-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
১. আমরা কি আপনার বক্ষ আপনার কল্যাণে প্রশস্ত করে দেইনি?(১)
(১) شرح শব্দের অর্থ উন্মুক্ত করা। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে দেবার শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কোথাও বলা হয়েছে, “কাজেই যে ব্যক্তিকে আল্লাহ হেদায়াত দান করার ইচ্ছা করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।” [সূরা আল-আন’আম: ১২৫] আবার কোথাও বলা হয়েছে, “আল্লাহ ইসলামের জন্য যার বক্ষ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং যে তার রবের দেয়া আলোতে রয়েছে, সে কি তার সমান যে এরূপ নয়? দুর্ভোগ সে কঠোর হৃদয় ব্যক্তিদের জন্য যারা আল্লাহর স্মরণে পরাঙ্মুখ! তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তি তে আছে।” [সূরা আয-যুমার: ২২] এই উভয় স্থানে বক্ষদেশ উন্মুক্ত করার অর্থই হচ্ছে, সব রকমের মানসিক অশান্তি ও সংশয়মুক্ত হওয়া, জ্ঞান ও সত্য উপলব্ধি করার উপযুক্ত করা এবং বক্ষকে প্রজ্ঞার আধার করার জন্য প্রস্তুত করা। জ্ঞান, তত্ত্বকথা ও উত্তম চরিত্রের জন্যে তার বক্ষকে প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছে। কোন কোন তাফসীরবিদ এস্থলে বক্ষ উন্মুক্ত করার অর্থ সে বক্ষ বিদারণই নিয়েছেন। হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর আদেশে বাহ্যত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বক্ষ বিদারণ করে তাকে যাবতীয় পঙ্কিলতা থেকে পরিষ্কার করে তাতে জ্ঞান ও তত্ত্বকথা দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন। [মুসলিম: ১৬৪, তিরমিযী: ৩৩৪৬] উপরোক্ত সব কয়টি অর্থই এ আয়াতে হওয়া সম্ভব, আর একটি অপরটির পরিপূরক। [আদ্ওয়াউল বায়ান]
তাফসীরে জাকারিয়া১। আমি কি তোমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিইনি? [1]
[1] পূর্বের সূরায় (মহানবী (সাঃ)-এর প্রতি) তিনটি নিয়ামত বা অনুগ্রহের কথা আলোচনা হয়েছে। এ সূরাতেও মহান আল্লাহ আরো তিনটি অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করছেন। তার মধ্যে তাঁর ‘বক্ষ প্রশস্ত’ করে দেওয়া হল প্রথম অনুগ্রহ। এর অর্থ হল, বক্ষ আলোকিত এবং উদার হওয়া; যাতে সত্য স্পষ্ট হয়ে যায় এবং তার জন্য হৃদয় সংকুলান হয়। একই অর্থে কুরআন কারীমের এই আয়াতওঃ {فَمَن يُرِدِ اللهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإِسْلاَمِ} অর্থাৎ, ‘‘আল্লাহ যাকে পথ-প্রদর্শন করতে চান, তার বক্ষকে ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন।’’ (সূরা আনআম ১২৫ আয়াত) অর্থাৎ, সে ইসলামকে সত্য দ্বীন বলে জেনে নেয় এবং তা গ্রহণ করে নেয়। এই ‘বক্ষ প্রশস্ত’-এর অর্থে সেই ‘বক্ষ বিদীর্ণ’ (সিনাচাক)ও এসে যায়; যা বিশুদ্ধ হাদীসানুযায়ী নবী (সাঃ)-এর দু’-দু’ বার ঘটেছিলঃ একবার বাল্যকালে যখন তাঁর বয়স ৪ বছর। একদা জিবরীল (আঃ) এলেন এবং নবী (সাঃ)-এর বক্ষ বিদীর্ণ করলেন। আর তাঁর হৃদয়ের ভিতর থেকে শয়তানী রক্তপিন্ডকে বের করে দিয়েছিলেন যা প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে বিদ্যমান থাকে এবং হৃদয় ধৌত করে পুনরায় তা ভরে দিয়ে বক্ষ বন্ধ করে দিলেন। (সহীহ মুসলিম ঈমান অধ্যায়, ইসরা পরিচ্ছেদ) আর একবার তা মি’রাজের সময় ঘটেছিল; জিবরীল (আঃ) তাঁর মুবারক বুকটাকে চিরে তাঁর অন্তরটাকে বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে পুনরায় স্বস্থানে রেখে দিলেন এবং তা ঈমান ও হিকমত দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিলেন। (সহীহাইন মি’রাজ পরিচ্ছেদ এবং নামায অধ্যায়)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
২. আর আমরা অপসারণ করেছি আপনার ভার,
-
তাফসীরে জাকারিয়া২। আমি তোমার উপর হতে অপসারণ করেছি তোমার সেই ভার; [1]
[1] এই ভার বা বোঝা নবুঅতের পূর্বে তাঁর চল্লিশ বছর বয়সকালের সাথে সম্পৃক্ত। এই জীবনে যদিও আল্লাহ তাঁকে গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন; সুতরাং তিনি কোন মূর্তির সামনে মাথা ঝুঁকাননি, কখনো মদ্য পান করেননি এবং এ ছাড়া অন্যান্য পাপাচরণ থেকেও তিনি সুদূরে ছিলেন। তবুও প্রসিদ্ধ অর্থে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য সম্পর্কে তিনি জানতেন না; আর না তিনি তা করেছেন। এই জন্য বিগত চল্লিশ বছরে ইবাদত ও আনুগত্য না করার বোঝ তাঁর হৃদয় ও মস্তিষ্কে সওয়ার ছিল; যা সত্যিকারে কোন বোঝ ছিল না। কিন্তু তাঁর অনুভূতি ও উপলব্ধি তা বোঝ বানিয়ে রেখেছিল। আল্লাহ তাআলা তাঁর সেই বোঝকে নামিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করে তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করলেন। এটা {لِيَغْفِرَ لَكَ اللهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ} আয়াতের অর্থের মত। (সূরা ফাত্হ ২ আয়াত)
কোন কোন আলেমগণ বলেন, এটা নবুঅতের বোঝ ছিল যেটাকে আল্লাহ হালকা করে দিলেন। অর্থাৎ, আল্লাহ এই রাস্তায় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ বৃদ্ধি এবং দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে সরলতা সৃষ্টি করলেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৩. যা আপনার পিঠ ভেঙ্গে দিচ্ছিল।(১)
(১) وزر এর শাব্দিক অর্থ বোঝা, আর نقض ظهر এর শাব্দিক অর্থ কোমর বা পিঠ ভারী করে দেয়া। অর্থাৎ কোমরকে নুইয়ে দেয়া। কোন বড় বোঝা কারও মাথায় তুলে দিলে যেমন তার কোমর নুয়ে পড়ে, তেমনি আয়াতে বলা হয়েছে যে, যে বোঝা আপনার কোমরকে নুইয়ে দিয়েছিল, আমরা তাকে আপনার উপর থেকে অপসারিত করে দিয়েছি। সে বোঝা কি ছিল, তার ব্যাখ্যায় কোন কোন তাফসীরবিদ বলেছেন যে, নবুওয়তের গুরুভার তার অন্তর থেকে সরিয়ে দেয়া ও তা সহজ করে দেয়ার সুসংবাদ এ আয়াতে ব্যক্ত হয়েছে। [আদ্ওয়াউল বায়ান]
তাফসীরে জাকারিয়া৩। যা তোমার পিঠকে করে রেখেছিল ভারাক্রান্ত।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৪. আর আমরা আপনার (মর্যাদা বৃদ্ধির) জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি(১),
(১) অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনেক সম্মানিত করা হয়েছে; কোন সৃষ্টিকে তার মত প্রশংসনীয় করা হয় নি। এমনকি আযান, ইকামত, খুতবা, ইত্যাদির ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নামের সাথেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম স্মরণ করা হয়। এভাবে তার মর্যাদা ও স্মরণ সমুন্নত করা হয়েছে। এ-ছাড়াও তার উম্মত ও অনুসারীদের নিকট তার সম-মর্যাদার আর কেউ নেই। [সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া৪। আর আমি তোমার খ্যাতিকে সমুচ্চ করেছি। [1]
[1] অর্থাৎ, যেখানে আল্লাহর নাম আসে সেখানে তাঁরও (নবীর) নাম আসে। যেমন, আযান, নামায এবং আরো অন্যান্য বহু জায়গায়। (এই হিসাবে সারা বিশ্বে প্রতি মুহূর্তেই লক্ষবার তাঁর নাম উচ্চারিত হয়ে থাকে।) পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে নবী (সাঃ)-এর নাম এবং গুণ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা হয়েছে। ফিরিশতাদের মাঝেও তাঁর সুনাম উল্লেখ করা হয়। নবী (সাঃ)-এর আনুগত্যকেও মহান আল্লাহ নিজের আনুগত্যরূপে শামিল করেছেন এবং নিজের আদেশ পালন করার সাথে সাথে তাঁর আদেশও পালন করতে মানব সম্প্রদায়কে নির্দেশ দিয়েছেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৫. সুতরাং কষ্টের সাথেই তো স্বস্তি আছে,
-
তাফসীরে জাকারিয়া৫। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি।
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৬. নিশ্চয় কষ্টের সাথেই স্বস্তি আছে।(১)
(১) আরবী ভাষার একটি নীতি এই যে, আলিফ ও লামযুক্ত শব্দকে যদি পুনরায় আলিফ ও লাম সহকারে উল্লেখ করা হয়, তবে উভয় জায়গায় একই বস্তুসত্তা অর্থ হয়ে থাকে এবং আলিফ ও লাম ব্যতিরেকে পুনরায় উল্লেখ করা হলে উভয় জায়গায় পৃথক পৃথক বস্তুসত্তা বোঝানো হয়ে থাকে। আলোচ্য আয়াতে العسر শব্দটি যখন পুনরায় العسر উল্লেখিত হয়েছে, তখন বোঝা গেল যে, উভয় জায়গায় একই عسر অর্থাৎ কষ্ট বোঝানো হয়েছে। পক্ষান্তরে يسر শব্দটি উভয় জায়গায় আলিফ ও লাম ব্যতিরেকে উল্লেখিত হয়েছে। এতে নিয়মানুযায়ী বোঝা যায় যে, দ্বিতীয় يسر তথা স্বস্তি প্রথম يسر তথা স্বস্তি থেকে ভিন্ন। অতএব আয়াতে (إِنَّ مَعَ الْعُسْرِ يُسْرًا) এর পুনরুল্লেখ থেকে জানা গেল যে, একই কষ্টের জন্যে দুটি স্বস্তির ওয়াদা করা হয়েছে। দু’এর উদ্দেশ্যও এখানে বিশেষ দু’এর সংখ্যা নয়; বরং উদ্দেশ্য অনেক। অতএব সারকথা এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একটি কষ্টের সাথে তাকে অনেক স্বস্তি দান করা হবে। হাদীসে এসেছে, “নিশ্চয় বিপদের সাথে মুক্তি আছে, আর নিশ্চয় কষ্টের সাথে আছে স্বস্তি”। [মুসনাদ আহমাদ: ১/৩০৭] হাসান বসরী ও কাতাদাহ বলেন, ‘এক কষ্ট দুই স্বস্তির উপর প্রবল হতে পারে না’। [ফাতহুল কাদীর, তাবারী]
তাফসীরে জাকারিয়া৬। নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি। [1]
[1] এ হল নবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণের জন্য শুভসংবাদ যে, তোমরা ইসলামের পথে যা কিছু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করছ এ ব্যাপারে চিন্তিত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই; যেহেতু এর পরেই আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য অবসর ও স্বস্তি এনে দেবেন। সুতরাং এইরূপই হয়েছিল; যা সারা পৃথিবীর লোকেরা অবগত।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৭. অতএব আপনি যখনই অবসর পান তখনই কঠোর ইবাদাতে রত হোন।
-
তাফসীরে জাকারিয়া৭। অতএব যখনই অবসর পাও, তখনই (আল্লাহর ইবাদতে) সচেষ্ট হও।[1]
[1] অর্থাৎ, নামায, তাবলীগ, অথবা জিহাদ থেকে যখনই অবসর পাও তখনই ইবাদত (দু’আ ও যিকরে)র জন্য সচেষ্ট হও। (যেহেতু ইবাদতের পর যিকরই বিধেয়।) অথবা এত বেশী আল্লাহর ইবাদত কর, যাতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান-আল-বায়ান
-তাইসিরুল
-মুজিবুর রহমান
-Sahih International
৮. আর আপনার রবের প্রতি গভীর মনোযোগী হোন।(১)
(১) النصب অর্থ কঠোর প্রচেষ্টার পর ক্লান্ত হওয়া। এ প্রচেষ্টাটি দুনিয়ার কাজেও হতে পারে, আবার আখেরাতের কাজেও হতে পারে। এখানে কী উদ্দেশ্য তা নিয়ে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। সবগুলো মতই গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কেউ কেউ বলেছেন, এর অর্থ সালাতের পর দু'আয় রত হওয়া। কেউ কেউ বলেন, ফরযের পর নফল ইবাদতে রত হওয়া। মূলত এখানে উদ্দেশ্য দুনিয়ার কাজ থেকে খালি হওয়ার পর আখিরাতের কাজে রত হওয়াই উদ্দেশ্য। শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, একমাত্র আল্লাহরই নিকট মনোযোগী হয়ে সকল ইবাদত যেন তিনি কবুল করে নেন, এ আশা করো। এ আয়াতে মুমিনদের জীবনে বেকারত্বের কোন স্থান দেওয়া হয় নি। হয় সে দুনিয়ার কাজে ব্যস্ত থাকবে, নয় আখেরাতের কাজে। [আদওয়াউল বায়ান, সা’দী]
তাফসীরে জাকারিয়া৮। আর তোমার প্রতিপালকের প্রতিই মনোনিবেশ কর। [1]
[1] অর্থাৎ, তাঁর কাছেই তুমি জান্নাতের আশা রাখ। তাঁর কাছেই তুমি নিজের প্রয়োজন ভিক্ষা কর এবং সর্ববিষয়ে তাঁরই উপর নির্ভর কর ও ভরসা রাখ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান