-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১. হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শক্ৰকে বন্ধুরূপে গ্ৰহণ করো না, তোমরা কি তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা প্রেরণ করছ, অথচ তারা, তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে(১), রাসূলকে এবং তোমাদেরকে বহিস্কার করেছে এ কারণে যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর উপর ঈমান এনেছ। যদি তোমরা আমার পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে এবং আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য বের হয়ে থাক, তবে কেন তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করছ? আর তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্ৰকাশ কর তা আমি সম্যক অবগত। তোমাদের মধ্যে যে কেউ এরূপ করে সে তো বিচ্যুত হয় সরল পথ থেকে।
(১) এখানে حق বলে কুরআন বোঝানো হয়েছে। [বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১) হে বিশ্বাসীগণ! আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না।[1] তোমরা তাদের কাছে বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও,[2] অথচ তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে, রসূলকে এবং তোমাদেরকে বহিষ্কৃত করেছে এই কারণে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে বিশ্বাস কর।[3] যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টিলাভের জন্য আমার পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে বহির্গত হয়ে থাক (তাহলে তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না)।[4] তোমরা গোপনে তাদের প্রতি বন্ধুত্বের বার্তা পাঠাও, অথচ তোমরা যা গোপন কর এবং তোমরা যা প্রকাশ কর, তা আমি সম্যক অবগত। তোমাদের যে কেউ এটা করে, সে তো সরল পথ হতে বিচ্যুত হয়। [5]
[1] মক্কার কাফেরগণ এবং নবী (সাঃ)-এর মাঝে হুদাইবিয়াতে যে সন্ধিচুক্তি হয়েছিল, মক্কার কাফেররা তা ভঙ্গ করল। এই জন্য নবী (সাঃ)ও গোপনে মুসলিমদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। হাত্বেব ইবনে আবী বালতাআ’ (রাঃ) বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী একজন মুহাজির সাহাবী ছিলেন। কুরাইশদের সাথে তাঁর কোন আত্মীয়তা ছিল না। কিন্তু তাঁর স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি মক্কাতেই ছিল। তিনি ভাবলেন যে, মক্কার কুরাইশদেরকে যদি নবী (সাঃ)-এর প্রস্তুতি সম্পর্কে জানিয়ে দিই, তাহলে এই অনুগ্রহের বদলায় তারা আমার সন্তান-সন্ততি ও মাল-ধনের হিফাযত করবে। তাই তিনি এই সংবাদটা লিখিত আকারে এক মহিলার মাধ্যমে মক্কার কাফেরদের নিকট প্রেরণ করলেন। এদিকে অহীর মাধ্যমে নবী করীম (সাঃ)-কে ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়া হয়। তাই তিনি আলী, মিকদাদ এবং যুবায়ের (রাঃ)-দেরকে বললেন, ‘‘যাও, ‘রওয্বাতু খাখ’ নামক স্থানে মক্কাগামিনী একজন মহিলাকে পাবে; তার কাছে আছে একটি পত্র, সেটি উদ্ধার করে নিয়ে আসবে।’’ তাঁরা গিয়ে তাঁর কাছ থেকে পত্র উদ্ধার করে নিয়ে এলেন, যা সে তার মাথার চুলের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। তিনি হাত্বেব (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, ‘‘তুমি এ কাজ কেন করেছ?’’ তিনি বললেন, ‘আমি এ কাজ কুফরী এবং দ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়ার কারণে করিনি, বরং অন্যান্য মুহাজির সাহাবীদের আত্মীয়-স্বজন মক্কাতে বিদ্যমান থাকায় তারা এঁদের (মুহাজির সাহাবীদের) সন্তান-সন্ততির হিফাযত করে। আমার সেখানে কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। তাই আমি চিন্তা করলাম যে, আমি যদি তাদের কিছু জানিয়ে দিই, তবে তারা আমার অনুগ্রহের মূল্য দিয়ে আমার সন্তানদের হিফাযত করবে।’ রসূল (সাঃ) এ কথা সত্য জেনে তাঁকে কিছুই বললেন না। তবুও আল্লাহ সতর্কতা স্বরূপ এই আয়াত অবতীর্ণ করলেন। যাতে আগামীতে কোন মু’মিন কোন কাফেরের সাথে যেন এই ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক না রাখে। (বুখারী সূরা মুমতাহিনার তাফসীর, মুসলিম ফাযায়েলে সাহাবা অধ্যায়)
[2] অর্থাৎ, নবী (সাঃ)-এর এই প্রস্তুতির খবর তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন করতে চাও?
[3] যখন তাদের তোমাদের সাথে এবং সত্যের সাথে এই ধরনের আচরণ, তখন তোমাদের জন্য কি এটা উচিত যে, তোমরা তাদের সাথে ভালবাসা রাখবে ও সহানুভূতি দেখাবে?
[4] বন্ধনীর মাঝে এটা শর্তের জওয়াব; যা আয়াতে ঊহ্য আছে।
[5] অর্থাৎ, আমার এবং তোমাদের শত্রুদের সাথে ভালবাসার সম্পর্ক জুড়া এবং তাদের কাছে গোপনে পত্র ও বার্তা প্রেরণ করা হল ভ্রষ্টতার পথ, যা অবলম্বন করা কোন মুসলিমের উচিত নয়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২. তোমাদেরকে কাবু করতে পারলে তারা হবে তোমাদের শত্রু এবং হাত ও জিহ্বা দ্বারা তোমাদের অনিষ্ট সাধন করবে, আর তারা কামনা করে যদি তোমরা কুফরী করতে।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(২) তোমাদেরকে কাবু করতে পারলে, তারা তোমাদের শত্রু হবে এবং হস্ত ও রসনা দ্বারা তোমাদের অনিষ্ট সাধন করবে এবং চাইবে যে, তোমরা অবিশ্বাসী হয়ে যাও। [1]
[1] অর্থাৎ, তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের অন্তরে বিরাজ করছে এই ধরনের হিংসা ও বিদ্বেষ, আর তোমরা তাদের উপর ভালবাসার ফুল বর্ষণ করতে চাও?
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩. তোমাদের আত্মীয়-স্বজন ও সন্তান-সন্ততি কিয়ামতের দিন কোন উপকার করতে পারবে না। আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন; আর তোমরা যা কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৩) তোমাদের আত্মীয়-স্বজন ও সন্তান-সন্ততি কিয়ামতের দিন কোনই কাজে আসবে না।[1] আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দেবেন। [2] আর তোমরা যা কর, তিনি তা দেখেন।
[1] অর্থাৎ, যে সন্তান-সন্ততিদের জন্য তোমরা কাফেরদের প্রতি ভালবাসা দেখাচ্ছ তারা তো তোমাদের কোন উপকারে আসবে না। তাহলে তাদের জন্য কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে আল্লাহকে অসন্তুষ্ট কেন করছ? কিয়ামতের দিন যে জিনিস উপকারে আসবে, তা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য। অতএব এর প্রতি যত্নবান হও।
[2] এর দ্বিতীয় অর্থ হল, আল্লাহ তোমাদেরকে পৃথক পৃথক করে দেবেন। অর্থাৎ, আনুগত্যকারীদেরকে জান্নাতে এবং অবাধ্যজনদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। কেউ কেউ বলেন, পৃথক হওয়ার অর্থ হল, এক অপরের কাছ থেকে পালাবে। যেমন, আল্লাহ বলেন, يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ যেদিন (কঠিন ভয়াবহতার কারণে) ভাই ভাই থেকে পালাবে। (আবাসাঃ ৩৪)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৪. অবশ্যই তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথে যারা ছিল তাদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, “তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর তা হতে আমরা সম্পৰ্কমুক্ত। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হল শক্ৰতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য; যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান আন।(১) তবে ব্যতিক্রম তাঁর পিতার প্রতি ইবরাহীমের উক্তিঃ আমি অবশ্যই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব; আর তোমার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আমি কোন অধিকার রাখি না।(২) ইবরাহীম ও তার অনুসারীগণ বলেছিল, হে আমাদের রব! আমরা আপনারই উপর নির্ভর করেছি, আপনারই অভিমুখী হয়েছি এবং ফিরে যাওয়া তো আপনারই কাছে।
(১) হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমাকে মানুষের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে। যতক্ষণ তারা এ সাক্ষ্য দিবে না যে, “আল্লাহ ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই, আর মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল। আর সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে। তারা এটা করলে আমার হাত থেকে তাদের জান ও মাল নিরাপদ করতে পারবে। তবে ইসলামের কোন হকের কারণে যদি পাকড়াও করা হয় সেটা ভিন্ন কথা। আর তাদের হিসাবের দায়িত্বভার আল্লাহর উপরই রইল।” [বুখারী: ২৫, মুসলিম: ২২]
(২) মুসলিমদেরকে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর উত্তম আদর্শ ও সুন্নাত অনুসরণ করার জোর আদেশ দেয়ার পর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে তার মুশরিক পিতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন ইবরাহিমী আদর্শের অনুসরণ থেকে একে ব্যতিক্রম প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে, অন্যসব বিষয়ে ইবরাহিমী আদর্শের অনুসরণ জরুরী, কিন্তু তার এই কাজটির অনুসরণ মুসলিমদের জন্যে জায়েয নয়। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ওযর সূরা আত-তাওবায় বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি পিতার জন্যে মাগফিরাতের দো'আ নিষেধাজ্ঞার পূর্বে করেছিলেন, অথবা এই ধারণার বশবর্তী হয়ে করেছিলেন যে, তার অন্তরে ঈমান বিদ্যমান আছে, কিন্তু পরে যখন জানলেন যে, সে আল্লাহর দুশমন। তখন এ বিষয় থেকেও নিজের বিমুখতা ঘোষণা করলেন। [দেখুন: বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৪) অবশ্যই তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তার অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ;[1] তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার উপাসনা কর, তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।[2] আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরকালের জন্য সৃষ্টি হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছ।’[3] তবে ব্যতিক্রম তার পিতার প্রতি ইব্রাহীমের উক্তি,[4] ‘আমি নিশ্চয়ই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব এবং তোমার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট কোন অধিকার রাখি না।’ (ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারিগণ বলেছিল,) ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তো তোমারই উপর নির্ভর করেছি,[5] তোমারই অভিমুখী হয়েছি এবং প্রত্যাবর্তন তো তোমারই নিকট।
[1] কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন না করার বিষয়কে আরো স্পষ্ট করার জন্য ইবরাহীম (আঃ)-এর উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে। أُسْوَةٌ এর অর্থ হল, এমন উত্তম নমুনা ও আদর্শ যার অনুসরণ করা যায়।
[2] অর্থাৎ, শিরকের কারণে আমাদের ও তোমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া আল্লাহর উপাসকদের সাথে গায়রুল্লাহর পূজারীদের কি সম্পর্ক থাকতে পারে?
[3] অর্থাৎ, এই বিচ্ছেদ ও বিদ্বেষ ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না তোমরা কুফরী ও শিরক ত্যাগ করে তাওহীদকে অবলম্বন করেছ। যখন তোমরা এক আল্লাহর অনুসারী হয়ে যাবে, তখন এ শত্রুতা বন্ধুত্বে এবং বিদ্বেষ সম্প্রীতিতে পরিবর্তন হয়ে যাবে।
[4] فِي ابراهيم এর মধ্যে সম্বন্ধসূচক যে শব্দ ঊহ্য আছে তা থেকে এটা ব্যতিক্রান্ত। অর্থাৎ, {قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي مَقَالاَتِ إِبْرَاهِيْمَ إلاَّ قَوْلَهُ لِأَبِيْه}ِ অথবা أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ থেকে ব্যতিক্রান্ত। কারণ তাঁর কথাগুলো সবই আদর্শ। যেন বলা হয়েছে যে, {قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيْمَ فِي جَمِيْعِ أَقْوَالِهِ وأَفْعَالِهِ إِلاَّ قَوْلَهُ لِأَبِيْه}ِ (فتح القدير) অর্থাৎ, ইবরাহীম (আঃ)-এর পুরো জীবনটাই এক অনুসরণীয় আদর্শ। তবে তাঁর (মুশরিক) পিতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এমন একটি কাজ, যাতে তাঁর অনুসরণ করা উচিত নয়। কেননা, তাঁর এই কাজটা ছিল তখনকার, যখন তিনি নিজ পিতার ব্যাপারটা জানতেন না। সুতরাং যখন তিনি অবগত হলেন যে, তাঁর পিতা আল্লাহর শত্রু, তখন তিনি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্নতার কথা ঘোষণা করলেন। যেমন, সূরা তাওবার ১১৪ নং আয়াতে রয়েছে।
[5] ‘তাওয়াক্কুল’ (নির্ভর, ভরসা) করার অর্থ হল, সাধ্যমত বাহ্যিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার সাথে সাথে ব্যাপারকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া। এর অর্থ এই নয় যে, বাহ্যিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন না করেই আল্লাহর উপর ভরসা প্রকাশ করা হোক। এ থেকে আমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। কাজেই ‘তাওয়াক্কুল’ এর এই (উপায়-উপকরণ গ্রহণ না করেই ভরসা করা) অর্থ ভুল হবে। নবী (সাঃ)-এর নিকট এক ব্যক্তি উপস্থিত হল এবং তার উটকে বাহিরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। তিনি তাকে (উটের কথা) জিজ্ঞাসা করলে, সে বলল, ‘আমি উটকে আল্লাহর ভরসায় রেখে এসেছি।’ তিনি (সাঃ) বললেন, (اعْقِلْها وَتَوَكَّلْ) ‘‘প্রথমে একে বাঁধ, তারপর আল্লাহর উপর ভরসা কর।’’ (তিরমিযী) إنابة অর্থ হল, আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করা, আল্লাহর অভিমুখী হওয়া।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫. হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে কাফিরদের ফিতনার পাত্র করবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন; নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৫) হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে অবিশ্বাসীদের জন্য ফিতনার কারণ করো না,[1] হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’
[1] অর্থাৎ কাফেরদেরকে আমাদের উপর বিজয় ও কর্তৃত্ব দান করো না। এতে তারা মনে করবে যে, তারাই সত্যের উপর আছে। এইভাবে আমরা কাফেরদের জন্য ফিতনা ও পরীক্ষার কারণ হয়ে যাব। অথবা অর্থ হল, তাদের হাতে কিংবা তোমার পক্ষ হতে আমাদেরকে কোন শাস্তির মধ্যে ফেলো না। এতেও আমাদের অস্তিত্ব তাদের জন্য ফিতনার কারণ হবে। কারণ তারা বলবে যে, যদি এরা হকপন্থী হত, তাহলে তাদের উপর এই কষ্ট কি আসত?
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
*ইবরাহীম আ. ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে
৬. যারা আল্লাহ্ ও শেষ দিবসের প্রত্যাশা করে অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে ওদের মধ্যে(১) উত্তম আদর্শ। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, (সে জেনে রাখুক), নিশ্চয় আল্লাহ্, তিনি অভাবমুক্ত, সপ্ৰশংসিত।
(১) অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার অনুসারীদের মধ্যে। [কুরতুবী, বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬) নিশ্চয়ই তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রত্যাশা কর,[1] তাদের জন্য তাদের মধ্যে[2] রয়েছে উত্তম আদর্শ। আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে[3] সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহ তো অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ।
[1] কেননা, এই ধরনের লোকরাই আল্লাহকে এবং আখেরাতের আযাবকে ভয় করে। এরাই অবস্থাসমূহ ও ঘটনাবলী থেকে উপদেশ গ্রহণ করে।
[2] অর্থাৎ, ইবরাহীম (আঃ) এবং তাঁর অনুসারী সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে। এর পুনরাবৃত্তি তাকীদ স্বরূপ করা হয়েছে।
[3] অর্থাৎ, ইবরাহীম (আঃ)-এর আদর্শ হতে মুখ ফিরিয়ে নিলে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭. যাদের সাথে তোমাদের শক্ৰতা রয়েছে সম্ভবত আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন(১); এবং আল্লাহ্ ক্ষমতাবান। আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
(১) আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তা'আলা ইঙ্গিত করেছেন যে, আজ যারা কাফের, ফলে তারা তোমাদের শত্রু ও তোমরা তাদের শত্ৰু, সত্বরই হয়তো আল্লাহ তা'আলা এই শক্রতাকে বন্ধুত্বে পর্যবসিত করে দিবেন। অর্থাৎ তাদেরকে ঈমানের তওফীক দিয়ে তোমাদের পারস্পরিক সুসম্পর্ককে নতুন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে দিবেন। এই ভবিষ্যদ্বাণী মক্কাবিজয়ের সময় বাস্তবরূপ লাভ করে। ফলে নিহতদের বাদ দিয়ে অবশিষ্ট সকল কাফের মুসলিম হয়ে যায়। [আল-ওয়াহেদী: আসবাবুন নুযুল ৪৫০] পবিত্র কুরআনের এক আয়াতে এর বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, (وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا) অর্থাৎ “আর আপনি দেখতে পাবেন মানুষদেরকে যে তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করবে” [সূরা আন-নাসর: ২] বাস্তবেও তাই হয়েছে। আবু সুফিয়ান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইসলামের ভীষণ দুশমন ছিলেন। কিন্তু এ সময়ে আল্লাহ তা'আলা আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বাদশা নাজাসী তাকে রাসূলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন, ফলে আবু সুফিয়ানের বিরোধিতায় ভাটা পড়ে, তিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্ৰহণ করেন। তার পুত্র মু'আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও ইসলাম গ্ৰহণ করেন। তারা পরবর্তীতে ইসলামের পক্ষের শক্তি হিসেবে নিজেদের শক্তিকে কাজে লাগান। [দেখুন: কুরতুবী]
তাফসীরে জাকারিয়া(৭) যাদের সাথে তোমাদের শত্রুতা রয়েছে, সম্ভবতঃ আল্লাহ তাদের ও তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। [1] আর আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
[1] অর্থাৎ, তাদেরকে মুসলমান করে তোমাদের ভাই ও সাথী বানিয়ে দেবেন। যার ফলে তোমাদের মাঝের শত্রুতা ও বিদ্বেষ বন্ধুত্ব ও ভালবাসায় পরিবর্তন হয়ে যাবে। আর হলও তা-ই। মক্কা বিজয়ের পর মানুষ দলে দলে মুসলমান হতে শুরু করল। আর তাদের মুসলিম হওয়ার সাথে সাথেই আপোসের বিদ্বেষ ভালবাসায় পরিবর্তন হয়ে গেল। যারা মুসলমানদের রক্ত-পিপাসু ছিল, তারা পরস্পরের সাহায্যকারীতে পরিণত হয়ে গেল।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৮. দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিস্কার করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা দেখাতে ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।(১)
(১) যেসব কাফের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কারেও অংশগ্রহণ করেনি, আলোচ্য আয়াতে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার ও ইনসাফ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ন্যায় ও সুবিচার তো প্রত্যেক কাফেরের সাথেও জরুরী। এতে যিম্মি কাফের, চুক্তিতে আবদ্ধ কাফের এবং শক্র কাফের সবাই সমান। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, আসমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার জননী আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর স্ত্রী ‘কুতাইলা’ হুদায়বিয়া সন্ধির পর কাফের অবস্থায় মক্কা থেকে মদীনায় পৌছেন। তিনি কন্যা আসমার জন্যে কিছু উপঢৌকনও সাথে নিয়ে যান। কিন্তু আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সেই উপঢৌকন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেনঃ আমার জননী আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, কিন্তু তিনি কাফের। আমি তার সাথে কিরূপ ব্যবহার করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ জননীর সাথে সদ্ব্যবহার কর। [বুখারী: ২৬২০, ৩১৮৩, মুসলিম: ১০০৩, আবু দাউদ: ১৬৬৮, মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৪৭, ইবনে হিব্বান: ৪৫২]
তাফসীরে জাকারিয়া(৮) দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি[1] এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি,[2] তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না।[3] নিশ্চয় আল্লাহ ন্যায়-পরায়ণদেরকে ভালবাসেন। [4]
[1] এখানে এমন কাফেরদের সাথে পার্থিব লেনদেন ও আচার-ব্যবহার বিষয়ক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। যারা দ্বীন ইসলামের কারণে মুসলিমদের সাথে বিদ্বেষ ও শত্রুতা রাখে না এবং এর ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না। এটা প্রথম শর্ত।
[2] অর্থাৎ, তোমাদের সাথে এমন আচরণও করে না যে, তোমরা হিজরত করতে বাধ্য হয়ে যাও। এটা দ্বিতীয় শর্ত। পরের আয়াত থেকে তৃতীয় আর একটি শর্তও পরিষ্কার হয়ে যায়। আর তা হল, তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যান্য কাফেরদেরকে কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতাও করে না; না পরামর্শ দিয়ে, আর না অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে।
[3] অর্থাৎ, এই ধরনের কাফেরদের সাথে অনুগ্রহ প্রদর্শন এবং সুবিচারপূর্ণ আচরণ করা নিষেধ নয়। যেমন, আসমা বিনতে আবী বাকর (রাঃ) তাঁর মুশরিক মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার করা সম্পর্কে নবী (সাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি বললেন, صِلِىْ أُمَّكِ ‘‘তোমার মায়ের সাথে সদ্ব্যবহার কর।’’ (বুখারীঃ আদব অধ্যায় ২৬২০নং, মুসলিমঃ যাকাত অধ্যায়ঃ ১০০৩নং)
[4] এতে ন্যায়পরায়ণতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি, কাফেরদের সাথেও। হাদীস শরীফে ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারকারীদের ফযীলত এইভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘‘আল্লাহর নিকট যারা ন্যায়পরায়ণ তারা দয়াময়ের ডান পার্শ্বে জ্যোতির মিম্বরের উপর অবস্থান করবে। আর তাঁর উভয় হস্তই ডান। (ঐ ন্যায়পরায়ণ তারা) যারা তাদের বিচারে, পরিবারে এবং তার কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বাধীন ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে ন্যায়নিষ্ঠ।’’ (মুসলিম ১৮২৭ নং)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৯. আল্লাহ শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে বের করাতে সাহায্য করেছে। আর তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই তো যালিম।
-
তাফসীরে জাকারিয়া(৯) আল্লাহ শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং তোমাদের বহিষ্করণে সহযোগিতা করেছে। তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে,[1] তারাই তো অত্যাচারী।[2]
[1] অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলার বাণী ও তাঁর নির্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
[2] কেননা, তারা এমন লোকের সাথে ভালবাসা রাখে, যারা ভালবাসার পাত্র নয়। আর এইভাবে তারা নিজেদের নাফসের প্রতি যুলুম করে। কেননা, তাকে আল্লাহর আযাবের জন্য পেশ করে থাকে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ لاَ تَتَّخِذُواْ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاء بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ} অর্থাৎ, হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না। (সূরা মাইদাহ ৫১ আয়াত)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
*কাফির স্বামীরা
১০. হে ঈমানদারগণ!(১) তোমাদের কাছে মুমিন নারীরা হিজরত করে আসলে তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করো(২) আল্লাহ তাদের ঈমান সম্বন্ধে সম্যক অবগত। অতঃপর যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মুমিন নারী, তবে তাদেরকে কাফিরদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে না। মুমিন নারীগণ কাফিরদের জন্য বৈধ নয় এবং কাফিরগণ মুমিন নারীদের জন্য বৈধ নয়। কাফিররা যা ব্যয় করেছে তা তাদেরকে ফিরিয়ে দিও। তারপর তোমরা তাদেরকে বিয়ে করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না যদি তোমরা তাদেরকে তাদের মাহর দাও। আর তোমরা কাফির নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না।(৩) তোমরা যা ব্যয় করেছ তা ফেরত চাইবে এবং কাফিররা যা ব্যয় করেছে তা যেন তারা চেয়ে নেয়। এটাই আল্লাহর বিধান; তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে থাকেন। আর আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ প্ৰজ্ঞাময়।
(১) আলোচ্য আয়াতগুলো একটি বিশেষ ঘটনা অর্থাৎ হুদায়বিয়ার সন্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত। হাদীসে এসেছে, “যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সন্ধি চুক্তি শেষ করলেন তখন তিনি সাহাবায়ে কিরামকে বললেন, তোমরা উঠ এবং উটগুলোর ‘নাহর’ বা রক্ত প্রবাহিত কর তারপর মাথা কামিয়ে ফেল। কিন্তু তাদের কেউই এটা শুনছিল না। শেষপর্যন্ত রাসূল এটা তিনবার বললেন। কিন্তু কেউ না শুনাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মে সালামাহ এর কাছে গিয়ে তা বিবৃত করলেন। উম্মে সালামাহ বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনি কি এটা বাস্তবে হওয়া চান? তবে আপনি কাউকে কিছু না বলে নিজের উটটি ‘নাহর’ করুন এবং আপনার মাথা কামানোর জন্য লোক ডেকে তা সম্পাদন করুন। তিনি তাই করলেন। ফলে সবাই তা করতে শুরু করে দিল। আর তখনই কয়েকজন মুমিন নারী এসে উপস্থিত। তখন আল্লাহ্ তা'আলা (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا جَاءَكُمُ الْمُؤْمِنَاتُ مُهَاجِرَاتٍ) এই আয়াত নাযিল করলেন।” [বুখারী: ২৩৭২]
এর কারণ হলো, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মক্কাবাসীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হুদায়বিয়ার বিখ্যাত শান্তিচুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল এই যে, মক্কা থেকে কোন ব্যক্তি মদিনায় চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিবেন যদিও সে মুসলিম হয়। কিন্তু মদীনা থেকে কেউ মক্কায় চলে গেলে কোরাইশরা তাকে ফেরত পাঠাবে না। এই শর্তের ভাষা ছিল ব্যাপক, যাতে পুরুষ ও নারী উভয়ই বাহ্যত অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ কোন মুসলিম পুরুষ অথবা নারী মক্কা থেকে মদীনায় চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ফেরত পাঠাবেন। এই চুক্তি সম্পাদন শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হুদায়বিয়াতেই অবস্থানরত ছিলেন তখন মুসলিমদের জন্যে অগ্নি পরীক্ষাতুল্য একাধিক ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়। তন্মধ্যে একটি ঘটনা হচ্ছে, সুবাই’আ বিনতে হারেস আল-আসলামিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা কাফের সায়ফী ইবনে রাহিবের পত্নী ছিলেন। তখন পর্যন্ত মুসলিম ও কাফেরের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হারাম ছিল না। এই মুসলিম মহিলা মক্কা থেকে পালিয়ে হুদাইবিয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে উপস্থিত হলেন। সাথে সাথে স্বামীও হাযির। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে দাবি জানাল যে, আমার স্ত্রীকে আমার কাছে প্রত্যাৰ্পণ করা হোক। কেননা, আপনি এই শর্ত মেনে নিয়েছেন এবং চুক্তিপত্রের কালি এখনও শুকায়নি। [তাফসীরে কুরতুবী: ২০/৪১০]
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছে। এসব আয়াতে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে। এর পরিণতিতে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, কোন মুসলিম নারী হিজরত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে পৌছে গেলে তাকে কাফেরদের হাতে ফেরত দেয়া হবে না। সে পূর্ব থেকেই মুসলিম হোক; -যেমন উল্লেখিত ভদ্রমহিলা, অথবা হিজরতের পর তার মুসলিমতত্ব প্রমাণিত হোক। তাকে ফেরত না দেয়ার কারণ এই যে, সে তার কাফের স্বামীর জন্যে হালাল নয়। উল্লেখিত আয়াতসমূহ অবতরণের ফলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, চুক্তিপত্রের উপরোক্ত শর্তটি ব্যাপক অর্থে প্রযোজ্য নয় যে, এই শর্তটির ব্যাপকতা কেবল পুরুষদের ক্ষেত্রে গ্রহণীয় নারীদের ক্ষেত্রে নয়। আয়াতের ভিত্তিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুক্তিপত্রের উল্লেখিত এই শর্তের সঠিক মর্ম ব্যাখ্যা করেন এবং তদনুযায়ী সুবাই’আ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাকে কাফেরদের কাছে ফেরত প্রেরণে বিরত থাকেন। কোন কোন বর্ণনায় অনুরূপ ঘটনা উম্মে কুলসুম বিনতে-উকবার ক্ষেত্রেও ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ৷ [বুখারী: ২৭১১, ২৭১২]
(২) আয়াতে মুহাজির নারীকে পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। সে পরীক্ষা কি ছিল এ ব্যাপারে বিভিন্ন মত বর্ণিত আছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মুহাজির নারীকে শপথ করানো হত যে, সে স্বামীর প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণার কারণে আগমন করেনি, মদীনার কোন ব্যক্তির প্রেমে পড়ে আসেনি এবং অন্য কোন পার্থিব স্বার্থের বশবতী হয়ে হিজরত করেনি; বরং একান্তভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসা ও সন্তুষ্টি লাভের জন্যে আগমন করেছে। যে নারী এই শপথ করত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে মদীনায় বসবাসের অনুমতি দিতেন এবং সে তার স্বামীর কাছ থেকে যে মোহরানা ইত্যাদি আদায় করেছিল, তা তার স্বামীকে ফেরত দিয়ে দিতেন। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, পরীক্ষা ছিল, কালেমা শাহাদাত বলা অর্থাৎ আশাহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়া আশাহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলা। তবে এখানে গ্রহণযোগ্য মত হলো, যা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নারীদের পরীক্ষার পদ্ধতি ছিল সেই আনুগত্যের শপথ, যা পরবর্তী আয়াতসমূহে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে;
(يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا جَاءَكَ الْمُؤْمِنَاتُ يُبَايِعْنَكَ عَلَىٰ أَنْ لَا يُشْرِكْنَ بِاللَّهِ شَيْئًا وَلَا يَسْرِقْنَ وَلَا يَزْنِينَ وَلَا يَقْتُلْنَ أَوْلَادَهُنَّ وَلَا يَأْتِينَ بِبُهْتَانٍ يَفْتَرِينَهُ بَيْنَ أَيْدِيهِنَّ وَأَرْجُلِهِنَّ وَلَا يَعْصِينَكَ فِي مَعْرُوفٍ فَبَايِعْهُنَّ وَاسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ)
মুহাজির নারীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাতে আয়াতে বৰ্ণিত বিষয়সমূহের শপথ করত। [তিরমিযী: ৩৩০৬, অনুরূপ বর্ণনা দেখুন: বুখারী: ৪১৮২, ৪৮৯১, মুসলিম: ১৮৬৬, মুসনাদে আহমাদ: ৬/২৭০]
(৩) كَوَافِر শব্দটি كَافِرَةٌ এর বহুবচন। এখানে মুশরিক নারী বোঝানো হয়েছে। [বাগভী]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০) হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের নিকট বিশ্বাসী নারীরা দেশত্যাগ করে আসলে, তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা কর। [1] আল্লাহ তাদের ঈমান (বিশ্বাস) সম্বন্ধে সম্যক অবগত আছেন। যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা বিশ্বাসীনী,[2] তবে তাদেরকে অবিশ্বাসীদের নিকট ফেরত পাঠিয়ে দিয়ো না। বিশ্বাসী নারীরা অবিশ্বাসীদের জন্য বৈধ নয় এবং অবিশ্বাসীরা বিশ্বাসী নারীদের জন্য বৈধ নয়।[3] অবিশ্বাসীরা যা ব্যয় করেছে, তা তাদেরকে ফিরিয়ে দাও।[4] অতঃপর তোমরা তাদেরকে বিবাহ করলে তোমাদের কোন অপরাধ হবে না;[5] যদি তোমরা তাদেরকে তাদের মোহর দিয়ে দাও। তোমরা অবিশ্বাসী নারীদের সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক বজায় রেখো না।[6] তোমরা যা ব্যয় করেছ,[7] তা ফেরত চেয়ে নাও এবং অবিশ্বাসীরা ফেরত চেয়ে নিক, যা তারা ব্যয় করেছে।[8] এটাই আল্লাহর ফায়সালা। তিনি তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করছেন।[9] আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
[1] হুদাইবিয়ার সন্ধিপত্রে একটি শর্ত এও ছিল যে, মক্কা থেকে কোন ব্যক্তি মুসলিমদের নিকট চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু তাতে পুরুষ বা মহিলা বলে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ ছিল না। তবে বাহ্যিকভাবে (أَحَدٌ) এর মধ্যে উভয়েই শামিল। কিছু দিন পর কোন কোন মহিলা মক্কা থেকে হিজরত করে মুসলমানদের কাছে চলে গেলে কাফেররা তাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী করে। ফলে এই আয়াতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের পথ প্রদর্শন করলেন এবং এই নির্দেশ দিলেন। পরীক্ষা করার অর্থ, এ ব্যাপারে যাচাই করে নাও যে, হিজরত করে আগমনকারিণী যে মহিলারা ঈমান আনার কথা প্রকাশ করছে, তারা তাদের স্বামীর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে অথবা কোন মুসলিমের প্রেমে পড়ে কিংবা অন্য কোন স্বার্থের কারণে তো চলে আসেনি? কেবল আশ্রয় গ্রহণের জন্য ঈমান আনার দাবী করছে না তো?
[2] অর্থাৎ, যাচাই করার পর যখন তোমরা এই ফলাফলে পৌঁছবে এবং প্রবল ধারণা এই সৃষ্টি হবে যে, বাস্তবিকই এ মু’মিনা।
[3] এটা হল তাদেরকে তাদের কাফের স্বামীদের নিকট ফিরিয়ে না পাঠানোর কারণ। আর তা হল, এখন আর কোন মু’মিন মহিলা কোন কাফেরের জন্য হালাল নয়, যেমন ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে এটা জায়েয ছিল। তাই তো নবী করীম (সাঃ)-এর কন্যা যায়নাব (রায্বিয়াল্লাহু আনহার) বিবাহ আবূল আ’স ইবনে রাবী’র সাথে হয়েছিল, অথচ সে মুসলিম ছিল না। আয়াতে আগামীতে এ রকম করতে নিষেধ করা হল। আর এই কারণেই এখানে বলা হল যে, তারা একে অপরের জন্য হালাল নয়। সুতরাং তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। হ্যাঁ, স্বামীও যদি মুসলিম হয়ে যায়, তবে তাদের বিবাহ বন্ধন প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে, যদিও স্বামী তার স্ত্রীর পরে (ইদ্দতের মধ্যে) হিজরত করে আসে।
[4] অর্থাৎ, তাদের কাফের স্বামীরা তাদেরকে যে মোহর দিয়েছিল, তা তোমরা তাদেরকে ফিরিয়ে দাও।
[5] এ কথা মুসলিমদেরকে বলা হচ্ছে যে, যে নারীরা ঈমানের কারণে তাদের কাফের স্বামীদেরকে ত্যাগ করে তোমাদের কাছে এসে গেছে, তোমরা তাদেরকে বিবাহ করতে পার। তবে শর্ত হল, তাদের প্রাপ্য মোহর তাদেরকে দিয়ে দেবে। তবে এ বিয়েও যথানিয়মে হবে। অর্থাৎ, প্রথমতঃ ইদ্দত পূরণ হওয়ার পর হবে। দ্বিতীয়তঃ এতে অভিভাবকের সম্মতি ও অনুমতি ও দু’জন ন্যায়পরায়ণ সাক্ষীর উপস্থিতিও আবশ্যক। অবশ্য যে মহিলার সাথে তার স্বামীর কোন সম্পর্ক (মিলন) হয়নি, তার সাথে ইদ্দত ছাড়াই সত্বর বিবাহ জায়েয।
[6] عِصَمٌ হল, عِصْمَةٌ এর বহুবচন। এখানে এর অর্থ, দাম্পত্য সম্পর্ক। অর্থাৎ, যদি স্বামী মুসলিম হয়ে যায় এবং স্ত্রী কাফের ও মুশরিক রয়ে যায়, তাহলে এ রকম মুশরিক মহিলাকে স্বীয় বিবাহ বন্ধনে রাখা বৈধ নয়। স্বামী তাকে সত্বর তালাক দিয়ে নিজের কাছ থেকে পৃথক করে দেবে। সুতরাং এই নির্দেশের পর উমার (রাঃ) তাঁর দু’জন মুশরিক স্ত্রীকে এবং ত্বালহা ইবনে উবায়দুল্লাহও তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেন। (ইবনে কাসীর) তবে স্ত্রী যদি কিতাবিয়া (ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান) হয়, তাহলে তাকে তালাক দেওয়া জরুরী নয়। কেননা, তাদের সাথে বিবাহ বৈধ। কাজেই সে (ইয়াহুদী বা খ্রিষ্টান স্ত্রী) যদি প্রথম থেকেই স্ত্রীরূপে স্বামীর কাছে থেকে থাকে, তবে ইসলাম কবুল করার পর তাকে বিচ্ছিন্ন করার কোন প্রয়োজন নেই।
[7] অর্থাৎ, সেই মহিলাদের উপর, যারা কুফরীতে অবিচল থাকার কারণে কাফেরদের নিকট চলে গেছে।
[8] অর্থাৎ, সেই মহিলাদের উপর, যারা মুসলিম হয়ে হিজরত করে মদীনায় চলে এসেছে।
[9] অর্থাৎ, উভয়েরই একে অপরকে মোহরের পাওনা আদায় করার, বরং চেয়ে নেওয়ার উল্লিখিত বিধান হল আল্লাহর বিধান। ইমাম ক্বুরত্বুবী বলেন, এ বিধান সেই যুগের সাথেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ ব্যাপারে সকল মুসলিমের ঐকমত্য রয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর) আর এর কারণ হল সেই চুক্তি, যা সেই সময় উভয় দলের মাঝে হয়েছিল। এই ধরনের চুক্তির পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ভবিষ্যতেও উক্ত বিধানের উপর আমল করা জরুরী হবে। অন্যথা হবে না।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান