ইসলামী জ্ঞান: নিত্যদিনের প্রয়োজনে শিয়া বিষয়ক ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া ১ টি
হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-র শাহাদাত এর পটভূমি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-র শাহাদাত এর পটভূমি ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হচ্ছে, ইরাকের (কুফার) জনগণ হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে চিঠি লিখে আহ্বান জানিয়েছিল, যেন তিনি তাদের কাছে যান এবং তারা তাঁকে খেলাফতের বায়আত দেবে—এটি ঘটে মুʼআওয়িয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-র মৃত্যুর পর এবং তাঁর ছেলে ইয়াজিদ খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর।
কিন্তু চিঠি লিখে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে আহ্বান করার পরে কুফার অবস্থা বদলে যায়। ইয়াজিদ ইবনু মুʼআওয়িয়ার পক্ষ থেকে উবাইদুল্লাহ ইবনু জিয়াদ কুফার শাসক নিযুক্ত হয় এবং সে হুসাইনের দূত মুসলিম ইবনু আকীলকে হত্যা করেন।
ফলে কুফার লোকদের কারও কারও অন্তরে হুসাইনের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও তাদের তলোয়ার ছিল উবাইদুল্লাহ ইবনু জিয়াদের পক্ষে। হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখনো জানতেন না যে মুসলিম ইবনু আকীলকে হত্যা করা হয়েছে এবং কুফার লোকেরা তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এদিকে সাহাবীদের মধ্য হতে যারা হুসাইনকে ভালোবাসতেন ও হিকমতপূর্ণ পরামর্শ দিতেন, তাঁরা তাঁকে ইরাকে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

যাঁরা তাঁকে এ পরামর্শ দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন:

  1. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস
  2. আবদুল্লাহ ইবন উমর
  3. আবু সাঈদ খুদরি
  4. জাবির ইবন আবদুল্লাহ
  5. মিসওয়ার ইবন মাখরামা
  6. আবদুল্লাহ ইবনুয যুবায়ের — রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম।

সকল পরামর্শ উপেক্ষা করে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইরাকের দিকে রওনা হন এবং কারবালায় অবস্থান নেন। সেখানে তিনি বুঝতে পারেন যে কুফার লোকেরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
তখন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শত্রু সেনাবাহিনীর কাছে তিনটি প্রস্তাব রাখেন:

আমাকে মক্কায় ফিরে যেতে দাও,
অথবা আমি ইয়াজিদের কাছে চলে যাই,
অথবা আমি সীমান্তে জিহাদে চলে যাই।
কিন্তু তারা কোনো প্রস্তাবই মেনে নেয়নি—বরং বললো, তাকে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করতে হবে।
হুসাইন তা অস্বীকার করলেন। এরপর তারা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ফলে তিনি নির্দোষ অবস্থায় শহীদ হন — রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।

("আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ", ১১/৪৭৩–৫২০)

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:

"ইয়াজিদ ইবনু মুʼআওয়িয়াহ এর জন্ম হয় উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-র খেলাফতের সময়ে। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পাননি এবং সাহাবি ছিলেন না—এ বিষয়ে সকল আলেম একমত।
তিনি ধার্মিকতা বা সালেহ হওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিলেন না, বরং মুসলমান যুবকদের একজন ছিলেন। তবে তিনি কাফের বা মুনাফিকও ছিলেন না। তাঁর খেলাফতের বায়আত কিছু মুসলিমের অপছন্দ এবং কিছু মুসলিমের সম্মতিতে অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে সাহস ও দানশীলতা ছিল। তিনি -তার বিরোধীদের বর্ণনা অনুযায়ী- প্রকাশ্যে গুনাহ করতেন বলে যা বলা হয়ে থাকে তা প্রমাণিত হয়নি। 

তাঁর খেলাফতের সময় কিছু বড় ঘটনা ঘটে:
এর একটি হলো: হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-র শাহাদাত।
তবে ইয়াজিদ তাঁকে হত্যা করার নির্দেশ দেননি, তাঁর শাহাদাতে আনন্দ প্রকাশ করেননি এবং তাঁর দাঁতের ওপর ছড়ি চালাননি। হুসাইনের মাথাও শামে পাঠানো হয়নি।
ইয়াজিদের নির্দেশ ছিল, হুসাইন যেন খেলাফতের দাবি না করে। তার সাথে যুদ্ধ যদি করতেই হয়, সেটা যেন সীমিত হয়। কিন্তু তাঁর প্রশাসকরা (যেমন ইবনু জিয়াদ) সীমা অতিক্রম করে।

হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু চেয়েছিলেন:
হয় আমি ইয়াজিদের কাছে যাই,
নয়তো সীমান্তে জিহাদে যাই,
অথবা মক্কায় ফিরে যাই।
তারা কোনোটি অনুমতি দিল না—বরং তাকে বন্দি করার জন্য জোর করে।

এরপর উমর ইবনু সা'দ তাঁকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেয় এবং তাঁকে হত্যা করা হয়—তিনি ছিলেন একজন নির্দোষ শহীদ।
তাঁর সঙ্গে আহলুল বাইতের আরও অনেকে শহীদ হন—রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম। হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-র শাহাদাত ছিল এক বিশাল মুসীবত (বিপর্যয়)। উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহর শাহাদাতও এক বড় ফিতনার দরজা খুলে দেয়। এই দুই ঘটনার ফলে মুসলিমদের মাঝে বিশাল বিশাল বিভাজন ও সংঘাত সৃষ্টি হয়।
(তথ্যসূত্র: “মাজমু‘ আল-ফাতাওয়া” ৩/৪১০–৪১৩)।

তিনি আরেক জায়গায় বলেন (মাজমুʼ ফাতাওয়া ২৫/৩০২–৩০৫):
"যেদিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হন—অন্যায় ও জুলুমকারী একটি গোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করে। আল্লাহ তাঁকে শহীদির মাধ্যমে সম্মানিত করেন, যেমন করে আল্লাহ আহলুল বাইতের অনেক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে শহীদি মর্যাদা দেন—যেমন: হামযা, জাফর এবং তাঁর পিতা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম। শহীদির মাধ্যমে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তাঁর স্তর উঁচু হয়। কারণ, তিনি ও তাঁর ভাই হাসান— যুবকদের নেতা এবং জান্নাতে তাদের উচ্চ স্তর রয়েছে। উচ্চ মর্যাদা পেতে হলে বিপদ ও পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
"সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত হন নবীগণ, তারপর সালেহগণ, তারপর তাদের পর যারা তাদের অনুসরণ করে।" (তিরমিযি)
হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা ইসলামের সম্মান ও মর্যাদার মাঝে জন্ম নেন, মুসলিমরা তাঁদের সম্মান করত, তাঁরা সম্মান-প্রাচুর্যে বড় হয়েছেন। হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হন এবং তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যদের সঙ্গে মিলিয়ে দেন এবং যাঁরা তাঁকে হত্যা করেছে, তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন।

আল্লাহ তা'আলা হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর সহগামী শহীদদের উপর রহমত বর্ষণ করুন এবং তাঁদের মর্যাদা আরও উঁচু করুন। আর যেসব জালেম ও মুনাফিক এই উম্মাহর মধ্যে ফিতনার আগুন জ্বালিয়েছে—আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন।

https://www.facebook.com/abubakar.m.zakaria/posts/pfbid02h6F743sA6J14U815DzdvTqEeRd5v5wbJxt7rpkXuiVfmnHbnapeHUT97hyzL5sryl