-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১. সকল প্রশংসা আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই(১)—যিনি রাসূল করেন ফিরিশতাদেরকে যারা দুই দুই, তিন তিন অথবা চার চার পক্ষবিশিষ্ট।(২) তিনি সৃষ্টিতে যা ইচ্ছে বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
(১) আল্লাহ্ তা'আলা এখানে তাঁর নিজের প্রশংসা করছেন। কারণ তিনি আসমান, যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। এ সৃষ্টিই প্রমাণ করছে যে, তিনি পূর্ণ ক্ষমতাবান। আর যিনি এত ক্ষমতার অধিকারী তাঁর প্রশংসা করাই যথাযথ। [সা’দী] এ আয়াত ছাড়াও কুরআনের অন্যান্য আয়াতে এ ধরণের প্রশংসা আল্লাহ নিজেই করেছেন। যেমন, সূরা আল-ফাতিহার প্রথমে, সূরা আল-আন’আমের শুরুতে, সূরা আস-সাফফাতের শেষে। [আদওয়াউল বায়ান]
(২) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা ফেরেশতাগণকে পালকবিশিষ্ট ডানা দান করেছেন যদ্বারা তারা উড়তে পারে। এ ফেরেশতাদের হাত ও ডানার অবস্থা ও ধরণ জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে নেই। কিন্তু এ অবস্থা ও ধরন বর্ণনা করার জন্য আল্লাহ যখন এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা মানুষের ভাষায় পাখিদের হাত ও ডানার জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে তখন অবশ্যই আমাদের ভাষায় এ শব্দকেই আসল অবস্থা ও ধরণ বর্ণনার নিকটতর বলে ধারণা করা যেতে পারে। এর কারণ সুস্পষ্ট যে, তারা আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত দুরত্ব বার বার অতিক্রম করে। এটা দ্রুতগতি সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমেই সম্ভবপর।
উড়ার মাধ্যমে দ্রুতগতি হয়ে থাকে। ফেরেশতাগণের পাখার সংখ্যা বিভিন্ন। কারও দুই দুই, কারও তিন তিন এবং কারও চার চার খানা পাখা রয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, বিভিন্ন ফেরেশতাকে আল্লাহ বিভিন্ন পর্যায়ের শক্তি দান করেছেন এবং যাকে দিয়ে যেমন কাজ করতে চান তাকে ঠিক তেমনিই দ্রুতগতি ও কর্মশক্তি ও দান করেছেন। এখানেই শেষ নয়, এক হাদীসে এসেছে, জিবরীল আলাইহিস সালামের ছয়শ' পাখা রয়েছে [বুখারী: ৩২৩২, মুসলিম: ১৭৪]। দৃষ্টান্তস্বরূপ চার পর্যন্ত উল্লেখিত হয়েছে।
তাফসীরে জাকারিয়া(১) সমস্ত প্রশংসা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা[1] আল্লাহরই -- যিনি ফিরিশতাদেরকে বাণীবাহক (দূত) করেন;[2] যারা দুই-দুই, তিন-তিন অথবা চার-চার ডানাবিশিষ্ট। তিনি তাঁর সৃষ্টিতে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করে থাকেন। [3] নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।
[1] فاطر এর অর্থঃ সর্বপ্রথম স্রষ্টা; উদ্ভাবনকর্তা, এ কথা আল্লাহর অসীম ক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে যে, তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে সর্বপ্রথম কোন নমুনা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন, সুতরাং তাঁর জন্য মানুষকে পুনরায় সৃষ্টি করা এমন কি কঠিন কাজ?
(বলা বাহুল্য এই শব্দ থেকেই সূরাটির নামকরণ হয়েছে।)
[2] উদ্দেশ্য জিবরীল, মিকাঈল, ইস্রাফীল এবং আযরাঈল (মালাকুল মাওত) ফিরিশতা, যাঁদেরকে আল্লাহ তাআলা পয়গম্বরগণের নিকট বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের উপর দূত স্বরূপ প্রেরণ করেন। তাঁদের মধ্যে কারো দুটি, কারো তিনটি, আবার কারো চারটি পাখা বা ডানা আছে, যার মাধ্যমে তাঁরা আকাশ থেকে পৃথিবীতে আসা-যাওয়া করেন।
[3] অর্থাৎ, কিছু ফিরিশতার তার থেকেও বেশি পাখা আছে, যেমন হাদীসে এসেছে; নবী (সাঃ) বলেছেন ‘‘মি’রাজের রাত্রে আমি জিবরীল (আঃ)-কে তাঁর আসল রূপে দেখেছি, তখন তাঁর ছয়শ’ পাখা ছিল। (বুখারীঃ সূরা নাজমের তফসীর) অনেকে ‘বৃদ্ধি’ করা কথাটিকে সাধারণ অর্থে রেখেছেন, যাতে চোখ চেহারা, নাক, মুখ ইত্যাদি সকল বস্তুর সৌন্দর্য শামিল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২. আল্লাহ মানুষের প্ৰতি কোন অনুগ্রহ অবারিত করলে কেউ তা নিবারণকারী নেই এবং তিনি কিছু নিরুদ্ধ করতে চাইলে পরে কেউ তার উন্মুক্তকারী নেই।(১) আর তিনি পরাক্রমশালী, হিকমতওয়ালা।(২)
(১) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “এমন কে আছে, যে তোমাদেরকে রিযিক দান করবে, যদি তিনি তাঁর রিযিক বন্ধ করে দেন? বরং তারা অবাধ্যতা ও সত্য বিমুখতায় অবিচল রয়েছে।” [সূরা আল-মুলকঃ ২১]
(২) এক হাদীসে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে বলেন, হে বৎস! জেনে রাখ, যদি দুনিয়ার সমস্ত জাতি তোমার কোন উপকার করতে চায়। তবে সে আল্লাহ যা নির্ধারিত করে রেখেছেন এর বাইরে তোমার কোন উপকার করতে পারবে না, পক্ষান্তরে যদি দুনিয়ার সমস্ত জাতি তোমার ক্ষতি করতে চায় তবে ততটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার উপর লিখে রেখেছেন। [তিরমিযী: ২৫১৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(২) আল্লাহ মানুষের প্রতি কোন করুণা করলে কেউ তার নিবারণকারী নেই এবং তিনি যা নিবারণ করেন তারপর কেউ তার প্রেরণকারী নেই। [1] তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
[1] রসূলগণের প্রেরণ ও কিতাবসমূহের অবতারণও সেই সকল করুণার মধ্যে গণ্য। অর্থাৎ সকল বস্তুর দাতাও তিনি এবং ফিরিয়ে নেওয়া বা নিবারণ করার মালিকও তিনি। তিনি ছাড়া না কেউ দাতা ও অনুগ্রহকারী আছে, আর না কেউ রোধকারী ও নিবারণকারী আছে। যেমন নবী (সাঃ) বলতেন, (اَللَّهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ) অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তুমি যা দান কর, তা রোধ করার এবং যা রোধ কর, তা দান করার সাধ্য কারো নেই। (বুখারী, মুসলিম)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩. হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। আল্লাহ ছাড়া কি কোন স্রষ্টা আছে, যে তোমাদেরকে আসমানসমূহ ও যমীন থেকে রিযিক দান করে? আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। কাজেই তোমাদেরকে কোথায় ফিরানো হচ্ছে?(১)
(১) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “বলুন, কে আসমানসমূহ ও যমীনের রব? বলুন, আল্লাহ। বলুন, তবে কি তোমরা অভিভাবকরূপে গ্ৰহণ করেছ আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে যারা নিজেদের লাভ বা ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়? বলুন, ‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হতে পারে? নাকি অন্ধকার ও আলো সমান হতে পারে?” তবে কি তারা আল্লাহর এমন শরীক করেছে, যারা আল্লাহর সৃষ্টির মত সৃষ্টি করেছে, যে কারণে সৃষ্টি তাদের কাছে সদৃশ মনে হয়েছে? বলুন, আল্লাহ সকল বস্তুর স্রষ্টা; আর তিনি এক, মহা প্রতাপশালী।” [সূরা আর-রা'দ: ১৬] [আদওয়াউল বায়ান]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩) হে মানুষ! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর। আল্লাহ ব্যতীত কি কোন স্রষ্টা আছে যে তোমাদেরকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী হতে রুযী দান করে? তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। সুতরাং কিরূপে তোমরা সত্যবিমুখ হচ্ছ? [1]
[1] অর্থাৎ, এই স্পষ্ট ও পরিষ্কার বর্ণনার পরেও তোমরা গায়রুল্লাহর ইবাদত করছ? تُؤْفَكُوْنَ এর উৎপত্তি যদি أَفَكَ থেকে হয়, তবে অর্থ হবে ফিরে যাওয়া; অর্থাৎ ‘‘তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছ? আর যদি إِفْكٌ থেকে হয়, তবে অর্থ হবে মিথ্যা, যা সত্যবিমুখ হওয়ার নাম। উদ্দেশ্য এই যে, তোমারা তাওহীদ ও আখেরাতকে অস্বীকার করার সুযোগ কোথা থেকে পেলে? অথচ তোমরা এটা স্বীকার কর যে, তোমাদের স্রষ্টা এবং আহারদাতা একমাত্র আল্লাহ। (ফাতহুল ক্বাদীর)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৪. আর যদি এরা আপনার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে আপনার আগেও রাসূলগণের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হয়েছিল।(১) আর আল্লাহর দিকেই সকল বিষয় প্রত্যাবর্তিত হবে।
(১) কাতাদাহ বলেন, এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনা প্ৰদান করা হচ্ছে, যেমনটি তোমরা শুনতে পাচ্ছ। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) এরা যদি তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে তোমার পূর্ববর্তী রসূলগণকেও তো মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল। আর আল্লাহর দিকেই সকল বিষয় প্রত্যাবর্তিত হয়ে থাকে। [1]
[1] এই আয়াতে নবী (সাঃ)-কে এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে, তোমাকে মিথ্যাজ্ঞান করে তারা কোথায় যাবে? শেষ পর্যন্ত সকল বস্তুর ফায়সালা তো আমারই হাতে। যেমন পূর্ব উম্মতরা তাদের পয়গম্বরদেরকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল, ফলে তারা ধ্বংস ছাড়া আর কি পেয়েছে? অতএব এরাও যদি সেরূপ কর্ম হতে বিরত না হয়, তাহলে এদেরকেও ধ্বংস করা আমার জন্য কোন কঠিন কাজ নয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫. হে মানুষ! নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; কাজেই দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং সে প্রবঞ্চক (শয়তান) যেন কিছুতেই তোমাদেরকে আল্লাহ্র ব্যাপারে প্রবঞ্চিত না করে।(১)
(১) الغرور শব্দটি আধিক্যবোধক। অৰ্থাৎ, “অতি প্ৰবঞ্চক” বা “বড় প্রতারক” এখানে হচ্ছে শয়তান যেমন সামনের বাক্য বলছে। তার কাজই মানুষকে প্রতারিত করে কুফর ও গোনাহে লিপ্ত করা। বলা হয়েছে, “শয়তান যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে ধোঁকা না দেয়। মূলত: শয়তানের ধোঁকা বিভিন্ন ধরনের। কখনো কখনো সে মন্দ কর্মকে শোভনীয় করে মানুষদেরকে তাতে লিপ্ত করে দেয়। তখন মানুষের অবস্থা হয় যে, তারা গোনাহ করার সাথে সাথে মনে করতে থাকে যে, তারা আল্লাহর প্রিয় এবং তাদের শাস্তি হবে না। আবার কখনো কখনো সন্দেহ সৃষ্টি করে তাদেরকে পথভ্ৰষ্ট করে দেয়। শয়তান লোকদেরকে একথা বুঝায় যে, আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই এবং কিছু লোককে এ বিভ্রান্তির শিকার করে যে, আল্লাহ একবার দুনিয়াটা চালিয়ে দিয়ে তারপর বসে আরাম করছেন, এখন তাঁর সৃষ্ট এ বিশ্ব-জাহানের সাথে কার্যত তাঁর কোন সম্পর্ক নেই।
আবার কিছু লোককে সে এভাবে ধোঁকা দেয় যে, আল্লাহ অবশ্যই এ বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা করে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি মানুষকে পথ দেখাবার কোন দায়িত্ব নেননি। কাজেই এ অহী ও রিসালাত নিছক একটি ধোঁকাবাজী ছাড়া আর কিছুই নয়। সে কিছু লোককে এ মিথ্যা আশ্বাসও দিয়ে চলছে যে, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও মেহেরবান, তোমরা যতই গোনাহ কর না কেন তিনি সব মাফ করে দেবেন এবং তাঁর এমন কিছু প্রিয় বান্দা আছে যাদেরকে আঁকড়ে ধরলেই তোমরা কামিয়াব হয়ে যাবে। [এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেখুন: ইবনুল কাইয়্যেম, ইগাসাতুল লাহফান ফী মাসায়িদিস শায়তান]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫) হে মানুষ! নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য;[1] সুতরাং পার্থিব জীবন যেন কিছুতেই তোমাদেরকে প্রতারিত না করে[2] এবং কোন প্রবঞ্চক যেন কিছুতেই আল্লাহ সস্পর্কে তোমাদেরকে প্রবঞ্চিত না করে। [3]
[1] আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য যে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে এবং সৎ ও অসৎ লোকদেরকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান ও প্রতিফল দেওয়া হবে।
[2] অর্থাৎ, আখেরাতের সেই সকল নিয়ামত থেকে যেন উদাস না করে দেয়, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক বান্দা ও রসূলগণের অনুসারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন। অতএব এই পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মোহে পড়ে আখেরাতের চিরস্থায়ী শান্তিকে দৃষ্টিচ্যুত করে ফেলো না।
[3] অর্থাৎ, শয়তানের প্রবঞ্চনা ও ধোঁকা থেকে বেঁচে থাক। কারণ শয়তান বড় ধোঁকাবাজ এবং তার উদ্দেশ্যই হল তোমাদেরকে ধোঁকায় ফেলে জান্নাত থেকে বঞ্চিত করা। এইরূপ একই শ্রেণীর শব্দ সূরা লুকমানের ৩৩নং আয়াতে বিবৃত হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬. নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু; কাজেই তাকে শত্রু হিসেবেই গ্ৰহণ কর। সে তো তার দলবলকে ডাকে শুধু এজন্যে যে, তারা যেন প্রজ্জলিত আগুনের অধিবাসী হয়।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৬) শয়তান তোমাদের শত্রু; সুতরাং তাকে শত্রু হিসাবেই গ্রহণ কর। [1] সে তো তার দলবলকে এ জন্য আহবান করে যে, ওরা যেন জাহান্নামী হয়।
[1] অর্থাৎ, তাকে কঠিন শত্রুই মনে কর, তার মিথ্যা প্রবঞ্চনা ও ধোঁকাবাজি থেকে ঐরূপ বাঁচার চেষ্টা কর, যেমন শত্রুর কবল থেকে বাঁচার জন্য মানুষ চেষ্টা করে থাকে। অন্য স্থানে উক্ত বিষয়কে এইভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। (أَفَتَتَّخِذُونَهُ وَذُرِّيَّتَهُ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِي وَهُمْ لَكُمْ عَدُوٌّ بِئْسَ لِلظَّالِمِينَ بَدَلا) অর্থাৎ, তবে কি তোমরা আমার পরিবর্তে তাকে ও তার বংশধরকে অভিভাবক বা বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে; অথচ তারা তোমাদের শত্রু? সীমালংঘনকারীদের পরিবর্তন কত নিকৃষ্ট! (সূরা কাহ্ফ ৫০ আয়াত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭. যারা কুফরী করে তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৭) যারা অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি এবং যারা বিশ্বাস করে ও সৎকাজ করে, তাদের জন্য আছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। [1]
[1] এখানেও আল্লাহ তাআলা অন্য স্থানের মত ঈমানের সাথে নেক আমলের কথা উল্লেখ করে তার গুরুত্বকে পরিষ্ফুটিত করে দিয়েছেন; যাতে মু’মিনগণ নেক আমল থেকে কোন সময় অমনোযোগী না হয়, যেহেতু ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের প্রতিশ্রুতি সেই ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত, যার সাথে নেক আমল থাকবে ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৮. কাউকে যদি তার মন্দকাজ শোভন করে দেখানো হয়। ফলে সে এটাকে উত্তম মনে করে, (সে ব্যক্তি কি তার সমান যে সৎকাজ করে?)। তবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে বিভ্ৰান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছে হিদায়াত করেন।(১) অতএব তাদের জন্য আক্ষেপ করে আপনার প্ৰাণ যেন ধ্বংস না হয়। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত।
(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর সৃষ্টিকে অন্ধকারে সৃষ্টি করেছেন। তারপর সেগুলোতে তার নূরের আলো ফেললেন। সুতরাং যার কাছে এ নূরের কিছু পৌঁছেছে সেই হেদায়েত প্রাপ্ত হবে। আর যার কাছে সে নূরের আলো পৌঁছেনি সে ভ্ৰষ্ট হবে। আর এজন্যই বলি, আল্লাহর জ্ঞান অনুসারে কলম শুকিয়ে গেছে। [তিরমিযী: ২৬৪২; মুসনাদে আহমাদ: ২/১৭৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(৮) কাকেও যদি তার মন্দ কাজ শোভন করে দেখানো হয় এবং সে একে উত্তম মনে করে,[1] সে ব্যক্তি কি তার সমান (যে সৎকাজ করে)? আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন।[2] অতএব তুমি ওদের জন্য আক্ষেপ করে নিজেকে ধ্বংস করো না।[3] নিশ্চয় ওরা যা করে, আল্লাহ তা খুব জানেন। [4]
[1] যেমন কাফের ও পাপাচারীরা, কুফর ও শিরক এবং ফিসক ও পাপাচরণ করে, অথচ মনে মনে ভাবে যে, তারাই উত্তম কর্ম করছে। অতএব ঐ ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তাআলা পথভ্রষ্ট করে দিয়েছেন, তাকে বাঁচানোর জন্য তোমার নিকট কোন সুব্যবস্থা আছে কি? অথবা সে কি ঐ ব্যক্তির মত যাকে আল্লাহ তাআলা সৎপথ প্রদর্শন করেছেন? উত্তর নাবাচক, না -- অবশ্যই না।
[2] আল্লাহ তাআলা নিজ ইনসাফ, ন্যায়পরায়ণতা ও নিয়ম-নীতি অনুযায়ী ঐ ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট করেন, যে নিরন্তরভাবে আপন কর্ম দ্বারা নিজেকে তার উপযুক্ত বানিয়ে নেয়। পক্ষান্তরে নিজ দয়া ও অনুগ্রহে ঐ ব্যক্তিকে সৎপথ প্রদর্শন করেন, যে সৎপথ অন্বেষণকারী হয়।
[3] কারণ, আল্লাহ তাআলার সকল কর্ম হিকমত ও পূর্ণ ইলমের সাথে সম্পাদিত হয়। অতএব কারোর পথভ্রষ্টতার জন্য তুমি এমন অনুতপ্ত হবে না যে, নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে।
[4] অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে তাদের কোন কথা বা কর্ম গুপ্ত নয়। উদ্দেশ্য হল, তাদের সাথে আল্লাহ তাআলার ব্যাপারটা একজন সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত এবং একজন বিজ্ঞের মত। সাধারণ এমন বাদশাদের মত নয়, যারা নিজের স্বাধীনতাকে ইচ্ছামত ব্যবহার করে, কখনো সালাম পাওয়ার পরেও অসন্তুষ্ট হয়, আবার কখনো কটুবাক্যের বদলে উপঢৌকন দিয়ে থাকে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯. আর আল্লাহ, যিনি বায়ু পাঠিয়ে তা দ্বারা মেঘমালা সঞ্চারিত করেন। তারপর আমরা সেটাকে নির্জীব ভূখণ্ডের দিকে পরিচালিত করি, এরপর আমরা তা দ্বারা যমীনকে তার মৃত্যুর পর আবার জীবিত করি। এভাবেই হবে মৃত্যুর পর আবার জীবিত হয়ে উঠা।(১)
(১) মৃত্যুর পর জীবিত হয়ে উঠার জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে উদ্ভিদ উৎপন্ন করার উদাহরণ আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনের অন্যত্রও পেশ করেছেন। [আদওয়াউল বায়ান]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯) আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করে তার দ্বারা মেঘমালা সঞ্চালিত করেন। অতঃপর তিনি তা নির্জীব ভূখন্ডের দিকে পরিচালিত করেন, অতঃপর তিনি তা দিয়ে পৃথিবীকে ওর মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করেন। পুনরুত্থান এরূপেই হবে। [1]
[1] অর্থাৎ, যেমন আমি মেঘ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে মৃত পৃথিবীকে জীবিত করে থাকি অনুরূপ কিয়ামতের দিবস সকল মৃত মানুষকেও জীবিত করব। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘মানুষের সর্বাঙ্গ শরীর পচে-গলে নষ্ট হয়ে যায়, শুধু মেরুদন্ডের নিম্নাংশের অস্থির ছোট্ট একটি অংশ অবশিষ্ট থাকে। সেই অস্থি থেকে পুনরায় সৃষ্টি ও দেহ গঠিত হবে।’’ (বুখারী, মুসলিম)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
* ভাল কথা বলতে বুঝানো হয়েছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। কারো মতে তা হল ‘সুবহানাল্লাহ ওয়াল হামদুলিল্লাহ ওয়ালা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার’। কেউ বলেন, তা হল আল্লাহর যিকির ও স্মরণ। ইমাম শাওকানী বলেন, যে কোন উত্তম ও ভাল কথা এখানে বুঝানো হয়েছে।
১০. যে কেউ সম্মান-প্রতিপত্তি চায়, তবে সকল সম্মান-প্রতিপত্তির মালিক তো আল্লাহই।(১) তাঁরই দিকে পবিত্র বাণীসমূহ হয় সমুত্থিত এবং সৎকাজ, তিনি তা করেন উন্নীত।(২) আর যারা মন্দ কাজের ফন্দি আঁটে তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। আর তাদের ষড়যন্ত্র, তা ব্যর্থ হবেই।
(১) অর্থাৎ সম্মান চাইলে কেবলমাত্র তাঁর কাছেই চাওয়া উচিত। আর তা চাইতে হবে তাঁর আনুগত্য করেই। কারণ, তিনি সম্মান প্রতিপত্তির মালিক। [বাগভী, মুয়াসসার] আসল ও চিরস্থায়ী মর্যাদা, দুনিয়া থেকে নিয়ে আখেরাত পর্যন্ত যা কখনো হীনতা ও লাঞ্ছনার শিকার হতে পারে না, তা কেবলমাত্র আল্লাহর বন্দেগীর মধ্যে পাওয়া যেতে পারে। তুমি যদি তাঁর হয়ে যাও, তাহলে তাঁকে পেয়ে যাবে এবং যদি তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে। [দেখুন: কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]
(২) ইবন আব্বাস বলেন, ভাল কথা হচ্ছে, আল্লাহর যিকির। আর সৎকাজ হচ্ছে, আল্লাহর ফরয আদায় করা, সুতরাং যে কেউ আল্লাহর ফরয আদায়ে আল্লাহর যিকির করবে তারই সে আমল উপরের দিকে উঠবে। আর যে কেউ যিকির করবে, কিন্তু আল্লাহর ফরয আদায় করবে না তার কথা তার আমলের দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে, তখন সেটা তার ধ্বংসের কারণ হবে। [তাবারী] কাতাদাহ বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা আমল ব্যতীত কোন কথা কবুল করেন না। যে ভাল বলল এবং ভাল আমল করল সেটাই শুধু আল্লাহ কবুল করেন। [তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০) কেউ ক্ষমতা (ইজ্জত-সম্মান) চাইলে (সে জেনে রাখুক) সকল ক্ষমতা (ইজ্জত-সম্মান) তো আল্লাহরই।[1] সৎবাক্য তাঁর দিকে আরোহণ করে[2] এবং সৎকর্ম তিনি তুলে (গ্রহণ করে) নেন।[3] আর যারা মন্দ কাজের ফন্দি আঁটে[4] তাদের জন্য আছে কঠিন শাস্তি। তাদের ফন্দি ব্যর্থ হবেই। [5]
[1] অর্থাৎ, যে ব্যক্তি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত হতে চায়, সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করে; আল্লাহর আনুগত্যেই তার এই উদ্দেশ্য পূরণ হবে। কারণ দুনিয়া ও আখেরাতের একমাত্র মালিক হচ্ছেন আল্লাহ, সকল সম্মান তাঁরই নিকটে, তিনি যাকে সম্মান দেবেন সেই সম্মানিত হবে, তিনি যাকে অপদস্থ করবেন তাকে পৃথিবীর কোন শক্তি সম্মান দিতে পারবে না। তিনি অন্য স্থানে বলেছেন, (الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا) অর্থাৎ, যারা বিশ্বাসীদের পরিবর্তে অবিশ্বাসীদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। তারা কি তাদের নিকট সম্মান অনুসন্ধান করে? অথচ সমস্ত সম্মান তো আল্লাহরই। (সূরা নিসা ১৩৯ আয়াত)
[2] اَلْكَلِمُ - كَلِمَةٌ এর বহুবচন। পবিত্র কালেমাসমূহের অর্থ হলঃ আল্লাহর তাসবীহ ও তাহমীদ (পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা), কুরআন তেলাঅত, ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ। ‘আরোহণ করে’ (উপরে চড়ে বা উঠে) এর অর্থ হলঃ কবুল বা গ্রহণ করা। অথবা তা নিয়ে ফিরিশতাদের আকাশে উঠে যাওয়া যাতে আল্লাহ তাআলা তার সওয়াব প্রদান করেন।
[3] يَرْفَعُهُ ক্রিয়ার কর্তা কে? অনেকে বলেন, الكلم الطيب অর্থাৎ, সৎকর্ম সৎবাক্যকে (আল্লাহর দিকে) উঠিয়ে থাকে। আর তার মানে, শুধু মুখে আল্লাহর যিকর (তাসবীহ ও তাহমীদে) কোন কাজ হবে না; যতক্ষণ না তার সাথে সৎকর্ম অর্থাৎ আহ্কাম ও ফরয আমল আদায় করা হবে। অনেকে বলেন, يرفعه ক্রিয়ার কর্তা মহান আল্লাহ। উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তাআলা সৎকর্মকে সৎবাক্যের উপর প্রধান্য দেন। কারণ সৎকর্ম দ্বারাই এই কথা প্রমাণ হয় যে, সৎবাক্য (তাসবীহ, তাহমীদ ইত্যাদি) আবৃত্তিকারী প্রকৃতপক্ষে তাতে আন্তরিক ও একনিষ্ঠ। (ফাতহুল ক্বাদীর) ঠিক যেন আল্লাহর নিকট আমল ছাড়া কেবল মুখের কথার কোন মূল্য নেই।
[4] গোপনভাবে কারোর ক্ষতি সাধন করার চেষ্টাকে مكر (চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র বা ফন্দি আঁটা) বলে। কুফর ও শিরকের কাজ করাও এক প্রকার চক্রান্তের কাজ। যেহেতু তাতে আল্লাহর পথের ক্ষতি সাধন করা হয়। মক্কার কাফেররা নবী (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে হত্যা ইত্যাদির যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাকেও চক্রান্ত বলা হয়েছে। লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে কোন কাজ করাকেও চক্রান্ত বলা যায়। এখানে উক্ত শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহার হয়েছে; অর্থাৎ এখানে সকল প্রকার চক্রান্ত ও ফন্দির নিন্দা করা হয়েছে।
[5] অর্থাৎ, তাদের চক্রান্তও ব্যর্থ হবে এবং তার শাস্তিও তাদেরকেই ভোগ করতে হবে যে চক্রান্ত করবে। যেমন বলেছেন, (وَلا يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلا بِأَهْلِه) অর্থাৎ, কূট ষড়যন্ত্র ষড়যন্ত্রকারীদেরই পরিবেষ্টন করে। (সূরা ফাত্বির ৪৩ আয়াত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান