-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* ৩৯৫ খৃস্টাব্দে রোমক সাম্রাজ্য থেকে পৃথক হয়ে বায়যানটাইন নামে যে সাম্রাজ্যটি পরিচিত হয়েছিল, এখানে الرومবলতে তাকে বুঝানো হয়েছে। সিরিয়া ও প্যালেস্টাইন এ সাম্রাজ্যের অধীন ছিল।
২. রোমক(১)রা পরাজিত হয়েছে—
(১) রোম বা রোমান কারা? ইবন কাসীর বলেন, ঈসু ইবনে ইসহাক ইবনে ইবরাহীমের বংশধরদেরকে রোম বলা হয়। যারা বনী-ইসরাঈলদের চাচাতো ভাইদের গোষ্ঠী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ আয়াতে ‘রোম’ বলে কাদেরকে বোঝানো হয়েছে? বস্তুত: আরবদের ভাষায় রোম বলতে দু'টি সম্প্রদায় থেকে উত্থিত একটি বিরাট জাতিকে বুঝায়। একদিকে গ্ৰীক, শ্লাভ সম্প্রদায়ভুক্ত রোমান, অপরদিকে লাতিন ভাষাভাষী ইতালিয়ান রোমান। যারা পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের মিশ্রণে একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠে। যার কিছু অংশ ইউরোপে আর কিছু অংশ এশিয়া মাইনরে। এই পুরো মিশ্রিত জাতিটাকেই আরবরা ‘রোম’ জাতি নামে অভিহিত করত। তবে মূল ল্যাটিন রোমানরা সবসময় স্বতন্ত্র ছিল। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
তাদেরকে ‘বনুল আসফার’ বা হলুদ রংয়ের সন্তানও বলা হয়। তারা গ্ৰীকদের ধর্মমতে বিশ্বাসী ছিল। আর গ্ৰীকরা সাতটি বিখ্যাত তারকার পূজারী ছিল। ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের ৩০০ বছর (মতান্তরে ৩২২ বছর) পর্যন্ত রোমরা গ্ৰীকদের ধর্মমতের উপরই ছিল। তাদের রাজত্ব শাম তথা বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন সহ জাযীরা তথা আরব সাগরীয় উপদ্বীপের এলাকাসমূহে বিস্তৃত ছিল। এ অংশের রাজাকে বলা হতো: কায়সার। তাদের রাজাদের মধ্যে প্রথম যে ব্যক্তি নাসারাদের ধর্মে প্রবেশ করে সে হচ্ছে, সম্রাট কন্সটান্টাইন ইবন অগাস্টি। তার মা তার আগেই নাসারা হয়েছিল। সে তাকে নাসারা ধর্ম গ্রহণের আহবান জানালে সে তা গ্ৰহণ করে। তার সময়ে নাসারাদের মধ্যে মতবিরোধ চরম আকার ধারণ করে। পরস্পর বিরোধিতা এমন পর্যায় পৌছেছিল যে, তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন সম্ভব ছিল না।
তখন ৩১৮ জন ধর্মীয় নেতা একত্রিত হয়ে কন্সটান্টাইনের জন্য এক প্রকার আকীদা বিশ্বাসের ভিত রচনা করে দেয়। যেটাকে তারা “প্রধান আমানত” বলে অভিহিত করে থাকে। বস্তুত তা ছিল নিকৃষ্টতম খিয়ানত। আর তারা তার জন্য আইনের বই রচনা করে। যাতে প্রয়োজনীয় হালালকে হারাম, আর হারামকে হালাল করে নেয়। এভাবে তারা মসীহ ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বীন পরিবর্তন করে নেয়, তাতে কোথাও বাড়িয়ে নেয় আবার কোথাও কমিয়ে নেয়। আর তখনই তারা পূর্বদিকে ফিরে সালাত আদায় করা আবিস্কার করে, শনিবারের পরিবর্তে রবিবারকে সম্মানিত দিন ঘোষণা করে, ক্রুশের ইবাদাত চালু করে, শুকর হালাল করে দেয়, নতুন নতুন ঈদের প্রচলন করে, যেমন ক্রশ দিবসের ঈদ, কাদাস বা পবিত্র ঈদ, গাতোস ঈদ ইত্যাদি। তারা এর জন্য পোপ সিষ্টেম চালু করে। যে হবে তাদের নেতা। তার নীচে থাকবে বাতারেকা (কার্ডিনেল), তার নীচে মাতারেনা, তার নীচে উসকুফ (বিশপ)ও কিসসিস (পাদ্রী), তার নীচে শামামিছাহ (ডিকন)।
তাছাড়া তারা বৈরাগ্যবাদ চালু করে। বাদশাহ তখন তাদের জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে গীর্জ ও ইবাদাতখানা তৈরী করে দেয়। আর তার নামের সাথে সংশ্লিষ্ট করে এক নগরীর পত্তন করে তার নাম দেয়া হয়, কন্সটান্টিনোপল। বলা হয়ে থাকে যে, সে রাজ্যে বার হাজার গীর্জা তৈরী করে। বেথেলহামকে তিন মিহরাব বিশিষ্ট ইবাদতখানা তৈরী করে। তার মা তৈরী করে কুমামাহ গীর্জা। এ দলটিকেই বলা হয়, আল-মালাকিয়্যাহ, যারা বাদশাহর দলভুক্ত লোক। তারপর তাদের থেকে ইয়াকুবীয়্যাহ সম্প্রদায় বের হয়। যারা ছিল ইয়াকুব আল-ইসকফ এর অনুসারী। তারপর তাদের থেকে বের হয় নাসিতুরীয়্যাহ সম্প্রদায়। যারা নাসিতুরা এর অনুসারী ছিল। তাদের দলের কোন কুল কিনারা নেই। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নাসারারা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছে” [আবু দাউদ: ৪৫৯৭] মোটকথা: তখন থেকে সে দেশের রাজারা খৃষ্টান ধর্মমতের উপর ছিল। যখনই কোন কায়সার মারা যেত, তার স্থানে অন্য কায়সার আসত। অবশেষে যে ছিল তার নাম ছিল হিরাক্লিয়াস। [ইবন কাসীর]
এ মিশ্রিত জাতির অর্থাৎ গ্ৰীক শ্লাভ ও এশিয়া মাইনরের জাতিদের সাথে মিশ্রিত হয়ে যে নব্য রোমান সমাজ সৃষ্টি হয়েছে তাদের সাথে মূল ইতালিয়ান রোমানদের সংযুক্তির কারণ হচ্ছে, সম্রাট ইউলিয়ূস তার দিগ্বিজয়ী আগ্রাসনে ইতালিয়ান রোমান এলাকা থেকে বের হয়ে এশিয়া মাইনর ও মধ্য এশিয়ার কোন কোন অঞ্চল যেমন ইরাক ও আরমেনিয়া, অনুরূপভাবে মিশর পর্যন্ত তার সম্রাজ্য বিস্তৃত করে। অন্যদিকে শ্লাভদের এলাকা সহ বসফরাসের তীরবর্তী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
মসীহ এর প্রায় জন্মের ৪০০ বছর আগে আলেক্সান্ডার এর সময় পর্যন্ত বাইজেন্টাইন সম্প্রদায় আশেপাশের বিভিন্ন রাষ্ট্র নিয়ে এক রাষ্ট্র অভিহিত হত। আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর বাইজেন্টাইন সম্রাজ্য আলাদা হয়ে যায় এবং ইতালিয়ান রোমানদের অধীনে চলে যায়। তখন থেকে ৩২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ অবস্থায় ছিল। তারপর সম্রাট কন্সটান্টাইন যখন কায়সার (সীজার) হন, তখন তিনি তার রাষ্ট্রকে আরও বিস্তৃত করেন এবং পুরো সাম্রাজ্যকে দু’ভাগে ভাগ করেন। পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজধানী হিসেবে ইটালিয়ান রোম নগরীকে বাছাই করেন। আর পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী হিসেবে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের সাথে মিলিয়ে এক শহর পত্তন করেন। যার নাম দিলেন, কন্সটান্টিনিয়্যাহ (বর্তমান ইস্তাম্বুল)। তিনি এমনভাবে এ শহরটির পিছনে শ্রম দেন যে, তার প্রসিদ্ধি ও সুনাম ইটালিয়ান রোম নগরীকে ছাড়িয়ে যায়।
৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর পুরো রাজ্যটি তার সন্তানদের মধ্যে বন্টিত হয়। তখন এ পূর্বাংশ যা রোম দেশ নামে খ্যাত হয় তা তার সন্তান কন্সটান্টিনোস এর করায়ত্বে আসে। তখন থেকে কনস্টান্টিনোপল ভিত্তিক রাষ্ট্রকে বলা হতে লাগল, রোম সাম্রাজ্য। আর রোম নগরীটি ইটালিয়ান রোমান সাম্রাজ্যের অধীন থেকে গেল। কিন্তু তখনও রোমান সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ বিভক্ত হয়ে যায়নি।
তারপর ৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট থিয়োদিসিয়োস তার দুই পুত্রের মধ্যে পুরো রোমান সম্রাজ্যকে দু’ভাগে ভাগ করে দেন। পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রাষ্ট্র। তখন থেকে পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ‘বিলাদুর রোম’ বা রোম সামাজ্য নামে খ্যাতি লাভ করে। যার রাজধানী ছিল কন্সটান্টিনোপল। ইউরোপিয়ানরা এ রাষ্ট্রকে বাইজেন্টাইন রাষ্ট্র নামেই অভিহিত করত। (মূল ইটালী ভিত্তিক রোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করে বুঝার সুবিধার্থে)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এ সম্রাজ্যের বিস্তৃতি শাম (সিরিয়া, লেবানন) ও ফিলিস্তিন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আর তখনকার রাজার নাম ছিল হিরাক্লিয়াস। যার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তার সাথে তখনকার দিনের অপর শক্তিমান রাষ্ট্র পারস্যের রাজা খসরু, ইবন হুরমুযের যুদ্ধে যখন পারসিকরা তাদের উপর জয়লাভ করে এবং ইন্তাকিয়া ও দামেশক পারসিকদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়, তখন এ আয়াত নাযিল হয়। [আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(২) রোমকগণ পরাজিত হয়েছে--
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* হিজাযের উত্তর পশ্চিম সীমানা সংলগ্ন আযরুয়াত ও বুসরার মধ্যবর্তী স্থান। সম্রাট হিরাক্লিয়াস ও খসরু পারভেজের মধ্যে এখানে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে খসরু পারভেজ বিজয় লাভ করে। ফলে মক্কার পৌত্তলিকরা খুশি হয়ে বলতে শুরু করে, আমরা মুসলিমদেরকে পরাজিত করব। তখন উক্ত আয়াতগুলো নাযিল হয়।
৩. কাছাকাছি অঞ্চলে(১); কিন্তু তারা তাদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয়ী হবে,
(১) অর্থাৎ পারস্যের অনুপাতে রোমকদের সবচেয়ে কাছের জনপদে রোমকগণ পারসিকদের হাতে পরাজিত হয়েছে। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩) (আরবের) নিকটবর্তী অঞ্চলে। কিন্তু ওরা ওদের এ পরাজয়ের পর শীঘ্রই বিজয় লাভ করবে--
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* بضع سنين তিন থেকে দশ বছর। এ আয়াতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে, অনধিক নয় বছরের মধ্যে রোমানরা পারসিকদের উপর বিজয় লাভ করবে। ৬২৩-২৪ খৃ এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়। আর সে বছরই বদর যুদ্ধে মুসলিমরা মুশরিকদেরকে পরাজিত করে।
৪. কয়েক বছরের মধ্যেই।(১) আগের ও পরের সব ফয়সালা আল্লাহরই। আর সেদিন মুমিনগণ খুশী হবে(২),
(১) এই সূরায় রোমক ও পারসিকদের যুদ্ধের কাহিনী আলোচিত হয়েছে। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই ছিল কাফের। তাদের মধ্যে কারও বিজয় এবং কারও পরাজয় বাহ্যতঃ ইসলাম ও মুসলিমদের জন্যে কোন কৌতুহলের বিষয় ছিল না। কিন্তু উভয় কাফের দলের মধ্যে পারসিকরা ছিল অগ্নিপূজারী মুশরিক এবং রোমকরা ছিল নাসারা আহলে কিতাব। ফলে এরা ছিল মুসলিমদের অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী। [ইবন কাসীর]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কায় অবস্থানকালে পারসিকরা রোমকদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে। হাফেজ ইবনে হাজার প্রমুখের উক্তি অনুযায়ী তাদের এই যুদ্ধ শাম দেশের আযরূ’আত ও বুসরার মধ্যস্থলে সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধ চলাকালে মক্কার মুশরিকরা পারসিকদের বিজয় কামনা করত। কেননা, শির্ক ও প্রতিমা পুজায় তারা ছিল পারসিকদের সহযোগী। অপরপক্ষে মুসলিমদের আন্তরিক বাসনা ছিল রোমকরা বিজয়ী হোক। কেননা, ধর্ম ও মাযহাবের দিক দিয়ে তারা ইসলামের নিকটবর্তী ছিল। [সা'দী]
কিন্তু ফল হল এই যে, তখনকার মত পারসিকরা যুদ্ধে জয়লাভ করল। এমনকি তারা কনষ্টাণ্টিনোপলও অধিকার করে নিল এবং সেখানে উপাসনার জন্যে একটি অগ্নিকুণ্ড নির্মাণ করল। এই ঘটনায় মক্কার মুশরিকরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল এবং মুসলিমদেরকে লজ্জা দিতে লাগল যে, তোমরা যাদের সমর্থন করতে তারা হেরে গেছে। ব্যাপার এখানেই শেষ নয়; বরং আহলে কিতাব রোমকরা যেমন পারসিকদের মোকাবেলায় পরাজয় বরণ করেছে, তেমনি আমাদের মোকাবিলায় তোমরাও একদিন পরাজিত হবে। এতে মুসলিমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত হয়। [সা'দী]
সূরা রূমের প্রাথমিক আয়াতগুলো এই ঘটনা সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। এসব আয়াতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, কয়েক বছর পরেই রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন এসব আয়াত শুনলেন, তখন মক্কার চতুষ্পার্শ্বে এবং মুশরিকদের সমাবেশ ও বাজারে উপস্থিত হয়ে ঘোষণা করলেন, তোমাদের হর্ষোৎফুল্ল হওয়ার কোন কারণ নেই। কয়েক বছরের মধ্যে রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে। মুশরিকদের মধ্যে উবাই ইবনে খালফ কথা ধরল এবং বলল, তুমি মিথ্যা বলছ। এরূপ হতে পারে না। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, আল্লাহর দুশমন, তুই-ই মিথ্যাবাদী। আমি এই ঘটনার জন্যে বাজি রাখতে প্ৰস্তুত আছি। যদি তিন বছরের মধ্যে রোমকরা বিজয়ী না হয়, তবে আমি তোকে দশটি উষ্ট্রী দেব।
উবাই এতে সম্মত হল। একথা বলে আবু বকর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে ঘটনা বিবৃত করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি তো তিন বছরের সময় নির্দিষ্ট করিনি। কুরআনের এই জন্যে بضع শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে এই ঘটনা ঘটতে পারে। তুমি যাও এবং উবাইকে বল যে, আমি দশটি উষ্ট্রীর স্থলে একশ উষ্ট্রী বাজি রাখছি, কিন্তু সময়কাল তিন বছরের পরিবর্তে নয় বছর এবং কোন কোন বর্ণনা মতে সাত বছর নির্দিষ্ট করছি। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু আদেশ পালন করলেন এবং উবাইও নতুন চুক্তিতে সম্মত হল। [তিরমিযী: ৩১৯৩, ৩১৯৪] বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায় যে, হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে এই ঘটনা সংঘটিত হয় এবং সাত বছর পূর্ণ হওয়ার পর বদর যুদ্ধের সময় রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করে।
(২) অর্থাৎ যেদিন রোমকরা পারসিকদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে, সেদিন আল্লাহর সাহায্যের কারণে মুসলিমরা উৎফুল্ল হবে। বাক্যবিন্যাস পদ্ধতির দিক দিয়ে বাহ্যতঃ এখানে রোমকদের সাহায্য বোঝানো হয়েছে। তারা যদিও কাফের ছিল, কিন্তু অন্য কাফেরদের তুলনায় তাদের কুফর কিছুটা হাল্কা ছিল। কাজেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে সাহায্য করা অবান্তর নয়। বিশেষতঃ যখন তাদেরকে সাহায্য করলে মুসলিমরাও আনন্দিত হয় এবং কাফেরদের মোকাবিলায় তাদের জিত হয়। [সা'দী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) কয়েক বছরের মধ্যেই, আগের ও পরের সকল সিদ্ধান্ত আল্লাহরই। সেদিন বিশ্বাসীরা আনন্দিত হবে;
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫. আল্লাহর সাহায্যে তিনি যাকে ইচ্ছে সাহায্য করেন এবং তিনিই প্রবলপরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৫) আল্লাহর সাহায্যে।[1] তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনিই পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।
[1] নবী (সাঃ)-এর যুগে পারস্য (ইরান) ও রোম দুটি বৃহৎ শক্তি ছিল। পারসীকরা ছিল অগ্নিপূজক মুশরিক এবং রোমানরা ছিল খ্রিষ্টান (আহলে কিতাব)। মক্কার মুশরিকদের সহানুভূতি ছিল পারসীকদের প্রতি; কারণ তারা উভয়েই গায়রুল্লাহর উপাসক ছিল। পক্ষান্তরে মুসলিমদের সহানুভূতি রোমের খ্রিষ্টান রাজ্যের প্রতি ছিল; কারণ খ্রিষ্টানরাও মুসলিমদের মত (আহলে কিতাব) ছিল এবং অহী ও রিসালাতের প্রতি বিশ্বাসী ছিল। তাদের উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ-বিবাদ লেগেই থাকত। নবী (সাঃ)-এর নবুঅত প্রাপ্তির কয়েক বছর পর পারসীকরা খ্রিষ্টানদের উপর বিজয়লাভ করার ফলে মুশরিকদের আনন্দ ও মুসলিমদের দুঃখ হয়। সেই সময় কুরআন কারীমের এই আয়াতগুলি অবতীর্ণ হয়। যাতে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, কয়েক বছরের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী হবে এবং বিজয়ীরা পরাজিত ও পরাজিতরা বিজয়ী হয়ে যাবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী অসম্ভব মনে হলেও আল্লাহর উক্ত বাণীর ফলে মুসলিমদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, তা অবশ্যই সংঘটিত হবে। যার ফলে আবু বাকর সিদ্দীক (রাঃ) আবু জাহলের সাথে বাজি করে ফেলেন যে, পাঁচ বছরের মধ্যে রোমানরা বিজয়ী হবেই। উক্ত বাজির কথা নবী (সাঃ) জানতে পারলে তিনি বললেন, بِضع (কয়েক) শব্দটি তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যা বুঝাতে ব্যবহার হয়। অতএব পাঁচ বছর বাজির সময় কম করে ফেলেছ, এতে আরো সময় বাড়িয়ে নাও। সুতরাং নবী (সাঃ)-এর কথামত আবু বাকর (রাঃ) তাঁর প্রস্তাবিত সময় আরো কিছু বাড়িয়ে দিলেন। ফল এই দাঁড়ালো যে, রোমানরা নয় বছর সময়ের মধ্যেই (সূরা অবতীর্ণ হওয়ার) ঠিক সপ্তম বছরে পুনরায় পারসীকদের উপর জয়যুক্ত হল। যাতে মুসলিমগণ অনেক অনেক আনন্দিত হয়েছিলেন। (তিরমিযী, তাফসীর সূরা রূম) অনেকে বলেন যে, রোমানদের এই বিজয় ঠিক ঐ সময় হয়েছিল, যখন মুসলিমগণ বদরের যুদ্ধে কাফেরদের উপর বিজয় লাভ করেছিলেন। মুসলিমগণ নিজেরা জয়ী হওয়ার ফলে আনন্দিত হন। রোমানদের এই বিজয় কুরআন কারীমের সত্যতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে। فِي أدنَى الأرض এর অর্থ হলঃ আরব ভূমির নিকটবর্তী এলাকা যেমন শাম, ফিলিস্তীন ইত্যাদি যেখানে খ্রিষ্টানদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬. এটা আল্লাহরই প্রতিশ্রুতি; আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যাতিক্রম করেন না, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬) এ আল্লাহরই প্রতিশ্রুতি;[1] আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না।
[1] অর্থাৎ, হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে সংবাদ দিচ্ছি যে, ‘‘অতি সত্বর রোমানরা পারসীকদের উপর পুনরায় বিজয়ী হবে।’’ এটা আল্লাহ তাআলার সত্য ওয়াদা, যা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবশ্যই পূর্ণ হবে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭. তারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্য দিক সম্বন্ধে অবগত, আর তারা আখিরাত সম্বন্ধে গাফিল।(১)
(১) অর্থাৎ পার্থিব জীবনের এক পিঠ তাদের নখদর্পণে। ব্যবসা কিরূপে করবে, কিসের ব্যবসা করবে, কোথা থেকে কিনবে, কোথায় বেচবে, কৃষিকাজ কিভাবে করবে, কবে বীজ বপন করবে, কবে শস্য কাটবে, দালান-কোঠা কিভাবে নির্মাণ করবে, বিলাস-ব্যসনের উপকরণ কিভাবে আহরণ করবে-এসব বিষয় তারা সম্যক অবগত। [কুরতুবী; আরও দেখুন: আত-তাফসীরুস সহীহ]
তাফসীরে জাকারিয়া(৭) ওরা পার্থিব জীবনের বাহ্য দিক সম্বন্ধে অবগত, অথচ পারলৌকিক জীবন সম্বন্ধে ওরা উদাসীন।[1]
[1] অর্থাৎ, অধিকাংশ মানুষেরই পার্থিব বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান আছে। সুতরাং মানুষ পার্থিব বিষয় অর্জনে চাতুর্য ও দক্ষতার প্রদর্শন করে থাকে; যা কিছু দিনের জন্য উপকারী। কিন্তু তারা আখেরাতের বিষয়ে একেবারে উদাসীন। অথচ আখেরাতের উপকারই হচ্ছে চিরস্থায়ী। অর্থাৎ, ইহলৌকিক (সংসার) বিষয়ে তারা সম্যক অবগত, আর পারলৌকিক (দ্বীন) বিষয়ে একেবারে উদাসীন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৮. তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না? আল্লাহ আসমানসমূহ, যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই তো তাদের রবের সাক্ষাতের ব্যাপারে কাফির।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৮) ওরা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না যে, আল্লাহই আকাশমন্ডলী, পৃথিবী ও ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছু যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট কালের জন্য সৃষ্টি করেছেন।[1] আর অবশ্যই বহু মানুষ তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাতে অবিশ্বাসী। [2]
[1] অথবা তা এক উদ্দেশ্য ও হকের সাথে সৃষ্টি করা হয়েছে; বিনা উদ্দেশ্যে বেকার সৃষ্টি করা হয়নি। আর সে উদ্দেশ্য হল এই যে, পুণ্যবানদেরকে তাদের পুণ্যের প্রতিদান এবং পাপীদেরকে তাদের পাপের শাস্তি প্রদান। অর্থাৎ, তারা কি নিজেদের অস্তিত্ব ও দেহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না যে, তাদেরকে কিভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে অথচ তাদের কোন অস্তিত্বই ছিল না এবং ঘৃণ্য এক ফোঁটা পানি দ্বারা তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে? তারপর এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই ঐ লম্বা ও চওড়া বিশাল আকাশ ও পৃথিবী তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া সকল কিছুর জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ‘কিয়ামত দিবস’। যেদিন এ সকল বস্তু ধ্বংস হয়ে যাবে। অর্থাৎ, তারা যদি এই সকল বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করত, তাহলে অবশ্যই আল্লাহর অস্তিত্ব, তিনি যে অদ্বিতীয় প্রতিপালক ও একমাত্র উপাস্য এবং তাঁর যে অশেষ ক্ষমতা তা বুঝতে সক্ষম হত এবং তাঁর উপর ঈমান আনয়ন করত।
[2] সৃষ্টি জগৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করাই হচ্ছে এর আসল কারণ। তাছাড়া কিয়ামতের দিনকে অস্বীকার করার পিছনে যুক্তিসঙ্গত কোন ভিত্তিই নেই।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯. তারা কি যমীনে ভ্ৰমণ করে না? তাহলে তারা দেখত যে, তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল, শক্তিতে তারা ছিল এদের চেয়ে প্রবল, তারা জমি চাষ করত, তারা সেটা আবাদ করত। এদের আবাদ করার চেয়ে বেশী। আর তাদের কাছে এসেছিল তাদের রাসূলগণ স্পষ্ট প্রমাণাদিসহ; বস্তুত আল্লাহ এমন নন যে, তাদের প্রতি যুলুম করেন, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৯) ওরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না এবং দেখে না যে,[1] ওদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে?[2] শক্তিতে তারা ছিল ওদের অপেক্ষা প্রবল।[3] তারা জমি চাষ করত এবং এরা পৃথিবীর যতটা আবাদ করেছে[4] তার চেয়ে তারা বেশি আবাদ করেছিল।[5] তাদের নিকট তাদের রসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলীসহ এসেছিল।[6] বস্তুতঃ ওদের প্রতি যুলুম করা আল্লাহর কাজ ছিল না,[7] বরং ওরা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল।[8]
[1] পূর্ব পুরুষদের পরিণাম, ধ্বংসাবশেষ ঘর-বাড়ি, বসবাস করার প্রকট চিহ্ন ইত্যাদি প্রত্যক্ষ করার পরও তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করার জন্য কঠোরভাবে ধমক দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, তারা বিভিন্ন জায়গায় সফর ও যাতায়াত করে তা প্রত্যক্ষ করে নিয়েছে।
[2] অর্থাৎ, ঐ সকল কাফেরদের (পরিণাম) যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তাদের কুফরী, সত্যকে অস্বীকার ও রসূলগণকে মিথ্যা মনে করার ফলে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
[3] অর্থাৎ, মক্কাবাসী এবং কুরাইশ অপেক্ষা।
[4] অর্থাৎ, মক্কাবাসীরা কৃষিকর্মে অদক্ষ ছিল, কিন্তু পূর্ববর্তী জাতিসমূহ সে কর্মেও তাদের থেকে বেশি অভিজ্ঞ ছিল।
[5] কারণ, তাদের বয়স, শারীরিক শক্তি ও জীবিকার উপায়-উপকরণও ছিল বেশি। সুতরাং তারা বেশি বেশি অট্টালিকা নির্মাণ, কৃষিকার্য এবং জীবিকা নির্বাহের সাজ-সরঞ্জামের ব্যবস্থাপনাও অধিক মাত্রায় করেছিল ।
[6] তারা তাদের নিকট প্রেরিত রসূলগণের প্রতি ঈমান আনেনি। সুতরাং সব রকম শক্তি, উন্নতি, অবকাশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্ত্বেও ধ্বংসই তাদের ভাগ্যে নির্ধারিত হল।
[7] অর্থাৎ, এমন ছিল না যে, তাদের কোন পাপ ছাড়াই তিনি তাদেরকে আযাবে পতিত করবেন।
[8] অর্থাৎ, আল্লাহকে অস্বীকার ও রসূলগণকে অগ্রাহ্য করে (তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল)।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১০. তারপর যারা মন্দ কাজ করেছিল তাদের পরিণাম হয়েছে মন্দ(১); কারণ তারা আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যা আরোপ করত এবং তা নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রুপ করত।
(১) ইবন আব্বাস বলেন, এর অর্থ যারা কুফরী করেছে তাদের প্রতিদান হচ্ছে, শাস্তি। [তাবারী; আত-তাফসীরুস সহীহ]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০) অতঃপর যারা মন্দ কাজ করেছিল তাদের পরিণাম হয়েছে মন্দ;[1] কারণ তারা আল্লাহর বাক্যাবলীকে মিথ্যা মনে করত এবং তা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত।
[1] سُوآى শব্দটির উৎপত্তি سُوء শব্দ থেকে। এটা فُعلَى -এর ওজনে أَسوَأ -এর স্ত্রী লিঙ্গ, যেমন حُسنَى - أَحسَن -এর স্ত্রী লিঙ্গ। অর্থাৎ, তাদের যে পরিণতি ঘটেছিল তা ছিল নেহাতই মন্দ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান