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের মধ্যে লি’আন করালেন। যখন উভয় পক্ষ থেকে পাঁচটি সাক্ষ্য পূর্ণ হয়ে লিআন সমাপ্ত হল, তখন ওয়াইমের বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, এখন যদি আমি তাকে স্ত্রীরূপে রাখি, তবে এর অর্থ এই হয় যে, আমি তার প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছি। তারপর তিনি তাকে তালাক দিয়ে দিলেন। [বুখারীঃ ৪৭৪৫, ৪৭৪৬, ৫৩০৯, মুসলিমঃ ১৪৯২]
আলোচ্য ঘটনাদ্বয়ের মধ্য থেকে প্রত্যেকটি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, লি’আনের আয়াত এর পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। হাফেয ইবনে হাজার ও ইমাম বগভী উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানকল্পে বলেছেন যে, মনে হয় প্ৰথম ঘটনা হেলাল ইবনে উমাইয়ার ছিল এবং লি’আনের আয়াত এরই পরিপ্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। এরপর ওয়াইমের এমনি ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়। হেলাল ইবনে উমাইয়ার ঘটনা তার জানা ছিল না। কাজেই এ ব্যাপারটি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পেশ করা হল তখন তিনি বললেনঃ তোমার ব্যাপারে ফয়সালা এই। এর স্বপক্ষে ইঙ্গিত এই যে, হেলাল ইবনে উমাইয়ার ঘটনায় হাদীসের ভাষা হচ্ছে فَنَزَلَ جِبْرَئِيْلُ এবং ওয়াইমেরের ঘটনায় ভাষা হচ্ছে قَدْ نَزَّلَ الله فِيْكَ এর অর্থ এরূপও হতে পারে যে, আল্লাহ্ তা'আলা তোমার অনুরূপ এক ঘটনায় এর বিধান নাযিল করেছেন।
উপরোক্ত দু'টি বর্ণনা ছাড়াও লি'আন সংক্রান্ত আরো কিছু হাদীস এসেছে যেগুলো থেকে লি’আনের গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন, ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, স্বামী-স্ত্রী লি’আন শেষ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন ৷ [বুখারীঃ ৫৩০৬, ৪৭৪৮ মুসনাদে আহমদঃ ২/৫৭] ইবনে উমরের অন্য এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর মধ্যে লি’আন করানো হয়। তারপর স্বামীটি গর্ভের সন্তান অস্বীকার করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করে দেন এবং ফায়সালা শুনিয়ে দেন, সন্তান হবে শুধুমাত্র মায়ের। [বুখারীঃ ৫৩১৫, ৬৭৪৮]
ইবনে উমরের আর একটি বর্ণনায় এসেছে যে, উভয়ে লি’আন করার পর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমাদের হিসাব এখন আল্লাহর জিম্মায়। তোমাদের একজন অবশ্যই মিথ্যুক।” তারপর তিনি পুরুষটিকে বলেন, এখন এ আর তোমার নয়। তুমি এর উপর নিজের কোন অধিকার দেখাতে পারো না। এর উপর কোনরকম হস্তক্ষেপও করতে পারো না। অথবা এর বিরুদ্ধে অন্য কোন প্রকার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্ৰহণ করার অধিকারও আর তোমার নেই। পুরুষটি বলে, হে আল্লাহর রসূল! আর আমার সম্পদ? (অর্থাৎ যে মোহরানা আমি তাকে দিয়েছিলাম তা আমাকে ফেরত দেবার ব্যবস্থা করুন)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সম্পদ ফেরত নেবার কোন অধিকার তোমার নেই। যদি তুমি তার উপর সত্য অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে ঐ সম্পদ সে আনন্দ উপভোগের প্রতিদান যা তুমি হালাল করে তার থেকে লাভ করেছো। আর যদি তুমি তার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকো তাহলে সম্পদ তোমার কাছ থেকে আরো অনেক দূরে চলে গেছে। তার তুলনায় তোমার কাছ থেকে তা বেশী দূরে রয়েছে।” [বুখারীঃ ৫৩৫০]
অপর বর্ণনায় আলী ইবন আবু তালেব ও ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ “সুন্নাত এটিই নির্ধারিত হয়েছে যে, লি’আনকারী স্বামী-স্ত্রী পরবর্তী পর্যায়ে আর কখনো বিবাহিতভাবে একত্র হতে পারে না।” [দারুকুতনী ৩/২৭৬] আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এরা দু’জন আর কখনো একত্র হতে পারে না। [দারুকুতুনীঃ ৩/২৭৬] লি'আনের উপযুক্ত আয়াত এবং এ হাদীসগুলোর আলোকে ফকীহগণ লি'আনের বিস্তারিত আইন-কানুন তৈরী করেছেন। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো হচ্ছেঃ
একঃ যে ব্যক্তি স্ত্রীর ব্যভিচার স্বচক্ষে দেখে লি'আনের পথ অবলম্বন না করে হত্যা করে বসে তার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। একটি দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে। কারণ নিজের উদ্যোগে ‘হদ’ জারি করার তথা আইন হাতে তুলে নেয়ার অধিকার তার ছিল না। দ্বিতীয় দল বলে, তাকে হত্যা করা হবে না এবং তার কর্মের জন্য তাকে জবাবদিহিও করতে হবে না, তবে এ ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে তার দাবীর সত্যতা প্রমাণিত হতে হবে (অর্থাৎ যথার্থই সে তার যিানার কারণে এ কাজ করেছে)। ইমাম আহমদ ও ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ বলেন, এটিই হত্যার কারণ এ মর্মে তাকে দু’জন সাক্ষী আনতে হবে। মালেকীদের মধ্যে ইবনুল কাসেম ও ইবনে হাবীব এ মর্মে অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করেন যে, যাকে হত্যা করা হয়েছে সেই যিনাকারীর বিবাহিত হতে হবে। অন্যথায় কুমার যিনাকারীকে হত্যা করলে তার কাছ থেকে কিসাস নেয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ ফকীহের মতে তাকে কিসাস থেকে শুধুমাত্র তখনই মাফ করা হবে যখন সে যিানার চারজন সাক্ষী পেশ করবে অথবা নিহত ব্যক্তি মরার আগে নিজ মুখে একথা স্বীকার করে যাবে যে, সে তার স্ত্রীর সাথে যিনা করছিল এবং এ সংগে নিহত ব্যক্তিকে বিবাহিতও হতে হবে।
দুইঃ ঘরে বসে লি’আন হতে পারে না। এ জন্য আদালতে যাওয়া জরুরী।
তিনঃ লি’আন দাবী করার অধিকার শুধু স্বামীর নয়, স্ত্রীরও। স্বামী যখন তার উপর যিনার অপবাদ দেয় অথবা তার শিশুর বংশধারা মেনে নিতে অস্বীকার করে তখন স্ত্রী আদালতে গিয়ে লি‘আন দাবী করতে পারে।
চারঃ সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি লি‘আন হতে পারে অথবা এ জন্য তাদের দু'জনের মধ্যে কি কিছু শর্ত পাওয়া যেতে হবে? এ বিষয়ে ফকীহদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। ইমাম শাফেঈ বলেন, যার কসম আইনের দিক দিয়ে নির্ভরযোগ্য এবং যার তালাক দেবার ক্ষমতা আছে সে লি’আন করতে পারে। প্ৰায় একই ধরনের অভিমত ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদেরও। কিন্তু হানাফীগণ বলেন, লি’আন শুধুমাত্র এমন স্বাধীন মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে হতে পারে যারা কাযাফের অপরাধে শাস্তি পায়নি। যদি স্বামী ও স্ত্রী দু’জনই কাফের, দাস বা কাযাফের অপরাধে পূর্বেই শাস্তি প্রাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে লি‘আন হতে পারে না। এ ছাড়াও যদি স্ত্রীর এর আগেও কখনো হারাম বা সন্দেহযুক্ত পদ্ধতিতে কোন পুরুষের সাথে মাখামাখি থেকে থাকে, তাহলে এ ক্ষেত্রেও লি‘আন ঠিক হবে না।
পাঁচঃ নিছক ইশারা-ইংগিত, রূপক, উপমা বা সন্দেহ-সংশয় প্রকাশের ফলে লি'আন অনিবার্য হয়ে পড়ে না। বরং কেবলমাত্র এমন অবস্থায় তা অনিবার্য হয় যখন স্বামী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যিানার অপবাদ দেয় অথবা সুস্পষ্ট ভাষায় সন্তানকে নিজের বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে।
ছয়ঃ যদি অপবাদ দেবার পর স্বামী কসম খেতে ইতঃস্তত করে বা ছলনার আশ্রয় নেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফার মতে, তাকে বন্দী করতে হবে এবং যতক্ষণ সে লি’আন না করে অথবা নিজের অপবাদকে মিথ্যা বলে না মেনে নেয় ততক্ষণ তাকে মুক্তি দেয়া হবে না। আর মিথ্যা বলে মেনে নিলে তার বিরুদ্ধে কাযাফের দণ্ড জারি হয়ে যাবে। এর বিপরীতপক্ষে ইমাম মালেক, শাফেঈ এর মতে, লি‘আন করতে ইতঃস্তত করার ব্যাপারটি নিজেই মিথ্যার স্বীকারোক্তি। ফলে কসম করতে ইতঃস্তত করলেই তার উপর কাযাফের হদ ওয়াজিব হয়ে যায়।
সাতঃ স্বামীর কসম খাওয়ার পর স্ত্রী যদি লি’আন করতে ইতঃস্তত করে, তাহলে হানাফীদের মতে তাকে বন্দী করতে হবে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া যাবে না যতক্ষণ না সে লি’আন করবে অথবা যিানার স্বীকারোক্তি না করে নেবে। অন্যদিকে উপরোক্ত ইমামগণ বলেন, এ অবস্থায় তাকে রজম করে দেয়া হবে। তারা কুরআনের ঐ উক্তি থেকে যুক্তি পেশ করেন যে, একমাত্র কসম খাওয়ার পরই স্ত্রী শাস্তি মুক্ত হবে। এখন যেহেতু সে কসম খাচ্ছে না, তাই নিশ্চিতভাবেই সে শাস্তির যোগ্য হবে।
আটঃ যদি লি'আনের সময় স্ত্রী গর্ভবতী থাকে তাহলে ইমাম আহমাদের মতে স্বামী গৰ্ভস্থিত সন্তানকে গ্ৰহণ করতে অস্বীকার করুক বা না করুক স্বামীর গর্ভস্থিত সন্তানের দায়মুক্ত হবার এবং সন্তান তার ঔরষজাত গণ্য না হবার জন্য লি‘আন নিজেই যথেষ্ট। ইমাম শাফেঈ বলেন, স্বামীর যিানার অপবাদ ও গর্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করা এক জিনিস নয়। এ জন্য স্বামী যতক্ষণ গৰ্ভস্থিত সন্তানের দায়িত্ব গ্ৰহণ করতে সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার না করবে ততক্ষণ তা যিানার অপবাদ সত্বেও তার ঔরসজাত গণ্য হবে। কারণ স্ত্রী যিনাকারিনী হওয়ার ফলেই বর্তমান গৰ্ভজাত সন্তানটি যে যিানার কারণে জন্ম নিয়েছে, এটা অপরিহার্য নয়।
নয়ঃ ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমাদ স্ত্রীর গর্ভধারণকালে স্বামীকে গৰ্ভস্থিত সন্তান অস্বীকার করার অনুমতি দিয়েছেন এবং এরই ভিত্তিতে লি'আনকে বৈধ বলেন। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা বলেন, যদি স্বামীর অপবাদের ভিত্তি যিনা না হয়ে থাকে বরং শুধু এটাই হয়ে থাকে যে, সে স্ত্রীকে এমন অবস্থায় গর্ভবতী পেয়েছে যখন তার মতে এ গর্ভস্থত সন্তান তার হতে পারে না তখন এ অবস্থায় লি'আনের বিষয়টিকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত মূলতবী করে দেয়া উচিত। কারণ অনেক সময় কোন কোন রোগের ফলে গৰ্ভ সঞ্চার হয়েছে বলে সন্দেহ দেখা দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গর্ভসঞ্চার হয় না।
দশঃ যদি পিতা সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে লি’আন অনিবার্য হয়ে পড়ে, এ ব্যাপারে সবাই একমত। আবার এ ব্যাপারেও সবাই একমত যে, একবার সন্তানকে গ্ৰহণ করে নেবার পর পিতার পক্ষে আর তার বংশধারা অস্বীকার করার অধিকার থাকে না। এ অবস্থায় পিতা বংশধারা অস্বীকার করলে কাযাফের শাস্তির অধিকারী হবে।
এগারঃ যদি স্বামী তালাক দেওয়ার পর সাধারণভাবে তালাকপ্ৰাপ্তা স্ত্রীর বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ দেয় তাহলে ইমাম আবু হানীফার মতে লি‘আন হবে না বরং তার বিরুদ্ধে কাযাফের মামলা দায়ের করা হবে। কারণ লি‘আন হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর জন্য। আর তালাকপ্ৰাপ্ত নারীটি তার স্ত্রী নয়। তবে যদি রজ’ঈ তালাক হয় এবং রুজু করার (স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেবার) সময়-কালের মধ্যে সে অপবাদ দেয়, তাহলে ভিন্ন কথা।
বারঃ লি’আনের আইনগত ফলাফলের মধ্য থেকে কোন কোনটার ব্যাপারে। সবাই একমত আবার কোন কোনটার ব্যাপারে ফকীহগণের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। যেসব ফলাফলের ব্যাপারে মতৈক্য হয়েছে সেগুলো হচ্ছেঃ
১. লি’আন অনুষ্ঠিত হলে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই কোন শাস্তি লাভের উপযুক্ত হবে না।
২. স্বামী যদি সন্তানের বংশধারা অস্বীকার করে তাহলে সন্তান হবে একমাত্র মায়ের। সন্তান বাপের সাথে সম্পর্কিত হবে না এবং তার উত্তরাধিকারীও হবে না। মা তার উত্তরাধিকারী হবে এবং সে মায়ের উত্তরাধিকারী হবে।
৩. নারীকে ব্যভিচারিনী এবং তার সন্তানকে জারজ সন্তান বলার অধিকার কারোর থাকবে না। যদিও লি’আনের সময় তার অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যার ফলে তার ব্যাভিচারিনী হবার ব্যাপারে কারোর মনে সন্দেহ না থাকে, তবুও তাকে ও তার সন্তানকে একথা বলার অধিকার থাকবে না।
৪. যে ব্যক্তি লি’আনের পরে তার অথবা তার সন্তানের বিরুদ্ধে আগের অপবাদের পুনরাবৃত্তি করবে সে হদে’র যোগ্য হবে।
৫. নারীর মোহরানা বাতিল হয়ে যাবে না।
৬. ইদ্দত পালনকালে নারী পুরুষের থেকে খোরপোশ ও বাসস্থানের সুবিধা লাভের হকদার হবে না।
৭. নারী ঐ পুরুষের জন্য হারাম হয়ে যাবে।
তাছাড়া, দু'টি বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। এক, লি’আনের পরে পুরুষ ও নারী কিভাবে আলাদা হবে? এ বিষয়ে ইমাম শাফেঈ বলেন, যখনই পুরুষ লি‘আন শেষ করবে, নারী জবাবী লি‘আন করুক বা না করুক তখনই সংগে সংগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে। ইমাম মালেক, লাইস ইবনে সা’দ ও যুফার বলেন, পুরুষ ও নারী উভয়েই যখন লিআন শেষ করে তখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। অন্যদিকে ইমাম আবু হানীফা, আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ বলেন, লি’আনের ফলে ছাড়াছাড়ি আপনা আপনি হয়ে যায় না বরং আদালত ছাড়াছড়ি করে দেবার ফলেই ছাড়াছাড়ি হয়। যদি স্বামী নিজেই তালাক দিয়ে দেয় তাহলে ভালো, অন্যথায় আদালতের বিচারপতি তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি করার কথা ঘোষণা করবেন। দুই, লি’আনের ভিত্তিতে আলাদা হয়ে যাবার পর কি তাদের উভয়ের আবার মিলিত হওয়া সম্ভব?
এ বিষয়টিতে ইমাম মালেক, আবু ইউসুফ, শাফেঈ, আহমাদ ইবন হাম্বল বলেন, লি’আনের মাধ্যমে যে স্বামী-স্ত্রী আলাদা হয়ে গেছে তারা এরপর থেকে চিরকালের জন্য পরস্পরের উপর হারাম হয়ে যাবে। তারা পুনর্বার পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলেও কোন অবস্থাতেই পারবে না। উমর, আলী ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহুমও এ একই মত পোষণ করেন। বিপরীত পক্ষে সাঈদ ইবন মুসাইয়েব, ইবরাহীম নাখঈ, শাবী, সাঈদ ইবনে জুবাইর, আবু হানীফা ও মুহাম্মাদ রাহেমাহুমুল্লাহর মতে, যদি স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নেয় এবং তার উপর কাযাফের হদ জারি হয়ে যায় তাহলে তাদের দু'জনের মধ্যে পুর্নবার বিয়ে হতে পারে। তারা বলেন, তাদের উভয়কে পরস্পরের জন্য হারামকারী জিনিস হচ্ছে লিআন৷ যতক্ষণ তারা এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে ততক্ষণ হারামও প্রতিষ্ঠিত থাকবে কিন্তু যখনই স্বামী নিজের মিথ্যা স্বীকার করে নিয়ে শাস্তি লাভ করবে। তখনই লি’আন খতম হয়ে যাবে এবং হারামও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। [দেখুন: কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯) এবং পঞ্চমবার বলে, তার স্বামী সত্যবাদী হলে তার নিজের উপর আল্লাহর ক্রোধ নেমে আসবে।[1]
[1] অর্থাৎ স্বামীর উত্তরে স্ত্রীও যদি চারবার হলফ ক'রে বলে যে, তার স্বামী মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবার বলবে, স্বামী যদি এ ব্যাপারে সত্যবাদী হয়, আর আমি যদি মিথ্যাবাদী হই, তাহলে আমার উপর আল্লাহর লানত (অভিশাপ) হোক। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে সে ব্যাভিচারের শাস্তি থেকে বেঁচে যাবে। তবে তাদের দুজনকে এক অপর হতে চিরদিনের মত পৃথক করে দেয়া হবে। একে লি'আন এই কারণে বলা হয় যে, এতে দুইজনই মিথ্যাবাদী হওয়া অবস্থায় নিজকে অভিশাপের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়। নবী (সাঃ) এর যুগেও এ শ্রেণীর কিছু ঘটনা ঘটে, যার বিস্তারিত আলোচনা হাদিসসমুহে বিদ্যমান রয়েছে। আর এই সমস্ত ঘটনাই উক্ত সকল আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার মূল কারণ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১০. তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে(১); এবং আল্লাহ তো তাওবা গ্রহণকারী ও প্রজ্ঞাময়।
(১) এখানে বাক্যের বাকী অংশ উহ্য আছে। কারণ, এখানে অনেক কিছুই বর্ণিত হয়েছে। যদি আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ না থাকত। তবে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারত। যদি আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ হিসেবে এ আয়াতসমূহ নাযিল না করা হতো তবে এ সমস্ত বিষয় মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিত। যদি আল্লাহর রহমত না হতো তবে কেউ নিজেদেরকে তাওবার মাধ্যমে পবিত্র করার সুযোগ পেত না। যদি আল্লাহর রহমত না হতো তবে তাদের মধ্যে যারা মিথ্যাবাদী তাদের উপর লা'নত বা গজব নাযিল হয়েই যেত। এ সমস্ত সম্ভাবনার কারণেই আল্লাহ তা'আলা এখানে উত্তরটি উহ্য রেখেছেন। [দেখুন: তাবারী, বাগভী, ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০) তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে[1] এবং আল্লাহ তওবা গ্রহণকারী ও প্রজ্ঞাময় না হলে (তোমাদের কেউ অব্যাহতি পেত না)।
[1] এর জওয়াব এখানে ঊহ্য আছে; অর্থাৎ, ‘তোমাদের মধ্যে মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর আযাব তৎক্ষণাৎ এসে পড়ত’ (অথবা তোমাদের কেউ অব্যাহতি পেত না।) কিন্তু যেহেতু তিনি তওবাগ্রহণকারী, ক্ষমাশীল ও প্রজ্ঞাময়, সেহেতু তিনি গোপন করে নিয়েছেন যাতে কোন ব্যক্তি বিশুদ্ধ মনে তওবাহ করলে আল্লাহ তাকে দয়ার কোলে আশ্রয় দেবেন। আর তিনি প্রজ্ঞাময় বলেই লিআনের মত সমস্যার সমাধান দিয়ে স্ত্রীর প্রতি ঈর্ষাবান আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন পুরুষদের জন্য উত্তম ও সুন্দর যুক্তিগ্রাহ্য পথ করে দিয়েছেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান