জান্নাত-জাহান্নাম আবদুল হামীদ ফাইযী ৮৯ টি
জান্নাত-জাহান্নাম আবদুল হামীদ ফাইযী ৮৯ টি

জাহান্নামে অধিকাংশ মানব-দানব নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি কি পূর্ণ হয়ে গেছ?’ জাহান্নাম বলবে, আরও আছে কি? (ক্বাফঃ ৩০) তখন আল্লাহ পাক নিজের কদম (পা) দোযখে রাখবেন। তখন সংকুচিত হয়ে সে বলবে, ব্যস, ব্যস্। (বুখারী ৭৩৮৪, মুসলিম ২৮৪৮নং)

জাহান্নামে কাফেরদের আযাব চিরস্থায়ী

জাহান্নামে জাহান্নামীরা চিরস্থায়ী বসবাস করবে। অবশ্য যদি কোন পাপের কারণে কোন মু’মিন জাহান্নামে যায়, তাহলে এক দিন না একদিন আল্লাহর দয়া ও ক্ষমায় অথবা কারো সুপারিশে অথবা পাপফল ভোগ করার শেষে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতে যাবে। হৃদয়ে তওহীদ থাকলে অর্থাৎ, শির্ক না করে থাকলে পাপী মুসলিমকে জাহান্নাম থেকে বের করা হবে।

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “(পরকালে) আল্লাহ বলবেন, সেই ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে বের কর, যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার হৃদয়ে যবের দানা পরিমাণ মঙ্গল (ঈমান) আছে। সেই ব্যক্তিকেও জাহান্নাম থেকে বের কর, যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার হৃদয়ে গমের দানা পরিমাণ মঙ্গল (ঈমান) আছে। আর সেই ব্যক্তিকেও জাহান্নাম থেকে বের কর, যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে এবং তার হৃদয়ে অণু পরিমাণ মঙ্গল। (ঈমান) আছে।” (আহমাদ ৩/২৭৬, তিরমিযী ২৫৯৩নং, এ হাদীসের মুল রয়েছে সহীহায়নে)

বাকী যাদের ঈমান নেই, সেই বেঈমানরা চিরদিন সেখানে আযাবের মধ্যে বসবাস করবে। তাদের শাস্তি ক্ষমা করা হবে না, লাঘব করা হবে না এবং তারা বা জাহান্নাম ধ্বংস হয়ে যাবে না। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অর্থাৎ, যারা (কাফের) অবিশ্বাস করে ও আমার নিদর্শনকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তারাই অগ্নিবাসী সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (বাক্বারাহঃ ৩৯)

وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অর্থাৎ, যারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করেছে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (আরাফঃ ৩৬)

إِنَّ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا لَا تُفَتَّحُ لَهُمْ أَبْوَابُ السَّمَاءِ وَلَا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ حَتَّىٰ يَلِجَ الْجَمَلُ فِي سَمِّ الْخِيَاطِ ۚ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُجْرِمِينَ

অর্থাৎ, অবশ্যই যারা আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যা বলে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা বেহেশ্তেও প্রবেশ করতে পারবে না যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করে। এরূপে আমি অপরাধীদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি। (আরাফঃ ৪০)

إِنَّ الْمُجْرِمِينَ فِي عَذَابِ جَهَنَّمَ خَالِدُونَ (74) لَا يُفَتَّرُ عَنْهُمْ وَهُمْ فِيهِ مُبْلِسُونَ (75)

অর্থাৎ, নিশ্চয় অপরাধীরা স্থায়ীভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। ওদের শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং ওরা তাতে (শাস্তি ভোগ করতে করতে) হতাশ হয়ে পড়বে। (যুখরুফঃ ৭৪-৭৫)

وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَىٰ عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُم مِّنْ عَذَابِهَا ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي كُلَّ كَفُورٍ

অর্থাৎ, যারা অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। ওদের মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হবে না যে, ওরা মরবে এবং ওদের জন্য জাহান্নামের শাস্তিও লাঘব করা হবে না। এভাবে আমি প্রত্যেক অবিশ্বাসীকে শাস্তি দিয়ে থাকি। (ফাত্বিরঃ ৩৬)

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَمَاتُوا وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَٰئِكَ عَلَيْهِمْ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ (161) خَالِدِينَ فِيهَا ۖ لَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنظَرُونَ (162)

অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা অবিশ্বাস করে (কাফের) এবং অবিশ্বাসী (কাফের) থাকা অবস্থায় মারা যায়, তাদের উপর আল্লাহ, ফিরিশ্তাগণ এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত। তারা চিরকাল তাতে (অভিসম্পাত ও দোযখে) অবস্থান করবে, তাদের শাস্তিকে লঘু করা হবে না এবং তারা কোন অবকাশও পাবে না। (বাক্বারাহঃ ১৬১-১৬২)

يُرِيدُونَ أَن يَخْرُجُوا مِنَ النَّارِ وَمَا هُم بِخَارِجِينَ مِنْهَا ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيمٌ

অর্থাৎ, তারা আগুন থেকে বের হতে চাইবে, কিন্তু তারা তা থেকে বের হতেই পারবে না এবং তাদের জন্য স্থায়ী শাস্তি রয়েছে। (মাইদাহঃ ৩৭)।

ثُمَّ قِيلَ لِلَّذِينَ ظَلَمُوا ذُوقُوا عَذَابَ الْخُلْدِ هَلْ تُجْزَوْنَ إِلَّا بِمَا كُنتُمْ تَكْسِبُونَ

অর্থাৎ, অতঃপর যালেমদেরকে বলা হবে, চিরস্থায়ী শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করতে থাকো, তোমাদেরকে তো তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিফলই দেওয়া হচ্ছে।' (ইউনুসঃ ৫২)।

মৃত্যুকে দুম্বার আকারে নিয়ে এসে যবেহ করা হবে এবং বলা হবে, হে জান্নাতীগণ! তোমরা চিরকাল বাস কর, আর কোন মৃত্যু নেই। হে জাহান্নামীগণ! তোমরা চিরকাল বাস কর, আর কোন মৃত্যু নেই।” (বুখারী, মুসলিম)। মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَنذِرْهُمْ يَوْمَ الْحَسْرَةِ إِذْ قُضِيَ الْأَمْرُ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ وَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ

অর্থাৎ, (হে রসূল!) তুমি তাদেরকে সতর্ক করে দাও পরিতাপের দিন সম্বন্ধে, যেদিন সকল সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাবে; অথচ (এখন) তারা উদাসীন আছে এবং তারা বিশ্বাস করে না। (মারয়্যামঃ ৩৯)

জাহান্নাম কাফের ও মুশরিকদের স্থায়ী বাসস্থান

জান্নাত যেমন মুমিনদের স্থায়ী বাসঘর, তেমনি জাহান্নামও কাফেরদের স্থায়ী আবাসস্থল। সেটাই তাদের বিশ্রামাগার; যদিও কোন বিশ্রাম তাদের নেই৷ সেটাই তাদের শয়নাগার; যদিও শয়নে কোন আরাম তাদের নেই। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَأْوَاهُمُ النَّارُ ۚ وَبِئْسَ مَثْوَى الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, জাহান্নাম হবে তাদের নিবাস। আর অনাচারীদের আবাসস্থল অতি নিকৃষ্ট! (আলে ইমরানঃ ১৫ ১)

أُولَٰئِكَ مَأْوَاهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

অর্থাৎ, এই লোকদের নিজেদের কৃতকর্মের ফলে ঠিকানা হবে জাহান্নাম। (ইউনুসঃ ৮)

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ كَذَّبَ بِالْحَقِّ لَمَّا جَاءَهُ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْكَافِرِينَ

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে অথবা তার নিকট হতে আগত সত্যকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তার অপেক্ষা অধিক সীমালংঘনকারী আর কে? অবিশ্বাসীদের আশ্রয়স্থল কি জাহান্নামে নয়? (আনকাবুতঃ ৬৮)।

فَالْيَوْمَ لَا يُؤْخَذُ مِنكُمْ فِدْيَةٌ وَلَا مِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا ۚ مَأْوَاكُمُ النَّارُ ۖ هِيَ مَوْلَاكُمْ ۖ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ

অর্থাৎ, আজ তোমাদের নিকট হতে কোন মুক্তিপণ গ্রহণ করা হবে না এবং যারা অবিশ্বাস করেছিল তাদের নিকট হতেও নয়। তোমাদের আবাসস্থল জাহান্নাম, এটাই তোমাদের চিরসঙ্গী। আর কত নিকৃষ্ট এই পরিণাম!' (হাদীদঃ ১৫)

وَإِذَا قِيلَ لَهُ اتَّقِ اللَّهَ أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْإِثْمِ ۚ فَحَسْبُهُ جَهَنَّمُ ۚ وَلَبِئْسَ الْمِهَادُ

অর্থাৎ, যখন তাকে বলা হয়, তুমি আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার আত্মাভিমান তাকে অধিকতর পাপাচারে লিপ্ত করে। সুতরাং তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট এবং নিশ্চয়ই তা অতি মন্দ শয়নাগার। (বাক্বারাহঃ ২০৬)

هَٰذَا ۚ وَإِنَّ لِلطَّاغِينَ لَشَرَّ مَآبٍ (55) جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا فَبِئْسَ الْمِهَا

অর্থাৎ, জাহান্নাম, সেখানে ওরা প্রবেশ করবে, সুতরাং কত নিকৃষ্ট সে শয়নাগার। (স্বাদঃ ৫৬)

فَأُولَٰئِكَ مَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ ۖ وَسَاءَتْ مَصِيرًا

অর্থাৎ, এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কত নিকৃষ্ট আবাস! (নিসাঃ ৯৭)

إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا ۚ وَإِن يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاءٍ كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ ۚ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءَتْ مُرْتَفَقًا

অর্থাৎ, আমি সীমালংঘনকারীদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি অগ্নি, যার বেষ্টনী তাদেরকে পরিবেষ্টন করে থাকবে। তারা পানীয় চাইলে তাদেরকে দেওয়া হবে গলিত ধাতুর ন্যায় পানীয়; যা তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে; কত নিকৃষ্ট সেই পানীয় এবং কত নিকৃষ্ট সেই (অগ্নির) আশ্রয়স্থল। (কাহ্‌ফঃ ২৯)।

إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا

অর্থাৎ, নিশ্চয় তা আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসাবে অতীব নিকৃষ্ট! (ফুরকানঃ ৬৬)

চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার প্রধান প্রধান কারণ

প্রত্যেক শাস্তির একটা সীমা আছে। কিন্তু সে কোন্ অপরাধ যার শাস্তি অসীম? কুরআন কারীম যারা (অর্থসহ) পড়েন, তাঁরা অবশ্যই সেই সকল অপরাধ সম্বন্ধে অবহিত হবেন। এখানে কতিপয় অপরাধের কথা উল্লেখ করা হলঃ

১। কুফরী ও শির্কঃ

প্রত্যেক কাফের মুশরিক নাও হতে পারে। তবে প্রত্যেক মুশরিক অবশ্যই কাফের। সুতরাং আমভাবে কুফরী এমন এক অপরাধ, যার জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম ভোগ করতে হবে। কুফরী মানে অস্বীকার, অবিশ্বাস; আল্লাহকে অবিশ্বাস অথবা আল্লাহর কিছুকে অবিশ্বাস। কপটতা বা মুনাফিকীর কুফরী, সন্দেহ পোষণের কুফরী, কিছুতে বিশ্বাস ও কিছুতে অবিশ্বাসের কুফরী, আদেশ-নিষেধ অমান্য করার কুফরী ইত্যাদি। মহান আল্লাহ বলেন,

قَالُوا رَبَّنَا أَمَتَّنَا اثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا اثْنَتَيْنِ فَاعْتَرَفْنَا بِذُنُوبِنَا فَهَلْ إِلَىٰ خُرُوجٍ مِّن سَبِيلٍ (11) ذَٰلِكُم بِأَنَّهُ إِذَا دُعِيَ اللَّهُ وَحْدَهُ كَفَرْتُمْ ۖ وَإِن يُشْرَكْ بِهِ تُؤْمِنُوا ۚ فَالْحُكْمُ لِلَّهِ الْعَلِيِّ الْكَبِيرِ (12)

অর্থাৎ, ওরা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের দু’বার মৃত্যু দিয়েছ এবং দু’বার আমাদেরকে জীবিত করেছ। আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করলাম। এখন নিষ্কৃতির কোন পথ মিলবে কি?’ ওদেরকে বলা হবে, তোমাদের এ শাস্তি তো এ জন্যে যে, যখন এককভাবে আল্লাহকে আহবান করা হত, তখন তোমরা তাঁকে অস্বীকার করতে। আর তার শরীক স্থির করা হলে তোমরা বিশ্বাস করতে। সুতরাং সুউচ্চ, মহান আল্লাহরই সমস্ত কর্তৃত্ব।” (মু'মিনঃ ১১-১২)।

قَالُوا أَوَلَمْ تَكُ تَأْتِيكُمْ رُسُلُكُم بِالْبَيِّنَاتِ ۖ قَالُوا بَلَىٰ ۚ قَالُوا فَادْعُوا ۗ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ

অর্থাৎ, তারা বলবে, তোমাদের নিকট কি স্পষ্ট নিদর্শনাবলী সহ তোমাদের রসূলগণ আসেনি?’ (জাহান্নামীরা) বলবে, অবশ্যই এসেছিল। (প্রহরীরা) বলবে, তবে তোমরা প্রার্থনা করতে থাক। আর সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের প্রার্থনা ব্যর্থই হয়।' (মু'মিনঃ ৫০)

الَّذِينَ كَذَّبُوا بِالْكِتَابِ وَبِمَا أَرْسَلْنَا بِهِ رُسُلَنَا ۖ فَسَوْفَ يَعْلَمُونَ (70) إِذِ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ وَالسَّلَاسِلُ يُسْحَبُونَ (71) فِي الْحَمِيمِ ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُونَ (72) ثُمَّ قِيلَ لَهُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ تُشْرِكُونَ (73) مِن دُونِ اللَّهِ ۖ قَالُوا ضَلُّوا عَنَّا بَل لَّمْ نَكُن نَّدْعُو مِن قَبْلُ شَيْئًا ۚ كَذَٰلِكَ يُضِلُّ اللَّهُ الْكَافِرِينَ (74) ذَٰلِكُم بِمَا كُنتُمْ تَفْرَحُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَبِمَا كُنتُمْ تَمْرَحُونَ (75) ادْخُلُوا أَبْوَابَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۖ فَبِئْسَ مَثْوَى الْمُتَكَبِّرِينَ (76)

অর্থাৎ, ওরা গ্রন্থ ও আমার রসূলদেরকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছিলাম, তা মিথ্যাজ্ঞান করে। সুতরাং শীঘ্রই ওরা জানতে পারবে। যখন ওদের গলদেশে বেড়ি ও শিকল থাকবে, ওদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর ওদেরকে অগ্নিতে দগ্ধ করা হবে; পরে ওদেরকে বলা হবে, কোথায় তারা, যাদেরকে তোমরা শরীক করতে---আল্লাহকে ছেড়ে?’ ওরা বলবে, ওরা তো আমাদের নিকট থেকে অদৃশ্য হয়েছে; বরং পূর্বে আমরা এমন কিছুকে আহবান করিনি, যার কোন সত্তা ছিল। এভাবে আল্লাহ অবিশ্বাসীদেরকে বিভ্রান্ত করে থাকেন। এটা এ কারণে যে, তোমরা পৃথিবীতে অযথা আনন্দ করতে ও দম্ভ করতে। ওদেরকে বলা হবে, জাহান্নামে চিরকাল বসবাসের জন্য ওতে প্রবেশ কর, কত নিকৃষ্ট উদ্ধতদের আবাসস্থল। (মু'মিনঃ ৭০-৭৬)।

مَّنْ أَعْرَضَ عَنْهُ فَإِنَّهُ يَحْمِلُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وِزْرًا (100) خَالِدِينَ فِيهِ ۖ وَسَاءَ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حِمْلًا (101)

অর্থাৎ, যে কেউ এ হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে, ফলতঃ সে কিয়ামতের দিন (মহাপাপের) বোঝা বহন করবে। ঐ (পাপের শাস্তি)তে ওরা স্থায়ী হবে এবং কিয়ামতের দিন এই বোঝা ওদের জন্য কত মন্দ হবে। (ত্বহাঃ ১০০- ১০১)।

وَقِيلَ لَهُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ تَعْبُدُونَ (92) مِن دُونِ اللَّهِ هَلْ يَنصُرُونَكُمْ أَوْ يَنتَصِرُونَ (93) فَكُبْكِبُوا فِيهَا هُمْ وَالْغَاوُونَ (94) وَجُنُودُ إِبْلِيسَ أَجْمَعُونَ (95) قَالُوا وَهُمْ فِيهَا يَخْتَصِمُونَ (96) تَاللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ (97) إِذْ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ الْعَالَمِينَ (98)

অর্থাৎ, ওদের বলা হবে, তারা কোথায় যাদের তোমরা উপাসনা করতে; আল্লাহর পরিবর্তে? ওরা কি তোমাদের সাহায্য করতে আসবে? না ওরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম? অতঃপর ওদের এবং পথভ্রষ্টদের অধােমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং ইবলীসের বাহিনীর সকলকেও। ওরা সেখানে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে বলবে, আল্লাহর শপথ! আমরা তো স্পষ্ট বিভ্রান্তিতেই ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে বিশ্বজগতের প্রতিপালকের সমকক্ষ গণ্য করতাম।' (শুআরাঃ ৯২-৯৮)।

بَلْ كَذَّبُوا بِالسَّاعَةِ ۖ وَأَعْتَدْنَا لِمَن كَذَّبَ بِالسَّاعَةِ سَعِيرًا

অর্থাৎ, বরং ওরা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে। আর যারা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে, তাদের জন্য আমি জ্বলন্ত জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছি। (ফুরকানঃ ১১)।

وَإِن تَعْجَبْ فَعَجَبٌ قَوْلُهُمْ أَإِذَا كُنَّا تُرَابًا أَإِنَّا لَفِي خَلْقٍ جَدِيدٍ ۗ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ الْأَغْلَالُ فِي أَعْنَاقِهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অর্থাৎ, যদি তুমি বিস্মিত হও, তাহলে বিস্ময়ের বিষয় তাদের কথা, (মৃত্যুর পর) মাটিতে পরিণত হওয়ার পরও কি আমরা নতুন জীবন লাভ করব?’ ওরাই ওদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে এবং ওদেরই গলদেশে থাকবে বেড়ি। ওরাই হবে দোযখবাসী, সেখানে ওরা চিরস্থায়ীভাবে বাস করবে। (রাদঃ ৫)।

২। কিয়ামত মিথ্যা মনে করার সাথে শরীয়তের আহকাম পালন না করা।

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

فِي جَنَّاتٍ يَتَسَاءَلُونَ (40) عَنِ الْمُجْرِمِينَ (41) مَا سَلَكَكُمْ فِي سَقَرَ (42) قَالُوا لَمْ نَكُ مِنَ الْمُصَلِّينَ (43) وَلَمْ نَكُ نُطْعِمُ الْمِسْكِينَ (44) وَكُنَّا نَخُوضُ مَعَ الْخَائِضِينَ (45) وَكُنَّا نُكَذِّبُ بِيَوْمِ الدِّينِ (46) حَتَّىٰ أَتَانَا الْيَقِينُ (47) فَمَا تَنفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ (48)

অর্থাৎ, তারা থাকবে জান্নাতে এবং তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবে--- অপরাধীদের সম্পর্কে, তোমাদেরকে কিসে সাক্বার (জাহান্নাম)এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাযীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। আমরা অভাবগ্রস্তদেরকে অন্নদান করতাম না এবং আমরা সমালোচনাকারীদের সাথে সমালোচনায় নিমগ্ন থাকতাম। আমরা কর্মফল দিবসকে মিথ্যা মনে করতাম। পরিশেষে আমাদের নিকট মৃত্যু আগমন করল। ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। (মুদ্দাস্‌সিরঃ ৪০- ৪৮)

৩। ভ্রষ্ট নেতা-বুযুর্গদের অনুসরণ করাঃ

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِن يَصْبِرُوا فَالنَّارُ مَثْوًى لَّهُمْ ۖ وَإِن يَسْتَعْتِبُوا فَمَا هُم مِّنَ الْمُعْتَبِينَ (24) وَقَيَّضْنَا لَهُمْ قُرَنَاءَ فَزَيَّنُوا لَهُم مَّا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَحَقَّ عَلَيْهِمُ الْقَوْلُ فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِم مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ ۖ إِنَّهُمْ كَانُوا خَاسِرِينَ (25)

অর্থাৎ, এখন ওরা ধৈর্যশীল হলেও জাহান্নামই হবে ওদের আবাস এবং ওরা ক্ষমাপ্রার্থী হলেও ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না। আমি ওদের সঙ্গী দিয়েছিলাম, যারা ওদের অতীত ও ভবিষ্যৎকে ওদের দৃষ্টিতে সুশোভিত করে দেখিয়েছিল। ওদের ব্যাপারে ওদের পূর্ববর্তী জ্বিন এবং মানুষদের ন্যায় শাস্তির কথা বাস্তব হয়েছে। নিশ্চয় ওরা ছিল ক্ষতিগ্রস্ত। (হা-মীম সাজদাহঃ ২৪-২৫)

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُولُونَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللَّهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُولَا (66) وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا (67) رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا (68)

অর্থাৎ, যেদিন অগ্নিতে ওদের মুখমণ্ডল উল্টেপাল্টে দগ্ধ করা হবে সেদিন ওরা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহর আনুগত্য করতাম ও রসূল (ﷺ)কে মান্য করতাম!' তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় বড় লোক (বুযুর্গদের আনুগত্য করেছিলাম, সুতরাং ওরা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! ওদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং মহা অভিসম্পাত কর।” (আহযাবঃ ৬৬-৬৮)

৪৷ মুনাফিকী, কপটতাঃ

অপরাধের দিক থেকে কুফরীর চাইতে মুনাফিকী অধিকতর সাংঘাতিক। তাই তার শাস্তিও অধিক। মহান আল্লাহ বলেন,

وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ هِيَ حَسْبُهُمْ ۚ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ ۖ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيمٌ

অর্থাৎ, আল্লাহ মুনাফিক্‌ পুরুষ, মুনাফিক্‌ নারী ও কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে, এটা তাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী শাস্তি। (তাওবাহঃ ৬৮)

إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا

অর্থাৎ, মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা অবশ্যই দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে এবং তাদের জন্য তুমি কখনও কোন সাহায্যকারী পাবে না। (নিসাঃ ১৪৫)

৫। অহংকারঃ

স্বৈরাচারী অহংকারীদের জন্য জাহান্নাম। এই অহংকারের ফলে মানুষ সত্য প্রত্যাখ্যান করে। ঈমান আনতে নাক সিঁটকায়, মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করে। অহংকারী জাহান্নামীদের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِينَ كَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَاسْتَكْبَرُوا عَنْهَا أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অর্থাৎ, আর যারা আমার নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা মনে করেছে এবং অহংকারে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (আরাফঃ ৩৬)

وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ تَرَى الَّذِينَ كَذَبُوا عَلَى اللَّهِ وُجُوهُهُم مُّسْوَدَّةٌ ۚ أَلَيْسَ فِي جَهَنَّمَ مَثْوًى لِّلْمُتَكَبِّرِينَ

অর্থাৎ, যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তুমি কিয়ামতের দিন তাদের মুখ কালো দেখবে। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি? (যুমারঃ ৬০)।

وَيَوْمَ يُعْرَضُ الَّذِينَ كَفَرُوا عَلَى النَّارِ أَذْهَبْتُمْ طَيِّبَاتِكُمْ فِي حَيَاتِكُمُ الدُّنْيَا وَاسْتَمْتَعْتُم بِهَا فَالْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَبِمَا كُنتُمْ تَفْسُقُونَ

অর্থাৎ, যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তুমি কিয়ামতের দিন তাদের মুখ কালো দেখবে। অহংকারীদের আবাসস্থল জাহান্নাম নয় কি? (আহক্বাফঃ ২০)

মহানবী (ﷺ) বলেন, “জান্নাত ও জাহান্নামের বিবাদ হল। জাহান্নাম বলল, আমার মধ্যে উদ্ধত ও অহংকারী লোকেরা থাকবে। আর জান্নাত বলল, ‘দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা আমার ভিতরে বসবাস করবে। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে ফায়সালা করলেন যে, তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। এবং তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেব। আর তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব।” (মুসলিম)।

আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “আমি তোমাদেরকে দোযখবাসী কারা তা বলে দেব না কি? প্রত্যেক রূঢ়-স্বভাব, দাম্ভিক, অহংকারী ব্যক্তি।” (বুখারী ৪৯১৮, মুসলিম ২৮৫৩নং)।

একদা নবী (ﷺ) বললেন, “যার হৃদয়ে অণু পরিমাণও অহংকার থাকবে সে জান্নাতে যাবে না।” এক ব্যক্তি বলল, লোকে তো পছন্দ করে যে, তার পোশাক ও জুতা সুন্দর হােক (তাহলে সে ব্যক্তির কি হবে?) নবী (ﷺ) বললেন, “অবশ্যই আল্লাহ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্য পছন্দ করেন। (সুতরাং সুন্দর জামা-পোষাক পরায় অহংকার নেই।) অহংকার হল, হক (সত্য) প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে ঘৃণা করার নাম।” (মুসলিম ৯১নং, তিরমিযী, হাকেম ১/২৬)।

প্রকাশ থাকে যে, কুফরী ছাড়া কাবীরা গোনাহর জন্য কোন মুমিন জাহান্নামে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে না। যার বুকে সরিষার দানা পরিমান ঈমান থাকবে, সে একদিন না একদিন জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে। যদিও খুনীর ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَمَن يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا

অর্থাৎ, যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন। (নিসাঃ ৯৩)

আর সুদখোরের ব্যাপারে বলেছেন,

الَّذِينَ يَأْكُلُونَ الرِّبَا لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ الَّذِي يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا ۗ وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ۚ فَمَن جَاءَهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىٰ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَمَنْ عَادَ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

অর্থাৎ, যারা সুদ খায় তারা (কিয়ামতে) সেই ব্যক্তির মত দন্ডায়মান হবে, যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে দিয়েছে। তা এ জন্য যে তারা বলে, ব্যবসা তো সুদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে বৈধ ও সুদকে অবৈধ করেছেন। অতএব যার কাছে তার প্রতিপালকের উপদেশ এসেছে, তারপর সে (সুদ খাওয়া থেকে) বিরত হয়েছে, সুতরাং (নিষিদ্ধ হওয়ার পূর্বে) যা অতীত হয়েছে, তা তার (জন্য ক্ষমার্হ হবে), আর তার ব্যাপার আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। কিন্তু যারা পুনরায় (সুদ খেতে) আরম্ভ করবে, তারাই দোযখবাসী; সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। (বাক্বারাহঃ ২৭৫)

তবুও অন্যান্য আয়াত ও হাদীসের ভিত্তিতে উক্ত শাস্তির ঘোষণাকে ধমক বলে মানতে হবে। অর্থাৎ, কোন মুসলিমের বুকে যদি তাওহীদ থাকে, তাহলে সে একদিন না একদিন মুক্তি পাবে; যদিও শাস্তি ভোগার পরে। যেহেতুঃ

একদা জিবরীল (আঃ) নবী (ﷺ)-কে বললেন, “আপনার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (নবী (ﷺ) বলেন, আমি বললাম, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে তবুও কি?” তিনি বললেন, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে।” (বুখারী ও মুসলিম)।

মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে (কলেমা) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলে, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেন।” (বুখারী, মুসলিম)

উপর্যুক্ত আয়াত দু’টিতে শাস্তি হিসাবে চিরস্থায়ী জাহান্নামের কথা যে বর্ণিত হয়েছে, তার অর্থ হল, সে যদি তওবা না করে, তাহলে তার শাস্তি এটাই হবে, যা মহান আল্লাহ তার অপরাধের দরুন তাকে দিতে পারেন। অনুরূপ তওবা না করা অবস্থায় চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার অর্থ হল, তাতে সুদীর্ঘ কাল অবস্থান করতে হবে। কারণ, কাফের ও মুশরিকরাই কেবল জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। তাছাড়া সুদ ও হত্যার সম্পর্ক যদিও বান্দার অধিকারের সাথে, যা থেকে তওবার মাধ্যমেও দায়িত্বমুক্ত হওয়া যায় না, তবুও আল্লাহ তাআলা স্বীয় কৃপা ও অনুগ্রহে তার এমনভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেন যে, নিহিত ব্যক্তিও প্রতিদান পেয়ে যাবে এবং সুদখোর ও হত্যাকারীরও মাফ হয়ে যাবে। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল কাদীর)

এমনিতে প্রত্যেক মহাপাপ ও অতি মহাপাপই জাহান্নামীর কাজ। তবে মহাপাপ আল্লাহ ইচ্ছা করলে ক্ষমা করতে পারেন, নচেৎ শাস্তি ভোগাতে পারেন। তবে অতি মহাপাপ অমার্জনীয় অপরাধ। যে যে কাজের জন্য জাহান্নাম যেতে হবে, তার কিছু নিম্নরূপঃ

কুফরী করা, শির্ক করা, বিদআত করা, কপটতা করা, আল্লাহ বা তার রসূলের নামে মিথ্যা বলা, মিথ্যা কথা বলা, হিংসা করা, আমানতে খিয়ানত করা, যুলুম করা, ব্যভিচার করা, ধোকা দেওয়া, ফাঁকি দেওয়া, আত্মীয়তার বন্ধন ছেদন করা, জিহাদ বর্জন করা, কার্পণ্য করা, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া, আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ ভাবা, বিপদে অধৈর্য হওয়া, গর্ব করা, অহংকার করা, আল্লাহর কোন ফরয ত্যাগ করা, কোন নিষিদ্ধ কর্ম করা, তার সীমা লংঘন করা, আল্লাহর মত অন্য কাউকে ভালবাসা অথবা ভয় করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপর ভরসা রাখা, লোকদেখানি কাজ করা, বাতিলের পক্ষপাতিত্ব করা, আল্লাহ, রসূল (ﷺ) বা দ্বীনের কোন বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা, সত্য প্রত্যাখ্যান করা, সত্য গোপন করা, সত্য সাক্ষ্য না দেওয়া, যাদু করা, মা-বাপের অবাধ্য হওয়া, স্বামীর অবাধ্য হওয়া, অবৈধ প্রাণ হত্যা করা, এতীমের মাল ভক্ষণ করা, সুদ খাওয়া, ঘুস খাওয়া, চুরি-ডাকাতি করা, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা, মিথ্যা কলঙ্ক রটানো, অপবাদ দেওয়া, ইত্যাদি।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “জাহান্নামবাসী পাঁচ ব্যক্তি; (১) সেই দুর্বল শ্রেণীর ব্যক্তি, যার (পাপ ও অন্যায় থেকে দুরে থাকার মত) জ্ঞান নেই। যারা তোমাদের অনুগত, যারা পরিবার চায় না, ধন-সম্পদও চায় না। (২) খিয়ানতকারী ব্যক্তি, যে তুচ্ছ কোন জিনিসের লোভে পড়লেই তাতে খিয়ানত করে। (৩) এমন ব্যক্তি, যে সকাল-সন্ধ্যায় তোমার পরিবার ও সম্পদের ব্যাপারে ধোকা দেয়। (৪) কৃপণ ব্যক্তি এবং (৫) দুশ্চরিত্র চোয়াড়।” (মুসলিম ৭৩৮৬নং)

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, কোন আমল মানুষকে বেশি জান্নাতে নিয়ে যাবে? তিনি বললেন, “আল্লাহভীতি ও সচ্চরিত্র।” আর তাঁকে (এটাও) জিজ্ঞাসা করা হল যে, কোন আমল মানুষকে বেশি জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বললেন, “মুখ ও যৌনাঙ্গ (অর্থাৎ, উভয় দ্বারা সংঘটিত পাপ)।” (তিরমিযী হাসান সহীহ সূত্রে)

নির্দিষ্ট কতিপয় জাহান্নামী ব্যক্তি

কেউ জান্নাতের কাজ করলেই তাকে জান্নাতী এবং জাহান্নামের কাজ করলেই তাকে জাহান্নামী মনে করা ঠিক নয়। কারণ হতে পারে, সে মরণের পূর্বে অথবা আল্লাহর কাছে তার বিপরীত হতে পারে। তবে শরীয়ত নির্দিষ্টভাবে যাকে জাহান্নামী বলে উল্লেখ করেছে, তাকে জাহান্নামী মনে করতে হবে। যেমনঃ ফিরআউন। মহান আল্লাহ তার সম্বন্ধে বলেছেন,

يَقْدُمُ قَوْمَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَوْرَدَهُمُ النَّارَ ۖ وَبِئْسَ الْوِرْدُ الْمَوْرُودُ

অর্থাৎ, কিয়ামতের দিন সে নিজ সম্প্রদায়ের অগ্রভাগে থাকবে, অতঃপর তাদেরকে উপনীত করবে দোযখে। আর তা অতি নিকৃষ্ট স্থান যাতে তারা উপনীত হবে। (হূদঃ ৯৮)

নূহ ও লূত (আলাইহিমাস সালাম)-এর স্ত্রী ও মহান আল্লাহ তাদের সম্বন্ধে বলেন,

ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ كَفَرُوا امْرَأَتَ نُوحٍ وَامْرَأَتَ لُوطٍ ۖ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ

অর্থাৎ, আল্লাহ অবিশ্বাসীদের জন্য নূহ ও লুতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছেন; তারা ছিল আমার দাসদের মধ্যে দুই সৎকর্মপরায়ণ দাসের অধীন। কিন্তু তারা তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ফলে তারা (নূহ ও লূত) তাদেরকে আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা করতে পারল না এবং তাদেরকে বলা হল, ‘জাহান্নামে প্রবেশকারীদের সাথে তোমরাও তাতে প্রবেশ কর। (তাহরীমঃ ১০)

এখানে খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা বলতে দাম্পত্যের খিয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা উদ্দেশ্য নয়। কেননা, এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, কোন নবীর স্ত্রী ব্যভিচারিণী ছিলেন না। (ফাতহুল কাদীর) খিয়ানত বলতে বুঝানো হয়েছে, এরা তাদের স্বামীদের উপর ঈমান আনেনি। তারা মুনাফিক্বী ও কপটতায় লিপ্ত ছিল এবং নিজেদের কাফের জাতির প্রতি তারা সমবেদনা পোষণ করত। যেমন, নূহ (আঃ)-এর স্ত্রী নূহ (আঃ)-এর ব্যাপারে লোকদেরকে বলে বেড়াত যে, এ একজন পাগল। আর লূত (আঃ)-এর স্ত্রী তার গোত্রের লোকদেরকে নিজ বাড়ীতে আগত অতিথির সংবাদ পৌছে দিত। কেউ কেউ বলেন, এরা উভয়ই তাদের জাতির লোকদের মাঝে নিজ নিজ স্বামীর চুগলি করে বেড়াত।

নূহ (আঃ) এবং লূত (আঃ) তাঁরা উভয়েই ছিলেন আল্লাহর পয়গম্বর, আর পয়গম্বররা আল্লাহর অতি নিকটতম বান্দাদের মধ্যে গণ্য হন, তা সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের স্ত্রীদেরকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবেন না।

আবু লাহাব ও তার স্ত্রী ও তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন,

تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ (1) مَا أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ (2) سَيَصْلَىٰ نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ (3) وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ (4) فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ (5)

অর্থাৎ, ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন উপকারে আসবে না। অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট (জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে এবং তার স্ত্রীও; যে ইন্ধন বহন করে। তার গলদেশে থাকবে খেজুর আঁশের পাকানো রশি। (সূরাঃ লাহাব)

আমর বিন আমের আল-খুযায়ীঃ মহানবী (ﷺ) তাকে জাহান্নামে নিজেরনাড়িভুড়ি টেনে নিয়ে বেড়াতে দেখেছেন। (বুখারী, মুসলিম, আহমাদ)

আম্মার (রাঃ)-এর ঘাতক ও তার ব্যাপারে মহানবী (ﷺ) বলেছেন, “সে জাহান্নামী।” (সঃ জামে’ ৪১৭০নং)

মানুষের মতই জ্বিনদেরও ভাল-মন্দ উভয়ই আছে। ভাল জ্বিনরা যেমন জান্নাতে যাবে, তেমনি খারাপ জ্বিনরা যাবে জাহান্নামে৷ মহান আল্লাহ উভয় জাতিকেই ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

অর্থাৎ, আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন ও মানুষকে কেবল এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। (যারিয়াতঃ ৫৬)

সুতরাং ইবাদত না করলে জাহান্নামে যেতে হবে। জ্বিনকেও হাশরের ময়দানে জমায়েত করা হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন,

وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ قَدِ اسْتَكْثَرْتُم مِّنَ الْإِنسِ ۖ وَقَالَ أَوْلِيَاؤُهُم مِّنَ الْإِنسِ رَبَّنَا اسْتَمْتَعَ بَعْضُنَا بِبَعْضٍ وَبَلَغْنَا أَجَلَنَا الَّذِي أَجَّلْتَ لَنَا ۚ قَالَ النَّارُ مَثْوَاكُمْ خَالِدِينَ فِيهَا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۗ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ

অর্থাৎ, যেদিন তিনি তাদের সকলকে একত্র করবেন (এবং বলবেন,) ‘হে জিন সম্প্রদায়! তোমরা অনেক মানুষকে তোমাদের অনুগত করেছিলে। আর মানব-সমাজের মধ্যে তাদের বন্ধুগণ বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক। আমরা পরস্পর পরস্পর দ্বারা লাভবান হয়েছি এবং তুমি আমাদের জন্য যে সময় নির্ধারিত করেছিলে এখন আমরা তাতে উপনীত হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামই তোমাদের বাসস্থান, সেখানে তোমরা চিরদিন থাকবে; যদি না আল্লাহ অন্য রকম ইচ্ছা করেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত। (আনআমঃ ১২৮)

فَوَرَبِّكَ لَنَحْشُرَنَّهُمْ وَالشَّيَاطِينَ ثُمَّ لَنُحْضِرَنَّهُمْ حَوْلَ جَهَنَّمَ جِثِيًّا (68) ثُمَّ لَنَنزِعَنَّ مِن كُلِّ شِيعَةٍ أَيُّهُمْ أَشَدُّ عَلَى الرَّحْمَٰنِ عِتِيًّا (69) ثُمَّ لَنَحْنُ أَعْلَمُ بِالَّذِينَ هُمْ أَوْلَىٰ بِهَا صِلِيًّا (70)

অর্থাৎ, সুতরাং শপথ তোমার প্রতিপালকের! আমি অবশ্যই তাদেরকে এবং শয়তানদেরকে সমবেত করব। অতঃপর আমি অবশ্যই তাদেরকে নতজানু অবস্থায় জাহান্নামের চতুর্দিকে উপস্থিত করব। অতঃপর প্রত্যেক দলের মধ্যে যে পরম দয়াময়ের প্রতি সর্বাধিক অবাধ্য আমি তাকে টেনে অবশ্যই বের করব। তারপর আমি অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা জাহান্নাম প্রবেশের অধিকতর যোগ্য তাদের বিষয়ে অধিক অবগত। (মারয়ামঃ ৬৮-৭০)

জাহান্নামে প্রবেশ করতে আদেশ দিয়ে বলা হবে,

ادْخُلُوا فِي أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِكُم مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ فِي النَّارِ ۖ كُلَّمَا دَخَلَتْ أُمَّةٌ لَّعَنَتْ أُخْتَهَا ۖ حَتَّىٰ إِذَا ادَّارَكُوا فِيهَا جَمِيعًا قَالَتْ أُخْرَاهُمْ لِأُولَاهُمْ رَبَّنَا هَٰؤُلَاءِ أَضَلُّونَا فَآتِهِمْ عَذَابًا ضِعْفًا مِّنَ النَّارِ ۖ قَالَ لِكُلٍّ ضِعْفٌ وَلَٰكِن لَّا تَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, তোমাদের পূর্বে যে জ্বিন ও মানবদল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা দোযখে প্রবেশ কর। যখনই কোন দল তাতে প্রবেশ করবে, তখনই অপর দলকে তারা অভিসম্পাত করবে। পরিশেষে যখন সকলে। ওতে একত্র হবে, তখন তাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! ওরাই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল, সুতরাং তুমি ওদেরকে দোযখের দ্বিগুণ শাস্তি দাও। আল্লাহ বলবেন, প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে; কিন্তু তোমরা জান না।' (আ'রাফ ৩৮) সুতরাং জ্বিনরা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَكُبْكِبُوا فِيهَا هُمْ وَالْغَاوُونَ (94) وَجُنُودُ إِبْلِيسَ أَجْمَعُونَ (95)

অর্থাৎ, অতঃপর ওদের এবং পথভ্রষ্টদের অধােমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে এবং ইবলীসের বাহিনীর সকলকেও। (শুআরাঃ ৯৪-৯৫)

মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি, তিনি জ্বিন-ইনসান দিয়ে জাহান্নাম পরিপূর্ণ করবেন। তিনি বলেছেন,

وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

অর্থাৎ, আমি জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই’ তোমার প্রতিপালকের এই বাণী পূর্ণ হবেই। (হূদঃ ১১৯)

পূর্বেই বলা হয়েছে, জাহান্নামীদের সংখ্যা জান্নাতীদের তুলনায় অনেক গুণ বেশি হবে। যেহেতু এ সংসারে অসৎ লোকের সংখ্যাই অধিক, আল্লাহর বাধ্য বান্দা কম, শয়তানের বাধ্য গোলামই বেশি। মানুষের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন,

وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ

অর্থাৎ, তুমি যতই আগ্রহী হও না কেন, অধিকাংশ লোকই বিশ্বাস করবার নয়। (ইউসুফঃ ১০৩)

وَلَقَدْ صَدَّقَ عَلَيْهِمْ إِبْلِيسُ ظَنَّهُ فَاتَّبَعُوهُ إِلَّا فَرِيقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ

অর্থাৎ, ওদের উপর ইবলীস তার অনুমান সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করল, ফলে ওদের মধ্যে একটি বিশ্বাসী দল ছাড়া সকলেই তার অনুসরণ করল। (সাবাঃ ২০)

তিনি শয়তানকে বিতাড়িত করার সময় বলেছিলেন,

لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنكَ وَمِمَّن تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ

অর্থাৎ, তোমার দ্বারা ও ওদের মধ্যে তোমার সকল অনুসারীদের দ্বারা আমি অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব।” (স্বাদঃ ৮৫)।

বলা বাহুল্য, অধিকাংশ জ্বিন-ইনসানই জাহান্নামের অধিবাসী।

মহান আল্লাহ আদম (আঃ)-কে আদেশ করবেন যে, যেন তিনি নিজ সন্তানদের মধ্য হতে হাজারে ৯৯৯ জনকে জাহান্নামের জন্য বের করে দেন। এই কথা শুনে গর্ভবতীরা তাদের গর্ভপাত করে ফেলবে, বালকরা বৃদ্ধ হয়ে পড়বে, আর মানুষকে দেখে মাতাল মনে হবে, অথচ তারা আসলে মাতাল হবে না; বরং আল্লাহর আযাবের ভয়াবহতার জন্য এ রকম (কিংকর্তব্যবিমূঢ়) হবে। সাহাবাদের কাছে এ কথা অত্যন্ত ভারী মনে হল, তাদের চেহারার রং পাল্টে গেল। নবী (ﷺ) তা দেখে বললেন ভয়ের কিছু নেই। ৯৯৯ জনের সংখ্যা য়্যা’জুজ-মাজুজের মধ্য হতে হবে আর তোমাদের মাত্র একজন। তোমাদের সংখ্যা অন্য মানুষদের তুলনায় এমন হবে, যেমন সাদা গরুর গায়ে একটি কালো লোম অথবা কালো গরুর গায়ে একটি সাদা লোম। আর আমি আশা করি যে, তোমরাই হবে জান্নাতের এক চতুর্থাংশ বা এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক। তা শুনে সাহাবারা আনন্দে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি উচ্চারিত করলেন। (বুখারী)

অন্য এক বর্ণনায় আছে, প্রত্যেক একশ’র মধ্যে ৯৯ জন জাহান্নামে যাবে। (বুখারী) হয়তো বা এ সংখ্যাতে য়্য’জুজ-মাজুজকে গণনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। আর আল্লাহই ভাল জানেন।

জাহান্নামবাসী অধিক হওয়ার কারণ এই নয় যে, অধিকাংশ মানুষের কাছে ইসলাম পৌঁছেনি। বরং অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেনি। যেহেতু যে মানুষের কাছে ইসলামের কথা পৌছেনি, মহান আল্লাহ তাকে শাস্তি দেবেন না। তিনি বলেছেন,

وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّىٰ نَبْعَثَ رَسُولًا

অর্থাৎ, আর আমি রসূল না পাঠানো পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দিই না। (বানী ইস্রাঈলঃ ১৫)।

আর তিনি প্রত্যেক জাতির ভিতরে রসূল বা সতর্ককারী পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন,

إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا ۚ وَإِن مِّنْ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٌ

অর্থাৎ, আমি তো তোমাকে সত্যসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; এমন কোন সম্প্রদায় নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয়নি। (ফাত্বিরঃ ২৪)

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

অর্থাৎ, অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রসূল পাঠিয়েছি এই নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও তাগূত থেকে দূরে থাক। (নাহলঃ ৩৬)

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ رَّسُولٌ

অর্থাৎ, প্রত্যেক উম্মতের জন্য এক একজন রসূল ছিল। (ইউনুসঃ ৪৭)

কিন্তু আম্বিয়ার দাওয়াত গ্রহণ না করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ জাহান্নামের উপযুক্ত হয়েছে।

এ গেল প্রত্যেক নবীর অনুসারীর কথা। পক্ষান্তরে শেষ নবীকে অধিকাংশ মানুষ অস্বীকার করল। আবার অনুসারীদের মধ্যেও নানা মতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে ৭৩টির মধ্যে ৭২টি জাহান্নামের উপযুক্ত হল। যার কারণ বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় যে, প্রবৃত্তি ও সন্দেহের বশবর্তী হয়েই অধিকাংশ মানুষ ভ্রষ্ট হয়েছে। যেহেতু মানুষের সৃষ্টিকর্তাই বলেছেন,

زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ

অর্থাৎ, নারী, সন্তান-সন্ততি, জমাকৃত সোনা-রূপার ভান্ডার, পছন্দসই (চিহ্নিত) ঘোড়া, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট লোভনীয় করা হয়েছে। এ সব ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহর নিকটেই উত্তম আশ্রয়স্থল রয়েছে। (আলে ইমরানঃ ১৪)।

আর সেই কারণেই জিবরীলের আশংকা সঠিক ছিল। মহান আল্লাহ যখন তাকে জাহান্নামের দিকে পাঠিয়ে বললেন, 'যাও, জাহান্নাম এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর।” তখন তিনি গেলেন এবং দেখলেন, তার আগুনের এক অংশ অপর অংশের উপর চেপে রয়েছে। অতঃপর তিনি ফিরে এসে বললেন, 'আপনার সম্মানের কসম! যে কেউ এর কথা শুনবে, সে এতে প্রবেশ করতে চাইবে না। তারপর জাহান্নামকে মনোলোভা জিনিসসমূহ দিয়ে ঘিরে দিতে আদেশ করলেন এবং পুনরায় তাকে বললেন, 'যাও, জাহান্নাম এবং তার অধিবাসীদের জন্য প্রস্তুতকৃত সামগ্রী দর্শন কর। সুতরাং তিনি গেলেন এবং দর্শন করে ফিরে এসে বললেন, 'আপনার সম্মানের কসম! আমার আশঙ্কা হয় যে, কেউ পরিত্রাণ পাবে না, সবাই তাতে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, সঃ তারগীব ৩৬৬৯নং)

অবশ্য সেই সাথে আরো একটি কারণ যুক্ত করা যায়, আর তা হল। দাদুপন্থীদের অন্ধানুকরণ। মহান আল্লাহ বলেন,

وَكَذَٰلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِّن نَّذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَىٰ أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَىٰ آثَارِهِم مُّقْتَدُونَ

অর্থাৎ, এভাবে তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখনই ওদের মধ্যে যারা বিত্তশালী ছিল তারা বলত, ‘আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এক মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।' (যুখরুফঃ ২৩)।

আর আসলে এ সবে রয়েছে মূলতঃ শয়তানের তাবেদারি। মহান আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ۚ أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطَانُ يَدْعُوهُمْ إِلَىٰ عَذَابِ السَّعِيرِ

অর্থাৎ, যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, আমাদের বাপ-দাদাকে যাতে পেয়েছি, আমরা তো তাই মেনে চলব। যদিও শয়তান তাদেরকে দোখযন্ত্রণার দিকে আহবান করে (তবুও কি তারা বাপ-দাদারই অনুসরণ করবে)? (লুকমানঃ ২১)

জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী মহিলা

যেমন পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, জাহান্নামীদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা বেশি। নবী (ﷺ) বলেছেন, “আমি বেহেশ্তের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশ অধিবাসীই গরীবদের দল। আর দোযখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশ অধিবাসীই মহিলা।” (বুখারী ও মুসলিম)

কুফরী ও শির্ক ছাড়াও এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার আরো অন্য কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে হাদীসে।

একদা নবী (ﷺ) (মহিলাদেরকে সম্বোধন করে) বললেন, “হে মহিলা সকল! তোমরা সাদকাহ-খয়রাত করতে থাক ও অধিকমাত্রায় ইস্তিগফার কর। কারণ আমি তোমাদেরকে জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসীরূপে দেখলাম।” একজন মহিলা নিবেদন করল, আমাদের অধিকাংশ জাহান্নামী হওয়ার কারণ কী? হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, “তোমরা অভিশাপ বেশি কর এবং নিজ স্বামীর অকৃতজ্ঞতা কর। বুদ্ধি ও ধর্মে অপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বিচক্ষণ ব্যক্তির উপর তোমাদের চাইতে আর কাউকে বেশি প্রভাব খাটাতে দেখিনি।” মহিলাটি আবার নিবেদন করল, ‘বুদ্ধি ও ধর্মের ক্ষেত্রে অপূর্ণতা কী? তিনি বললেন, “দু’জন নারীর সাক্ষ্য একটি পুরুষের সাক্ষ্য সমতুল্য। আর (প্রসবোত্তর খুন ও মাসিক আসার) দিনগুলিতে মহিলা নামায পড়া বন্ধ রাখে।” (মুসলিম)।

মহানবী (ﷺ) বলেন, “আমি দেখলাম, জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী হল মহিলা।” সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, তা কী জন্য হে আল্লাহর রসুল? তিনি বললেন, “তাদের কুফরীর জন্য। তারা বললেন, ‘আল্লাহর সাথে কুফরী? তিনি বললেন, “(না, তারা স্বামীর কুফরী (অকৃতজ্ঞতা) ও নিমকহারামি করে। তাদের কারো প্রতি যদি সারা জীবন এহসানী কর, অতঃপর সে যদি তোমার নিকট সামান্য ত্রুটি লক্ষ্য করে, তাহলে বলে বসে, তোমার নিকট কোন মঙ্গল দেখলাম না আমি!” (বুখারী, মুসলিম)।

দেখানো হচ্ছেঃ ৭১ থেকে ৮০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮৯ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 6 7 8 9 পরের পাতা »