মুমিন অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, প্রতিকারের চেষ্টা করেন বা দাওয়াত দেন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাওয়াবের জন্য, জাগতিক ফলালল বা নিজের স্বার্থের জন্য নয়। কাজেই এক্ষেত্রে শরীয়ত সম্মত সুন্নাত পদ্ধতিতে দাওয়াত দিতে হবে, দাওয়াতের জন্য কোনো হারাম বা মাকরুহ কর্ম করা তো দূরের কথা, দাওয়াতের জন্য কোনো মুস্তাহাব কর্ম বর্জন করাও সুন্নাত বিরোধী। ‘‘আল্লাহর পথে দাওয়াত’’ পুস্তিকাতে আমি বিষয়টি আলোচনা করেছি। কিন্তু এ সকল আবেগতাড়িত মানুষ অন্যের জীবনে বা সমাজে ও রাষ্ট্রে ‘‘ইসলাম প্রতিষ্ঠা’’-র জন্য নিজের জীবনে ‘‘পাপ প্রতিষ্ঠা’’ করেন। ইসলামের মূলনীতি, পূন্য অর্জনের চেয়ে পাপ বর্জন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি যদি কোনো কর্ম ফরয হওয়া বা হারাম হওয়ার দ্বিবিধ সম্ভাবনা থাকে তবে তা বর্জন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

إذا أمرتُكُمْ بِشيءٍ فأْتُوا مِنْهُ ما استطعتُمْ ، و إذا نهيْتُكُمْ عن شيءٍ فدَعُوهُ

‘‘আমি যখন তোমাদেরকে কোনো কর্মের নির্দেশ প্রদান করি তখন তোমরা সে কর্মের যতটুকু পার পালন করবে। আর যখন আমি তোমাদেরকে কোনো কর্ম থেকে নিষেধ করি তখন তোমরা সে কর্ম সর্বোতভাবে বর্জন করবে।’’[1] খারিজীগণের বিভ্রান্তি অপনোদনে সাহাবীগণের বক্তব্যে আমরা বিষয়টি দেখতে পাব। অনেক সময় শয়তান আবেগের মাধ্যমে মুমিনকে এ মূলনীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে সাওয়াবের নামে পাপে লিপ্ত করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার নামে কোনো মানুষের অধিকার নষ্ট করা বা কারো সম্পদ, সম্ভ্রম বা প্রাণের সামান্যতম ক্ষতি করা। এভাবে মুমিন ইবাদত পালনের নামে কঠিনতম হারাম কর্মে লিপ্ত হন। ইবাদতটি যদি ফরযও হয় তাহলেও তা বিনা ওজরে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করলে শুধু আল্লাহর হক্ক নষ্ট হয়, যা আল্লাহ তাওবা বা ওজরের কারণে ক্ষমা করবেন। কিন্তু এ ইবাদত পালনের নামে মানুষের হক্ক নষ্ট করলে বা ক্ষতি করলে তা কঠিন হারাম হওয়া ছাড়াও ‘‘বান্দার হক্ক’’ সংশি­ষ্ট হওয়ার কারণে তাওবা করলেও আল্লাহ তা ক্ষমা করেন না।
ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে সম্মানিত বস্ত্ত মানব জীবন ও মানুষের হক্ক বা অধিকার। মানুষকে আল্লাহ সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন। শুধুমাত্র ‘আইনানুগ বিচার’ অথবা ‘যুদ্ধের ময়দান’ ছাড়া অন্য কোনোভাবে কোনো মানুষকে হত্যা করা, সন্ত্রস্ত করা, আঘাত করা, কষ্ট দেওয়া বা কোনোভাবে কারো ক্ষতি করা, কারো সম্পদ বা সম্ভ্রমের সামান্যতম ক্ষতি করা কঠিনতম হারাম কর্ম। এ বিধান সর্বজনীন। কোনো ধর্মের কোনো মানুষকেই উপরের দুটি অবস্থা ছাড়া হত্যা করা, আঘাত করা বা কষ্ট দেওয়া যাবে না।

কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে অগণিত নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘মানব রক্ত’ কঠিনতম হারাম। একমাত্র সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনে ‘মানব জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই’ একজন মানুষের হত্যা বৈধ করা হয়েছে শুধু এ দুটি ক্ষেত্রে। এ দুটি বিষয়ই সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমরা খুব সহজেই বুঝি যে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বিচার, জিহাদ বা হত্যার অনুমতি থাকলে পৃথিবীর বুকে কোনো মানুষই বেঁচে থাকতে পারবে না। কারণ পৃথিবীর বুকে প্রায় প্রতিটি মানুষ অন্য কোনো না কোনো মানুষের দৃষ্টিতে জালিম, অনাচারী বা কাফির। কাজেই জুলম, অনাচার বা কুফরের কারণে যদি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত স্বচ্ছ বিচারপদ্ধতি বা জিহাদের মাধ্যম ছাড়া ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে বিচার ও জিহাদের ক্ষমতা বা অধিকার ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে দুনিয়াতে কেউই বেঁচে থাকতে পারবে না।

বিচার ও জিহাদের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড বা হত্যার ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি যে, বিচারকের ভুলে নিরপরাধীর সাজা হওয়ার চেয়ে অপরাধীর বেঁচে যাওয়া বা সাজা কম হওয়া ভাল। অনুরূপভাবে জিহাদের নামে ভুল মানুষকে হত্যা করার চেয়ে জিহাদ না করা অনেক ভাল। জিহাদের নামে ভুল মানুষকে হত্যা করলে শত পুন্য করেও জান্নাত থেকে বঞ্চিত হতে হবে। পক্ষান্তরে সাধারণভাবে আজীবন জিহাদ না করলেও এরূপ শাস্তিলাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশেষত জিহাদের গুরুত্ব অনুধাবন করা সত্ত্বেও জিহাদের শর্ত না পাওয়ায় জিহাদ বর্জন করলে কোনোরূপ গোনাহ হবে বলে কুরআন কারীমে বা হাদীস শরীফে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি।[2]

বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমাকে যদি নিহত হতে হয় সেও ভাল, তবে হত্যকারী হয়ো না। মুসলমানদের পারস্পরিক যুদ্ধ, সন্ত্রাস বা হানাহানির সময়ে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন:


ليكن عبد الله المقتول ولا يكن عبد الله القاتل ... ليكن كخير ابني ادم


‘‘এরূপ পরিস্থিতিতে মুমিন নিহত হোক, কিন্তু সে যেন হত্যাকারী না হয়।’’ ‘‘সে যেন আদমের দু সন্তানের মধ্যে (হাবিল ও কাবিল) উত্তম জনের (হাবিলের) মত হয়।’’[3] এ সকল নির্দেশনার কারণে সাহাবীগণ হত্যাকে ভয়ঙ্করভাবে ভয় পেতেন। খলীফা উসমান ইবনু আফ্ফান (রা) বিদ্রোহীদের দ্বারা অবরুদ্ধ হলে সেনাবাহিনী এবং সমাজের নেতৃবৃন্দ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের ও অস্ত্রধারণের অনুমতি প্রার্থনা করেন। ইসলামী শরীয়তে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বৈধ। কিন্তু উসমান (রা) বিদ্রোহীদের বুঝানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, আর বিদ্রোহীরা সুযোগ পেয়ে তাকে হত্যা করে। উসমান (রা)-এর মূলনীতি ছিল, আমি নিহত হতে রাজি, কিন্তু কারো রক্তের দায়িত্ব নিয়ে আল্লাহর কাছে যেতে রজি নই।


[1] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৬৫৮: মুসলিম, আস-সহীহ ২/৯৭৫।

[2] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৮৪, ৩১০; তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৩৩; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৪২৬; শাওকানী, মুহাম্মাদ ইবনু আলী (১২৫৫ হি.) নাইলুল আউতার, ৭/২৭১-২৭২; আল-আমিদী, আলী ইবনু মুহাম্মাদ (৬৩১ হি.), আল-ইহকাম ২/১৩০, ৪/৬৫।

[3] আবু দাউদ, আস-সুনান ৪/১০০; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১৩১০; আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ৮/১৪৩। হাদিসটি সহীহ।