কুরআনে কারীমে কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলো মানুষের এমন মানসিক অবস্থাকে বোঝায়, যা কোনো ভালো বা খারাপ কাজের কারণে তার মনে সৃষ্টি হয়। এসব অনুভূতির প্রকাশ কুরআনে কারীমে বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে করা হয়েছে, যেমন:
খাশিয়া (ভয় সহ শ্রদ্ধা),
খাওফ (ভয়),
ফাযাʼ (আতঙ্ক),
রু'ব (ভীতিকর আতঙ্ক),
রাহবা (আতঙ্ক সহ সাবধানতা),
ওয়াজাফ (কম্পন),
ওয়াজাল (ভীত সন্ত্রস্ত হওয়া)।
এই শব্দগুলোর মধ্যে সাধারণ কিছু মিল থাকলেও, কুরআনে ব্যবহৃত প্রসঙ্গ অনুযায়ী এদের মাঝে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্যও রয়েছে। আমাদের আলোচনায় আমরা প্রথমে এসব শব্দের ভাষাগত অর্থ তুলে ধরব, এরপর তাদের তাৎপর্যমূলক পার্থক্য ব্যাখ্যা করব।
১. আল-জাযা‘ (الجزع)
‘জাযাʼ শব্দের অর্থ এমন একটি দুঃখ বা কষ্ট, যা মানুষকে সে যেটা করছিল, তা করা থেকে বিচ্যুত করে। এর মূল অর্থ হলো: কোনো দড়িকে মাঝখান থেকে কেটে ফেলা। এটি ধৈর্যের বিপরীত। কুরআনে এটি এসেছে দুইবার:
ফেল করা অর্থে: {আমরা ধৈর্য ধরি বা চিৎকার করি, কিছুই তফাৎ হয় না} (ইব্রাহিম: ২১)
নামরূপে: {যখন বিপদ আসে, তখন সে হয়ে পড়ে অতিশয় জাজুয়া} (আল-মাআরিজ: ২০)
২. আল-হাযার (الحذر)
হাযার অর্থ এমন এক সতর্কতা, যা কোনো ভয়ের আশঙ্কায় নেওয়া হয়। কুরআনে এটি এসেছে ১৭ বার। যেমন:
ক্রিয়াপদ হিসেবে: {আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর কাছ থেকে সতর্ক করছেন} (আল-ইমরান: ২৮)
নামরূপে: {আমরা সবাই সতর্ক ছিলাম} (আশ-শু‘আরা: ৫৬)
৩. আল-খাশইয়া (الخشية)
খাশইয়া হলো এমন এক ধরনের ভয়, যা শ্রদ্ধা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে হয়। কুরআনে এটি এসেছে ২৩ বার। যেমন:
{আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী, তারাই ভয় করে} (ফাতির: ২৮)
৪. আল-খাওফ (الخوف)
খাওফ মানে হলো: এমন এক শঙ্কা, যার ভিত্তি হতে পারে কোনো অনুমান বা নিশ্চিত প্রমাণ। এটি আশা (রজা) ও ভরসার বিপরীত। কুরআনে এসেছে ৬৫ বার। যেমন,
{তারা তাঁর রহমত আশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে} (ইসরা: ৫৭)
৫. আর-রু‘ব (الرعب)
রু‘ব মানে হলো: এমন ভয়, যা সম্পূর্ণ আত্মার ভিতর কাঁপন ধরিয়ে দেয়। কুরআনে এসেছে ৫ বার:
{আমি কাফেরদের অন্তরে রু‘ব ছড়িয়ে দেব} (আলে ইমরান: ১৫১)
৬. আর-রাহবা (الرهبة)
রাহবা অর্থ: ভয় সহ নিরাপত্তার চেষ্টা, অভ্যন্তরীণ উদ্বেগ। কুরআনে এসেছে ৮ বার:
{তারা তাদের রবকে ভয় করে} (আল-আ‘রাফ: ১৫৪)
৭. আর-রওʼউ (الروع)
রওʼউ এর অর্থ হলো: হৃদয়ে ভয় বা আতঙ্কের অনুভূতি। কুরআনে একবার এসেছে:
{যখন ইব্রাহিমের কাছ থেকে আতঙ্ক দূর হয়ে গেল} (হূদ: ৭৪)
৮. আল-ফারক (الفرق)
ফারক মানে হলো: প্রচণ্ড ভয়। কুরআনে তা এসেছে একবার:
{তারা (মনাফিকরা) এমন এক সম্প্রদায় যারা ভয় পায়} (আত-তাওবা: ৫৬)
৯. আল-ফাযা‘ (الفزع)
ফাযা‘ অর্থ: হঠাৎ ভীত হওয়া, আতঙ্ক। কুরআনে তা এসেছে ৬ বার:
{তাদেরকে মহাআতঙ্ক কষ্ট দিবে না} (আল-আম্বিয়া: ১০৩)
১০. আল-হালাআ‘ (الهلع)
হালাআ‘ মানে হলো: সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ের অস্থিরতা ও আতঙ্ক। কুরআনে একবার:
{নিশ্চয় মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে হালুআ (অস্থির প্রকৃতির)} (আল-মাʼআরিজ: ১৯)
১১. আল-ওয়াজাফ (الوجف)
ওয়াজাফ অর্থ: কম্পন, হৃদয়ের কাঁপুনি। কুরআনে তা এসেছে একবার:
{সেদিন অনেক হৃদয় কাঁপবে} (আন-নাযিʼআত: ৮)
১২. আল-ওয়াজাল (الوجل)
ওয়াজাল মানে হলো: চিত্তে ভয়ের অনুভূতি। কুরআনে তা এসেছে ৫ বার। যেমন,
{যারা তাদের রবের যিকিরে ভীত হয়} (আল-হাজ্জ: ৩৫)
কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য:
১. খাওফ ও ওয়াজাল এর মধ্যে পার্থক্য
খাওফ: নিরেট ভয়ের অনুভব।
ওয়াজাল: সেই ভয় যার মধ্যে আত্মগ্লানি, কম্পন, আত্মবিস্ময় কাজ করে।
২. খাওফ ও রাহবা এর পার্থক্য
খাওফ: ভয় পাওয়ার সাধারণ অবস্থা।
রাহবা: সেই ভয় যা মানুষকে পালাতে বা গোপন হতে প্ররোচিত করে।
৩. খাওফ ও খাশইয়া এর পার্থক্য
খাওফ: কেবল ভয় (অন্তরাত্মায় সম্ভাব্য ক্ষতির অনুভব)।
খাশইয়া: জ্ঞান থেকে উদ্ভূত শ্রদ্ধাভয়ে কাঁপা।
৪. খাওফ ও হাযার এর পার্থক্য
খাওফ: এমন কিছুর ভয়, যা ঘটতে পারে।
হাযার: সাবধানতা অবলম্বন, এমনকি তা নিশ্চিত হুমকির ক্ষেত্রেও কার্যকর।
৫. খাওফ ও ফাযা‘ এর পার্থক্য
খাওফ: ধীরে গঠিত মানসিক অবস্থা।
ফাযা‘: হঠাৎ ভয়, যা তাৎক্ষণিক বিস্ময় সৃষ্টি করে।
৬. আল-জাযা ও আল-হালাআ‘ এর পার্থক্য
জাযা: সাধারণ আতঙ্ক বা অস্থিরতা।
হালাআ‘: সেই জাযা যা অতিমাত্রায় বাড়ে এবং দুর্বহ হয়ে ওঠে।